Published : 04 Oct 2020, 02:31 PM
কোভিড সংকটের বহুমুখিতা শুধু মানুষের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নয়, বিশ্ব অর্থনীতির স্বাস্থ্যকেও ক্রমাগত রুগ্ন করেই যাচ্ছে। ব্যবসা-বাণিজ্য আর কর্মসংস্থানের ভয়াবহ সংকোচনে হাঁপিয়ে উঠেছে বিশ্ব অর্থনীতি। অবাধ যাতায়াত বিশেষ করে বিমান ভ্রমণ বৈশ্বিক অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কোভিড সংকটে ধসে গেছে বেসামরিক বিমান চলাচল, চরম আর্থিক সংকটে বিভিন্ন দেশের এয়ারলাইন্সগুলো। বিমান ভ্রমণকে বলা হয় ব্যবসা বাণিজ্যের লাইফ লাইন।
গত দুই দশকের আমার পেশাগত কর্মব্যস্ততায় বিমান ভ্রমণবিহীন মাস ছিল দুর্লভ। বছরে লক্ষ মাইল ফ্লাই করার জীবনযাত্রায় বিমান, বিমানবন্দর, লাউঞ্জ, ইমিগ্রেশনের কোলাহলমুখর পরিবেশ জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যায়। ভ্রমণ নির্ভর বিশেষ করে বহুজাতিক কর্পোরেট কালচারে অভ্যস্ত পেশাজীবীদের কাছে ভ্রমণ করা না করার বিষয়টি পেশার মেলোডি বিশেষ করে মানসিক স্বাস্থ্যের উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। করোনাভাইরাসের থাবায় ভ্রমণে অভ্যস্ত পেশাজীবীদের মাসের পর মাস পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে চলতে হচ্ছে। উড়তে অভ্যস্ত কর্পোরেট কালচারের বিশাল কর্মী বাহিনী একটি মাস নয়, মূলত সাতটি মাস ধরে গ্রাউন্ডেড হয়ে আছে। আমার নিজের ক্ষেত্রে গত ২৯ ফেব্রুয়ারি দিল্লি থেকে টরেন্টো হয়ে মন্ট্রিয়ল পর্যন্ত দীর্ঘ ফ্লাইটের পর আর বিমানবন্দরমুখো হতে হয়নি। অফিস, সহকর্মী, মুখোমুখি মিটিং ছেড়ে বাসা থেকে অফিস, ওয়েবিনার, জুম, এমএসটিম, স্কাইপে বিজনেস, ভিপিএন লিঙ্কে সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে জীবন আর জীবিকার পথ চলা।
এপ্রিল, মে, জুনের কঠিন কোভিড পরিস্থিতির পর এয়ারলাইন্সগুলো বিভিন রাষ্ট্রের নিয়মকানুন মেনে সীমিত আকারে আবার চলতে শুরু করেছে। কানাডার বিভিন্ন শহর থেকে জাপানের বিভিন্ন এয়ারপোর্টে এয়ার কানাডার নিয়মিত অনেকগুলো ফ্লাইট ছিল। কোভিডকালে এয়ার কানাডা জুন থেকে সপ্তাহে মাত্র ৪-৫ টি চালু রেখেছে ভ্যাংকুবার থেকে নারিতা পর্যন্ত। কোভিডের কারণে ইউরোপ, জাপান আর দক্ষিণ এশিয়ায় আমার অনেকগুলো ট্রিপ বাতিল হয়ে যায়। তবে অগাস্ট-সেপ্টেম্বরে জাপান ভ্রমণ বিশেষ কারণে জরুরি ছিল। জাপান বিশ্বের শতাধিক দেশের নাগরিকদের জাপান ভ্রমণ নিষিদ্ধ করে, কানাডা আর বাংলাদেশ তার অন্তর্ভুক্ত। অগাস্টের ৩১ তারিখ পর্যন্ত শুধু জাপানের নাগরিক আর বাসিন্দাদের জাপান প্রবেশের অনুমোদন ছিল। জরুরি প্রয়োজনের কারণে আর জাপানের স্থায়ী বাসিন্দা হবার সুবাদে কোভিড পরিস্থিতির মধ্যে জাপান যাবার সিদ্ধান্ত নেই। পেশাগত ব্যস্ততার কারণে সেপ্টেম্বরের আগে সুযোগ হয়ে উঠেনি। