Published : 07 Dec 2020, 03:10 AM
সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি-দখল-ক্যাসিনো ব্যবসাসহ বিভিন্ন কালিমা মুছে ইতিবাচক ভাবমূর্তি ও আদর্শে ফিরতে গত বছর ২৩ নভেম্বর জমকালো কংগ্রেসের মধ্যে দিয়ে গঠিত হয় যুবলীগের কেন্দ্রিয় কমিটি। আর কমিটির শীর্ষপদে আসে নতুন মুখ। যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মনির সন্তান শেখ ফজলে শামস পরশ সংগঠনের চেয়ারম্যান হন। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় মাইনুল হোসেন খান নিখিলকে। জাতীয় কংগ্রেসের প্রায় এক বছর পর সম্প্রতি পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে।
২০১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতেও পরিচ্ছন্ন ইমেজের দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের নিয়ে আসা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ অনেক পদে আনা হয়েছে নতুন মুখ। এই কমিটিতে আছেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম, জনসাধারণের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে সোচ্চার আইনজীবী সৈয়দ সাইদুল হক সুমন। আলোচিত সংসদ সদস্য মুজিবর রহমান চৌধুরী নিক্সনও সংগঠনটির সভাপতিমণ্ডলীতে স্থান পেয়েছেন। এছাড়া বেশ কয়েকজন শিক্ষক, চিকিৎসক ও আইনজীবীও যুবলীগের কেন্দ্রিয় কমিটিতে এসেছেন।
যুবলীগের নতুন কমিটিতে যারা স্থান পেয়েছেন, তাদের মধ্যে হাতেগোনা দুয়েকজন ছাড়া প্রায় সবাই যোগ্য ও পরিচ্ছন্ন ইমেজের। বোঝা যায়, অনেক বিচার-বিবেচনা করেই কমিটির সদস্যদের নির্বাচন করা হয়েছে। বাংলাদেশের অবক্ষয়গ্রস্ত রাজনীতিতে এটা অত্যন্ত ইতিবাচক দিক। সৃজনশীল, পরিচ্ছন্ন ইমেজের যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিরা রাজনীতিতে নাম লেখালে উপকার ছাড়া অপকার নেই। দীর্ঘদিনের অভ্যাস, ব্যবস্থা, কাঠামো, মানসিকতা ইত্যাদি নানা কারণে হয়তো সবসময় যোগ্য ও দক্ষ ব্যক্তিরা কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনতে পারেন না। কিন্তু তাদের চেষ্টায় একটা ইতিবাচক ধারা ঠিকই সৃষ্টি হয়। ভালো মানুষের হাত ধরে ভালো কাজও কিছু হয়। ভালোটা পুরোপুরি করতে না পারলেও তারা অন্তত খারাপটা করেন না। এটাও সমাজের জন্য একটা বিরাট প্রাপ্তি।
গত বছর যুবলীগের চেয়ারম্যান পদে যখন একেবারেই আনকোরা শেখ ফজলে শামস পরশকে নির্বাচন করা হয়েছিল, তখনই একটা পরিবর্তনের আভাস মিলেছিল। রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম হলেও পরশ ছিলেন একেবারেই রাজনীতির বাইরের মানুষ। পরশের বাবা শেখ ফজলুল হক মনি ছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতির এক আলোচিত নাম, গত শতকের ষাটের দশকের তুখোড় ছাত্রনেতা, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্নে এবং রাজনৈতিক অনুসারী। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার দিন শেখ মনি এবং তার স্ত্রী আরজু মনিকেও হত্যা করা হয়েছিল। শেখ মনি দম্পতি রেখে গেছেন দুই পুত্র সন্তান শেখ ফজলে শামস পরশ এবং শেখ ফজলে নূর তাপস। রক্তে তাদের রাজনীতি। তাপস ব্যারিস্টার। রাজনীতিতে সক্রিয় কয়েক বছর ধরেই। সংসদ সদস্য হয়েছেন একাধিকবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে। বর্তমানে তিনি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
রাজনীতিতে নামার সব ধরনের সুযোগ সামনে থাকার পরও শেখ পরশ এত বছর রাজনীতির ডামাডোল থেকে দূরে ছিলেন। রাজনৈতিক দলে নাম লিখিয়ে বিত্ত-বৈভব, প্রভাব-প্রতিপত্তি বাড়ানোর উৎকট প্রতিযোগিতা যখন অবাধে চলছে, তখন রাজনীতির প্রতি পরশের নির্লিপ্ততা নিঃসন্দেহে তার নির্লোভ মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। পরশ ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন অধ্যাপনাকে। তার দিন কাটত ক্লাসে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে লেখাপড়া ও গবেষণা নিয়ে কথা বলে, যিনি অবসর সময়ে সঙ্গীত আর বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকতে পছন্দ করতেন, তাকেই দেওয়া হয়েছে যুবলীগের মতো একটা সংগঠনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব! তিনিই বা কেন, কোন বিবেচনা থেকে রাজনীতিতে নাম লিখিয়ে যুবলীগের মতো একটি বিতর্কিত, আলোচিত এবং বড় সংগঠনের 'বোঝা' কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন?
