Published : 01 Feb 2012, 01:05 PM
ব্রিটিশ শাসনামলে জন্ম তার এক সময় বাংলার 'চিতোর' বলে খ্যাত মাদারীপুরে, ১৯০১ সালে। ভারত বিখ্যাত এবং ১৯১৬ সালে লখনউয়ে অনুষ্ঠিত ৩১তম অধিবেশনে নির্বাচিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি অম্বিকাচরণ মজুমদারের ভাতুষ্প্রুত্র সতীশ চন্দ্র মজুমদারের পুত্র তিনি, উত্তরাধিকার সূত্রে জমিদার পরিবারের সন্তান। প্রমত্ত আড়িয়াল খাঁ নদের তীরবর্তী জন্মস্থান সেনদিয়া গ্রাম ও তৎকালীন মহকুমা শহর মাদারীপুরে শৈশব ও কৈশোর কেটেছে তার।
অগ্নিযুগের বিপ্লবী ফণীভূষণ মজুদমদার পারিবারিকভাবেই রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বেড়ে উঠেছিলেন। দেশাত্মবোধ ও জনসেবামূলক কাজে ভরপুর ছিল ত্রিকালদর্শী এ অকুতোভয় বিপ্লবীর জীবন। মাদারীপুর উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক, বাঁকুড়া কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আইএসসি এবং কলকাতা বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে কৃতিত্বের সাথে বিএ পাস করেন। তিনি কলকাতা রিপন কলেজে আইন বিষয় অধ্যয়ন করেন। তাছাড়া, কিছুদিনের জন্য তিনি রাজশাহী কলেজে বিএ ক্লাসে পড়াশোনা করেছিলেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন। ১৯১৯ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে মাদারীপুরের আরেক বিখ্যাত বিপ্লবী পূর্ণ চন্দ্র দাসের শিষ্য হিসেবে গুপ্ত সমিতিতে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে ফণীভূষণ মজুমদারের রাজনীতিতে হাতেখড়ি। সেই যে ঘর ছেড়েছিলেন, আর ঘরে ফেরা হয়নি তার, বাঁধা হয়নি ঘর-সংসার, অকৃতদার থেকেছেন আজীবন। ১৯৮১ সালের ৩১ অক্টোবর আমৃত্যু রাজনীতি, দেশ ও জনগণের সেবায় নিমগ্ন ছিলেন তিনি।
একদিকে বিপ্লবী পার্টি ও গুপ্ত সমিতি'র সদস্য, অন্যদিকে ১৯২৫ সালে মাদারীপুর শান্তি সেনাবাহিনীর সক্রিয় কর্মী হিসেবে যোগ দেন ফণীভূষণ মজুমদার। ইংরেজ শাসকদের চোখে ধুলো দিতে মূলত এটি ছিল সে সময়ে অন্যান্য বিপ্লবীর মত তার রাজনৈতিক কৌশল। তবুও রক্ষা হয়নি, ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের দিন কলকাতায় প্রথম যে ২৩ জন বিপ্লবী গ্রেপ্তার হন, তিনি ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। একটানা ৮ বছর জেল খেটে তিনি ১৯৩৮ সালে কারামুক্তিলাভ করে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর নিবিড় সান্নিধ্যে আসেন। সে সময়ে জন্মভূমিতে ফিরে তিনি মাদারীপুর স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গঠন করেন। অন্যদিকে, নেতাজীর ডাকে সাড়া দিয়ে কলকাতায় তিনি নেতাজী প্রতিষ্ঠিত 'বেঙ্গল ফরওয়ার্ড ব্লক' পত্রিকা ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেন।
১৯৩৯ সালে ত্রিপুরায় অনুষ্ঠিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ৫১তম অধিবেশনে ফণীভূষণ মজুমদারের অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতায় বাংলার বিপ্লবীদের সমন্বয় ঘটে এবং তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে গান্ধীজী মনোনীত পট্টভিসি তারামিয়ার বিরুদ্ধে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু বিপুল ভোটাধিক্যে কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন। গান্ধীজীর সাথে মতান্তরের কারণে কংগ্রেস সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করে নেতাজী 'ফরওয়ার্ড ব্লক' নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের সময় ফণীভূষণ মজুমদার নেতাজীর দক্ষিণ হস্ত হিসেবে কাজ করেন। ১৯৪০ সালে নেতাজীর সাথে কলকাতায় হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণ আন্দোলনে অংশ নিয়ে তিনি পুনরায় গ্রেপ্তার হন এবং এক বছর পর দুই জনেই জেল থেকে ছাড়া পান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪১ সালে বৃটিশ আইবি পুলিশের কড়া পাহারাকে ফাঁকি দিয়ে দেশত্যাগের এক সপ্তাহ পূর্বে ফণীভূষণ মজুমদারকে নেতাজী ডেকে পাঠান। নেতাজী তার দেশত্যাগের সিদ্ধান্তের কথা জানান এবং নেতাজীর অনুপস্থিতিতে প্রিয় ও বিশ্বস্ত সহকর্মীকে করণীয় বুঝিয়ে দেন।