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে যখন সুযোগ হলো, দেখা গেল জাপান সরকার জাপানে প্রবেশের নিয়ম আবার পরিবর্তন করেছে ১ সেপ্টেম্বর থেকে। নতুন নিয়মে শর্তসাপেক্ষে বিদেশীদের প্রবেশ সহজ করেছে। বিদেশীরা জাপানি দূতাবাসে যোগাযোগ করে ভ্রমণ জরুরি কিনা সেই সংক্রান্ত অনুমোদনপত্র আর বিমানে ওঠার আগের ৭২ ঘণ্টার মধ্যে কোভিড নেগেটিভ টেস্ট ফলাফল সাপেক্ষে যাত্রা করতে পারবে। এই নিয়ম জাপানি বাসিন্দাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়। নতুন নিয়মে কোভিডকালে মন্ট্রিয়ল থেকে ভ্যাংকুবার হয়ে নারিতা যাবার ঝুট-ঝামেলাপূর্ণ আয়োজনটি ছিল উড্ডয়নের নিউ নর্মালের আবরণে অ্যাবনর্মাল সব অভিজ্ঞতা নিয়ে। মন্ট্রিয়ল এয়ারপোর্ট, ভ্যাংকুবার এয়ারপোর্ট, নারিতা এয়ারপোর্ট, বোর্ডিং, বিমানের ভেতর, খাবার-দাবার সবকিছুতেই ছিল কোভিড সৃষ্ট জটিলতা, বিচ্ছিন্নতা, একরকম বিষণ্ণ সময়ের অনুভূতি। আমাদের জেনারেশনে এই কোভিড সময় সিনেমার পর্দা ছেড়ে বাস্তবতায় নজিরবিহীন এক অভিজ্ঞতার নাম। স্বাভাবিক সময়ে বিমান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে আমার বেশ কিছু কলাম/লেখা রয়েছে। কোভিডকালের বিমান ভ্রমণ অর্থাৎ কোভিড ফ্লাইটের অভিজ্ঞতাটুকু উড্ডয়ন অভিজ্ঞতায় ভিন্ন মাত্রা তো বটেই।
জাপানি রেসিডেন্ট হবার সুবাধে অগাস্ট পর্যন্ত জাপান যাত্রা ছিল অনেকটাই সহজ। সেই সহজ সময়ের সুযোগ নেবার সুযোগ ছিল না পেশাগত ব্যস্ততায়, তাই সেপ্টেম্বরের তুলনামূলক ঝামেলাপূর্ণ যাত্রায় প্রথমেই কথা বলতে হয় মন্ট্রিয়লে জাপান কনস্যুলেটে। জাপান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বলা ছিল জাপান দূতাবাসে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের কপি ইমেইলে পাঠিয়ে পরে সশরীরে উপস্থিত হয়ে ক্লিয়ারেন্স সনদ নিয়ে আসবার জন্যে। এই পর্যায়ে বিষয়টি ছিল রুটিন ওয়ার্ক, যথারীতি দ্রুততায় ক্লিয়ারেন্স চলে আসে। তারপর ছিল ফ্লাইটে ওঠার ৭২ ঘণ্টা আগে কোভিড টেস্ট।