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আগ্রহেই পরশ রাজনীতিতে জড়িয়েছেন। তার সামনে ছিল অনেক কঠিন দায়িত্ব। তার প্রধান দায়িত্ব ছিল এই সংগঠনের শরীর থেকে সব কালিমা মুছে ফেলা। একটা পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তি উপহার দেওয়া। ক্যাসিনোকাণ্ড, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজিসহ নানা অপকর্মে জড়িয়ে যুবলীগ দেশের অনেকের কাছেই একটি মহাআতঙ্ক হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিল। এই সংগঠনের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে তা সফলতা ও দক্ষতার সঙ্গে পালন করা চাট্টিখানি কথা নয়। পরশ পরিচ্ছন্ন ইমেজের একজন শিক্ষাবিদ। কোনও সংগঠনের ছাতা ব্যবহার করার অভিজ্ঞতা তার নেই। তিনি কোনও অরাজনৈতিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলেও শোনা যায় না। সংগঠন পরিচালনায় এমন 'অনভিজ্ঞ' পরশের স্পর্শে যুবলীগকে 'শুদ্ধ' করা, বদনাম ঘোচানো, নিঃসন্দেহে অত্যন্ত কঠিন কাজ।
সেই কঠিন কাজের অঙ্গীকার অবশ্য তিনি যুবলীগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়ার পরই ঘোষণা করেছিলেন। যুবলীগের দায়িত্ব নিয়ে পরশ ঘোষণা করেছিলেন, "আগামীর যুবলীগ হবে একটি মেধাসম্পন্ন রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক ক্ষমতা সম্পন্ন সংগঠন। এখানে থাকবেন শিক্ষিত ও সাধারণ মানুষ। এখানে কোনো অনুপ্রবেশকারী কিংবা কোনো দুস্কৃতিকারীকে ঢুকতে দেওয়া যাবে না।"
তিনি আরও বলেছিলেন, "যুবলীগের কোনো দুর্বলতা নেই, চাওয়া-পাওয়া নেই। যুবলীগে আমরা সার্ভ করার জন্যই এসেছি। অন্য কোনো পারপাস, ব্যক্তিগত লোভ-লালসা নিয়ে আসিনি। আমরা রাজনীতির মূলনীতিতে ফিরে যেতে চাই। যার একটি হচ্ছে মানুষের সেবা করা, অন্যটি হচ্ছে প্রতিবাদ। সেখানে অন্যায় অত্যাচার, নির্যাতন হবে সেখানেই যুবলীগ প্রতিবাদ করবে।"
বর্তমান তরুণ-যুবকরা যে রাজনীতিকে ঘৃণা করে, রাজনীতি থেকে নিজেদের দূরে রাখতে চায়, পরশ সেটা জানেন এবং সেজন্যই তিনি যুবলীগের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেওয়ার পর বলেছিলেন, "যুবসমাজ যেন 'আই হেট পলিটিকস' নীতি থেকে বেরিয়ে এসে 'জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু' বলে কাজ করতে প্রেরণা পায় সেই লক্ষ্যে তিনি কাজ করবেন।" যুবলীগ চেয়ারম্যান হিসেবে পরশের এ বক্তব্য অনেকের মধ্যে আশার সঞ্চার করে।
করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে প্রায় এক বছর পর ঘোষিত যুবলীগের নতুন পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে যোগ্য, দক্ষ ও পরিচ্ছন্ন ইমেজের ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্তি যুবলীগের চেয়ারম্যান হিসেবে পরশের প্রথম সাফল্য হিসেবেই বিবেচনা করা যেতে পারে।
গত কয়েক দশকে আমাদের দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাটাকেই প্রায় নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। রাজনৈতিক সংগঠনের পাশাপাশি ছাত্র, যুব, শ্রমিক ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনগুলোও ধান্দাবাজি ও ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। দলবাজি, ক্ষমতার দাপট, চাঁদাবাজি, দখল, সন্ত্রাসসহ নানা ধরনের অপকর্মের আখড়ায় পরিণত হয়েছে এসব দল ও সংগঠন। ফলে বিভিন্ন দল ও সংগঠনের প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভ ও অশ্রদ্ধা দিন দিন বেড়েছে।
