Published : 08 Dec 2020, 11:39 PM
ভাস্কর্য-বিরোধিতার মাধ্যমে উস্কানি দেওয়ায় তিনজনের বিরুদ্ধে 'রাষ্ট্রদ্রোহ' মামলা নিয়েছে আদালত। এর প্রতিক্রিয়ায় আল সাফা ইসলামিক মিডিয়াতে দেওয়া বিবাদী নেতার বিবৃতির মদিনা সনদ সংশ্লিষ্ট অংশ: "মামলার আইনজীবী তিনি তার বক্তব্যের মাধ্যমে গণমাধ্যমের সামনে তুলে ধরেছেন সেটি হল যে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী তিনি মদিনা সনদে বাংলাদেশকে চালানোর জন্য দাবি করেছেন বা মদিনা সনদে বাংলাদেশ চলবে বলে মন্তব্য করেছেন। তো বাংলাদেশের কনস্টিটিউশন এবং সংবিধানের বিরুদ্ধাচরণ আখ্যায়িত করে উনাকেও এই রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় বিবাদী করা হয়েছে।"
যেহেতু মদিনা সনদের মত গুরুত্বপূর্ণ দলিলের কথা আগেও উঠেছে তাই শুধু এর ধর্মতাত্বিক দিক নিয়ে শালীন আলোচনা দরকার।
প্রেক্ষাপট
গঠনতন্ত্র হল কোনও সংগঠনের মূল দলিল যার ভিত্তিতে তার কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হয়। সব সংগঠনেরই গঠনতন্ত্র থাকে এবং রাষ্ট্রও একটা রাজনৈতিক সংগঠন। নবীজী (স) ৬২২ সালে মদিনায় হিজরত করার পরের বছরই এই "সহীফা" তৈরি করে মদিনার অমুসলিমদের কাছে প্রস্তাব করেন, বিস্তারিত আছে "সিরাত"-এ (ইবনে হিশাম ইবনে ইশাক) পৃষ্ঠা ২৩১-২৩৪। দলিলের নাম 'The Covenant Between The Muslims and The Medinans And With The Jews – অর্থাৎ "মুসলিম ও মদিনাবাসী এবং ইহুদিদের মধ্যে কভেন্যাণ্ট" অর্থাৎ চুক্তি, কথা দেওয়া, প্রতিজ্ঞা, ইত্যাদি।
'সিরাত' থেকে ভাবানুবাদ দিচ্ছি-
মুজাহির ও আনসারদের বিষয়ে রসুল (সা.) একটি চুক্তিপত্র লেখেন যাহাতে তিনি ইহুদিদের সাথে 'বন্ধুত্বসুলভ চুক্তি' (Friendly Agreement) করেন এইভাবে- 'ইহা রসুল মুহম্মদের পক্ষ হইতে মুমিনগণ, কুরাইশ মুসলিমগণ এবং মদিনার যাহারা তাহাদের পরে আসিয়া যোগ দিয়াছে ও পরিশ্রম করিয়াছে তাহাদের ভিতরে সম্পর্ক স্থির করিতে। তাহারা সকলে এক উম্মা।
১৪০০ বছর আগের দলিল দিয়ে আজকের রাষ্ট্র "মদীনা সনদে দেশ চলবে" এই দাবিটা যেহেতু উঠেছে তাই দলিলটা খুঁটিয়ে দেখার দরকার আছে। দলিলটা এখন ইন্টারনেটে ফ্রি পাওয়া যায়, ড. হামিদুল্লাহ'র বিখ্যাত ছোট্ট বই 'দ্য ফার্স্ট রিটেন কন্সটিটিউশন ইন্ দ্য ওয়ার্ল্ড' অর্থাৎ 'বিশ্বের প্রথম লিখিত গঠনতন্ত্র' দেখা যেতে পারে।
সনদের ধারাগুলো পড়ে নিলে এ নিবন্ধ বুঝতে সুবিধে হবে, মোট ৪৭টি, কখনো ৫২ বলা হয়েছে। পরবর্তীতে মদীনার অমুসলিম গোত্রদের সাথে মুসলিমদের যুদ্ধগুলোকে এ দলিলের আলোচনার বাইরে রাখতে হবে কারণ সেগুলো পরের দিকের হিস্টোরিক্যাল ডেভেলপমেন্ট, ঘটনার বিবর্তন। এ দলিলের গুরুত্ব ও অবদান নবীজীর (স) মদিনা জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ের, কারণ পরবর্তীতে এটা বাতিল করা হয়। নিচে দেখুন-
