Published : 16 Dec 2020, 02:21 PM
বিজয়ের পঞ্চাশ বছরে দাঁড়িয়ে বাঙালি নিজেকে একটিবারের জন্য প্রশ্ন করে দেখতে পারেন, কী ছিল আমার পরিচয়, কী ছিল আমার অধিকার, কী ছিল আমার সার্বভৌমত্ব আর কেমন ছিলাম আমি! এই 'আমি' বাঙালিকে কখনো স্বাধীনতার জন্য, কখনো সার্বভৌমত্বের জন্য যুদ্ধ করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের জাতিসত্ত্বার 'বাংলাদেশ' প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে। আর ঊনপঞ্চাশ বছরের এই বয়স জুড়ে কখনো নিজের সাথে, কখনো ভাইয়ের সাথে, কখনো পরিবারের সাথে আবার কখনো বন্ধু-বান্ধব আর পাড়া-প্রতিবেশির সাথে যুদ্ধ করতে হয়েছে। এই আমাকে বাঙালি জাতিসত্ত্বার বিরুদ্ধের ষড়যন্ত্রগুলো প্রতিবারই মোকাবেলা করে এগুতে হয়েছে, ঘুরে দাঁড়িয়েছি।
কারণ, অবৈধভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলদারিগণ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করে বার-বার বাঙালিকে আবদ্ধ করতে চেয়েছিল, একটি ব্যর্থ রাষ্ট্র করার নীল নকশা প্রণয়ন করেছিল! তারা খুনীদের ইনডেমনিটি দিয়ে রক্ষা করতে চেয়েছিল, সংবিধানকে ক্ষত-বিক্ষত করা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, ভাষা আন্দোলন, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান ত্রিশ লাখ শহীদ, দুই লাখেরও বেশি নিকৃষ্ট নির্যাতন-সম্ভ্রম বিনাশে নারী মুক্তিযোদ্ধাদের আড়াল করেছিল, অলিখিতভাবে নিষিদ্ধ করেছিল ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ! অসাম্প্রদায়িক চেতনা আর ধর্মীয় সম্প্রীতির মূল্যবোধকে ধ্বংস করতেই ধর্মের অপব্যাখ্যা সৃষ্টি করেছে!
তারা জানত, একটি দেশ তখনই শক্তিশালী হয় যখন সেদেশের মানুষের মাঝে দেশাত্মবোধ গভীরভাবে কাজ করে। আর দেশাত্মবোধ বা দেশপ্রেম তখনই মন-মগজে মর্যাদা পায় যখন সেদেশের জনগণ তার জন্মভূমির সঠিক ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে জানাশোনা থাকে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, পঁচাত্তর পরবর্তী প্রজন্ম বার-বার এই একটি জায়গায় প্রতিনিয়ত প্রতারণার শিকার হয়েছে, বিকৃতি ইতিহাস পড়ে বিভ্রান্ত হয়েছে। পরিকল্পিতভাবেই দেশ ও দেশের মানুষকে ভিন্ন পথে পরিচালিত করতে, মানুষে মানুষে ভেদাভেদ সৃষ্টি করতে এবং সর্বপরি দেশাত্মবোধ থেকে দূরে রাখতেই মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি করেছে, পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তিকরণের মাধ্যমে ভ্রান্ত পথে রীতিমতো ঠেলে দিয়েছে!