গত কয়েক দশকের অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, কোনো ভালো মানুষ, সৎ মানুষ রাজনীতিতে জড়াতে চান না। জড়ালেও টিকতে পারেন না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষ এখন রাজনীতিতে জড়ায় নগদপ্রাপ্তির আকর্ষণে। কারণ, রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হলে নানা ধরনের অন্যায় সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যায়। বড় বড় প্রকল্পও গৃহীত হয় রাজনৈতিক সহচরদের ফায়দা দেওয়ার উদ্দেশ্যে। এ ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার আকর্ষণেই চারদিকে ক্ষমতাসীন দল এবং তার অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনে নীতিহীন লোকরা ভিড় জমান এবং বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প থেকে অন্যায় সুযোগ-সুবিধা নিয়ে ফুলে-ফেঁপে দুর্বৃত্তে পরিণত হন। ব্যাংক ও শেয়ার মার্কেট লুটের সুযোগ এবং শাসনকাঠামোর অকার্যকারিতা তাদের অনেককে দানবে পরিণত করে। এই বাস্তবতায় নীতি ও আদর্শভিত্তিক রাজনীতিকে ফিরিয়ে আনাটা ছিল সময়ের দাবি। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ণের দুষ্টচক্র থেকে বের না হলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। এ জন্য দরকার প্রতিটি সংগঠনে সৎ, যোগ্য, দক্ষ ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ ও নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা। সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের প্রয়োজন এমন ভালো মানুষ, যারা শুধু মনে মনে ভালো চাইবেন না বরং ভালো কিছুর জন্য লড়াই করবেন। কখনও নিজের মতামত জানাতে পিছপা হবেন না। সততার সঙ্গে নিজের মতামত দেয়ার কারণে কিছু মানুষ যদি তার ওপর বৈরী ভাবাপন্নও হয়, সেটুকু গ্রহণ করার মতো তাদের সৎ সাহস থাকবে। এসব সত্যিকারের ভালো মানুষ যদি রাজনীতিতে আসেন তবেই পরিবর্তন আসবে। কিন্তু আমাদের দেশে কোনো সচেতন অভিভাবকই তার সন্তানকে রাজনীতিবিদ হিসেবে দেখতে চান না। সবাই চান ছেলে-মেয়ে বড় হয়ে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যারিস্টার, বিসিএস ক্যাডার, ব্যবসায়ী কিংবা ক্রিকেটার হবে। কোনোভাবেই রাজনীতিবিদ নয়। তাহলে রাজনীতিটা করবে কে বা কারা?
এই প্রশ্নের সদর্থক উত্তর খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল পরশের যুবলীগের চেয়ারম্যান হওয়ার মধ্য দিয়ে। একা বড় বেশি ভালো কাজ করা যায় না। এ জন্য দরকার হয় টিম। দক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদের একটি টিম যদি সত্যিকার অর্থে ভালো কিছু করার অঙ্গীকার নিয়ে কাজ করে তাহলে কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন সহজ হয়। যুবলীগের নবনির্বাচিত পূর্ণাঙ্গ কমিটি সেখানে আশার আলো দেখাচ্ছে।
একথা ঠিক দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা রাজনীতির দুষ্ট চক্র ভেঙ্গে ফেলা মোটেও সহজ নয়। ধান্দা ও ফায়দাবাজির ঊর্ধ্বে জনকল্যাণে কাজ করা, জনগণের সেবা করা, সমাজ উন্নয়নে সৃজনশীল ভূমিকা রাখার সংস্কৃতি রাতারাতি তৈরি হবে না। তবে এর জন্য ধারাবাহিক চেষ্টা ও আন্তরিক প্রয়াস থাকতে হবে।
যুবলীগ এবার নতুন একটা টিম পেয়েছে। এখানে অনেক দক্ষ, যোগ্য, ভালো মানুষের সমাহার ঘটেছে। এখন সংগঠনের প্রধান হিসেবে যুবলীগকে বদলাতে হলে শেখ পরশকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হবে। সৃজনশীল নতুন পথ খুঁজে নিয়ে এগোতে হবে, সংগঠনের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে 'আগুনের পরশ মণি।' 'ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা' পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালানোর হিম্মত দেখাতে পারলেই না মানুষ তাকে বলবে, 'বাপকা বেটা'।