নেতাজী এবং তার পরিবারের সাথে তিনি কতটা ঘনিষ্ঠ ছিলেন তা বোঝা যায় ১৯৭২ সালের ১৭ জানুয়ারি সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে নেতাজীর ভাতুষ্পুত্র শিশির কুমার বোস ঢাকা সফরে এসে ফণীভূষণ মজুমদারের বাসায় ওঠেন এবং তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করতে উদগ্রীব ছিলেন বিধায় তাৎক্ষণিকভাবে অতিথিকে সাথে নিয়ে ফণীভূষণ মজুমদার বঙ্গবন্ধুর বাসায় গিয়ে হাজির হন।
বঙ্গবন্ধুও অতিথিকে যথাযোগ্যভাবে স্বাগতম জানিয়ে দীর্ঘসময় বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেন।
যাহোক, ১৯৪১ সালে নেতাজীর দেশত্যাগের পর পুলিশ ফণীভূষণ মজুমদারকে গ্রেপ্তার করে প্রথমে কলকাতা জেলে ও পরে মাদারীপুরে গৃহবন্দি করে রাখে। একটানা ৫ বছর অন্তরীণ থাকার পর তিনি ১৯৪৬ সালে মুক্তি পান।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ভারতবর্ষে স্বাধীনতা সংগ্রামের ডামাডোল বেজে ওঠে। তাতে ফণীভূষণ মজুমদার সামনের কাতারে নেতৃত্ব দেন বটে, কিন্তু ধর্মীয় পরিচয়ে দ্বি-জাতি তত্ত্ব-র ভিত্তিতে বিভাজিত ভারতের স্বাধীনতায় তিনি রাজি ছিলেন না। দ্বি-জাতি তত্ত্বের উগ্র ধ্বজাধারীদের প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৪৬-এর গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং এবং নোয়াখালী রায়ট সংঘটিত হলে তিনি অনেকটাই মুষড়ে পড়েন, তবে দমে না গিয়ে সাম্প্রদায়িক তাণ্ডবে ভূতুড়ে নগরীতে পরিণত হওয়া কলকাতা শহরের নীরবতা ভাঙা, ক্ষতিগ্রস্তদেরকে সেবা-শুশ্রুষা করা এবং সেখানে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
হাজার বছরের ভিটে-মাটি থেকে উৎখাত, সম্ভ্রম ও লাখ লাখ মানুষের মৃতদেহের উপর দিয়ে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে বৃটিশদের নিকট থেকে বিভাজিত ভারতের স্বাধীনতা পাওয়া গেল। আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, রাজনৈতিক সহকর্মী প্রমুখ প্রায় সকলে পাকিস্তান ত্যাগ করে ভারত চলে যাচ্ছেন। সে সময়ে সহকর্মীরা ফণী ভূষণ মজুমদারকেও তাদের সঙ্গী হতে উৎসাহিত করলে তিনি দৃঢ়ভাবে তা প্রত্যাখান করেন। মাতৃভূমি ত্যাগ না করে এখানে থেকেই তিনি নতুনভাবে রাজনীতি এবং জনসেবা করার দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবন্ধ হন। তিনি বললেন- "পাকিস্তান সরকার আমার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিতে পারে, আমার মৃতদেহ পদ্মায় ভাসিয়ে দিতে পারে, কিন্তু আমার জন্মভূমির মাটিকে তো আর ভাসিয়ে দিতে পারবে না"।
কাজেই জন্মভূমিতে থেকেই রাজনীতির পাশাপাশি ফণীভূষণ মজুমদার পুরোদস্তুর সমাজসেবা ও জনসেবার কাজ করে চালিয়ে যান। ১৯৪৮ সালে তিনি মাদারীপুর মহকুমা তাঁতী সমবায় সমিতি এবং কিছুদিনের মধ্যে মৃতপ্রায় কংস বণিক সমিতি পুনর্গঠন করেন। রাজতৈনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে গিয়ে সঙ্গত কারণে তিনি ভাষা আন্দোলনের সূচনাপর্বে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। এ জন্য তাকে গ্রেপ্তার করে পাকিস্তান সরকার ১৯৪৮ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত কারারুদ্ধ করে রাখে।
