Published : 11 Sep 2020, 05:29 PM
কোভিড ভ্যাকসিন এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত বস্তু। সম্ভবত কোনো গ্লোবাল সংকটে এই প্রথম সমগ্র বিশ্ব তাকিয়ে আছে একটিমাত্র পণ্যের দিকে। উন্নত বিশ্বের দেশগুলো ভ্যাকসিন মহাসড়কে ছুটে চলছে অবিরাম সাধ্যের সবটুকু ঢেলে কার রেসিংয়ের মতো সবার আগে লক্ষ্যে পৌঁছার জন্যে। উদ্ভাবন বা উৎপাদনে সরাসরি অংশগ্রহণ নেই কিন্তু অর্থ আছে, অগ্রিম লগ্নিতে অনেকটা জুয়া খেলার মতোই ঝুঁকি নিচ্ছে তারা নিজ জনগণের কল্যাণে। জাতীয়তাবাদী চেতনায় নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণে অন্যকে বঞ্চিত করে হলেও তৎপর সবাই, আর এদের এই রক্ষণশীল আচরণ ভাবিত করছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে। নতুন শব্দচয়ন 'ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ'। স্নায়ুযুদ্ধ পরবর্তী বিশ্ব ব্যবস্থায় ভ্যাকসিনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট রাজনীতি, প্রাইড, স্বার্থ, ব্যবসা সব মিলিয়ে ধনী রাষ্ট্রগুলোর স্বার্থপরতার তীব্রতায়, অর্থ এবং প্রযুক্তিতে পিছিয়ে থাকা বিশ্বকে নিয়ে উদ্বিগ্ন বিশ্ব বিবেক; বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধানের কণ্ঠস্বরে তাই উদ্বেগ স্পষ্ট।
প্রায় ২০০ অ্যান্টিটি কাজ করছে ভ্যাকসিন নিয়ে, উদ্ভাবনে প্রবল প্রতিযোগিতায় এক ডজন প্রতিযোগী এখন পর্যন্ত কে আগে পৌছবে এরকম স্নায়ুচাপ নির্ভর দৌড়ে প্রথম কাতারে রয়েছেন। সাফল্যকে স্পর্শ করতে চাচ্ছে সবাই, কে আগে ধরতে পারবে এই তাড়নায় তাড়িত হয়ে ব্যর্থতার 'গেম চেইঞ্জিং ঝুঁকি' নিয়ে ভাবছে না কেউ। উদ্ভাবনের পাশাপাশি সমান গুরুত্ব পাচ্ছে ভ্যাকসিন কেনার চুক্তি। ভ্যাকসিনের সফল উদ্ভাবনের পর কেনা বা সংগ্রহে অক্ষমতা পশ্চিমা বিশ্বের গণতান্ত্রিক সরকারগুলোর জন্যে সরকার পতনের ভয়ংকর অস্ত্র হয়ে দেখা দেবে এই আশঙ্কায় কোনো সরকারই ঝুঁকি নিতে চাচ্ছে না। উন্নত বিশ্ব নিজ দেশের জনস্বাস্থ্যে, জনকল্যাণে খুবই স্পর্শকাতর। তিন কোটি ৭৬ লক্ষ কানাডাবাসীর জন্যে প্রায় ২০ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন সংগ্রহে প্রস্তুত কানাডা। হিউমেন ট্রায়াল ফেজ ৩-তে যারা আছেন শুধু তারা নন, যারা ফেজ ২-এ আছেন, তাদের সাথেও চুক্তি করেছে কানাডা সরকার। অগ্রিম পেমেন্ট নিয়ে হাজির, সফল হবে এমন নিশ্চয়তা ছাড়াই গ্যামব্লিং করতে দ্বিধা নেই। জনগণের স্বার্থ আর সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকা উভয় তাগিদে ভ্যাকসিনটা জরুরি। এই ডেসপারেট আচরণ, জাতীয় আর রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিকোণ থেকে জাতীয়তাবাদী চেতনায় অভিনন্দিত হলেও বৈশ্বিক প্রেক্ষিতে দুর্বল দেশগুলোর বঞ্চিত হবার বিশেষ করে প্রাথমিক পর্যায়ে গরীব দেশগুলোর ভ্যাকসিন প্রাপ্তির সম্ভাবনাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেবে।
গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রে মেরিল্যান্ডভিত্তিক কোম্পানি নোভাভেক্স আর জন্সন জন্সনের ফার্মা উইং জ্যান্সেন ইঙ্কের সাথে ১১.৪ কোটি ডোজের চুক্তি করেছে কানাডা। ফেজ ২ শুরু করতে যাওয়া কোম্পানিদ্বয় আদৌ ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে সফল হবে কিনা কিংবা হেলথ কানাডার অনুমোদন জুটবে কিনা এই ভাবনা না ভেবে আপাতত সম্ভাবনার ওপর ভরসা করেই এগিয়ে যাচ্ছে সরকার। ফেজ ৩-তে থাকা দুটো কোম্পানি ফাইজার-বায়ো এন টেক আর মডার্নার সাথে আগেই চুক্তি হয়েছে যথাক্রমে ২ কোটি আর প্রায় ৬ কোটি ডোজের জন্যে। ওয়ারেন বাফেটের সেই বিখ্যাত পরামর্শ "সব ডিম একই ঝুড়িতে রাখতে নেই" অনুসারে কানাডা সরকার একই উৎস থেকে ভ্যাকসিন সংগ্রহ করার ঝুঁকি নিতে নারাজ। বিভিন্ন ভ্যাকসিন বিভিন্ন ধরনের, কোনটি কাজ করবে নিশ্চিত নয়, করলেও কতদিন ধরে অ্যান্টিবডি কার্যকর থাকবে ইত্যাদি নানা হিসেব নিকেশে ডিমগুলো ভিন্ন ভিন্ন ঝুড়িতে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ এই ধারণায় ডিমগুলো তারা সংগ্রহই করছে ভিন্ন ভিন্ন উৎস থেকে। সব ধরনের ভ্যাকসিন সফল হবে এমন ঘটার সম্ভাবনা নেই। আপাতত সবচেয়ে সম্ভাবনাময় ভ্যাকসিনটির ক্ষেত্রে শেষতক দেখা যেতে পারে কাজ হচ্ছে না, আবার দেখা গেল লো প্রোফাইলে থাকা ভ্যাকসিনটি কার্যকর। প্রচলিত ধারণা ভাইরাল ভেক্টর প্রযুক্তির ভ্যাকসিন উদ্ভাবন কঠিন হলেও কার্যকারিতার ক্ষেত্রে অবস্থান শক্তিশালী, আবার প্রোটিন বেইসড ভ্যাকসিনের উদ্ভাবন জটিল না হলেও, কার্যকারিতা ততটা শক্তিশালী হয় না। এই রকম বিভিন্ন কৌশলের কারণে ধনী রাষ্ট্রগুলো সব অপশনেই প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে চাইছে। ভ্যাকসিন প্রযুক্তির ভিন্নতা নিয়ে একটু আলোচনা করতে চাচ্ছি।
বিজ্ঞানীরা শতাধিক ফ্রন্টে কাজ করছে ভ্যাকসিন আবিষ্কারে। উদ্ভাবনের নানা কৌশল, কিছু কৌশল ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত, কিছু একেবারেই নতুন প্রযুক্তি। বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস বা ভাইরাসের অংশ বিশেষ দিয়ে চলছে ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের এই প্রচেষ্টা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভ্যাকসিনের লক্ষ্য থাকে ভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনকে টার্গেট করা। কোভিডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে মূলত আট ধরনের কৌশল নিয়ে কাজ হচ্ছে। কৌশলগুলো হচ্ছে নিষ্ক্রিয় বা দুর্বল ভাইরাস ব্যবহার করে, ভাইরাল ভ্যাক্টর রেপ্লিকেট করে বা না করে, ডিএনএ বা আরএনএ দিয়ে, আমিষ বা প্রোটিন সাব ইউনিট বা ভাইরাসের মতো পার্টিকল দিয়ে। (তথ্য সুত্র- ন্যাচার ডট কম)।
