Published : 07 Dec 2020, 08:54 PM
বঙ্গবন্ধুর চব্বিশ বছরের আন্দোলন-সংগ্রামের দিনগুলো শুধু পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক ও শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধেই ছিলো না, এদেশের কতিপয় পাকিস্তানপন্থীদের বিরুদ্ধেও সমানতালে করতে হয়েছে। নানামুখী অপপ্রচার আর ষড়যন্ত্রের জাল ভেদ করে শেখ মুজিবুর রহমান তার নিজস্ব ধ্যান-জ্ঞান আর বিচার-বিশ্লেষণ করে দেশ ও জাতির জন্য যেটা ভালো মনে করেছেন- এটিই বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও রাজনৈতিক কর্মসূচি নিয়েছেন। আর সেখানে নানা দল, উপদলের সাথে নানা মতের বিরুদ্ধে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শুধু 'স্বাধীনতা' আর 'বাংলাদেশ' বিনির্মাণ নিয়েই এগিয়েছেন।
আর তাই নিজেদের পক্ষে অবস্থান সৃষ্টি করতে, নিজেদের জনসমর্থন অর্জনে তখনও ধর্ম ব্যবসায়িকরা ধর্মকে পুঁজি করে, সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে রীতিমত ব্ল্যাকমেইল-আত্মসাৎ করে পশ্চিম পাকিস্তান ও তাদের শাসনতন্ত্রের পক্ষে জনমত সৃষ্টি করার ষড়যন্ত্র করেছে। শেখ মুজিবুর রহমানকে বিতর্কিত করার মাধ্যমে তার ওপর দেশের সাড়ে সাত কোটি বাঙালির আস্থা-বিশ্বাস আর ভরসার মজবুত জায়গাটিকে ভীষণভাবে নড়বড়ে আর প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে 'হিন্দু' আর 'ভারতের দালাল' বলে মিথ্যাচার-অপপ্রচার করে এ বাঙালার স্বাধীনতাকামী জনগণকে ভ্রান্ত করতে-তখনও ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়েছে, মনগড়া ফতোয়া ছড়িয়েছে এবং ধর্মকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছে।
বঙ্গবন্ধু তার আদর্শগত জায়গা 'বাঙালি জাতীয়তাবাদ' থেকে হাজার বছরের স্বপ্ন নিয়েই ধর্মকে 'রাষ্ট্র' আর 'রাজনীতি' থেকে ব্যক্তিগত বিশ্বাসের জায়গায় রাখতে চেয়েছেন। আর তাই 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগকে সার্বজনীন এবং সকল সম্প্রদায়ের নাগরিক অধিকার-বিশ্বাসের জায়গা নিশ্চিত করেছেন। শুধু তাই নয়, দীর্ঘ চব্বিশ বছর আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে স্বাধীন-সার্বভৌম পবিত্র ভূমি-রাষ্ট্র 'বাংলাদেশ' সৃষ্টি করেছেন, সেই স্বাধীন মাটিতে পা রেখেই (১০ জানুয়ারি, ১৯৭২) বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, "সকলে জেনে রাখুন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের স্থান চতুর্থ।… কিন্তু অদৃষ্টের পরিহাস, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ইসলামের নামে এ দেশের মুসলমানদের হত্যা করেছে। ইসলামের অবমাননা আমি চাই না। আমি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিতে চাই যে, বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয়ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এ দেশে কৃষক-শ্রমিক, হিন্দু-মুসলমান সুখে থাকবে, শান্তিতে থাকুক।"
