Published : 08 Nov 2020, 02:23 AM
অনেক সময় অনেক খুন হঠাৎ করে ঘটে যায়। অনিচ্ছাকৃত বা অপরিকল্পিত খুন, অবস্থার প্রেক্ষিতে অথবা অসাবধানতায় ঘটে যায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের হত্যাকাণ্ড এসবের মধ্যে পড়ে না। ১৯৭৫ সালের ১৫ই অগাস্টের হত্যাকাণ্ড ছিল সুপরিকল্পিত এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। একটা নবজাতক দেশের নীতি আদর্শকে পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল খুনিরা, তাদের দেশি এবং বিদেশি প্রভুদের নির্দেশে।
এই হত্যাকাণ্ড ছিল একটা শিশু রাষ্ট্রের নীতি আদর্শকে তথা বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে। এ হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্য ছিল প্রগতিশীল বাংলাদেশকে হত্যা করে প্রতিক্রিয়াশীল বাংলাদেশ গঠনের উদ্দেশ্যে। পাকিস্তানি আদলে একটি দেশ তৈরির উদ্দেশ্যে। যার জন্য সেদিন বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারসহ প্রাণ দিয়েছিলেন প্রায় ২৫/২৬ জন। মোটকথা যারা বেঁচে থাকলে বঙ্গবন্ধুর নীতি আদর্শকে দাবিয়ে রাখা যেত না, তাদের কাউকেই সেদিন ছাড় দেয়নি খুনি-চক্র এবং হত্যা পরিকল্পনাকারীরা।
খুনি-চক্রের যে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে আদালত তাদের কারোর উজ্জ্বল বা মানবিক কোন অতীত নেই। যা থেকে ভাবা যেতে পারে খুনিদের অন্তত একজন পরিস্থিতির চাপে পড়ে বা অবস্থার স্বীকার হয়ে খুনি-চক্রে যোগ দিতে বাধ্য হয়েছিল। এসব খুনিদের কেউ অনিচ্ছায় এ দলে যোগ দেয়নি। বরং স্বতঃস্ফূর্তভাবে সে দলে যোগ দিয়েছিল। তারা জাতীর জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে অবৈধভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা করায়ত্ত করেছিল। খুনিদের মধ্যে পরবর্তীতেও কোন অনুশোচনা লক্ষ্য করা যায়নি। তাদের মধ্যে উগ্রতা দাম্ভিকতা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিদ্যমান ছিল। একজন বাঙালির যে জীবন-যাপন, তা তাদের মধ্যে ছিল না। একজন খুনি রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চেয়ে যে আবেদন করেছিল তাও ইংরেজিতে ছিল।
সাবেক সচিব মুক্তিযোদ্ধা মুসা সাদিক লিখেছেন,
বঙ্গভবনে খুনিদের একদিন পার হলো। ১৬ আগস্ট সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্টের ফটোগ্রাফার আমির খসরুর কাছ থেকে খবর পেয়ে আমি ও কুমার শংকর হাজরা (খুনি মোশতাকের অফিসার) দোতলায় গেলাম খুনিদের মাতলামি করার ঘটনা দেখতে। আমরা দু'জন দোতলায় লিফটের দরজা খুলতেই দেখলাম লিফট থেকে ১০-১২ হাত দূরে বঙ্গবন্ধুর এক খুনি রিসালদার এক হাতে মদের বোতল, আরেক হাতে আগ্নেয়াস্ত্র। রাতে জানলাম আর্মি চীফ জেনারেল শফিউল্লাহ বঙ্গভবনে বন্দি। রাত ১১টার পরে খুনিদের দুটি মাইক্রোবাসে সুন্দরী মহিলারা এসে বঙ্গভবনে নামল। তাদের দোতলায় কিলারদের কক্ষের দিকে নিয়ে যাওয়া হলো। বলা হলো কিলারদের স্ত্রীরা এসেছেন। অনেকে বিশ্বাস করতে পারল না।
এই ঘটনা প্রমাণ করে এরা কতটা ঠাণ্ডা মাথার খুনি ছিল। জাতীর জনককে হত্যার পর তাদের মধ্যে কোন অনুশোচনা তো ছিলই না, বরং তারা মদ-নারী নিয়ে ফূর্তি করেছে। মুসা সাদিক বর্ণনা অনুযায়ী ওই 'সুন্দরী নারী'রা যদি খুনিদের স্ত্রীও হয়ে থাকে, তারাও কীভাবে সেদিন খুনি স্বামীর সাথে বঙ্গভবনে ঘুমাতে পেরেছিল সে প্রশ্নও থেকে যায়। যতদূর জানি ডালিমের স্ত্রী ছিল বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ কন্যা শেখ রেহানার সহপাঠী বান্ধবী। তার শ্বশুর ছিল আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য।
এসব খুনিদের কেউ তৎকালীন সময়ে সমাজ বা পরিবার থেকে বর্জিত হয়েছে তাও জানা নেই। এদের একজনের স্ত্রীও জাতির জনককে হত্যার অপরাধে স্বামীকে পরিত্যাগ করেনি। খুনিদের অনেকেরই বঙ্গবন্ধু পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠতা ছিল। তারা ভেতরের খবর খুব ভালভাবে জানতো। যা তাদেরকে খুনের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তা করেছে। আর তারা এতটাই পেশাদার ছিল যে, বঙ্গবন্ধু পরিবারের ঘনিষ্ঠ থেকেও তাদেরকে গুলি করতে খুনিদের হাত কাঁপেনি। বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র আর খুনি নুর দুজনই জেনারেল ওসমানীর এডিসির দায়িত্ব পালন করেছে। তাদের মধ্যেও যথেষ্ট বন্ধুত্বও ছিল। তাদের সম্পর্ক ছিল 'তুই'-তে, যতদূর জানি।
বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতেও উল্লেখ করেছেন পাকিস্তানে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গুণ্ডাদের লেলিয়ে দিয়েছিল শত্রুবাহিনী। আর ১৯৭০-এর নির্বাচনে জয়ের পর থেকে বঙ্গবন্ধুর জীবনের ঝুঁকি বেড়ে গিয়েছিল কয়েক হাজার গুণ যা তার মৃত্যু পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। "দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে যখন বঙ্গবন্ধু সংবিধান প্রণয়ন করেন তখন জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতা এই চারটি মূলনীতি ছিল। এই চার নীতি নিয়ে বঙ্গবন্ধু অসংখ্যবার বলেছেন, আমরা শুধু একটি ভূখণ্ড বা পতাকার জন্য যুদ্ধ করিনি বরং কতগুলো মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করার জন্য যুদ্ধ করেছি।"
পরাজিত শক্তিসহ তাদের মিত্রদের বঙ্গবন্ধুর কার্যকলাপ পছন্দ হয়নি। পরাজিত ভুট্টো আর তার মিত্র আমেরিকা এবং চীনও বঙ্গবন্ধুকে মেনে নিতে পারেনি। তারা ছক তৈরি করেছে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার। যখন পাকিরা পাকিস্তানে তাকে ফাঁসি দিতে পারেনি তখন থেকে চোরা পথের সাহায্য নিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে জিয়া, ফারুকের ভূমিকা ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। তারা আইএসআই এর সদস্য ছিল। জিয়া কয়েকবার কোর্ট মার্শালের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের হস্তক্ষেপে সে বেঁচে গিয়েছিল। সে সময় প্রধানমন্ত্রী চাননি মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বিধাবিভক্ত করতে। কারণ এমনিতেই মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে দুইটি দল ছিল।
খুনিদের পাকিস্তানি প্রভুরা যখন দেখেছিল যে, মোস্তাক-জিয়া কুলিয়ে উঠতে পারছে না তাদের কর্ম সম্পাদনে, তখন মুক্তিযুদ্ধের ঠিক শেষ পর্যায়ে ফারুককে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করিয়েছিল। কারণ তারা বুঝেছিল দাগী জিয়া তাদের উদ্দেশ্য সম্পাদনে যথেষ্ট না। ফারুক যে যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধার তকমা লাগাতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল সেটা ভারতীয় কূটনীতিক শশাঙ্ক এস ব্যানার্জির 'ভারত, মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও পাকিস্তান' গ্রন্থে পরিষ্কার। সেখানে তিনি আরও উল্লেখ করেছেন, জিয়াউর রহমান মিস্টার ব্যানার্জির সাথে দেখা করে। তার সাথে সাক্ষাতের উদ্দেশ্য ছিল ফারুক রহমানের একটি সুটকেস ও কর্নেল ব্যাটন ফেরত নেয়া। যা ফারুক রহমান ভারত-পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে যুদ্ধ ক্ষেত্রে যাবার আগে মিস্টার ব্যানার্জির কাছে গচ্ছিত রাখে।
মিস্টার ব্যানার্জি কর্নেল জিয়াউর রহমানের অনুমতি চান তাকে একটা বা দুটো অপ্রিয় প্রশ্ন করার। এক প্রশ্নের উত্তরে জিয়া স্বীকার করেছিল যে সে ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসের মিলিটারি অ্যাটাশের সাথে দেখা করেছিল।
এই প্রশ্নের পর মিস্টার ব্যানার্জি লিখেছেন,
তিনি (জিয়া) সাথে সাথেই মিটিং শেষ করে দিতে পারতেন কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি তা করেননি।" মিস্টার ব্যানার্জির গ্রন্থে প্রমাণ পাওয়া যাবে জিয়া ফারুকরা আগে থেকেই সংঘবদ্ধভাবে কাজ করেছে। তা না হলে একজন উচ্চ পদস্থ সেনা কর্মকর্তার তার অধীনস্তের কুলির কাজ করার কথা না।
অ্যান্থনি মাসকারেনহাসের সাথে খুনি রশিদ যা বলে তা এখানে উদ্ধৃত হল। এ কথাবার্তা থেকে বোঝা যাবে খুনিরা কতটা ঠাণ্ডা মাথার, হিংস্র ছিল এবং তাদের উদ্দেশ্যই ছিল বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে হত্যা করা।
অ্যান্থনি মাসকারেনহাস: তোমরা মুজিবকে শোধরানোর জন্য চেষ্টা করেছিলে কিনা?