ফণীভূষণ মজুমদারের প্রতিজ্ঞাবদ্ধ এসব কর্মকাণ্ড এবং কারারুদ্ধের কিছুটা বর্ণনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের 'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' গ্রন্থের ১৮৭-১৮৮ পৃষ্ঠায় ফুটে উঠেছে। বঙ্গবন্ধু তার ডায়েরিতে ফরিদপুর জেলে থাকার বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন- "দুই দিন পরে খবর এল, আমাকে ফরিদপুর জেলে নিয়ে যেতে। আমি ফরিদপুর জেলে ফিরে এলাম। এবার আমাকে রাখা হল রাজবন্দিদের ওয়ার্ডে। এই ওয়ার্ডে দুইটা কামরা; এক কামরায় পাঁচজন ছিল। আরেক কামরায় গোপালগঞ্জের বাবু চন্দ্র ঘোষ, মাদারীপুরের বাবু ফণী মজুমদার ও আমি। এই দুইজনকে আমি পূর্ব থেকেই জানতাম। ফণী মজুমদার পূর্বে ফরোয়ার্ড ব্লকের নেতা ছিলেন। ইংরেজ আমলে আট-নয় বৎসর জেল খেটেছেন। দেশ স্বাধীন হবার পরেও রেহাই পান নাই। বিবাহ করেন নাই। তাঁর বাবা আছেন পাকিস্তানে, পেনশন পান। ফণী বাবু দেশ ছাড়তে রাজি হন নাই বলে তিনিও দেশ ছাড়েন নাই। হিন্দু-মুসলমান জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে তাঁকে ভালবাসত। কেউ কোন বিপদে পড়লে ফণী মজুমদার হাজির হতেন। কারো বাড়িতে কেউ অসুস্থ হলে ফণী মজুমদারকে পাওয়া যেত। আমাকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন"।
'অসমাপ্ত আত্মজীবনী' পড়ে বোঝা যায় বঙ্গবন্ধু ১৯৪৯ বা ১৯৫০ সালের কোনো একদিন এই বর্ণনা তার ডায়েরিতে লিখেছেন। জীবদ্দশায় ফণী ভূষণ মজুমদারও বলেছেন বঙ্গবন্ধু এবং তিনি ফরিদপুর জেলের একই কক্ষে দুই বছর রাজবন্দি হিসেবে কারাবাস করেন। এ সময়ে এই দুই মহান দেশপ্রেমিক বাঙালি নব্য পাকিস্তানি উপনিবেশ থেকে দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা এবং কর্মসূচি প্রণয়ন করেন। যার ফলে ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্মলগ্ন থেকে ফণী ভূষণ মজুমদার এ দলের নেতাকর্মীদের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে মাদারীপুর-গোপালগঞ্জ নির্বাচনী এলাকা থেকে ফণীভূষণ মজুমদার পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হলে তিনি গ্রেপ্তার হন এবং ১৯৬২ পর্যন্ত অন্তরীণ থাকেন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে তাকে পুনরায় গ্রেপ্তার করা হয় এবং ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মুক্তি পান। পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে বিস্তারিত আলোচনা শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ফণীভূষণ মজুমদারকে তৎকালীন ফরিদপুর-১৯ আসন (রাজৈর) থেকে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়। তাতে তিনি বিপুল ভোটে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ৭০-এর নির্বাচনে বাঙালিদের নিরঙ্কুশ বিজয় হলেও পাকিস্তানিরা ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করে। তাতে বঙ্গবন্ধু প্রথমে অসহযোগ আন্দোলন এবং পরবর্তীতে স্বাধীনতার ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধের ডাক দিলে ফণীভূষণ মজুমদার বাংলাদেশ ও ভারতে অবস্থানরত তার বিপ্লবী সহকর্মীদেরকে মুক্তিযুদ্ধের জন্য সংগঠিত করেন। তিনি অন্যান্য সহকর্মীদেরকে সাথে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে গমন করেন। তার উদ্যোগে আওয়ামী লীগের কয়েকজন শীর্ষ নেতার সাথে আলাপ-আলোচনা করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সর্বাত্মক সহায়তাদানের বিষয়ে তড়িৎ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