৭২ ঘণ্টা মূলত কোভিডকালে ফ্লাইটের নিয়মিত অনিশ্চয়তার কারণে একটু ঝুঁকিপূর্ণ ডেডলাইন। তারপর বিতর্ক ছিল এই ৭২ ঘণ্টা কী স্যাম্পল প্রদান থেকে, না ফলাফল পাওয়া থেকে কারণ এখানেই ২৪ ঘণ্টা যোগবিয়োগ হয়ে যায়। তারপর কোনো কারণে ফ্লাইট বাতিল হয়ে ১ দিন বিলম্ব হলে ৭২ ঘণ্টার প্যাঁচে বিমানের ওঠার যোগ্যতাই হয়তো পার হয়ে যাবে। অনেক সময় অ্যারাইভ্যাল বিমানবন্দরে আবার ৭২ ঘণ্টার হিসেবনিকেশ নিয়ে ঝামেলা করে। নিয়ম ঠিকমতো না জানার কারণে অনেকেই ভোগান্তির শিকার হন কিংবা অদক্ষ স্টাফের ভুল সিদ্ধান্তের শিকার হন। এই অবস্থায় নিয়ম কানুনের হার্ড কপি সাথে রাখা জরুরি। আইন কানুনের দ্রুত পরিবর্তনশীল অবস্থায় বিমানবন্দর স্টাফদের লেটেস্ট নিয়মকানুন জানা বা ব্যাখ্যা করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। মন্ট্রিয়ল এয়ারপোর্টে বোর্ডিং পাস দেবার সময়ে আমার জাপান যাত্রা কোন আইনে তা বের করতে গিয়ে ভদ্রমহিলা বলছিলেন যে অবস্থা এমন ধারা উপধারা বুঝতে হলে আইনজীবী লাগবে। সমস্যা হচ্ছে ভুল ব্যবস্থাপনায় কোনো যাত্রী জাপান থেকে ফেরত আসলে এয়ারলাইন্সের যে আর্থিক ক্ষতি তাতে বোর্ডিং পাস যিনি দিচ্ছেন তাকে জবাবদিহি করতে হয়। আমি উনাকে জাপান বিদেশ মন্ত্রকের সাম্প্রতিক সার্কুলারের মূল বক্তব্যটি ইন্টারনেটে ধরিয়ে দেওয়াতে বেশ কৃতজ্ঞ মনে হল।
যিনি ভ্রমণ করছেন তিনি যদি সংশ্লিষ্ট দেশের কর্তৃপক্ষের (ইমিগ্রেশন, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়) সাম্প্রতিকতম নির্দেশনার কপি হাতে রাখেন তাতে মানবিক ভুল সিদ্ধান্তের শিকার হতে হয় না। যেমন কোভিড টেস্টের ক্ষেত্রে নিয়মটি হচ্ছে আরোহণের ৭২ ঘণ্টা আগে ফলাফল, সেই ক্ষেত্রে স্যাম্পল প্রদানের তারিখটি হবে ফলাফলের একদিন আগে। জাপানের ক্ষেত্রে ওদের নিজস্ব ফরম্যাটে বা ফরম্যাট অনুসারে যাবতীয় তথ্য দিয়ে ফলাফলের রিপোর্ট লাগবে। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য যেমন পাসপোর্ট নম্বর, জন্মতারিখ, পাসপোর্ট অনুসারে নাম, স্যাম্পল প্রদান/ফলাফলের তারিখ, আরটিপিসিআর বা নিউক্লিক এসিড অ্যাম্লিফিকেশন বা অ্যান্টিজেন টেস্টের কোনটি করা হয়েছে উল্ল্যেখ করাসহ টেস্ট করা প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা, সিল ইত্যাদি লিগ্যাল তথ্য থাকতে হবে। ইমিগ্রেশন অফিসার যিনি ফরম্যাটে ফলাফল দেখতে অভ্যস্ত তাকে শুধু ফলাফলের ইমেইল কপি ধরিয়ে দেবার সময় তথ্যগুলো ঠিকমতো আছে কিনা চেক করা উচিত। আবার যিনি ইমেইল কপি দেখে অভ্যস্ত, তিনি ফরম্যাটে ফলাফলে দ্বিধাগ্রস্ত হতেই পারেন। মনে রাখা উচিত বিশ্বের সব দেশেই ইমিগ্রেশন অফিসাররা নিজেদেরকে ঈশ্বরের মতোই ক্ষমতাবান মনে করে।