তার একটাই কারণ, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে-আঘাত করা। মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় 'ভাইয়ে-ভাইয়ে ঝগড়া'র মিমাংসার মিথ্যাচার বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার সেই এজেন্ডা বাস্তবায়নের নীল-নকশা; বাংলাদেশকে বিশ্ববাসীর বিবেচনায় ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করা! স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জনগণকে ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করতে পারলে, বিকৃতি ইতিহাস মন-মগজে স্থাপন করে বিভ্রান্ত আর বিভাজন সৃষ্টি করতে সক্ষম হলে-ঘুরে দাঁড়ানো বাঙালি খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
ষড়যন্ত্রকারীরা জানে বঙ্গবন্ধুর ২৪ বছরের আন্দোলন-সংগ্রাম ছিল বাঙালির জন্য, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের জন্য। পৃথিবীর যেখানে শোষণ হয়েছে, বঙ্গবন্ধু শোষিতের পক্ষে অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ করেছেন। মানুষ-মানবতা যেখানে নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়েছে, বঙ্গবন্ধু তাদের একজন হয়ে অধিকারের পক্ষে কথা বলেছেন। শত লোভ-লালসা আর মৃত্যুর কবর দেখিয়েও বঙ্গবন্ধুকে মা-মাটি আর মানুষ-মানবতা থেকে দূরে রাখা সম্ভব হয়নি। বিশ্ব পরাশক্তি আমেরিকা-পাকিস্তান মিলেও মহান মুক্তিযুদ্ধে যখন বঙ্গবন্ধু ও বাঙালিকে ধ্বংস করতে পারেনি, তখন পরিকল্পিতভাবে ১৯৭৫ সালে ১৫ অগাস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করার মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের মূল স্রোতধারা 'অসাম্প্রদায়িক' ও 'গণতান্ত্রিক' বাংলাদেশকে পাকিস্তানি ছায়া সরকারের আদলে পরিচালনা করতে শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনীদের বিচারের পথে 'ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ' জারি করে শুধু খুনীদের বিচারকাজই বন্ধ করেনি বরং খুনের মহা পরিকল্পনারকারীদেরও দায়মুক্তি দিয়েছে। রাতারাতি 'জয় বাংলা' হয়ে যায় 'বাংলাদেশ জিন্দাবাদ'। 'বাংলাদেশ বেতার'কে রেডিও পাকিস্তানের আদলে 'রেডিও বাংলাদেশ' করে! পাকিস্তানের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী সংবিধানকে ক্ষত-বিক্ষত করে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে স্বাধীনতাবিরোধী রাজাকারদেরও এদেশে ফিরিয়ে এনে রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করে 'অসাম্প্রদায়িক' স্বাধীন-সার্বভৌমত্বকে 'সাম্প্রদায়িক' রাষ্ট্র গঠনে চূড়ান্ত ষড়যন্ত্রের নীল-নকশা প্রণয়ন করেন জিয়াউর রহমান।
ঠিক এমনি এক ক্রান্তিলগ্নে মানুষ আর মানবতার ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। সেদিন তার জীবনের ন্যায় প্রকৃতিও একাকার হয়েছিল। চারপাশে ঝড়-বৃষ্টি। কুর্মিটোলা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও শেরেবাংলা নগর পরিণত হয়েছে জনসমুদ্রে। সেদিন স্বতস্ফূর্ত লাখ-লাখ মানুষজনকে ঝড়-বৃষ্টিও যেন স্নান করিয়ে দিয়েছিল। উত্তেজিত, অধিকারবঞ্চিত মানুষের মাঝে প্রকৃতিও তার পরমতসহিষ্ণুতা আর শান্তি বার্তা দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার আগমন ঘিরে। আর শেখ হাসিনাকে এক পলক দেখতে সেদিন সারা বাংলাদেশের মানুষের গন্তব্য ছিল রাজধানী ঢাকা। স্বাধীনতার অমর স্লোগান, আবারও 'জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু' ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয় বাংলার আকাশ-বাতাস। জনতার কণ্ঠে বজ্রনিনাদে ঘোষিত হয়েছিল 'হাসিনা তোমায় কথা দিলাম- পিতৃ হত্যার বদলা নেব'। 'শেখ হাসিনার আগমন, শুভেচ্ছা স্বাগতম'। ১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের দৃঢ় অঙ্গীকার, বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার, স্বৈরতন্ত্রের চির অবসান ঘটিয়ে জনগণের হারানো গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সার্বভৌম সংসদীয় পদ্ধতির শাসন ও সরকার প্রতিষ্ঠার শপথ নিয়ে আওয়ামী লীগের সভাপতি'র দায়িত্ব গ্রহণ করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
ঝড়-বাদল আর জনতার আনন্দাশ্রুতে অবগাহন করে শেরেবাংলা নগরে লাখ লাখ জনতার সংবর্ধনার জবাবে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা বলেছিলেন, 'সব হারিয়ে আমি আপনাদের মাঝে এসেছি, বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তার আদর্শ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে জাতির পিতার হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণে আমি জীবন উৎসর্গ করতে চাই।'