ইতোমধ্যে প্রচলিত বিভিন্ন ভ্যাকসিনে নিষ্ক্রিয় বা দুর্বল ভাইরাস ব্যবহার করে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি করা হয় যাতে রিয়েল টাইমে ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হলে অ্যান্টিবডি ভাইরাসকে ধ্বংস করবে। ভ্যাকসিনে ব্যবহৃত নিষ্ক্রিয় বা দুর্বল ভাইরাস নিজে রোগ তৈরিতে অক্ষম কিন্তু আপনার শরীরের প্রতিরক্ষা সিস্টেমকে গুড ফেইথে ধোঁকা দিয়ে আসল ভাইরাসের বিরুদ্ধে সৈন্য সামন্তের রণসজ্জা অর্থাৎ অ্যান্টিবডি তৈরিতে উদ্বুদ্ধ করে। ইনফ্লুয়েঞ্জা, চিকেনপক্স, মিসেলস, মাম্পস, রুবেলা ইত্যাদির ভ্যাকসিন এই কৌশলে তৈরি। কোভিড ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে সিনোভ্যাকসহ অনেকেই কাজ করছেন এই প্রযুক্তিতে।
ভাইরাল ভ্যাক্টর ভ্যাকসিন প্রযুক্তিতে এডেনো ভাইরাসের (সাধারণ সর্দিকাশির ভাইরাস) মধ্যে করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনের জিনটিকে প্রবেশ করিয়ে দেওয়া হয়। এডেনো ভাইরাসের নিজের একটি জিন মিসিং থাকার ভ্যাকসিনে ব্যবহারের ক্ষেত্রে এটি মানুষের দেহে ভাইরাল লোড তৈরি করতে পারে না অর্থাৎ রেপ্লিকেট করতে পারে না। বরং জেনেটিক্যালি ইঞ্জিনিয়ারড এই এডেনো ভাইরাস শরীরে করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিন তৈরি করে শরীরকে অ্যান্টিবডি তৈরি করতে উদ্বুদ্ধ করে ফলে রিয়েল টাইমে ভাইরাস সংক্রমণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে শরীর প্রস্তুত থাকে। জন্সন জন্সন, ক্যানসাইনো, অক্সফোর্ড এই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। রাশিয়ার আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন স্পুটনিক-৫ একই কৌশল অবলম্বনে তৈরি।
জেনেটিক ভ্যাকসিনে করোনাভাইরাসের জেনেটিক কোড ব্যবহার করা হয়। এটি ডিএনএ কিংবা আরএনএ ভ্যাকসিন হতে পারে। জেনেটিক কোড ব্যবহার করে শরীরে ভাইরাল প্রোটিন উৎপন্ন করে অ্যান্টিবডি তৈরির মেকানিজমকে সক্রিয় করা হয়। উৎপন্ন অ্যান্টিবডি আমাদের সুরক্ষা দেয়। মানব ভ্যাকসিনে ডিএনএ ভ্যাকসিন খুব প্রচলিত নয়। আরএনএ ভ্যাকসিনে উৎসাহ বেশি। এখানে ডিএনএ ভ্যাকসিন থেকে একটি স্টেপ কম, সরাসরি ম্যাসাঞ্জার আরএনএ ব্যবহার করা হয়, যা স্পাইক প্রোটিন তৈরি করে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরির ক্ষেত্র তৈরি করে। মডার্না, ফাইজার এবং বায়োএনটেক এই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে।
প্রোটিন ভিত্তিক ভ্যাকসিনে সরাসরি করোনাভাইরাসের প্রোটিন বা প্রোটিনের অংশবিশেষ ব্যবহার করা হয়। এই পদ্ধতিতে মূল ভাইরাস ব্যবহৃত হয় না, ভাইরাসের প্রোটিন বা প্রোটিন ব্যবহার করে ইমিউন সিস্টেমকে বিপদের সংকেত দিয়ে অ্যান্টিবডি উৎপাদনে ব্যস্ত করে দেওয়া হয়। এই অ্যান্টিবডি রিয়েল টাইমে ভাইরাল সংক্রমণের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে (তথ্য সূত্র- নিউইয়র্ক টাইমস, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইত্যাদি)।