ফ্রিকুয়েন্ট ফ্লাইয়ার বিমান যাত্রীদের বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা দ্রুত করবার জন্যে কন্সিয়েজ সার্ভিসসহ অনেক সুযোগ সুবিধে থাকে কিন্তু কোভিড জরুরি অবস্থায় এইগুলো অনেকটাই অনুপস্থিত। মন্ট্রিয়লে এয়ার কানাডার লাউঞ্জ কিংবা প্রায়োরিটি সিকিউরিটি অ্যাক্সেস বন্ধ ছিল। পার্থক্যগুলো পর্যবেক্ষণ করতে লাগলাম। কোভিডকালেও মন্ট্রিয়ল থেকে ভ্যাংকুবারের ফ্লাইট পূর্ণ থাকে বলে শুনেছি। তবে ড্রিম লাইনার বোয়িং ৭৮৭-৯ এই বিমানটি যাত্রীতে ৬০% পূর্ণ ছিল। টেকঅফের সময় দেখলাম আমার পেছনের সিটের ভদ্রমহিলা অনেকক্ষণ কাশলেন, সবাই তাকাচ্ছিল, স্বাভাবিক সময়ে হয়তো কেউ এ নিয়ে ভাবত না। ক্রু মেম্বার আমাকে বললেন অস্বস্তি হলে সিট বদল করতে পারেন। যাক এরপরে আর ওনার কাশির সমস্যা ছিল না। সোয়া ৫ ঘণ্টার ফ্লাইটে বিশাল দেশ এই কানাডার অন্য শহর প্রশান্ত মহাসাগর বিধৌত নন্দন কানন ভ্যাংকুবারে পৌঁছলাম। মন্ট্রিয়ল কানাডার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হলেও বিমান বন্দরের আকার আর মানে তৃতীয় বৃহত্তম শহর ভ্যাংকুবারের চেয়ে অনেক পিছিয়ে।
বিমান থেকে নামার মুখে দেখলাম আমার নাম লিখে এয়ার কানাডার এক ভদ্রমহিলা দাড়িয়ে আছেন দরজার সামনে। উনি আমাকে এক্সিকিউটিভ লাউঞ্জ পর্যন্ত নিয়ে গেলেন, এটি ছিল এয়ার কানাডার প্রিভিলেজড কোন্সিয়েজ সার্ভিস। ভদ্রমহিলা কোভিড সময়কালে নারিতাতে আমার কি কি করতে হতে পারে, তার ব্রিফিং দিচ্ছিল। এরকম ফাঁকা লাউঞ্জের অভিজ্ঞতা এই প্রথম। কোভিড সংক্রমণ প্রতিহত করার ডিজাইনে নতুন করে সাজানো লাউঞ্জে খাবার নিজ হাতে নেবার বদলে স্টাফরা খাবার টেবিলে দিয়ে যায়। মেশিন থেকে নিজে পছন্দের কফি নেবার বদলে স্টাফরাই দিয়ে যায়। একক হাতে ব্যবহারের ফলে সংক্রমণের চান্স কমে আসে। এক্সিকিউটিভদের আসা-যাওয়া ব্যস্ততামুখর ইন্টারন্যাশনাল লাউঞ্জ কিংবা বিমানবন্দরের যাত্রীমুখ করিডোরের চেনারূপের বদলে চুপচাপ বিষণ্ণ এক পরিবেশে চলছে বিমানবন্দরের কার্যক্রম।
ভ্যাংকুবার থেকে নারিতার প্রায় ১০ ঘণ্টার ফ্লাইট। ড্রিম লাইনার ৭৮৭-৯ বোয়িং বিমানটির যাত্রী ধারণ ক্ষমতা প্রায় ৩০০, যাত্রী ছিলেন মাত্র ১৮ জন। এর মধ্যে নারিতা হয়ে কুয়ালালামপুরের যাত্রী ছিল অর্ধেক। বিমান ভ্রমণের ইতিহাসে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে এত স্বল্প যাত্রীর ফ্লাইটের অভিজ্ঞতা আমার এই প্রথম। ১০-১২ জন যাত্রীর ছোট ছোট বিমানে উঠেছি বহুবার তবে আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে ১৮ জন যাত্রীর এই কোভিড ফ্লাইটটি মনে রাখার মতো।