সেদিন তিনি আরও বলেছিলেন 'আমার আর হারাবার কিছুই নেই। পিতা-মাতা, ভাই-রাসেল সবাইকে হারিয়ে আমি আপনাদের কাছে এসেছি, আমি আপনাদের মাঝেই তাদেরকে ফিরে পেতে চাই। আপনাদের নিয়েই আমি বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে তা বাস্তবায়ন করে বাংলার দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে চাই, বাঙালি জাতির আর্থ-সামাজিক তথা সার্বিক মুক্তি ছিনিয়ে আনতে চাই।'
শুরু হয় শেখ হাসিনার নিরবচ্ছিন্ন দীর্ঘ সংগ্রাম। দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে সামরিক জান্তা ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে চলে তার একটানা অকুতোভয় রাজনৈতিক আন্দোলন। জেল-জুলুম, অত্যাচার কোনোকিছুই তাকে তার সংগ্রামী পথ থেকে টলাতে পারেনি। শত-সহস্র প্রতিকূলতাতেও হতোদ্যম হননি তিনি। বাংলার মানুষের হারিয়ে যাওয়া অধিকার 'অসাম্প্রদায়িক', 'গণতন্ত্র' আর 'ভোটাধিকার' পুনরুদ্ধার করতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তিনি বারবার স্বৈরাচারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেছেন, আবির্ভূত হয়েছেন গণতন্ত্রের মানসকন্যা রূপে।
দীর্ঘ ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালের ১২ জুন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের উন্নয়নের গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের ইতিহাস রচনা শুরু হয়। কৃষিতে প্রবৃদ্ধি অর্জন, মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, স্বয়ম্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের মাধ্যমে এই সেক্টরে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ চালু করা এবং ১৯৯৮ সালে শতাব্দীর ভয়াবহতম বন্যা সাফল্যের সঙ্গে মোকাবিলা এবং অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, মূল্যস্ফীতি ১৯৯৬ সালের ৮.৯ শতাংশ থেকে ২০০১ সালে ১.৯ শতাংশে নেমে এসেছিল, জিডিপির প্রবৃদ্ধি হয়েছিল আগের সরকারের ৪.৫ শতাংশের তুলনায় প্রতি বছর গড়ে ৫ শতাংশ হারে, বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৬০০ মেগাওয়াট থেকে ৪,৩০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়, খাদ্যশস্য উৎপাদন ২ কোটি ৬৮ লাখ মেট্রিক টনে উন্নীত করে খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জিত হয়েছিল।
প্রথমবারের মতো ১৯৯৮ সালে দেশের দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুরক্ষাকল্পে শেখ হাসিনা সেইফটি নেট কার্যক্রম শুরু করেন। গ্রহণ করা হয় 'একটি বাড়ি একটি খামার'-এর মতো দারিদ্র্যবিমোচনে যুগান্তকারী কর্মসূচি। বয়স্কভাতা ও বিধবাভাতার মতো উদ্ভাবনী কর্মসূচিগুলোর সূচনাও ঘটে ওই সময়ে। প্রান্তিক কৃষকের কথা চিন্তা করে শেখ হাসিনা দেশে প্রথমবারের মতো কৃষকের জন্য ১০০ কোটি টাকা প্রণোদনা প্রদান করেন। নাগরিকের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার ওপর জোর দিয়ে সরকারি উদ্যোগে প্রতি ৬ হাজার জনসংখ্যার জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করেছেন। মোবাইল ফোন খাতের একচেটিয়া ব্যবসার অবসান ঘটিয়ে স্বল্পমূল্যে সবার কাছে মোবাইল ফোন সহজলভ্য করেছেন। বাংলাদেশকে ফাইবার অপটিক্যাল কেবলের মাধ্যমে বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত করেছেন। এ ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তি সরঞ্জামের ওপর থেকে আমদানি শুল্ক কমিয়ে সরকার তথ্যপ্রযুক্তিকে জনগণের কাছে সহজলভ্য করে তোলেন যার ফলে বাংলাদেশ ডিজিটাল ও প্রযুক্তির আধুনিক যুগে প্রবেশের সুযোগ পায়। পরিবহন খাতের বিকেন্দ্রীকরণ বেসরকারি উদ্যোগে আধুনিক পরিবহনব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেন।
আবার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি, পার্বত্য চট্টগ্রামের শান্তি চুক্তি, ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি, জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে নির্বাচন বিশ্ব আঙিনায় বাংলাদেশকে মর্যাদা ও গুরুত্বের সঙ্গে নতুনভাবে উপস্থাপন করেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা।
যে হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীদের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন, সেই তিনিই ১৯৯৮ সালে শেখ হাসিনাকে 'ইউনেস্কো পুরস্কার' প্রদান অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সাফল্যের স্তুতি বর্ণনা করে বক্তব্য দিয়েছেন।