রশিদ: না, আমি কোনও চেষ্টা করিনি। কারণ আমি ছিলাম সেনাবাহিনীর জুনিয়র কর্মকর্তা। আমার কোনও সুযোগ ছিল না তাকে সঠিক পথে পরিচালিত হওয়ার কথা বলা।
অ্যান্থনি মাসকারেনহাস: এই পরিস্থিতিতে তুমি কি তাঁকে পদত্যাগ করতে বলতে পারতে না? নাকি এটা খুব জরুরি ছিল তাঁকে হত্যা করা?
রশিদ: তিনি ছিলেন সকল কিছুর কেন্দ্রবিন্দু। তিনি শুধু একজন প্রশাসক ছিলেন না। তার চমৎকার ক্ষমতা ছিল জনগণকে নিয়ন্ত্রণে রাখার। তিনি জীবিত থাকলে আমাদের পক্ষে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন হতো। কেননা তিনি ছিলেন অনেক অভিজ্ঞ রাজনীতিক। তিনি যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করতেন না।
অ্যান্থনি মাসকারেনহাস: এই কারণেই কি তোমরা তাঁকে হত্যা কর?
রশিদ: হ্যাঁ, এ কারণেই তাকে হত্যা করি। আমার তাকে মারতেই হত।
দৈনিক যুগান্তরে ১৮ অক্টোবর ২০২০-এ মো. সিদ্দিকুর রহমান লিখেছেন,
"পরিবারের সবাইকে হত্যা করে খুনিরা খুঁজতে থাকে তাকে। খুঁজতে খুঁজতে একসময় পেয়েও যায়। ভয় পেয়ে রাসেল কাঁদতে থাকে আর বলে, 'আমাকে মেরো না, আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে যাও।' শিশু রাসেল তখনও জানত না ঘাতকরা তার পরিবারের উপস্থিত সবাইকে মেরে ফেলেছে। সশস্ত্র ঘাতক তাকে বলে, চল তোর মায়ের কাছে। বলে টানতে টানতে নিয়ে যায় দোতলায়। বাবা-মায়ের রক্তাক্ত নিথর দেহ দেখে চমকে ওঠে আর কাঁদতে থাকে রাসেল। নিষ্ঠুর ঘাতকের দল মায়ের কাছে নিয়ে শিশু রাসেলকে গুলি করে ঝাঁঝরা করে দেয়। তার নিথর শরীর আছড়ে পড়ে মায়ের শরীরে। এমন নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।"
এসব ঘটনা প্রমাণ করে খুনিদের মধ্যে নূন্যতম মানবতাবোধ ছিল না।
অধিকাংশ খুনি আশ্রয় নিয়েছিল লিবিয়াতে। আরেক খুনি স্বৈরাচারী গাদ্দাফির কাছে। তার কাছ থেকে তারা সবরকম পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। এমনকি গাদ্দাফি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনুরোধ করেছিল খুনিদের ফাঁসি না দেবার জন্য।
এসব খুনিদের আচরণে কখনও প্রকাশ পায়নি যে, তারা বাঙালি সংস্কৃতিতে বিশ্বাস করে। তাদের সন্তানদের সম্বন্ধে খুব বেশি কিছু জানা যায়নি, কেমন তাদের জীবন ব্যবস্থা। তবে আমি এদের একজনের সন্তান সম্বন্ধে জানি, নিজের চোখে দেখা। ১৯৯৩ সাল তখন আমি রোমানিয়ার রাজধানী বুখারেস্ট ছিলাম। কিছু কাজে বাংলাদেশ দূতাবাসে যেতে হত মাঝে মাঝেই। সে সময় বঙ্গবন্ধুর খুনিদের একজন আজিজ পাশা বাংলাদেশ দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা ছিল। তার মেয়েকে বুখারেস্টে দেখেছি তার রোমানিয়ান বন্ধুর সাথে ইউরোপিয়ান ধাঁচের জীবনযাপন করতে। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুর খুনিদের তো বটেই, তাদের পারিবারিক জীবনেও বাঙালিয়ানার কোনও ছাপ ছিল না। খুনিরা তো বাঙালি সংস্কৃতিকে ঘৃণাই করেছে। তারা ইংরেজিতে ক্ষমার দরখাস্ত করেছে, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বঙ্গভবনে উর্দুভাষায় খিস্তি দিয়েছে বাঙালি জাতিকে।
