Published : 06 Dec 2020, 10:51 PM
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির অত্যন্ত জনাকীর্ণ হয়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে এবং ভূমিধসসহ যেকোনো মৃ্ত্যুর ঝুঁকি এড়াতে বাংলাদেশ সরকার কয়েক দফায় এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। স্বেচ্ছায় স্থানান্তরে রাজি হওয়ায় ১ হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গাকে গত ৪ ডিসেম্বর ভাসানচরে নেওয়া হয়েছে। সরকারের এই উদ্যোগের সঙ্গে সহমত পোষণ করছে না জাতিসংঘসহ কিছু আন্তর্জাতিক সংগঠন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের বিষয়ে বাংলাদেশের আন্তরিক উদ্যোগকে ক্ষতিগ্রস্ত বা অপব্যাখ্যা না করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে।
আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র মিয়ানমার, আমরা অনেকে যাকে বার্মা বলেই বেশি চিনি, সেখানে বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী আরাকান রাজ্যে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর চরম দমন-পীড়ন চালিয়ে, গণহত্যা চালিয়ে কমপক্ষে ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে আসতে বাধ্য করা হয়েছে। বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে অভিযানের নামে নিরীহ রোহিঙ্গাদের নির্বিচারে হত্যা করা হয়েছে । বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, লুট করা হয়েছে সহায়-সম্পদ। প্রাণ বাঁচাতে লাখ লাখ অসহায় রোহিঙ্গা সীমান্তের সব পয়েন্ট দিয়ে স্রোতের মতো বাংলাদেশে ঢুকেছে। ২০১৭ সালের ২৫ অগাস্ট ভোররাতে আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি সংক্ষেপে আরসা নামের একটি বিদ্রোহী সংগঠন সেনাবাহিনী ও পুলিশের ৩০টা ক্যাম্পে একযোগে হামলা চালায় বলে অভিযোগ তুলে মিয়ানমার সেনাবাহিনী কমপক্ষে ১০০ রোহিঙ্গা গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে। দেখামাত্র গুলি করছে। লাশ হয় নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছে অথবা আগুনে পুড়িয়ে দিচ্ছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এই রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযান নতুন না হলেও ২০১৭ সালে তারা তাদের অতীতের রেকর্ড ভঙ্গ করেছে।
১৯৭৮ সালে প্রথম সামরিক হামলার মুখে রোহিঙ্গারা ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়ে বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেয়। তখন বিষয়টি সাময়িক মনে করা হলেও তা একটি স্থায়ী সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। মাঝখানে নানা কূটনৈতিক উদ্যোগের কারণে কিছু শরণার্থী বার্মা ফিরিয়ে নিলেও বিভিন্ন ঘটনায় তারা আবার বাংলাদেশে ফিরে এসে এক মারাত্মক মানবিক সংকট তৈরি করেছে। ধারণা করা হয়, আনুমানিক প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অবস্থান করছিল। বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশের পক্ষে বছরের পর বছর কয়েক লাখ শরণার্থীর ভার বহন করা সম্ভব নয়। তারপরও মানবিকতার কথা বিবেচনা করে বাংলাদেশ দশকের পর দশক ধরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের থাকতে দিয়েছে। ২০১৭ সালে যে হারে রোহিঙ্গারা এসেছে তা আতঙ্কিত হওয়ার মতো। যদি দ্রুত এদের ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করা না হয় তাহলে বাংলাদেশ এক বড় সংকটের মধ্যে পড়বে। মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সমস্যা বাংলাদেশের সামাজিক এবং রাজনৈতিক সমস্যাকে বাড়িয়ে তুলবে।