১৯৭২ সালে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে প্রথম যে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে সেখানে বিশ্বব্যাংক বলেছে, 'সবচেয়ে ভালো পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশ একটি নাজুক ও জটিল উন্নয়ন সমস্যার নাম'। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে 'তলাবিহীন ঝুড়ি' বলে প্রথম আখ্যায়িত করেছিলেন Just Faaland I John Richard Parkinson নামক দুজন অর্থনীতিবিদ। তাদের রচিত Bangladesh : the test case of development শীর্ষক বইতে বাংলাদেশ সম্পর্কে অবজ্ঞা করে বলেছিলেন, 'যদি বাংলাদেশ উন্নতি করতে পারে তাহলে পৃথিবীর যে কোনো দেশ উন্নতি করতে পারবে।' তাদের কথা ভুল প্রমাণিত করে ১৯৯৬-২০০১ সালে বাংলাদেশ তার প্রাপ্য মর্যাদা পুনরায় ফিরে পেয়েছিল শেখ হাসিনার বিচক্ষণ নেতৃত্বের কারণে।
এরপর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের ঐতিহাসিক নির্বাচনে চার-তৃতীয়াংশ আসনে বিশাল বিজয় অর্জনের মাধ্যমে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠিত হয়। দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে বিজয়ের পর ১২ জানুয়ারি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা দ্বিতীয় মেয়াদে আবারও প্রধানমন্ত্রী হন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। আর গত দশ বছর বাংলাদেশের উন্নয়ন অর্জন সারা বিশ্বে প্রশংসিত হয়েছে।
পৃথিবীর অনেক আন্তর্জাতিক গবেষণা ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত সংস্থা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে বিস্ময়কর ও অনুকরণীয় বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। Citigroup -এর বিবেচনায় ২০১০ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যবর্তী সময়ে বিশ্বে সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধি সঞ্চালক 3G (Global Grotwh Generator) Countries তালিকায় স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ। 3G (Global Grotwh Generator) Countries-এর ২০১৭-এর The World in ২০৫০ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশ, ভারত ও ভিয়েতনামকে আগামী দিনে ২০৫০ সাল পর্যন্ত বিশ্বে সবচেয়ে দ্রুতগতির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনকারী দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ ২০৫০ সালের মধ্যেই পরিণত হবে পৃথিবীর ২৩তম বৃহত্তর অর্থনীতির দেশে এবং পেছনে ফেলবে মালয়েশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার মত দেশকেও।
যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান ব্লুমবার্গও বিশ্ব অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি বিশ্লেষণ করে বিভিন্ন দেশের প্রবৃদ্ধি অর্জনের হার নিয়ে তৈরি প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, বাংলাদেশ হবে বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ প্রবৃদ্ধির দেশ। বিনিয়োগের আকর্ষণীয় গন্তব্য হিসেবে J P Morgan-এর Frontier Five তালিকায় স্থান পেয়েছে বাংলাদেশ। জাপান এক্সটার্নাল ট্রেড অর্গানাইজেশনের (জেটরো) মতে, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ জাপানিদের কাছে দ্বিতীয় পছন্দের তালিকায় রয়েছে।
অন্যদিকে মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাবশালী পত্রিকা 'আরব নিউজ'-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, 'দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বিদেশি বিনিয়োগের পরবর্তী কেন্দ্রস্থল হওয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে বাংলাদেশ।' আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বলছে, ২০২১ সালের মধ্যে এটি ৩২ হাজার ২০০ কোটি ডলারের বাজারে পরিণত হবে। ২০১৭ সালে যুক্তরাজ্যভিত্তিক Business Insider পত্রিকার নিবন্ধে সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং ও তাইওয়ানের পর বাংলাদেশকে ভবিষ্যতের পঞ্চম এশিয়ান টাইগার হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। অতি সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান Lowy Institute তাদের গবেষণায় এই বক্তব্যের সপক্ষে বলেছে, বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে তাইওয়ানকেও ছাড়িয়ে যাবে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক বৈশ্বিক ব্র্যান্ড মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠান 'ব্র্যান্ড ফ্রিল্যান্স' কর্তৃক প্রকাশিত Nation Brands ২০১৭ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান ১০০ দেশের মধ্যে ৩৯তম, যা ২০১৬ সালেও ছিল ৪৪তম। প্রথমবারের মতো ২০০৯-১০ অর্থবছরে Standard and Poor's এবং Moody's বাংলাদেশের ওপর সভরেন ক্রেডিট রেটিং প্রণয়ন করে। তাদের ২০১৭-এর প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে যে, বাংলাদেশের ক্রেডিট রেটিংয়ের পরিমাণ Ba3 stable। সম্প্রতি World Economic Forum (WEF) বিশ্বের ৭৪টি সম্ভাবনাময় অর্থনীতির ওপর সমীক্ষা করে, যেখানে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন-বিষয়ক Inclusive Development Index অনুযায়ী পৃথিবীতে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৪তম এবং ভারতের অবস্থান ৬২তম, পাকিস্তান ৪৭তম, শ্রীলঙ্কা ৪০তম ও চীন ২৬তম।