ভ্যাকসিন উদ্ভাবন নিয়ে সাজ সাজ রবের মধ্যে আশা নিরাশার দোলাচলে ভ্যাকসিনের প্রাপ্যতার বিষয়ে ২০২১ সালের প্রথমদিককেই বিবেচনায় নিচ্ছে সবাই। সরকারগুলো ভ্যাকসিন উৎপাদকদের সাথে গোপনীয়তার চুক্তিতে আবদ্ধ থাকায় খরচের বিষয়ে তেমন তথ্য নেই, ফলে ভ্যাকসিনের প্রতি ডোজে খরচটা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা নেই। তবে অর্থের অভাবে সম্ভাবনাময় ভ্যাকসিন উৎপাদনকারী যাতে পিছিয়ে না পড়ে সেজন্য ধনী রাষ্ট্রগুলো খোলামেলা হাতে সহযোগিতা করছে। ধনী দেশগুলো চুক্তি বা ডিলে লকডাউন করার ফলে ভ্যাকসিন উদ্ভাবকদের আইনগতভাবে চুক্তি অনুসারে সরবরাহের বাধ্যবাধকতা তৈরি হওয়াতে গরীব দেশগুলোকে অপেক্ষা বা ধনীদের উদ্বৃত্ত ডোজ থেকে অনুগ্রহের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে। ইতিহাস বলে এই অনুগ্রহ খুব একটা সুখকর নয়। বহু দেশ এই অনুগ্রহকে রাজনৈতিক হাতিয়ার বানিয়ে প্রভাব বলয় বাড়াতে সচেষ্ট। এমন কি যাদের নিজেদের ভ্যাকসিনের তেমন কোনো খবর নেই, তাকিয়ে আছে পশ্চিমের দিকে তারাও অপেক্ষাকৃত দুর্বলদের সাথে ভ্যাকসিন কূটনীতির আশ্রয় নিচ্ছে। অনেকটা, "আমার সাথে থাক, দুইটা বেশি পেলে তোকেও দেব"।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান তেদ্রোস আধানম গ্যাব্রিয়েসাসের ভাষ্য অনুসারে ভ্যাকসিন সংগ্রহে স্বার্থপরতা প্যানডেমিক পরিস্থিতিকে আরও জটিল করবে। ধনী দেশগুলোর প্রতি হু এর আহবান COVAX এ অংশগ্রহণ এবং হু প্রধান এই বিষয়ে ১৯৪ দেশে চিঠি দিয়েছেন। কোভেক্স হচ্ছে ১৭২ দেশের ভ্যাকসিন উৎপাদকদের সাথে একটি বৈশ্বিক উদ্দ্যোগ যাতে নিরাপদ ভ্যাকসিন প্রাপ্তিতে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়। শুধু ধনী দেশগুলোর ভ্যাকসিন প্রাপ্তিতে প্রবেশাধিকার হবে ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদের নামে অনৈতিক অবস্থান। রাজনীতি নয়, জাতীয়তাবাদ নয়, বিজ্ঞান হবে কোভিড নিয়ন্ত্রণে মূলমন্ত্র। গরীব দেশগুলোর চাহিদা উপেক্ষা করে বিশ্বকে যেমন কোভিড মুক্ত করা যাবে না তেমনি বিশ্ব অর্থনীতির স্বাস্থ্যও ঠিক রাখা সম্ভব নয়। হু এর ভয় জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণে বাড়াবাড়ি ভ্যাকসিন বিতরণে হুমকি হয়ে দাঁড়ায় কিনা।
ইউরোপীয় দেশগুলো, বিল/মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশন এবং ওয়েলকাম ট্রাস্ট এর প্রতিশ্রুত ৮ বিলিয়ন ডলারের এক্সেস টু কোভিড-১৯ টুলস (এসিটি) কার্যক্রমে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং ভারতের অংশ না নেবার ঘটনা ভ্যাকসিন জাতীয়তাবাদ ধারণাকে ইঙ্গিত করছে। এরকম ইঙ্গিত আরও আছে। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ভ্যাকসিন ডোজ উৎপাদনকারী ভারতের সেরাম ইন্সিটিউটের প্রধান নির্বাহী বলছেন- "বিদেশ যাবার আগে ভ্যাকসিন যাবে আমার দেশের মানুষের কাছে"। এসক্ট্রাজেনেকা বলছে অক্সফোর্ডের সাথে তাদের এই উদ্যোগের প্রথম তিন কোটি ডোজ যাবে যুক্তরাজ্যে। যুক্তরাজ্যের পর যুক্তরাষ্ট্রের ১.