১. এ দলিল আরবের শতাব্দীপ্রাচীন গোত্রভিত্তিক সংঘাতময় সমাজ উৎখাত করে সব গোত্র ও ধর্মের অভিবাসীকে নিয়ে নির্ধারিত ভৌগোলিক সীমাবেষ্টিত "এক জাতি" (দলিলের ভাষায় 'উম্মা') প্রতিষ্ঠা করেছিল। যে নবীজী (স) জীবনে গোত্রগুলোর পারষ্পরিক যুদ্ধের অপসংস্কৃতি ছাড়া আর কোনই সমাজ-ব্যবস্থা দেখেননি, "সবাই মিলে এক উম্মা" এই প্রগতিশীল কনসেপ্ট তার অসাধারণ মেধার প্রমাণ। এ ছিল মানবসভ্যতার অগ্রগতির দিকে এক বৈপ্লবিক পদক্ষেপ।
২. জনগণের নিরাপত্তার আস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মদিনা সনদের ধারাগুলো পড়লে দেখা যাবে এর ভিত্তিতে প্রতিটি মানুষের মনে নিরাপত্তার আস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যে কোনো শাসনকর্তার জন্য এ এক বিপুল অর্জন যা অতীত বর্তমানের অনেক দেশেই ছিলনা বা নেই।
ইসলামী রাষ্ট্রপন্থিরা মদিনা সনদকে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করেছেন?
ক. "রসুলুল্লাহ (সা.) মদিনা পৌঁছে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার কারণে সর্বপ্রথম মদীনায় ও তৎপার্শ্ববর্তী এলাকায় বসবাসরত ইহুদী গোত্রসমূহের মধ্যে শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেছিলেন। চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, ইহুদীরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হবে না এবং কোন আক্রমণকারীকে সাহায্য করবে না। তারা আক্রান্ত হলে মুসলমানগণ তাদেরকে সাহায্য করবে। শান্তিচুক্তিতে আরও অনেক ধারা ছিল"- মওলানা মুহিউদ্দিনের অনুদিত বাংলা-কোরান, পৃষ্ঠা ১৩৪৯, ৩৩৫ ও ৪৮।
খ. ওই দলিলটি ছিল 'মদিনা চুক্তি'এবং 'মদিনা সনদ'– ৩য় খণ্ড, বিধিবদ্ধ ইসলামি আইন পৃষ্ঠা ৩৬০, প্রকাশক বাংলাদেশ ইসলামী ফাউন্ডেশন।
গ. "মদিনায় স্থায়ীভাবে শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা এবং জুলুম ও সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে মদীনায় বসবাসকারী অন্যান্য ধর্মালবম্বী বিশেষত ইয়াহুদীদের সাথে তিনি এক শান্তিচুক্তি সম্পাদন করেন, যা ইতিহাসে মদিনা সনদ নামে খ্যাত"। (সূত্র: ইসলামী জীবন- সন্ত্রাস নির্মূলে মহানবী (সা.)-এর শ্বাশ্বত কর্মসূচি-মুহাম্মদ মুহিব্বুল্লাহ ভুঞা, দৈনিক ইনকিলাব ১৪ সেপ্টেম্বর ২০০৮।)
এমন অজস্র উদাহরণ আছে। অর্থাৎ আমরা দেখছি ইসলামী রাষ্ট্রপন্থিরাও দলিলটাকে 'গঠনতন্ত্র' বলেননি, বলেছেন শান্তিচুক্তি, মদিনা চুক্তি এবং মদিনা সনদ। তার কারণও আছে। সনদের ধারাগুলো পড়লেই স্পষ্ট হবে ওটার বিষয় প্রধানত যুদ্ধ ও যুদ্ধসংক্তান্ত বিষয়াদি, শান্তিচুক্তি, রক্তমূল্য, গোত্রগুলোর মধ্যে পারষ্পরিক সম্পর্ক ইত্যাদি। 'রাষ্ট্রীয় গঠনতন্ত্র' একটা বিশাল, জটিল ও ব্যাপক বিষয়, এতে শত বিষয়ের হাজারো ধারা থাকে। তাছাড়া-