আবার একই ফোরামে বৈশ্বিক প্রতযোগিতায় সক্ষমতা সূচকেও বাংলাদেশ ১৮০টি দেশের মধ্যে আগের বছরের চেয়ে ৭ ধাপ এগিয়ে ৯৯তম অবস্থানে এসেছে। তা ছাড়া অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮০টি দেশের মধ্যে আগের বছরের চেয়ে ৯ ধাপ এগিয়ে ১২৮তম অবস্থানে রয়েছে। বৈশ্বিক মানব উন্নয়ন সূচকে (HDI) ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৬তম। লিঙ্গসমতার দিক থেকে ১৪৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৭তম এবং টানা তিন বছর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর তালিকায় বাংলাদেশ শীর্ষে রয়েছে।
উপমহাদেশের আরেক নোবেলবিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ ড. অমর্ত্য সেনও বাংলাদেশের সামাজিক ক্ষেত্রে, বিশেষত শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের সফলতার বিষয়টি তার বইসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে উল্লেখ করেছেন।
তবে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর মতে, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন উড়ন্ত সূচনার পর্যায়ে রয়েছে। তার ভাষায় প্রবৃদ্ধি 'তরতর' করে বাড়ছে। তিনি আরও মন্তব্য করেন, 'আজকের বাংলাদেশ পুরোটাই সাফল্যের গল্প, যা বিশ্বের অনেক দেশের জন্যই দৃষ্টান্ত।' জাতিসংঘ কর্তৃক নির্ধারিত Millennium Development Goals বাংলাদেশ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের আগে এবং ২০১৫-এর অনেক আগেই বাস্তবায়ন করে সারা বিশ্বের দৃষ্টি কেড়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। The Rise of the South শীর্ষক জাতিসংঘের 'মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন ২০১৩'-তে যে ১৮টি দেশ এমডিজি অর্জনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
আবার জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন মন্তব্য করেছিলেন, 'বাংলাদেশ পারে, বাংলাদেশ হচ্ছে অর্থনীতির এলাকায় একটি রোল মডেল।' বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট কিম ইয়ং জিমও বাংলাদেশের প্রশংসায় পিছিয়ে থাকেননি। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ সফরে এসে বাংলাদেশ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, 'বাংলাদেশের অগ্রগতি সারা বিশ্বের জন্য অনুকরণীয়।'
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা ২০১৫ সালে কেনিয়া সফরে গিয়ে বাংলাদেশের আইসিটি খাতের ভূয়সী প্রশংসা করে বলেছিলেন, 'সব দেশের উচিত বাংলাদেশকে অনুসরণ করা, তারা কীভাবে উদ্যোক্তা তৈরি করছে তা শেখা উচিত'-এইসব 'অর্থনৈতিক অগ্রগতি' আর বিশ্বদরবারে 'মর্যাদাশীল বাংলাদেশ' প্রতিষ্ঠিত হয়েছে শেখ হাসিনার অর্থনীতির মুক্তির সংগ্রামের কারণে।
এক সময় দারিদ্র্য-দুর্ভিক্ষে জর্জরিত যে বাংলাদেশ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম করত, সেই বাংলাদেশ আজ বিশ্বজয়ের নবতর অভিযাত্রায় এগিয়ে চলছে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্ব, যোগ্যতা, নিষ্ঠা, মেধা-মনন, দক্ষতা, সৃজনশীলতা, উদার গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গী ও দূরদর্শী নেতৃত্বে। বিশ্বসভায় আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাংলাদেশ, গৌরবময় হয়েছেন বাঙালি যা অর্জনে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন শেখ হাসিনা।
বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাস সংকটের এই ক্রান্তিলগ্নেও শেখ হাসিনা জনগণের 'জীবন' ও 'জীবিকার' সুরক্ষা নিশ্চিত করতে নিঃস্বার্থভাবে নিরলস পরিশ্রম করেছেন, করে যাচ্ছেন। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে সৃষ্ট সংকটের শুরু থেকেই তিনি এ ভাইরাস প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জনগণকে সচেতন করার লক্ষ্যে জাতির অভিভাবক হিসেবে ৩১ দফা নির্দেশনা মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন বার বার।