কানাডার ভ্যাংকুবার থেকে নারিতার ফ্লাইটটি দিনের আলো ধরেই যাত্রা শুরু এবং পৌঁছানো। ড্রিমলাইনার নামের সাথে মিলে যায় যখন দিনের বেলায় বিমানের সাটারবিহীন অপেক্ষাকৃত বড় ডিমিং জানালায় সূর্যকে চাঁদের মত দেখায় আর একটা স্বাপ্নিক আবহ বিমানের ভেতর আর বাহির জুড়ে বিরাজ করে। এয়ার কানাডার ১০ ঘণ্টার এই ফ্লাইটটি ছিল বেশ আরামদায়ক, শুধু সদ্য চলে যাওয়া টাইফুনের কারণে জাপানে নামার সময় কিছুটা ঝাঁকুনি। ফ্লাইটে মাস্ক ব্যবহার ছিল বাধ্যতামূলক, অবশ্য বিমানবন্দরে প্রবেশ করতে হলে মাস্ক পরতেই হবে। বিমানে স্বাভাবিক অবস্থার মতো খাবার সার্ভিস ছিল না। গরম খাবারের বদলে কনফেকশনারী বক্সে লাঞ্চ, ডিনার আর নাস্তার ব্যবস্থা। গরম চা বা কফি ছিল। কোভিডকালে সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতে এটাই নিউনরমাল। নিরিবিলি এই ভ্রমণে মনে হচ্ছিল নিজের চার্টার করা বিমানে ভ্রমণ করছি। ফ্লাইটে ইমিগ্রেশন আর কাস্টমসের নিয়মিত কাগজের বাইরে কোভিড বিষয়ে বিস্তারিত একটি ফর্ম দেওয়া হলো যাতে ফোন, ইমেইল, জাপানের অবস্থানের ঠিকানাসহ বিস্তারিত তথ্য দিতে হয়েছে।
আগে থেকেই ধারণা ছিল নারিতাতে আনুষ্ঠানিকতায় অনেক সময় লাগবে। বিমান নারিতাতে অবতরণের পরপরই এটি টের পেলাম। বিমান বোর্ডিং গেটে থামার পর দরজা খোলা মাত্রই কর্মকর্তারা প্রবেশ করে আমাদের সিটে বসে থাকা অবস্থাই কাগজপত্র পরীক্ষা নিরিক্ষা করলেন; ভাবখানা বেঠিক হলে নামতে দেওয়া হবে না, এই বিমানেই যেখান থেকে আসা সেখানে ফেরত। যে ভদ্রমহিলা আমার কাগজপত্র দেখছিলেন বেশ মমতাময়ী, বিনয়ের সাথে কাগজপত্র দেখলেন। বিমান থেকে বের হয়ে নারিতা বিমান বন্দরের টার্মিনাল ১ এর প্রথম করিডোরেই আমাদের বসার ব্যবস্থা করা হল কোভিড টেস্টের জন্যে। কোভিড টেস্ট বুথের সামনে লম্বা লাইন। প্রথম বুথে রেজিস্ট্রেশন করে কোভিড ফর্মের উপর সিরিয়াল নাম্বার বসিয়ে দিলেন। তারপর যেতে বললেন দ্বিতীয় বুথে যেখানে কিছু নির্দেশনা দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হল তৃতীয় বুথে। এই বুথে লালা থেকে করোনাভাইরাসের উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়। ছোট টিউবে প্রায় ৫ মিলি লালা জমা করে পরীক্ষার জন্যে দিতে হয়। স্যালাইভা বা লালার এই টেস্ট অ্যান্টিজেন টেস্ট।