এ সম্বন্ধে মুসা সাদিক নিখেছেন,
বঙ্গভবনে খুনিদের ২য় দিন পার হলো ঘন ঘন মিটিং করে এবং হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের থেকে আনা গাড়ি গাড়ি মদের বোতল ও হোটেল পূর্বাণীর রাশি রাশি অন্ন ধ্বংস করে। (খুনিরা আগ্নেয়াস্ত্রের মুখে ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে গাড়ি ভর্তি করে মদ এনে বঙ্গভবনের দোতলায় বোঝাই করে ফেলে। এসব মদের কোন টাকা পরিশোধ করেনি খুনীরা। হোটেল পূর্বাণীর খাবারের কোন টাকা দেয়নি তারা। উক্ত দুই হোটেল থেকে মদ ও খাবার অস্ত্রের মুখে হাইজ্যাক করে আনত তারা।) বঙ্গভবনের দোতলায় অতিথিদের থাকার রুমের সবগুলোতেই খুনিরা থাকতে শুরু করে। সেখানে বঙ্গবন্ধুর খুনিরা ১৮ আগস্ট সোমবার রাতে হঠাৎ কয়েক রাউন্ড ফায়ার করে বসলে সমগ্র বঙ্গভবনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।
প্রেসিডেন্টের পিএস-২ জনাব আব্দুল মান্নান (আমরা উভয়ে পশ্চিমবঙ্গের হিসেবে আমার সঙ্গে তার আস্থাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল এবং আমরা পারস্পরিক বিশ্বাসভাজন ছিলাম) পরদিন সকালে আমাকে বললেন : "কাল রাত ৯টার দিকে দোতলায় খুনিদের মধ্যে মাতলামো শুরু হয়। তারা আকাশে কয়েক রাউন্ড গুলি ছুঁড়ে চিৎকার করে বলতে থাকে, "মীরজাফর শেখ মুজিব শেষ, বাংলাদেশ শেষ। কোন কুত্তাকা বাচ্চা শেখ মুজিবের বাচ্চার নাম লিয়া তো উয়ো বাস্টার্ড কো খতম কর দেংগে। উয়ো বাঙালি বাচ্চাকে হাম খতম কর দেংগে। বাংলাদেশ মর গিয়া। ইসলামী দেশ হো গিয়া ….। কোইয়ি, কাহা, কোন শালা মাদার…হঁযায়, হাম লোগোকে রোখেংগে। মুজিব কা বাচ্চা কোইয়ি, কাহা হঁযায় …।" মদ খেয়ে মাতাল হয়ে অটোমেটিক মেশিন গান হাতে উর্দুতে খিস্তিখেউড় করে বঙ্গবন্ধুকে ও বাঙালী জাতিকে তারা গালাগাল দিচ্ছিল। বঙ্গভবনের সব সিভিল অফিসার ও স্টাফরা ভয়ে দূরে দূরে গিয়ে পিলার আড়াল করে তাদের এসব উর্দু অশ্রাব্য গালাগাল শুনছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় টিক্কা-নিয়াজীরা বঙ্গভবনে বসে বাঙালী জাতির মা-বোন তুলে যেভাবে অশ্রাব্য গালাগাল করত সেভাবেই তারা আমাদের মা-বোনের জাত তুলে পাক সেনাদের কণ্ঠস্বরে গালাগাল করছিল।
বঙ্গবন্ধু তার জীবদ্দশায় বারবার আইনানুগ বিচারের কথা বলেছেন। তার সুযোগ্য কন্যা আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীও একই মনোভাব পোষণ করেন। তিনি এতটাই মানবিক যে কারো শাস্তি তার পরিবারের উপর চাপিয়ে দেন না। মেহেরপুর গাংনী এলাকার কোন এক নেতা নাকি প্রধানমন্ত্রীকে প্রস্তাব করেছিলেন, তিনি বজলুল হুদাকে খতম করে দিতে চান। তখন তিনি বিরোধীদলীয় নেত্রী ছিলেন। তিনি পরিষ্কার গাংনী এলাকার ওই নেতাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যার আইনানুগ বিচার চান। কোনরকম হঠকারিতা তিনি বরদাস্ত করবেন না।