অসহায় রোহিঙ্গা শিশু-নারী-বৃদ্ধের আর্তনাদ-হাহাকার দেখে, শিশুসহ মানুষের লাশ নদীতে ভাসতে দেখে, মানবতার চরম অপমান ও লাঞ্ছনা দেখে যারা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য আকুলি-বিকুলি করেছেন, তারা এখন তাদের অবস্থানে অবিচল থাকতে পারছেন না। এই অতিরিক্ত বিপুল জনগোষ্ঠীর চাপ আমাদের দেশের সামাজিক স্থিতি বিনষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ানোর আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। নিরাপত্তাজনিত সমস্যা দেখা দেওয়ার আশঙ্কাও আছে। আমাদের অর্থনীতিও লাখ লাখ অতিরিক্ত মানুষের ভরণ-পোষণ চালানোর মতো মজবুত কি না সেটাও ভাবনার বিষয় বৈ কি। আমরা খুবই আবেগপ্রবণ জাতি। চোখের সামনে যেটা দেখি, সেটা নিয়ে আমরা এতই আবেগময় হয়ে উঠি যে একটু দূরে কি আছে সেটা ভাবনায় আনি না। এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, রোহিঙ্গা সমস্যাটি শুধু মানবিক নয়, রাজনৈতিকও। আর এই দুই সমস্যা এককভাবে বাংলাদেশের পক্ষে সমাধান করা বা মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের মনোভাবে পরিবর্তন না এলে এই সমস্যার আর কোনো সহজ সমাধান নেই।
এটা নিয়ে দেশের ভেতর যারা রাজনীতি করতে চান, তাদের উদ্দেশে বলার কথা শুধু এটুকুই যে, আগুন নিয়ে খেলার পরিণতি কখনো ভালো হয় না। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২০১৭ সালে বলেছিলেন, 'সরকার রোহিঙ্গাদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যর্থ হয়েছে'। বিএনপি নেতা এমন মন্তব্য করেছিলেন শুধু সরকারের সমালোচনা করার জন্যই। কারণ রোহিঙ্গাদের স্বার্থ রক্ষা করার কোনো অঙ্গীকার সরকারের ছিল না? তারাতো এদেশের নাগরিক নয়। তাহলে সরকার তাদের স্বার্থ রক্ষা করবে কিভাবে? মির্জা আলমগীর সাহেবের মনে থাকার কথা যে, রোহিঙ্গারা ১৯৭৮ সালে যখন প্রথম শরণার্থী হয়ে বাংলাদেশে আসে তখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন জেনারেল জিয়া। তিনি কি পেরেছিলেন বার্মার সামরিক কর্তৃপক্ষের মন গলাতে? জিয়ার পরেও বিএনপি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে পুরো দুই মেয়াদে এবং একবার স্বল্প মেয়াদে ক্ষমতায় ছিল। কী করা হয়েছিল তখন রোহিঙ্গাদের স্বার্থে? নিজেরা যেটা পারেননি, এবং কেন পারেননি, সেটা মাথায় রেখে বর্তমান সরকারের সমালোচনা করলে ভালো হবে।
সরকারের কূটনৈতিক ভূমিকার সমালোচনাও করা হচ্ছে। রোহিঙ্গা সমস্যা যেহেতু বছরের পর বছর ধরে চলছে সেহেতু এই সমস্যা সমাধানে সরকার আগে থেকে কিছু ভূমিকা নিশ্চয়ই পালন করতে পারতো। দৃশ্যমান তৎপরতা চালাতে পারতো। ভারতের সঙ্গে সীমান্ত সমস্যা সমাধানসহ আরো কিছু তামাদি সমস্যা সমাধানে সরকারের সাফল্য আছে। সমুদ্রসীমার মামলা জয়ও সরকারের সাফল্য। কিন্তু রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে সরকারের তেমন কোনো ইনিশিয়েটিভের কথা শোনা যায় না। তবে এক্ষেত্রে এটাও মনে রাখতে হবে যে, সংকট সৃষ্টিকারী দেশটির নাম মিয়ানমার বা বার্মা। বার্মাকে অনেকে দুনিয়াছাড়া দেশ বলে থাকেন। এটা খুব বেঠিক নয়।
ভারত ভাগের এক বছর পর ইংরেজরা বার্মাকে স্বাধীনতা দেয়। ১৯৪৮ সালে স্বাধীন বার্মার প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন জেনারেল অং সান। কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই অং সান এবং তার মন্ত্রিপরিষদের সব সদস্যকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী। তখন থেকে বার্মা চলে যায় সামরিক শাসনের অধীন। লৌহকপাটের দেশ বলেই বার্মা পরিচিতি পায়। পৃথিবীর আর কোনো দেশেই এত দীর্ঘ সময় সামরিক শাসনাধীন চলার রেকর্ড নেই। বাইরের দুনিয়াকে বার্মা খুব হিসেবের মধ্যে নেয়- তার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। চরম স্বেচ্ছাচারী বার্মার সামরিক কর্তৃপক্ষ শুরু থেকেই আরাকান রাজ্যের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিজ দেশের মানুষ বলে মনে করেনি। ধর্মের দিক থেকে রোহিঙ্গারা মুসলমান, আবার তাদের ভাষা বাংলা,চট্রগ্রামের আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে রোহিঙ্গাদের ভাষার অভিন্নতার কারণে বার্মিজ শাসকেরা কখনো তাদের বার্মার অধিবাসী বলে মনে করেন না। তাদের 'বাঙালি' বলা হয়। সমস্যাটা এখানেই। যেহেতু তাদের বহিরাগত মনে করা হয়, সেহেতু তাদের দেশছাড়া করার অধিকার বার্মার শাসকদের আছে বলে তারা মনে করেন।