আমাদের সকল উদ্বেগ-উৎকণ্ঠাকে পেছনে ফেলে 'পেটে খেলে পিঠে সয়'-শ্লোগানকে সামনে রেখে ছাত্রলীগ থেকে আওয়ামী লীগ, এমনকি পুলিশ কর্মকর্তাসহ কৃষকের পেটের ভাতের ব্যবস্থা 'ফসল' ঘরে উঠেছে একমাত্র শেখ হাসিনার বিচক্ষণ নেতৃত্বের কারণে। আর কর্মহীন হয়ে পড়া মানুষের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে খাদ্য ও অন্যান্য সহায়তার ব্যবস্থা করে ১০ মিলিয়নের বেশি পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে শেখ হাসিনার সরকার।
অন্যদিকে ৪ মিলিয়ন শিক্ষার্থীকে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক, শ্রমিক ও দিনমজুরসহ ৫ মিলিয়ন মানুষকে নগদ অর্থ সহায়তা, সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে গ্রাম পর্যায়ের প্রায় ১৮ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক ও ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র হতে বিনামূল্যে ৩০ ধরনের ওষুধ প্রদান-সময় উপযোগী উদ্যোগ শেখ হাসিনার সফল সিদ্ধান্ত। সরকারি সহায়তার পাশাপাশি তিনি নিজে উদ্যোগী হয়ে তহবিল সংগ্রহ করেছেন। এতিম ও গরিব শিক্ষার্থী, মাদ্রাসা, মসজিদ, মন্দির, স্কুল শিক্ষক, শিল্পী, সাংবাদিকসহ যারা সাধারণভাবে সরকারি সহায়তার আওতাভুক্ত নন, তাদের মধ্যে ২.৫ বিলিয়নের বেশি টাকা সুষ্ঠুভাবে বিতরণও করেছেন। যার ফলে সাধারণ মানুষকে করোনাভাইরাস খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারেনি।
শুধু তাই নয়, ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের লঘুচাপ আর প্রাকৃতিক সম্পদের বিনিময়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণের মেরুদণ্ডহীন নেতৃত্বের অপসংস্কৃতি (!) শেখ হাসিনার নেতৃত্বের কাছে পরাজয় বরণ করেছে। টাকার কাছে বিক্রি হয়ে পড়া আর ক্ষমতাকেন্দ্রিক রাজনীতি-এই দেশেকে রীতিমতো চেপে বসেছিল। কিন্তু মহামারী করোনাকালেও শেখ হাসিনা দেখিয়েছেন, শক্তি-সাহস দিয়েছেন আর বুঝিয়েছেন কিভাবে শত-সহস্র প্রতিকূল পরিস্থিতিতে অবস্থান করেও দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করতে হয়, মানুষের পাশে দাঁড়াতে হয়। আর সে নির্দেশ মতে শুধু ছাত্রলীগ থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাই নয়, শেখ হাসিনার ঘোর বিরোধী এমন অনেকেও ওই অপসংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে ছোট ছোট গ্রুপ করে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। আর এই কাজ করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের ৫৮টি সাংগঠনিক জেলায় সংগৃহীত তথ্যে দল, সহযোগী ও অঙ্গসংগঠনের মোট ৫৩৫ জন নেতাকর্মী করোনাকালে মৃত্যুবরণ করেছে।
মহামারী করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশ্ব অর্থনীতি যেখানে মুখ থুবড়ে পড়েছে, সেখানে শেখ হাসিনার সাহসী আর বিচক্ষণ পদক্ষেপ বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত। সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) তাদের ২০২০ সালের অক্টোবরে প্রকাশিত 'ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক'-এর প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর ভারতজুড়ে হইচই শুরু হয়েছে। কারণ, রিপোর্টে উঠে এসেছে যে, ২০২০ সালে চলতি মূল্যে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হবে ১ হাজার ৮৮৭ দশমিক ৯৭ মার্কিন ডলার। আর ২০২০ সালে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি হবে ১ হাজার ৮৭৭ মার্কিন ডলার। এর পাশাপাশি ২০২০ সালে বাংলাদেশের জিডিপি ৩ দশমিক ৮ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে এবং ভারতের জিডিপি ১০ দশমিক ৩ শতাংশ কমবে।
আর সর্বশেষ বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালের ৯ ডিসেম্বর রিজার্ভ ছিল ৩২ দশমিক ১১ বিলিয়ন ডলার। করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে একের পর এক রেকর্ড গড়ে গত ২৯ অক্টোবর অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে রিজার্ভ ৪১ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। আর আশা করা যাচ্ছে, আগামী বছরের মধ্যে বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ ৫০ বিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়াবে।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বের অর্থনীতির এই সফলতা নিয়ে বাংলাদেশে তেমন আলোচনা না হলেও ভারতজুড়ে বিষয়টি তুমুল আলোচনার জন্ম দিয়েছে। ভারতের শীর্ষস্থানীয় সব মিডিয়ায় এ নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা, বিশ্লেষণ-বিতর্ক। আইএমএফ-এর তথ্যটি বিশেষভাবে সবার নজর কেড়েছে, কারণ বিগত ৫ বছর ধরে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি বাংলাদেশ থেকে গড়ে ২৪% বেশি ছিল! আর সেখানে তারাই পেছনে পড়তে বসেছে!