শুধু তাই নয়, ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর খসড়া সংবিধান প্রসঙ্গে জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু যে ভাষণ দিয়েছিলেন, সে ভাষণেও তিনি বলেছিলেন- "…আর হবে ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে; মুসলমান তার ধর্ম পালন করবে; খ্রিস্টান, বৌদ্ধ-যে যার ধর্ম পালন করবে। কেউ কারও ধর্মে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না, বাংলার মানুষ ধর্মের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ চায় না। রাজনৈতিক কারণে ধর্মকে ব্যবহার করা যাবে না। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য ধর্মকে বাংলার বুকে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। যদি কেউ ব্যবহার করে, তাহলে বাংলার মানুষ যে তাকে প্রত্যাঘাত করবে, এ আমি বিশ্বাস করি।" এবং সংবিধানেও রাষ্ট্রনীতি 'ধর্মনিরেপক্ষতা' যুক্ত করেছিলেন।
আজ বাংলাদেশের বয়স যখন পঞ্চাশের ঘরে, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী উদযাপন যখন ঘড়ির কাটায় চূড়ান্ত, তখন এই আধুনিক আর তথ্য-প্রমাণের সভ্য সমাজ-রাষ্ট্রে কেন মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণা আর হুমকি-ধামকি কিংবা ব্যর্থ রাষ্ট্র আফগানিস্তান-পাকিস্তানের আদলে বাংলাদেশ করার চক্রান্ত- এটি গভীরভাবে অনুধাবনের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কারণ, 'ভাস্কর্য সংস্কৃতি' রাতারাতি সৃষ্টি হয়নি কিংবা সরকার প্রধান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার একান্ত-ব্যক্তিগত চিন্তা-স্বপ্নের ফসল নয়। ত্রি-মাত্রিক এই শিল্পকর্ম ভাস্কর্য নবীর (সা.) আমলেও 'পুতুল' আকারে ছিল।
হযরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, ''আমি রাসুলের (সা.) উপস্থিতিতে পুতুলগুলি লইয়া খেলিতাম এবং আমার বান্ধবীরাও আমার সহিত খেলিত। যখন আল্লাহর রাসুল (সা.) আমার খেলাঘরে প্রবেশ করিতেন, তাহারা লুকাইয়া যাইত, কিন্তু রাসুল (সা.) তাহাদিগকে ডাকিয়া আমার সহিত খেলিতে বলিতেন।'' [সহি বুখারি, ৮ম খণ্ড, হাদিস : ১৫১]
উম্মুল মোমেনীন হজরত আয়েশা সিদ্দিকী (রা.) বলেছেন,
যখন আল্লাহর রাসুল (সা.) তাবুক অথবা খাইবার যুদ্ধ হইতে ফিরিলেন তখন বাতাসে তাঁহার কক্ষের সামনের পর্দা সরিয়ে গেলে তাঁহার কিছু পুতুল দেখা গেল। তিনি [(রাসুল (সা.)] বললেন, "এইগুলি কী?" তিনি বললেন, "আমার পুতুল।" ওইগুলির মধ্যে তিনি দেখিলেন একটি ঘোড়া যাহার ডানা কাপড় দিয়া বানানো হইয়াছে এবং জিজ্ঞাসা করিলেন, "ইহা কি যাহা উহার উপর রহিয়াছে?" তিনি উত্তরে বলিলেন, "দুইটি ডানা।" তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন, "ডানাওয়ালা ঘোড়া?" তিনি উত্তরে বলিলেন, "আপনি কি শোনেননি যে সুলেমানের ডানাওয়ালা ঘোড়া ছিল?" তিনি বলেছেন, ইহাতে আল্লাহর রাসুল (সা.) এমন অট্টহাসি হাসিলেন যে আমি উনার মাড়ির দাঁত দেখিতে পাইলাম। [সহি আবু দাউদ, বুক-৪১, হাদিস : ৪৯১৪]
হযরত আয়েশা (রা.) থেকে আরও জানা যায়,
আল্লাহর রাসুল (সা.) তাহাকে সাত বৎসর বয়সে বিবাহ করিয়াছিলেন এবং তাহাকে নয় বৎসর বয়সে কনে হিসেবে তাহার বাসায় লইয়া যাওয়া হয়, এবং তাহার পুতুলগুলি তাহার সাথে ছিল এবং যখন তিনি দেহত্যাগ করিলেন তখন তাহার বয়স ছিল আঠারো।' [সহি মুসলিম, বুক-৮, হাদীস : ৩৩১১]