মুক্তিযোদ্ধাদেরকে ভারত কর্তৃক সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করায় তিনি সর্বাধিক ভূমিকা পালন এবং ভারত সরকারের দেওয়া প্রথম অস্ত্র চালানটি তার মাধ্যমে হস্তান্তর করা হয়। তিনি মুজিবনগরে স্থাপিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের উপদেষ্টা কমিটির অন্যতম সদস্য, মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা কমিটির সদস্য, দক্ষিণ-পশ্চিম আঞ্চলিক কাউন্সিলের (যশোর-ফরিদপুর) চেয়ারম্যান এবং ওই সময়ে ভারতে আশ্রিত ১১টি শরণার্থী শিবির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের দুই যুগ পর ফণীভূষণ মজুমদার ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তার জন্য ভারতে গমন করেন। কিন্তু এই দুই যুগ পরেও ভারতীয়দের মধ্যে তার পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা বিন্দুমাত্র ঘাটতি দেখা যায়নি। মূলত নেতাজীর ঘনিষ্ঠ ও বিশ্বস্ত সহকর্মী এবং ফরোয়ার্ড ব্লকের নেতা হিসেবে ভারতবিভক্তির পরেও সেখানে ছিল তার বিপুল জনপ্রিয়তা, যা মোক্ষম কাজে লাগিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন আমাদের মুজিব নগর সরকার। সে সময় তিনি মুজিব নগর সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য না হলেও মন্ত্রীর পদমর্যাদায় তাকে এমনসব কর্মকাণ্ডে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, যেসব অন্য কারোর পক্ষে করা ততটা সহজ ছিল না, যতটা সহজ ও ফলপ্রসূভাবে ফণীভূষণ মজুমদারের পক্ষে করা সম্ভব ছিল।
উদাহরণস্বরূপ, ভারতীয় পার্লামেন্টের লোকসভা ও রাজ্যসভার সদস্যদের যুক্ত অধিবেশনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ভাষণদানের জন্য ফণীভূষন মজুমদারকেই দায়িত্ব দেওয়া হয়। কারণ, তৎকালীন ভারতীয় মন্ত্রিপরিষদ এবং শীর্ষস্থানীয় সংসদ সদস্যদের অধিকাংশের সাথে ছিল তার সখ্যতা ও ঘনিষ্ঠতা। তাদের অনেকের সাথে তিনি ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত একসাথে রাজনীতি করেছেন, কেউ কেউ ছিলেন তার কর্মীস্থানীয়।
ভারতীয় নেতাদের মধ্যে তার কতটা প্রভাব ও জনপ্রিয়তা ছিল তার একটি উদাহরণ এখানে তুলে ধরা যেতে পারে এভাবে- তৎকালীন ভারতের অন্যতম সংসদ সদস্য দ্বিজেন্দ্রলাল সেনগুপ্ত উপরোল্লিখিত তাদের যুক্ত অধিবেশনের পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে দিল্লীতে সকলের কাছে ফণীভূষণ মজুমদারকে তাদের নেতা হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এবং পার্লামেন্টের অভ্যন্তরে যুক্ত অধিবেশনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সর্বাত্মক সহায়তাদানের সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য সেখানে তোলপাড় করেছিলেন।
এ কারণে ভারতীয় সংসদের সেই যুক্ত অধিবেশনে ফণীভূষণ মজুমদারের জ্বালাময়ী ভাষণে মুহুর্মুহু করতালি এবং 'জয় বাংলা' স্লোগানে সেদিন প্রকম্পিত হয়ে ওঠে ভারতীয় পার্লামেন্ট হাউজ। তার সেই তেজোদ্দীপ্ত ও মর্মস্পর্শী ভাষণের ফলে সেদিন ভারতের সকল দলের সংসদ সদস্যদের সর্বসম্মতিক্রমে ভারতীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সর্বাত্মক সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ফলে বেগবান হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ত্বরান্বিত হয় আমাদের স্বাধীনতা।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিজয়ের পরপরই ফণীভূষণ মজুমদার সরাসরি ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বদেশ প্রত্যাবর্তন এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রিসভা গঠন করেন। তিনি ফণীভূষণ মজুমদারকে খাদ্য এবং বেসামরিক পরিববহন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করেন। দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন ফণীভূষণ মজুমদার। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের প্রথম নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ফরিদপুর-১৯ (রাজৈর) আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে প্রথমে বঙ্গবন্ধু-মন্ত্রীসভার খাদ্য ও বেসামরিক পরিববহন মন্ত্রণালয় এবং পরে ভূমি প্রশাসন ও ভূমি সংস্কার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বলাভ করেন। এ সময় তিনি অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান প্রভৃতি দেশ ভ্রমণপূর্বক যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের জন্য খাদ্রসামগ্রী সংগ্রহার্থে বিভিন্ন দেশের সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ১৯৭৪ সালে ষড়যন্ত্রমূলক ও কৃত্রিমভাবে সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় সততা ও নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালনে তিনি দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করেন।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে জাতীয় দল হিসেবে বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠিত হয়। ফণীভূষণ মজুমদারকে বঙ্গবন্ধু বাকশালের কৃষক ফ্রন্টের সেক্রেটারি এবং পুনর্গঠিত মন্ত্রীসভার ভূমি প্রশাসন, ভূমি সংস্কার, স্বায়ত্ত্বশাসন, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিযুক্ত করেন। বাঙালি জাতির সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট স্বাধীনতাবিরোধী দেশি-বিদেশি শক্তির লেলিয়ে দেওয়া নরপিশাচ হায়েনার দল সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে। প্রায় ৭৫ বছর বয়সী ফণীভূষণ মজুমদার তখন গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় পিজি হাসপাতালে (বর্তমান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল) চিকিৎসাধীন ছিলেন।
ফলে রাতের আঁধারে খুনিদের কর্তৃক সংঘটিত নারকীয় হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে তার পক্ষে কিছুই জানা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। কারণ সে সময় হাসপতাল কেবিনে রেডিও বা টেলিভিশন রাখার কোনও ব্যবস্থা ছিল না। দিনের বেলা কালো পোষাক পরিহিত অস্ত্রধারী একদল দস্যু হাসপাতালের কেবিনে ঢুকে অশ্রাব্য ভাষায় ফণীভূষণ মজুমদারকে গালাগাল করতে-করতে টেনে-হিঁচড়ে রুম থেকে বের করে নিয়ে যেতে থাকে। তা দেখে পুরো হাসপতাল জুড়ে কান্নাকাটি ও হইচই এর রোল পড়ে যায়। পাশের দুইটি কেবিনে পল্লীকবি জসিম উদ্দীন এবং বৌদ্ধ ধর্মগুরু সংঘরাজ জ্যোতিঃপাল মহাথের চিকিৎসাধীন ছিলেন। তারাও চেষ্টা করে সর্বজন শ্রদ্ধেয় বিপ্লবী এই রাজনীতিবিদকে টানাহেঁচড়া না করা থেকে নরপিশাচদেরকে নিবৃত করতে ব্যর্থ হন।
দস্যুরা প্রথমে তাকে রেডিও স্টেশনে এবং পরে বঙ্গভবনে নিয়ে যায়। সেনাপরিবেষ্টিত থমথমে বঙ্গভবনের দরবার হলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় আরও অনেকের সাথে বন্দুকের মুখে জোরপূর্বক ফণীভূষণ মজুমদারকে কলঙ্কজনকভাবে সেদিন মন্ত্রী হিসেবে শপথবাক্য পড়তে বাধ্য করা হয়। ঘৃণিত সেই শপথ অনুষ্ঠান সম্পর্কে সেদিন চাকরিসূত্রে বঙ্গভবনে অবস্থানরত বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত সচিব মোহাম্মদ মুসা ওরফে মুসা সাদিক তার বহু সাক্ষাৎকার ও একাধিক লেখায় এভাবে বর্ণনা করেছেন- "শপথের আগে দেখলাম তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রী ফণীভূষণ মজুমদারকে শাসাচ্ছেন ওই উচ্চ পদস্থ ব্যক্তি। ফণীবাবু বঙ্গবন্ধুকে খুনের বিষয়ে কথা বলায় ওই কর্মকর্তা তাকে সেনাদের হাতে প্রাণ যাওয়ার ভয়ও দেখান"।