আর সর্বশেষ স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ৪১তম স্প্যান বসানোর ঐতিহাসিক মুহূর্তের পর দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের সাথে গোটা জাতির আবেগ-ভালোবাসা আর আনন্দ-উচ্ছ্বাসের বর্ণনাগুলো ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছে। জন্মবধি যাদের অবিশ্বাস-সন্দেহ ছিল যে, পদ্মার বুকে কখনো পদ্মা সেতু হবে, হতে পারে – এর বাস্তবায়ন দেখে অনেকে রীতিমত কেঁদে ফেলেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে অভিনন্দন, ধন্যবাদ জানিয়েছেন। আমরা যে পারি, আমাদের যে আত্মমর্যাদা আছে – এটি শেখ হাসিনাই বুঝিয়েছেন, প্রমাণ করেছেন।
বিশেষ করে, পদ্মা সেতু নিয়ে রাজনৈতিক বক্তব্য-বিবৃতি, সমালোচনা, ষড়যন্ত্র যতটা ছিল, তার চেয়েও বেশি ছিল পদ্মার বুকে পদ্মা সেতু করতে পারবে – এই অবিশ্বাস, সন্দেহ। কিন্তু যিনি বাঙালিকে চেনেন, যিনি বাঙালির ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাস বোঝেন, যিনি দেশের প্রতিটি বাঙালির আত্মমর্যাদা আর আত্ম অহংকারের বিষয়গুলো উপলব্ধি করেন – শেখ হাসিনাই সেই আত্মবিশ্বাস নিয়ে একক চিত্তে দৃঢ় মনোবল-বিশ্বাস নিয়ে ছুটে চলেছেন, সকল মিথ্যাচার-অপপ্রচার আর দুর্নীতির গালগপ্প মোকাবেলা করে বাঙালির স্বপ্নের পদ্মা সেতুর ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার পদ্মা সেতুর পুরো মূল কাঠামো দৃশ্যমাণ করেছেন।
আর বিজয়ের এই দিনে বাঙালি জাতি হিসেবে আমরা কোথায় থাকার কথা, পঞ্চাশে এসে কোথায় দাঁড়িয়েছি – এটি স্বপ্নের পদ্মা সেতুর প্রকল্পবিরোধী কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করলেই প্রতীয়মান হয়, একটি জাতিকে বার-বার থমকে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করেছিল স্বাধীনতা-উন্নয়নবিরোধী ব্যক্তি ও মহল। বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে এদেশবিরোধীরা বার-বার বিচার দিয়েছে, দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে বিদেশীদেরও ব্যবহার করাসহ দেশের আত্মমর্যাদা আর ভাবমূর্তি নষ্ট করতে পরিকল্পনা গ্রহণ করেই তাদের নোংরা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে, বাংলাদেশকে তার মাথা তুলে দাঁড়াতে বাঁধা সৃষ্টি করেছে।
তাই, একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি গঠনে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের এ পথচলা কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না, ছিল কণ্টকাকীর্ণ এবং বিপদসংকুল। গণমানুষের মুক্তির লক্ষ্যে আন্দোলন সংগ্রামের কারণে তাকে বারবার ঘাতকদের হামলার শিকার ও কারা নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। কিন্তু তিনি নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে, বাঙালির নৈতিক অধিকারের প্রশ্নে ছিলেন পিতার মতোই অবিচল, দৃঢ় ও সাহসী আর আপোষহীন। জনগণের ভালোবাসায় অভিষিক্ত হয়ে টানা তৃতীয়বারসহ চতুর্থবারের মতো রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পেয়ে তিনি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষের কল্যাণে যুগান্তকারী অবদান রেখে চলেছেন। 'রূপকল্প ২০২১' এর মধ্যম আয়ের বাংলাদেশকে 'রূপকল্প ২০৪১' এর বাস্তবায়নের মাধ্যমে একটি উন্নত, আধুনিক, সমৃদ্ধ, অসাম্প্রদায়িক কল্যাণকামী রাষ্ট্র গঠনে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা, প্রতীয়মান।