২ বিলিয়ন বিনিয়োগে ৩০ কোটি ডোজ যাবে। এই ধরনের জাতীয়তাবাদী স্বার্থপরতা আগেও ছিল। ২০০৯ সালে সোয়াইন ফ্লুতে প্রায় ৩ লাখ মানুষ মারা যায়। ভ্যাকসিনের দখলও তখন ছিল ধনীদের হাতেই। সোয়াইন ফ্লু ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন তাদের সবার জন্যে ডোজ নিশ্চিত করে তাদের স্টক থেকে মাত্র ১০% গরীব দেশগুলোকে দিয়েছিল। বিলম্বিত এই ন্যূনতম খয়রাতি ছিল গরীব দেশগুলোর জন্যে প্রহসন। ১৯৯৬ সালে আবিষ্কৃত এইচআইভি ভাইরাসের শক্তিশালী অ্যান্টিভাইরাল ড্রাগ অনেক মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে কিন্তু এর কালো অধ্যায়টি হচ্ছে সবচেয়ে উপদ্রুত আফ্রিকার দেশগুলোতে পশ্চিমাদের উৎপাদিত এই ড্রাগ পৌঁছাতে সময় নিয়েছিল ৭ বছর। শক্তি আর বিত্তশালীদের জাতীয় স্বার্থ বার বার জিতে গেছে। বিশ্ব আজ অপেক্ষাকৃতভাবে অনেক মানবিক আর কোভিড বিষয়ে অনেক সোচ্চার, বিল গেটসের মত ধনীরা হাত বাড়িয়েছে গরীবদের জন্যে, তারপরেও আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। সমস্যা হবে একটি সফল ভ্যাকসিনের খোঁজ পাওয়া মাত্র কাড়াকাড়ির মধ্যে সাপ্লাই চেইনের সীমাবদ্ধতাজনিত পিছিয়ে থাকার দুর্ভোগ। একটি দেশের সব জনগণের জন্যে ডোজ নিশ্চিত করার চাইতে বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যকর্মীসহ অগ্রাধিকার প্রাপ্তদের প্রাপ্তি নিশ্চিত করা নৈতিকতা আর মানবিকতার মানদণ্ডে সঠিক সিদ্ধান্ত। এরকম একটা ব্যবস্থার জন্যে রাজনীতিবিদ নয়, এপিডেমিওলজিস/অনুজীব বিজ্ঞানী আর সমাজ বিজ্ঞানীদের প্রধান ভূমিকায় থাকা উচিত। অকার্যকর সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের চেয়ে বৈশ্বিকভাবে নিয়ন্ত্রিত মেকানিজমটা জরুরি। উন্নত বিশ্বের স্বল্পঝুঁকি বা ঝুঁকিবিহীন জনসংখ্যার জন্যে ডোজ নিশ্চিত করার চাইতে উদাহরণস্বরূপ বাংলাদেশে ফ্রন্ট লাইনের স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্যে ভ্যাকসিন অনেক বেশি জরুরি আর মানবিক। এই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে COVID-19 Vaccines Global Access (COVAX) Facility। কোবেক্সের লক্ষ্য গরীব দেশগুলোর জন্যে ২০২১ সালের শেষ নাগাদ ২০০ কোটি ডোজের ব্যবস্থা করা। তারা ১২ ধরনের ভিন্ন ভিন্ন ভ্যাকসিনের পেছনে ইনভেস্ট করতে যাচ্ছে। ভিন্ন ভিন্ন ভ্যাকসিনের পেছনে ইনভেস্ট করার মূল কারণ ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে ব্যবহৃত নানাবিধ কৌশলের অনিশ্চয়তা। একটি কাজ না করলে যেন অন্যটি পাওয়া যায়।