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড পরবর্তী ৮১ দিন মন্ত্রী থাকা অবস্থায়ও ফণীভূষণ মজুমদারকে খুনিচক্র সার্বক্ষণিক কড়া নজরে রাখে। তবু তিনি মুষড়ে পড়া আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদেরকে সংগঠিত করতে থাকেন। তার সরকারি বাসভনে এসব নেতা-কর্মীদেরকে তিনি নানান কৌশলে মিলিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। ১৯৭৫-এর ৩ নভেম্বর প্রতিক্রিয়াশীল ও খুনিচক্র কর্তৃক জেলখানায় জাতীয় চার নেতার বর্বর হত্যাকাণ্ড, ৭ নভেম্বর সেনাবাহিনীর মুক্তিযুদ্ধ স্বপক্ষীয় বীর সেনানীদেরকে হত্যা ও নানা প্রকার ষড়যন্ত্রমূলক ঘটনার মধ্য দিয়ে হলেও, কলঙ্কজনক ওই মন্ত্রিত্বের পরিসমাপ্তি ঘটে। ফণীভূষণ মজুমদারের উপর সামরিক স্বৈরাচারের নজরদারি, নানা প্রকার হুমকি-ধামকি এবং হয়রানি বেড়ে যায়। তিনি এসব উপেক্ষা করে এবং গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের সন্ত্রস্ত, আত্মগোপনে চলে যাওয়া ও বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদকারী নেতা-কর্মীদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেন।
এভাবেই মুজিব-বলয়ের নেতা-কর্মীরা দুর্দিনে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আশ্রয়স্থল হিসেবে তার ছত্রছায়ায় সংগঠিত হতে থাকেন। ফলে ১৯৭৭ সালে সামরিক-স্বৈরাচার তাকে বিনা অজুহাতে গ্রেপ্তার করে। এক বছরের বেশি সময় পর হাইকোর্টের আদেশবলে ১৯৭৮ সালে তিনি মুক্তি পান। ওই বছর কাউন্সিল অধিবেশনে তিনি আওয়ামী লীগের অন্যতম সহ-সভাপতি এবং জাতীয় শ্রমিক লীগের উপদেষ্টার পদে নিযুক্ত হন। ১৯৭৯ সালে নানা প্রকার ষড়যন্ত্র ও প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে তিনি ফরিদপুর-১১ (কোটালীপাড়া-রাজৈর) আসন থেকে বিপুল ভোটাধিক্যে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৮০ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে উক্ত সংগঠনের প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত হন। পরবর্তী বছর, অর্থাৎ ১৯৮১ সালের যে-কাউন্সিল অধিবেশনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে তার অবর্তমানে সর্বসম্মতিক্রমে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়, সেসময়ও ফণীভূষণ মজুমদারকে অন্যতম প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত করা হয় এবং ওই বছর ৩১ অক্টোবর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি এ পদেই বহাল ছিলেন।
ব্রিটিশ-ভারত, পাকিস্তান এবং স্বাধীন বাংলাদেশে নানা পর্যায়ে নানা প্রকার ঝুঁকি নিয়ে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত রাজনৈতিক ভুবনে দৃঢ় পদচারণা করেছেন বিপ্লবী কর্মবীর ফণীভূষণ মজুমদার। প্রায় ৩০ বছর তিনি জেল খেটেছেন। জানামতে বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের আর কোনো রাজনৈতিক নেতা এত বছর জেল খাটেননি। জন্মগতভাবে রাজনৈতিক উত্তরাধিকারসূত্রে গোটা ভারতীয় উপ-মহাদেশে পরিচিত এক বিখ্যাত এবং জমিদার পরিবারের সন্তান হয়েও তার মধ্যে কখনও কোনও কিছুতেই বাহুল্য বা বিন্দুমাত্র অহমবোধ দেখা যায়নি। বরঞ্চ চলন-বলন, পোশাক-পরিচ্ছদ ও আচার-ব্যবহারে তিনি ছিলেন একেবারেই সাধারণ এবং অত্যন্ত পরিমার্জিত। আর রীতি-নীতি, সময়ানুবর্তিতা, নিয়মানুবর্তিতা, সততা, কর্মনিষ্ঠা, কর্তব্যপরায়ণতা, স্বমত ও ভিন্নমতের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের প্রতি সহমর্মিতা, কর্মীবাৎসল্য, সাধারণ ও খেটে খাওয়া জাতি-ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল মানুষের প্রতি ভালবাসা ও সম্মানবোধ সবকিছুতেই তিনি ছিলেন অনন্যসাধারণ ও সকলের অনুকরণীয়।
নিরহঙ্কারী, নির্লোভী ও নির্মোহ বিপ্লবী ফণীভূষণ মজুমদারের ৪০তম মহাপ্রয়াণ দিবসে তার প্রতি প্রণতি ও বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।