হতে পারে যে রোহিঙ্গাদের পূর্বপুরুষ চট্টগ্রাম থেকেই আরাকান রাজ্যে গিয়ে বসতি স্থাপন করেছেন। কিন্তু সেটা তো নিশ্চয়ই বহু বছর আগের কথা। বংশ পরম্পরায় তারা সেখানে আছেন । এখন তারা আরাকানের মাটির সন্তান। তাদের অধিকারহীন, মর্যাদাহীন রাখার কোনো নৈতিক এবং আইনি সুযোগ বার্মার শাসক গোষ্ঠীর নেই। যুক্তি-বুদ্ধির ধারে কাছে যেতে রাজি নন বার্মার সামরিক কর্তৃপক্ষ। দুনিয়া জুড়ে যারা মোড়লি করেন, গণতন্ত্র- মানবাধিকারের যারা ফেরিওয়ালা, তারা বার্মায় পৌঁছতে পারেন না। ওখানে নাক গলালে নাক কাটা যাওয়ার ভয় আছে বলে তারা ও পথ মাড়ান না। রোহিঙ্গাদের ওপর প্রথম বড় সামরিক হামলা হয় ১৯৭৮ সালে, যেটা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। বার্মার একগুঁয়ে সামরিক শাসকদের চাপে ফেলার জন্য কোনো আন্তর্জাতিক মাতব্বরকে এত বছরেও এগিয়ে আসতে দেখা যায়নি ।
ধারণা করা হয়েছিল, বার্মার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী, বার্মার প্রথম প্রধানমন্ত্রী অং সানের কন্যা অং সান সু চির দল ক্ষমতায় এলে হয়তো পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে সু চির দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি বিপুল ভোটে জয়লাভ করলেও সরকার গঠন করতে হয়েছে সেনাবাহিনীর সঙ্গে আপস-সমঝোতা করে। সু চিকে প্রধানমন্ত্রীও হতে দেওয়া হয়নি। সু চি হয়েছেন স্টেট কাউন্সিলর এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রী। বেসামরিক ছদ্মাবরণে শাসণ চালাচ্ছে আসলে সেনাবাহিনী। তাই রোহিঙ্গা প্রশ্নে সু চির আমলেও নীতিগত কোনো পরিবর্তন হয়নি। হবে তেমন কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। সু চি যে সামরিক বাহিনীর ইচ্ছার বাইরে যাবেন না, সেটা এরমধ্যই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন। অনেকেই সু চির শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পাওয়ার বিষয়টি সামনে এনে বলছেন, তার দল ক্ষমতায় থাকতে রোহিঙ্গাদের ওপর এই বর্বর আক্রমণ ও মানবতাবিরোধী আচরণ প্রত্যাশিত নয়। যারা এমন বলেন, তারা শান্তিতে নোবেল পাওয়াটাকে যত বড় বিষয় বলে মনে করেন প্রকৃত অর্থে এখন শান্তিতে নোবেল তত বড় বিষয় নেই।
শান্তিতে নোবেলবিজয়ী হওয়া যে এখন পশ্চিমা দুনিয়ার রাজনৈতিক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে শান্তিতে নোবেলজয়ীদের তালিকা দেখলেই তা স্পষ্ট হয়ে যায়। সু চি দীর্ঘদিন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছেন। নির্যাতন সহ্য করেছেন। কিন্ত শেষপর্যন্ত ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য আপস করেছেন। আর একবার আপসের পথে হাঁটলে মনের দৃঢ়তা বজায় রাখা যায় না। তাছাড়া গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করা সু চি কতটুকু অসাম্প্রদায়িক চেতনার অধিকারী, সেটাও আমাদের জানা নেই। ক্ষমতায় যাওয়ার পর একজন মুসলিম সাংবাদিক তার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সাংবাদিকের মুসলিম পরিচয় জেনে তিনি যে খুশি হননি, সে খবরও তখনই গণমাধ্যমে এসেছিল। রোহিঙ্গারা মুসলমান, তাই তাদের প্রতি সু চি সদয় হবেন না- এটাই তো বরং স্বাভাবিক।
রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব আইন করে বাতিল করা হয়েছে মিয়ানমারে। নাগরিকত্বহীন মানুষদের বার্মাছাড়া করার অজুহাত কর্তৃপক্ষ খুঁজছিল এবং তাদের হাতে মোক্ষম হাতিয়ার তুলে দিয়েছে আরসা নামের 'বিদ্রোহী' সংগঠনটি। তারা সেনা ও পুলিশ ফাঁড়িতে হামলা করেছে– রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে হামলে পড়ার জন্য এর চেয়ে বড় যুক্তি আর কিছু থাকতে পারে না। সন্ত্রাস এবং জঙ্গিবাদ হলো এমন ইস্যু যার পক্ষে দাঁড়ানোর মতো কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না বর্তমান বিশ্বে। রোহিঙ্গাদের আগে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হতো এবং এখন বলা হবে জঙ্গি। ব্যস, রোহিঙ্গারা এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আন্তরিক সহানুভূতি পায় কীভাবে?