এদেশের জন্য, এদেশের মানুষের জন্য রাজনীতি করেছেন, অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আর পাকিস্তানপন্থী, চীনপন্থী, রাশিয়াপন্থী, আমেরিকাপন্থী, ভারতপন্থী, সৌদি-আরবপন্থীসহ নানানপন্থী রাজনীতি ও রাজনীতিবিদের মাঝে বঙ্গবন্ধুর পরে একমাত্র শেখ হাসিনাই বাংলাদেশপন্থী রাজনীতি করে বাংলাদেশকে মর্যাদাশীল রাষ্ট্র বানাতে সক্ষম হয়েছেন। চার দশকেরও বেশি সময়ের পথচলায় জেল-জুলুমের সঙ্গে যার দিকে বার বার বন্দুক তাক করা হয়েছে, যার দিকে বার বার সন্ত্রাসীর বোমা-গুলি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে, যাকে রক্তাক্ত ও কণ্টকাকীর্ণ পথেও দমাতে পারেনি; তিনি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা, অবিরাম ছুটে চলেছেন দেশ ও দেশের মানুষের কল্যাণ সাধনের লক্ষ্য অর্জনে। মুক্তিযুদ্ধের মুল স্রোতধারা' ও 'অসাম্প্রদায়িক' 'গণতান্ত্রিক' বাংলাদেশকে পুনরুদ্ধার সংগ্রামে তিনি অবিচল ছুটে চলা সাহসী যোদ্ধা।
প্রতিটি মানব সন্তানের জন্য তার পরিবার যেমন গুরুত্বপূর্ণ, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ধর্ম চর্চার অভিভাবক-নেতৃত্ব যেমন অপরিহার্য; তেমনিভাবে একটি দেশ ও জাতির জন্য বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও নেতার গুণাবলীও সেদেশের জনগণের আত্মমর্যাদা ও সভ্য মনমানসিকতা বিকশিত হতে সাহায্য করে, অনুকরণীয় করে তোলে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমার তার দীর্ঘ ২৪ বছর আন্দোলন-সংগ্রাম করে বাঙালি চেতনাবোধে উদ্ধুদ্ধ করে একটি জাতিকে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন, আর পঁচাত্তর পরবর্তী অবহেলিত জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে দীর্ঘ ২৬ বছর আন্দোলন-সংগ্রাম করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর মাধ্যমে সে জাতিকে 'আত্মমর্যাদা' আর 'সক্ষমতা'র উন্নয়নে নব উদ্যোমের বাংলাদেশ বিশ্বায়নে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
পরিশেষে বাঙালি নিজেকে আরেকটি প্রশ্ন করতে পারেন, ব্যক্তি নাগরিকের জায়গায় কী দায়িত্ব রয়েছে, কী দায়িত্ব গ্রহণ করেছি আর কী পালন করা উচিত। নানান মত, নানান পথ-বিতর্কের উর্ধ্বে 'আমি বাঙালি' এবং 'বাংলাদেশ আমার'-এটি ভেতর থেকে উপলব্ধি করেই দায়িত্ব নিতে হবে। আলোচনা-সমালোচনা ঘাড়ে তুলেই সভ্যতায় আলো ছড়াতে হবে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দায়িত্ব নিয়ে যে 'স্বাধীনতা' এনে দিয়েছেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দায়িত্ব নিয়ে যে 'আত্মমর্যাদা' আর 'সক্ষমতা'র নব উদ্যোমের বাংলাদেশ বিশ্বায়নে প্রতিষ্ঠিত করেছেন-এটিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই হোক প্রকৃত বাঙালির পথ ও পদ্ধতি।