আবার তিনি এও বলেছেন, আল্লাহর রাসুলের (সা.) উপস্থিতিতে পুতুল নিয়ে খেলতেন এবং যখন তার সঙ্গিনীরা যারা তার কাছে আসতেন তখন তারা চলে যেতেন। কারণ তাহারা আল্লাহর রাসুলের (সা.) জন্য লজ্জা পেতেন। যদিও আল্লাহর রাসুল (সা.) তাদেরকে তার (আয়েশার) কাছে পাঠিয়ে দিতেন।
[সহি মুসলিম, বুক-৩১ হাদীস : ৫৯৮১]
আবার কোরআনে সুস্পষ্ট বলা আছে: (১.) মূর্তিপূজা শয়তানের কাজ [মায়েদা : ৯০] এবং (২.) "এই মূর্তিগুলো কী, যাদের তোমরা পূজারি হয়ে বসে আছ?" [আম্বিয়া : ৫২]।
এখানে কোরআনের নিষেধ হলো মূর্তিপূজা, উপাসনা-আরাধনা-ইবাদত সম্পর্কে। কারণ, মূর্তিপূজা মাধ্যমে আল্লাহর অংশীদারিত্ব অথবা আল্লাহ'র সাথে 'শরিক করা'কে বোঝানো হয়েছে। আর ইসলামী শরীয়া অনুযায়ী এটাই মানুষকে 'মুশরিক' করে তোলে যা মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য অনুমোদিত নয়।
তাহলে এখানে সহজভাবে প্রশ্ন আসে, যে মূর্তির প্রতি কোনো মুসলমান ইবাদত করে না কিংবা আল্লাহ'র অংশীদারিত্ব করা হয় না, যে মূর্তি শুধু ইতিহাস-ঐতিহ্যে আর সৌন্দর্য্যের ধারক-বাহক এবং একটি জায়গাকে সুসজ্জিত করে রাখে, সে ব্যাপারে পবিত্র কোরআন কী বলে?
"তারা সোলায়মানের (আ.) ইচ্ছানুযায়ী দুর্গ, ভাস্কর্য, হাউযসদৃশ বৃহদাকার পাত্র এবং চুল্লির উপর স্থাপিত বিশাল ডেগ নির্মাণ করত।" [সুরা সাবা, আয়াত : ১৩] অর্থাৎ, পূজা-আরাধনা করলে সেটা হয় প্রতিমা যা মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য ইসলাম অনুমোদন করে না। আর না করলে হয় ভাস্কর্য (মূর্তি)। ইসলাম প্রতিমার বিরুদ্ধে, ভাস্কর্য ও মূর্তির বিরুদ্ধে নয়।
তাহলে অনেকে এও বলতে পারেন, যেহেতু ইসলাম 'প্রতিমা'কে অনুমোদন করে না তাহলে ভেঙ্গে ফেলতে হবে কিংবা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেওয়া যাবে কি?
কখনই প্রতিমাকে ভেঙ্গে ফেলা বা ভেঙ্গে গুড়িয়ে দেওয়া যাবে না। কারণ, বাংলাদেশ ইসলামী শরীয়া আইন ও ফতোয়া দিয়ে পরিচালিত হয় না। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ 'সংবিধান' ও 'আইন' দিয়ে চলে। আমাদের দেখতে হবে, আমরা যা নিয়ে বিতর্ক করছি-এটি সংবিধানবিরোধী কিনা কিংবা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক কিনা।
আমাদের বুঝতে হবে, ধর্মনিরপেক্ষতা রাষ্ট্র পরিচালনার একটি নীতি। এর অর্থ 'ধর্মহীনতা' বা 'ধর্ম বিমুখতা' নয়। এটি হচ্ছে, রাষ্ট্র তার নাগরিকদের ধর্ম বা বিশ্বাসের বিষয়ে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকবে। কে কোন ধর্মে বিশ্বাসী বা কে অবিশ্বাসী অথবা নাস্তিক এ বিষয়ে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রযন্ত্র কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করবে না, করতে পারবে না। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সমান অধিকার, সবাই রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে সমান-এই হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা।