গঠনতন্ত্র তৈরিই হয় দুই বা বেশি পক্ষের আলোচনা-বিতর্ক করে। কিন্তু নবীজী (স) আল্লাহ প্রদত্ত অধিকারবলে নিজে থেকে এককভাবে ওটা তৈরি করেছিলেন।
গঠনতন্ত্রে আলাপ-আলোচনা-বিতর্কের মাধ্যমে পরিবর্তনের সুযোগ থাকতে হয়। মদিনা সনদের ওপরে আলোচনা বা পরিবর্তনের সুযোগ ছিল না এবং কোন পরিবর্তন হয়ওনি।
গঠনতন্ত্রকে ক্রমাগত পরিমার্জন ও পরিবর্ধন করে প্রয়োগ করতে হয় যা এ দলিলের ক্ষেত্রে হয়নি।
একতরফা ঘোষণায় চুক্তি বাতিল করা যায় কিন্তু আলোচনা ছাড়া গঠনতন্ত্র বাতিল করা যায় না। অমুসলিমরা এ-চুক্তি ভঙ্গ করলে "ওবাদা ইবনে সামেত (রা.) প্রমুখ সাহাবী প্রকাশ্যভাবে তাদের সাথে চুক্তি বিলোপ ও অসহযোগের কথা ঘোষণা করেন"। (মওলানা মুহিউদ্দিনের অনূদিত বাংলা-কোরান পৃ: ৩৩৬।)
এবারে আত্মসমালোচনা, যাকে খুব বুদ্ধিমানের মতো প্রচণ্ডভাবে এড়িয়ে চলি আমরা। কিন্তু তাতে প্রচণ্ড ক্ষতি হয়। মদিনা সনদের ধারায় আছে-
কেহ যদি কোন মুসলিমকে ইচ্ছাকৃতভাবে খুন করে ও তাহা প্রমাণিত হয়, তবে নিশ্চয়ই খুনির মৃত্যুদণ্ড হইবে"। – ধারা ২১।
আবার নিচের ধারাটিও আছে-
কোন অবিশ্বাসীকে খুন করার বদলে কোন মুসলমান অন্য মুসলমানকে খুন (ইয়াক্তালু) করিবে না। (ধারা ১৪- দ্য ফার্স্ট রিট্ন্ কন্সটিটিউশন ইন্ দ্য ওয়ার্ল্ড, পৃষ্ঠা ৪৫ ও ৪৭- ড. মুহম্মদ হামিদুল্লাহ।)
এ দিয়ে দেশ চলতে পারে?
মদীনায় তখন মোটামুটি দশ হাজার লোকের বাস (ড. মুহম্মদ হামিদুল্লাহ পৃ. ১৩), আর মুজাহির-আনসার মিলিয়ে মুসলমানের সংখ্যা মাত্র দু'শো।"(দ্য প্রসেস অব্ ইসলামিক রেভল্যুশন" – মওলানা মওদুদি, পৃ. ৪২।)
অর্থাৎ অমুসলিমরা ৯৮ শতাংশ, ওটা ওদেরই ভিটেমাটি পৈতৃক জায়গা। এই অন্যায় অপমানকর চুক্তিতে সেই দশ হাজার লোক ও তাদের শক্তিশালী নেতারা নিজেদেরই দেশে বসে নিজেদেরই বিরুদ্ধে কেন রাজি হবে মাত্র দুইশো জনের নেতার সাথে? আপনি হবেন? প্রশ্নই ওঠে না। ওরা নবীজীকে আল্লাহর রসুল বলেই মানেনি, তার নেতৃত্ব মানবে কেন? নেতা কখনো নেতাগিরি ছাড়তে চায়? এ সামাজিক শাসন নবীজী অবশ্যই করেছিলেন, তবে শুরুতেই নয় বরং কয়েক বছর সংগ্রামের পরে মদিনার এবং অন্যান্য অমুসলিম গোত্রগুলোকে তার আওতায় এনে।
কাজেই ১৪০০ বছর আগেকার যে শান্তিচুক্তির বিষয় প্রধানত গোত্রীয় শান্তিচুক্তি ও সাহাবীরা যা 'বিলোপ' করেছিলেন, সেটাকে 'গঠনতন্ত্র' নাম দিয়ে বর্তমানে গোত্রীয় সংস্কৃতিমুক্ত কোনও 'দেশ চলবে', এ বাক্য পর্যালোচনার দাবি রাখে। হ্যাঁ, মদিনা সনদের যে স্পিরিট, যে মর্মবাণী তা শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বের প্রতিটি দেশের জন্য চিরকালের উদাহরণস্বরূপ।
সবাইকে সালাম।