বাংলাদেশে যারা গণস্বাস্থ্যের কিটের বিষয় অবহিত আছেন তারা জানেন বহুল আলোচিত অ্যান্টিবডি কিটের পাশাপাশি লালা থেকে অ্যান্টিজেন টেস্টের বিষয়ও কথা হয়েছিল। ডেইলি স্টারের মতো কিছু পত্রিকা বিশ্বের প্রথম উদ্ভাবন, জাপানীদের আগে বাংলাদেশ করে ফেলেছে নানান কথার ফানুস উড়িয়েছিল। বারবারই বলেছি বাংলাদেশে বিজ্ঞান সাংবাদিকতা লজ্জাজনক সংকটে। গণস্বাস্থ্য অবশ্য নিজে থেকেই এই স্যালাইভা টেস্ট থেকে সরে এসেছিল।
এই স্যালাইভা টেস্টের সমস্যা হচ্ছে বয়স্ক মানুষদের তো আর বাচ্চাদের মতো লালা বা স্যালাইভা পর্যাপ্ত নয়, থুথু মিশে গেলে টেস্টে সমস্যা হয়। দীর্ঘ বিমান ভ্রমণের পর মুখ এমনিতেই শুকনো থাকে ফলে লালার বদলে থুথু আর বাতাস দিয়ে টিউব ভরে যায়। এই সমস্যা সমাধানে নাকের ভেতর থেকে স্যাম্পল নিয়ে আরটিপিসিআরের ব্যবস্থাও আছে। নাকের ভেতর সোয়াব টেস্টের স্যামপ্লিং এ অনেকে অস্বস্তিবোধ করেন তাই জনকল্যাণমুখী জাপানিরা উভয় টেস্টের ব্যবস্থা করেছেন, একটিতে ঝামেলা হলে অন্যটির ব্যবহার, ফলাফলে দিতে সময় লাগে একই। আমি অবশ্য বৈশ্বিক গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড আরটিপিআরের টেস্টের পথেই হেঁটেছি।
স্যাম্পল দেবার পর আরও দুটো বুথ পেরোতে হয়। এক বুথে ফলাফলের অপেক্ষায় বসে থাকার সিট নাম্বারসহ কিছু কাগজপত্র ধরিয়ে দেওয়া হয়। অন্য বুথে জাপানে থাকার ঠিকানাসহ ফোন নাম্বার, ই-মেইল রেকর্ড করে অনুরোধমূলক কোয়ারেন্টাইনে কী করণীয় বিস্তারিত বলা হয়। তারপর নির্ধারিত সিটে বসিয়ে রাখা হয় কোভিড টেস্টের রেজাল্ট আসা পর্যন্ত। রেজাল্ট পেতে সময় নিয়েছিল দেড় ঘণ্টা। এই সময়ে এরা পর্যাপ্ত পানির বোতল সরবরাহ করে থাকে। জাপানীদের সহজাত আতিথিয়তায় বরাবরই মুগ্ধ হবার মতো। রেজাল্ট এলে সিরিয়াল নাম্বার ধরে লাউড স্পীকারে ডেকে বলবে পরবর্তী বুথে যেতে। এই বুথে আপনি যে দেশ থেকে এসেছেন সেখানকার কোভিড টেস্টের কাগজসহ জাপান দূতাবাসের কাগজ দেখাতে হয়। এরপর নারিতা এয়ারপোর্টের রেজাল্ট আপনাকে জানিয়ে (নেগেটিভ হলে) কোয়ারান্টাইনের কাগজ ধরিয়ে দিয়ে ইমিগ্রেশন কাউন্টারে দিকে যেতে বলবে। তারপর ইমিগ্রেশন, কাস্টমসের আনুষ্ঠানিকতার রুটিন স্টেপগুলো পার হয়ে বের হয়ে আসবেন।
এয়ারপোর্ট থেকে কোনো পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করা যাবে না। সাধারণত বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয়-স্বজনের গাড়িতে আসতে হয়। কোয়ারেন্টাইন সময় দুই সপ্তাহ। গণপরিবহণ আর জনসমাগম এড়িয়ে চলা, প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না যাবার পরামর্শ থাকে। বিষয়টি খবরদারির মতো নয়, অনেকটা আপনি সুস্থ আছেন কিনা খোঁজখবর