আর বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা বা রাষ্ট্র থেকে ধর্মকে সম্পূর্ণ পৃথক করে দেওয়া বোঝায় না, বরং রাষ্ট্রের প্রদত্ত সুবিধায় সব ধর্মের সমান অধিকার ও অংশগ্রহণকে বোঝানো হয়েছে। যেমন, সংবিধানের ১২নং অনুচ্ছেদে ধর্মনিরপেক্ষতা বলতে সব ধরনের সাম্প্রদায়িকতা, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য বা নিপীড়ন ও ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদার সুযোগ বিলোপ করার কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের ৪১ নম্বর অনুচ্ছেদে সব নাগরিকের স্বাধীনভাবে যেকোনও ধর্ম প্রচার ও পালনের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। ২৭-২৮ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান সুরক্ষার অধিকার ভোগ করবে। রাষ্ট্রধর্মের ভিত্তিতে কোনও নাগরিকের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করবে না। সুতরাং যেকোনও হিন্দু বা বৌদ্ধ বাংলাদেশি নাগরিকের বৈষম্যহীনভাবে ধর্ম পালন ও প্রচার করার অধিকার রয়েছে। সব ধর্মের মানুষের সমান মর্যাদা ও অধিকার সংবিধানের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়েছে বিধায় এ দেশে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ অন্যান্য সকল ধর্মের সবাই রাষ্ট্রের বিচারে সমান।
আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করলে দেখবেন, ইসলাম ধর্মের অসাধারণ শিক্ষার বাস্তব প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর জীবনীতে। তিনি [মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)] মক্কার নির্যাতিত অবস্থা থেকে মুক্তির আশায় ধর্মীয় স্বাধীনতা লাভের প্রত্যাশায় মদিনায় পৌঁছানোর পর মদিনার ইহুদি ও অন্যান্য ধর্ম গোষ্ঠী ও গোত্রের সাথে একটি 'সন্ধি' করেন যেটি 'মদিনা সনদ' নামে বিশ্ব বিখ্যাত। 'মদিনা সনদ'- এর প্রতিটি ছত্রে সকল ধর্মের ও বর্ণের মানুষের সমান নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। মদিনার সকল নাগরিককে এক জাতিভুক্ত বলে ঘোষণা করেছেন। মদিনা সনদের ২৫ নম্বর ধারায় ধর্ম নিরপেক্ষতার একটি বিরল উদাহরণ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এতে বলা হয়, বনু আওফ গোত্রের ইহুদিরা মুমিনদের সাথে একই উম্মতভুক্ত বলে গণ্য হবে। ইহুদিদের জন্য ইহুদিদের ধর্ম, মুসলমানদের জন্য মুসলমানদের ধর্ম। একই কথা এদের মিত্রদের এবং এদের নিজেদের জন্য প্রযোজ্য। তবে যে অত্যাচার করবে এবং অপরাধ করবে সে কেবল নিজেকে এবং নিজ পরিবারকেই বিপদগ্রস্ত করবে।
এখানেই আমাদের শিক্ষণীয় বিষয় যে, বিশ্বনবী মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) প্রতিষ্ঠিত নীতি হলো, যে যে ধর্মেরই হোক না কেন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে তাদের জাগতিক অবস্থান সমান। এটি নিছক একটি ঘোষণাই নয় বরং মহানবী (সা.) মদিনার শাসনকাজ পরিচালনাকালে এর সুষ্ঠু বাস্তবায়নও করেছিলেন।
পাঠক! তাহলে আমরা কেন মিথ্যাচার-অপপ্রচার করে ভিন্ন ধর্মালম্বীদের বিরুদ্ধে বিষোগার করবো? কারণটাও স্পষ্ট, এখানে একশ্রেণির মানুষ ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, করছে ধর্মের নামে ব্যবসা। কে ধর্ম বিশ্বাস রাখবে, কে ঈমান আনবে কিংবা কে ঈমান আনবে না-এই বিষয়ে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে ইসলাম। আর ইসলাম কারো মনগড়া কথায় পরিচালিত নয়, কারো মনগড়া ফতোয়ার উপর ইসলাম নির্ভরও করে না।
কোরআনে আল্লাহতায়ালা বলেছেন, 'তুমি বল, তোমার প্রতিপালক-প্রভুর পক্ষ থেকে পূর্ণ সত্য সমাগত, অতএব যার ইচ্ছা সে ঈমান আনুক আর যার ইচ্ছা সে অস্বীকার করুক'। [সুরা : কাহাফ, আয়াত : ২৮]