ধনী দেশগুলোকে নিজের স্বার্থ দেখভাল থেকে বিরত রাখা যাবে না। তাই পাশাপাশি কোবেক্সে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা জরুরি। এক্ষেত্রে ধনীদের সুবিধে হচ্ছে কোন নির্দিষ্ট ভ্যাকসিনে তাদের ইনভেস্টমেন্ট ব্যর্থ হলে কোবেক্সের সদস্য হিসেবে তাদের জনসংখ্যার ২০% এর জন্যে ভ্যাকসিন পেয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার ৬ বিলিয়ন ডলারে অনেকগুলো ভ্যাকসিন উৎপাদকের সাথে চুক্তি করেছে যাতে ২০২১ সালের প্রথম দিকে নিজ জনগণের জন্যে ভ্যাকসিন নিশ্চিত করা যায়। ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি এবং নেদারল্যান্ডের মধ্যকার ভ্যাকসিন অ্যালায়েন্স ৪০ কোটি ডোজের চুক্তি করেছে এসক্ট্রাজেনেকার সাথে। চীন এগিয়ে যাচ্ছে নিজস্ব ভ্যাকসিন নিয়ে, রাশিয়া ইতোমধ্যেই ভ্যাকসিন অনুমোদন দিয়ে মাঠে রয়েছে। ফলে অনিশ্চয়তা রয়েছে কখন তারা তাদের আবিষ্কৃত ভ্যাকসিন শেয়ার করবে কিংবা রাজনীতির দাবার চালে ভ্যাকসিন নিয়ে খেলবে কিনা।
ভ্যাকসিন রাজনীতির কতিপয় এপিসোডের সাথে বাংলাদেশের জনগণের ইতোমধ্যেই পরিচয় হয়ে গেছে। ভারত-চীনের সাম্প্রতিক সীমান্ত সংঘাত ভ্যাকসিন কূটনীতিতে বাংলাদেশের গুরুত্ব বাড়িয়েছে বৈকি। ভ্যাকসিন নিয়ে চীনের প্রতিশ্রুতি, ভারতের প্রতিশ্রুতি উপভোগ করা যেতেই পারে। একটি দায়িত্বশীল রাজনৈতিক সরকার বৈশ্বিক রাজনীতি, কূটনীতিতে তার অবস্থানে প্রয়োজনীয় চালটি চালবেন এটি স্বাভাবিক। রাজনীতি আর কূটনীতির মারপ্যাঁচে জনগণের স্বার্থ, নিরাপত্তা কোনো অবস্থাতেই উপেক্ষা করা উচিত নয়। বাংলাদেশে কোভিড ব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত কর্তৃপক্ষের উচিত রাজনীতি আর কূটনীতি যাদের দায়িত্বে সেটি তাদের উপর ছেড়ে দিয়ে কোভিড থেকে জনগণকে রক্ষা করার প্রয়াসে সম্ভাব্য সব কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া। ভ্যাকসিন কূটনীতির আশ্বাসের ওপর বিন্দুমাত্র ভরসা না করে সরাসরি ভ্যাকসিন উৎপাদকদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করে স্বাস্থ্যকর্মীসহ কোভিডের ফ্রন্টলাইন ফাইটারসহ কোভিডে উচ্চ ঝুঁকির জনসংখ্যার জন্যে ভ্যাকসিন প্রাপ্তি নিশ্চিত করা। কোভিড ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের প্রচুর ভুল ভ্রান্তি ছিল, ভ্যাকসিন প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সেই শিক্ষাটুকু বিশেষ করে সময় গেলে সাধন হবে না ধরনের গাফলতি থেকে শিক্ষা নিয়ে ভ্যাকসিন প্রাপ্তির জন্যে উচিত সব কিছু করা। কোভিড পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে যতসব অনৈতিক ব্যবসাপাতির চিত্র পত্র-পত্রিকায় উঠে এসেছে, তা এক কথায় ভয়ংকর। ভ্যাকসিনকে কেন্দ্র করে আরও মারাত্মক দুর্নীতির সম্ভাবনা আছে। লগ্নির পরিমাণ বিশাল বিধায় রাঘব বোয়ালদের ভূমিকা থাকবে। এই অবস্থায় ভ্যাকসিন নিয়ে দুর্নীতির সুযোগ অঙ্কুরে বিনষ্ট না করতে পারলে জাতিকে দুর্ভাগ্যের দুর্ভোগ থেকে রক্ষা করা যাবে না। দুর্নীতি হয়ে গেলে কমিটি গঠন, বহিষ্কার বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থার চেয়ে শুরু থেকেই প্রতিরোধটা অত্যাবশ্যক।