নেবার মতো। অসুস্থ হলে কি করতে হবে তার সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা দেওয়া আছে। পুরো ব্যবস্থাটিতে বিদেশ থেকে আগত কারো পক্ষে সরকারি নজরদারি নেটের বাইরে থাকার সুযোগ নেই। স্থানীয় সরকারের স্বাস্থ্য অফিস থেকে যোগাযোগ করা হয় এবং মেইলের মাধ্যমে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত দেহের তাপমাত্রা আর কোনো উপসর্গ আছে কিনা নিয়মিত জানাতে হয়।
বিশ্বের দেশে দেশে কোভিড সংক্রমণ এখন মূলত কমিউনিটি সংক্রমণ, শুরুর দিককার মত বিদেশ থেকে নয়। নারিতা বিমানবন্দরে অসংখ্য বুথের এই ব্যবস্থাটি আদৌ দক্ষ ব্যবস্থাপনা কিনা প্রশ্ন থাকতেই পারে। ৭২ ঘণ্টার ব্যবধানে দুবার কোভিড টেস্ট এবং ১৪ দিনের কোয়ারান্টাইন একসাথে দরকার আছে কিনা প্রশ্ন রয়েছে। ৭২ ঘণ্টায় দুবার নেগেটিভ টেস্টের পর সাধারণ জনগণের তুলনায় অনিরাপদ ভাবার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তবে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে তুলনামূলকভাবে সৎ, নির্লোভী, আত্মমর্যাদাবান, সর্বোপরি জনগণের অর্থ ব্যয়ে লজ্জাশরমওয়ালা জাপানি আমলাতন্ত্র সম্পর্কে যারা জানেন তাদের কাছে এই সীমাবদ্ধতার প্রশ্নের উত্তরও রয়েছে। দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত হবার চেয়ে আত্মহনন যাদের প্রাইড, সেই জাতির আমলাতন্ত্রে লাল ফিতার অভিযোগ থাকলেও মোটা দাগে কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগ মুক্ত।
জাপানে স্কুল কলেজ খোলা, অফিস আদালত সীমিত আকারে খোলা, দোকানপাট, মল, রেস্তোরাঁ, কফিশপ সবই খোলা। গ্রেটার টোকিও'র পৌনে চার কোটি জনসংখ্যার বিপরীতে সবকিছু প্রায় খোলা অবস্থায় কোভিড সংক্রমণ দিনে তিনশতের কম। কোভিড সংক্রমণ চাপিয়ে রাখার জাপানিদের এই সফলতার দিকে তাকাতে হলে জাপানি ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি এদের সহজাত সংস্কৃতির দিকেও তাকাতে হবে। কেবল এই কোভিড যুগ নয়, রাস্তাঘাটে মাস্ক পরা মানুষজন জাপানে যুগ যুগ ধরে দৈনন্দিন দৃশ্যপট। হাল্কা ঠাণ্ডা লাগলেই জাপানিরা মাস্ক ছাড়া বের হয় না। আর এখন কোভিড সময়ে রাস্তাঘাট, স্কুল কলেজ, অফিস পাড়া সবখানে প্রায় ১০০% মাস্ক পরা মানুষ দেখবেন। একা গাড়ি চালাচ্ছে কিন্তু অভ্যাসের কারণে মাস্ক পরে আছে রাস্তাঘাটে এরকম ঘটনা অসংখ্য।
একটি রেজিমেন্টেড সমাজ তো তার রেজিমেন্টেড আমলাতন্ত্র, নিষ্ঠাবান টেকনোক্রেট আর নিবেদিত রাজনৈতিক নীতি নির্ধারকদের সততা আর আন্তরিকতার সুবিধেটুকু পাবেই।