সাম্প্রতিক ভাস্কর্য বিতর্ক-অপপ্রচার মূলত ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়া আর ধর্ম ব্যবসার অংশ। কারণ, এদেশে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আগেই অনেকের ভাস্কর্য, মূর্তি ছিল যেগুলো উপাসনালয়ের জন্য নির্মিত হয়নি। আর সেসব ভাস্কর্য, মূর্তির পাশে বসেই আজকের ভাস্কর্যবিরোধীরা রাজনৈতিক মিটিং-মিছিল করেছে, জোটবদ্ধ হয়ে সরকার পরিচালনাও করেছে।
আর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ভারতীয় উপমহাদেশে সিন্ধু সভ্যতায় প্রথম ভাস্কর্যের দৃশ্যায়ন লক্ষ্য করা গেছে। বর্তমান পাকিস্তানের মহেঞ্জোদাড়ো এবং হরপ্পাতেও ভাস্কর্যের প্রমাণ পাওয়া যায়। পরবর্তীতে ধীরে-ধীরে ব্রোঞ্জ ধাতু ও পাথরে খোদাই করে সৃষ্টি করা হয় ভাস্কর্যগুলো।
মূলত, ভাস্কর্যশিল্প একটি দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য আর শিল্প-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। নানা সময়ে আবিষ্কৃত নানা ভাস্কর্য পর্যালোচনা করলে আরও জানা যায়, সুদূর অতীতকাল থেকেই পৃথিবীতে ভাস্কর্যশিল্পের বিকাশ ঘটেছিল। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে ভাস্কর্য পৃথিবীর ইতিহাস ও সংস্কৃতির গৌরব বহন করে চলেছে। এ থেকে আজ মুসলিম বিশ্বও পৃথক নয়। সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়া, ইরাক, ইরান, তুরস্ক, কাতার, মালয়েশিয়ার মতো দেশগুলোতেও দৃষ্টিনন্দন ভাস্কর্য দৃশ্যমান।
বাংলাদেশের ভাস্কর্যের তথ্য-প্রমাণ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, বগুড়ায় দেশের অন্যতম পুরনো ভাস্কর্যটি রয়েছে, যেটি ইংল্যান্ডের রাজা সপ্তম অ্যাডওয়ার্ডের। এ আবক্ষ ভাস্কর্যটি ১৯০১ থেকে ১৯০৫ সালের মধ্যে নির্মাণ করা হয়।
দুঃখজনক হলেও এটাই সত্য, যিনি ২৪ বছর আন্দোলন-সংগ্রাম ও দেশি-বিদেশী শত্রুকে মোকাবেলা করে ৭ই মার্চের ভাষণের মাধ্যমে সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে খালি হাতে কীভাবে যুদ্ধ করতে হয়, শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও যুদ্ধ করতে হবে-এই রণকৌশল দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন, যার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ ও লাল-সবুজ এর স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যিনি সকল মিথ্যাচার-অপপ্রচার প্রতিহত করে মাত্র সাড়ে তিন বছরে একটি মানবিক মূল্যবোধ অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ নিয়ে এগিয়েছিলেন, সেই মহামানব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মাণ হয় অবৈভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলকারী জিয়াউর রহমানের পরে।
ধর্মীয় ছদ্মবেশে ইসলামের অপব্যাখ্যা সৃষ্টি করে, ধর্মীয় অনুভূতিকে পূঁজি করে গুটি কয়েক ব্যক্তি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য নির্মাণে বাধা দিলেও দেশে 'বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি'র প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ভাস্কর্য নিয়ে কোনও মন্তব্য নেই, নেই কোনো ফতোয়া!