রোহিঙ্গারা দীর্ঘ সময় ধরে যেরকম বঞ্চনার শিকার তাতে তাদের দিয়ে উগ্রবাদী কাজকর্ম করানো খুবই সহজ বিষয়। এরমধ্যে রোহিঙ্গাদের কারো কারো জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে না তাও নয়। আরসা নামের সংগঠনটির পেছনে কারা কারা আছে, তারা কোন ভাবাদর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ, আইএস নামের ইসলামি জঙ্গিবাদী সংগঠনের সঙ্গে তাদের কোনো যোগাযোগ বা সম্পর্ক আছে কি না– এ সব কিছুই এখনো অজানা। কিন্তু রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বেপরোয়া হয়ে যদি কয়েক শ কিংবা কয়েক হাজার সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের পথে যায়ও তাহলে কি সমগ্র রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযান চালানো ন্যায্যতা পায়? যদি সত্যি তাদের মধ্যে তেমন কেউ থেকে থাকে তাহলে তাকে বা তাদের খুঁজে বের করা হোক। তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হোক। তা না করে একটি জনগোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করার যে পথ মিয়ানমার সেনাবাহিনী গ্রহণ করছে, সেটা একেবারেই সমর্থনযোগ্য নয়। এটা এথনিক ক্লিনজিং। এটা মানবতাবিরোধী জঘন্য অপরাধ। অথচ পৃথিবীর শক্তিধর দেশগুলো রোহিঙ্গানিধন পর্ব না দেখার ভান করে আছে। এখন তারা অন্ধ। এমন কি মুসলিম দেশগুলোকেও এ ব্যাপারে প্রতিবাদী হতে দেখা যাচ্ছে না। 'উম্মা'এখানে কাজ করছে না।
বাংলাদেশ পড়েছে কঠিন সংকটজনক অবস্থায়। মিয়ানমারকে কূটনৈতিকভাবে চাপ দেওয়ার খুব বেশি সুযোগ বাস্তবে নেই। মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। মিয়ানমার অসুবিধায় পড়ুক– এমন কিছু চীন করবে না। সে ধরনের যেকোনো উদ্যোগেরও চীন বিরোধিতা করবে। ভারতও মিয়ানমারকে যে চটাতে চায় না মোদির সফর ও বক্তব্য তার প্রমাণ। তুরস্ক মিয়ানমারের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি এবং বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতা মাথায় রেখেই সংকট সমাধানের পথ খুঁজতে হবে বাংলাদেশকে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ যে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থা বজায় রেখে চলছে, সেটাই অব্যাহত রাখতে হবে। সরকার পাবলিকের মতো হুজুগে মেতে কোনো হঠকারিতা যেমন করতে পারে না, তেমনি জনমতের বিরুদ্ধে যাওয়াও সরকারের পক্ষে কঠিন। মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গা ইস্যু হতে পারে এই অঞ্চলে ষড়যন্ত্রের রাজনীতির এক উর্বর ক্ষেত্র। ইসলামি জঙ্গি সংগঠন আইএস মধ্যপ্রাচ্য থেকে ঘাঁটিহারা হওয়ায় তাদের পায়ের নিচে মাটি দরকার।
এই অবস্থায় বাংলাদেশকে মাথা ঠান্ডা রেখেই এগুতে হবে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয়, খাদ্য, নিরাপত্তা যেমন দিতে হবে, তেমনি তারা যাতে নিজ দেশে মর্যাদা নিয়ে ফিরে যেতে পারে, সেজন্য কূটনৈতিক তৎপরতাও জোরদার করতে হবে, অব্যাহত রাখতে হবে। রোহিঙ্গাদের বেঁচে থাকার অধিকার কেড়ে নিয়ে মিয়ানমার শান্তিতে থাকতে পারে না – এই বার্তা তাদের দিতে হবে বিশ্ব জনমত সংগঠিত করেই। কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শরণার্থীদের জন্য আর্থিক সহায়তা দিতে যতটা তৎপর, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার পরিবেশ তৈরির জন্য মিয়ানমারের ওপর চাপ দিতে ততটা আগ্রহী নয়। মানবাধিকার নিয়ে সোচ্চার বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন মিয়ানমারের ওপর চাপ সৃষ্টির ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোনো ভূমিকা রাখছে বলে মনে হয় না। রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি মিয়ানমারে দ্রুত, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করতে মিয়ানমারে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টিতে উদ্যোগী হতে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশ সরকার যথার্থভাবেই মনে করে যে, রোহিঙ্গা সংকটের টেকসই সমাধান হলো তাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন। কাজেই এই পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের সঙ্গে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব নিয়ে অর্থপূর্ণভাবে কাজ করাই হবে বাস্তবিক উদ্যোগ।