আমার আব্বাকে আমি যেদিন আমাদের প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনার এই মনোভাবের কথা বলেছিলাম, সেদিন তিনি আমাকে জানিয়েছিলেন, "তুমি যত কিছুই বল না কেন বাবা, আমার সুযোগ থাকলে আমি এদের গুলি করতাম, কোন কিছু না ভেবে।" আমার আব্বাকে এমন মতামত প্রকাশ করতে আমি কোনদিন দেখিনি। তিনি সারা জীবন আমাকে কোনরকম গণ্ডগোল মারামারি থেকে দূরে থাকতে উপদেশ/নির্দেশ দিয়েছেন বা অনুরোধ করেছেন। তার সেদিনের মতামত আমাকে আশ্চর্য করেছিল।
সরকার, আওয়ামী লীগ ও ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রীও কখনো খুনিদের পরিবারের প্রতি বৈরী আচরণ করেননি। এর নাম গণতন্ত্র উদারতা ও মহানুভবতা। আমাদের এলাকায় অনেকের কাছেই একটা ভুল তথ্য প্রচলিত আছে যে খুনি বজলুল হুদার বাবা রিয়াজ উদ্দিন বিশ্বাস একজন যুক্তফ্রন্টের মেম্বার অব প্রভেন্সিয়াল অ্যাসেম্বিলি (এমপিএ) ছিলেন। কিন্তু তথ্যটা ঠিক না। তিনি যুক্তফ্রন্টের বিরুদ্ধে নির্বাচন করে এমপিএ হয়েছিলেন। সে সময় তার বিরুদ্ধে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী ছিলেন আলমডাঙ্গা উপজেলা পরিষদের প্রথম চেয়ারম্যান মকবুলার রহমানের বাবা ডা. মকছেদ আলী।
একজন জাসদ নেতা আমাকে বলেছেন, মকবুলার রহমান উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হবার পর একবার হুদা তার বাবার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন। তখন ওই জাসদ নেতাও সাথে ছিলেন। তখন ওই জাসদ নেতা হুদার বাবাকে প্রশ্ন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু হত্যায় হুদার জড়িত থাকার বিষয়ে। তিনি (হুদার বাবা) উত্তরে জানিয়েছিলেন, "মুজিবকে হত্যার পর হুদা একবারই আমার সামনে এসেছিল। আমি তাকে প্রশ্ন করেছিলাম তুমি নাকি মুজিবকে হত্যা করেছ? উত্তরে সে বলে, না। এরপর ভ্যাগাবন্ডটা আর কোনদিন আমার সামনে আসেনি।"
এসব কারণে হয়ত আমাদের প্রধানমন্ত্রী উদারতা দেখান। যাতে খুনিদের পরিবার হেনস্তার স্বীকার না হয়। সবথেকে জরুরি এসব খুনিদের কোনভাবেই কয়েকজনের ফাঁসি হয়ে গিয়েছে বলে আমরা ঢিল দিতে পারি না। খুনিরা বিভিন্ন সময়ে চক্রান্ত করেছে, করছে এবং ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত রাখবে। তারা শেখ ফজলে নুর তাপসের উপর হামলা চালিয়েছিল। এরকম আরও অনেক চক্রান্তের জন্য জাতিকে সরকারকে প্রস্তুত থাকতে হবে। অনেক ফ্রিডম পার্টির সদস্য এখন আওয়ামী লীগে ঢুকে গেছে।
হুদার বাবাকে দিয়ে হুদার ভাইকে বিচার করা যাবে না। হুদার ভাইয়ের তৎপরতা আগাগোড়াই বিপদজনক এবং সন্দেহজনক। ফাঁসির পর হুদার কবরটাকে এখন তারা মাজারে রূপান্তর করেছে। স্মৃতিফলকে যেসব কথা লিখেছে সেগুলো উস্কানিমূলক। সরকারের সেদিকে নজর দেওয়া উচিৎ। আলমডাঙ্গা থানার একজন শান্তি-কমিটির নেতার ছেলে ফ্রিডম পার্টি করতো, তার কী দাপট তখন! এই লোক এখন আওয়ামী সাংস্কৃতিক গোষ্ঠির নেতা। সরকার এগুলো না দেখলে ভবিষ্যতে অঘটনের আশঙ্কা আছে।