১৯৯৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে জিয়া স্মৃতি জাদুঘরের সামনে জিয়াউর রহমানের ভাস্কর্যটি স্থাপন করা হলেও স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্ণাঙ্গ ভাস্কর্য ২০১০ সাল থেকেই দেশের বিভিন্ন জেলায় নির্মিত হয়ে আসছে।
এছাড়াও ২০০১-২০০৫ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় খাগড়াছড়ি শহরের মুসলিমপাড়া মোড়ে জিয়াউর রহমানের আরেকটি ভাস্কর্য স্থাপন করেন দলটির তদানীন্তন স্থানীয় সংসদ সদস্য ওয়াদুদ ভুঁইয়া। জেলা বিএনপির নেতাকর্মীরা বিভিন্ন জাতীয় দিবস ও দলীয় কর্মসূচির অংশ হিসেবে জিয়াউর রহমানের ভাস্কর্যে পুস্পস্তবক অর্পণের পাশাপাশি বিভিন্ন অনুষ্ঠানও পালন করেছে, করছেন।
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বিরোধী মহল বিশ্বাস করেন যে, উপমহাদেশের প্রখ্যাত হাদিস বিশারদ, দেওবন্দী ধারার প্রতিনিধিত্বকারী এবং বাংলাদেশের একজন বর্ষিয়ান নেতা মরহুম শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হক, যিনি চারদলীয় জোটের শীর্ষ চার নেতার একজন ছিলেন।
এখানে প্রশ্ন আসতেই পারে, 'দেওবন্দী ধারা' প্রতিনিধিত্বকারী আজিজুল হক কী করে জোট সরকারের শীর্ষ নেতা হয়েও জিয়াউর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপন করার অংশীদার হলেন? তখন ইসলামী (মন গড়া) মূল্যবোধ কোথায় ছিল? তখন কি ইসলাম অনুমোদন করেছিল? নাকি ব্যক্তিগত স্বার্থের কাছে ফতোয়া বিলীন হয়ে গিয়েছিল? ইসলাম কি ব্যক্তিগত স্বার্থ, ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ কিংবা ব্যক্তিগত মতামতের উপর নির্ভর করে?
পাঠক নিশ্চয় প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করবেন, তবে ১৯৭৫ সালে ১৫ অগাস্ট বিশ্ব ইতিহাসের বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড-সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমানের পরে হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ মূলত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য যে কয়েকটি সিদ্ধান্ত গ্রহন করেছিল তার মধ্যে প্রথমত-ধর্মকে সাংবিধানিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে ব্যবহার করা, দ্বিতীয়ত-বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অলিখিত চুক্তিতে নিষিদ্ধ করা।
তারা জানত, শেখ মুজিবুর রহমান অবৈধভাবে বন্দুকের নল ঠেকিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করেননি। একটি জাতিকে তৈরি করতে তিনি দীর্ঘ ২৪ বছর আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। শত-সহস্র ষড়যন্ত্র আর অপপ্রচারের মাঝেও যিনি ৭ই মার্চের ভাষণের মাধ্যমে স্বাধীনতাবিরোধী-রাজাকার, আলবদর, আলসামস, জামায়াত ইসলামের নেতাকর্মী ব্যাতিত দেশের বৃহত জনগণকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার মন্ত্র দিয়েছেন, ত্রিশ লাখ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান যার নেতৃত্বে যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন, যার আহ্বানে দুই লাখেরও বেশি নারী মুক্তিযোদ্ধা ইতিহাসের সর্বোচ্চ ধৈর্যশক্তি দিয়ে বর্বর অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে সম্মান-সম্ভ্রম বিনাশ করেছেন-এই বাঙালির বৃহত অংশকে ভয়-ভীতি আর মিথ্যাচার-অপপ্রচার করে বেশিদিন দাবিয়ে রাখা যাবে না।
যে ভয় থেকে 'ধর্ম'কে সংবিধানে 'বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম' আর 'রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম' করেছে, যে ভয় থেকে তথাকথিত বহুদলীয় রাজনীতির নামে স্বাধীনতাবিরোধী-রাজাকার ও ধর্মভিত্তিক-সাম্প্রদায়িক রাজনীতি অনুমোদন করা হয়েছে, যে ভয় থেকে সাম্প্রদায়িক-ধর্মীয় রাজনীতি বাহাত্তরের সংবিধান থেকে 'নিষিদ্ধ' মুছে ফেলেছে- একই ভয়-'বঙ্গবন্ধুর আদর্শ' আর 'মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস' থেকেই ভাস্কর্য বিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেছে যা কখনোই সফল হবে না। কারণ, স্বাধীনতাকামী বাঙালি প্রতিবারই স্বাধীনতাবিরোধী ও ধর্ম ব্যবসায়িদের প্রত্যাখ্যান করেছে, মৌলবাদীদের ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করেছে।