Published : 01 Sep 2020, 01:40 PM
২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সাহিত্যের আন্তর্জাতিক যোগাযোগের অংশ হিসেবে জাতীয় কবিতা পরিষদের আমন্ত্রণে সুইডেনের পাঁচজন কবি সম্পাদক ও অনুবাদক সপ্তাহখানেকের জন্যে ঢাকায় এসেছিলেন। সাতদিনের ঢাকায় অবস্থানকালে তারা একুশে গ্রন্থমেলা, জাতীয় কবিতা উৎসব, একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সেমিনার, জাতীয় স্মৃতিসৌধ পরিদর্শন, পুরনো ঢাকার অলিগলি, বুড়িগঙ্গা, ঢাকার চিত্রগ্যালারি, সেন্টার ফর এশিয়ান থিয়েটার, বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, জাতীয় জাদুঘর, বইয়ের দোকানসহ নানা সাংস্কৃতিক আয়োজন দেখে ফিরে গিয়ে ঢাকা এবং ঢাকার সাহিত্য নিয়ে তারা একাধিক লেখা ছেপেছিলেন ইউরোপের পত্রপত্রিকায়। ঢাকা ছাড়ার পূর্বে রিপোর্টাস ইউনিটিতে তারা সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে অংশ নিয়েছিলেন। সেই মতবিনিময়ে সুইডিশ একাডেমী থেকে পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি অরনে ইয়নসন ঢাকা শহরকে এক বাক্যে তুলে ধরেছিলেন- এইভাবে "ঢাকা এতটা সুন্দর এবং প্রাণবন্ত শহর যা কখনো ঘুমায় না"।
সেই অরনে ইয়নসন এক যুগ পরে আবার ঢাকায় এসেছিলেন ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। এর মধ্যে ঢাকা বেড়েছে আয়তনে, আকারে, সবুজ ঘেরা বাড়িগুলো হারিয়ে গেছে। গড়ে উঠেছে উঁচু উঁচু দালান। শহর হয়েছে দালান যানবাহনের জনস্রোতের আর যানজটের। অরনের ঢাকা নিয়ে এবার কোন মন্তব্য নাই, কোন লেখাও নাই। অরনে প্রসঙ্গে এখানেই থামি।
এ বছর আমরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপন করছি। যদিও করোনাভাইরাসের থাবায় থেমে গেছে অনেক উদ্যোগ। নানা প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি এবং সংস্থার উদ্যোগে আয়োজিত হয়েছে দৃশ্যমান অনেক কিছুই। আমাদের খোদ ঢাকার দুই নগর সংস্থার পক্ষ থেকে মুজিববর্ষের অংশ হিসেবে দৃশ্যমান উল্লেখযোগ্য কী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে? বিশেষ করে এই নগরকে মানুষের কাছে দেশি বিদেশি পরিব্রাজকের কাছে তুলে ধরার জন্যে কী আয়োজন নগর কর্তৃপক্ষের?
এবার অন্য একটি ঘটনা উল্লেখ করি। গোথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতার জন্যে সম্মানিত ডক্টরেট সুইডেনের প্রাচীন এবং বহুল প্রচারিত সংবাদপত্র দগেনস নিহেতার (Dagens Nyheter বা দিনের সংবাদ) এর সাবেক প্রধান সম্পাদক অরনে রুথ এক সংলাপে ঢাকা সম্পর্কে অনেকগুলো সুন্দর কথা বলেছিলেন। তার কথা শেষে একটা ছোট প্রশ্ন ছিল- ইউরোপের সাহিত্য সংস্কৃতির ঐতিহ্যের সঙ্গে ঢাকার পার্থক্য কী?
আমার উত্তর ছিল- We have institutional lack. (আমাদের রয়েছে প্রতিষ্ঠানের অভাব)
On the other hand, you have institutional block. (অন্যদিকে তোমাদের রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক বাধা)
এর পরের প্রশ্ন ছিল- কোনটা ভালো?
আমার উত্তর ছিল, দুটোই সমানভাবে ভালো এবং সমানভাবে খারাপ।
আমাদের প্রতিষ্ঠানিক উদ্যোগ এবং সংস্কারের যে সঙ্কট রয়েছে বিশেষ করে সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তা আমরা স্বাধীনতার পাঁচ দশকে এসে খতিয়ে দেখতে পারি। এই জন্যে আমাদের খুব বেশি জিনিস ঘাটাঘাটির দরকার নাই। আমি কেবল দুটো খবরের দিকে আপনাদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই।
সপ্তাহ কয়েক আগে দেশব্যাপী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মুজিব কর্নারের জন্যে বই কেনার অনিয়মের অভিযোগে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা কর্তৃপক্ষ ক্রয় প্রক্রিয়া বাতিল করতে বাধ্য হয়।
কিন্তু এই অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে দৃশ্যত কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এই অনিয়ম আর বিব্রতকর বইকেনার তালিকায় এমন একজন লেখক ও প্রকাশকের বই অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, যিনি আদতে কোন লেখক নন। এক সময় তিনি শাহবাগে রাস্তায় বসে খবরের কাগজ বিক্রি করতেন। তাতে দোষের কিছু নাই। পরে তিনি নানা ক্ষমতাবান আমলা আর রাজনীতিক বুদ্ধিজীবীদের ছত্রছায়ায় বাম্পার ধনবান প্রকাশকে পরিণত হন। যার বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। যা খবরের শিরোনাম পর্যন্ত হয়েছে। এমন একজন বিরল প্রতিভাধর (?) বঙ্গসন্তানের বইও বিতর্কিত তালিকায় স্থান পেয়েছিল।
সেই রেশ কাটতে না কাটতেই খবর এলো, একই কর্তৃপক্ষের আশীর্বাদে শাহেদ-পাপুল-পাপিয়া গোত্রের এক প্রতিভাধর, বেসরকারি টেলিভিশনের সাংবাদিকের ভূইফোড় দুই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে বিশ কোটি টাকার বই কেনার উদ্যোগ নিয়েছে; কোন রকম গ্রহণযোগ্য নিয়মনীতি না মেনে। শেষতক সংসদীয় কমিটি একটি তদন্ত কমিটি করেছে। আমাদের প্রতিষ্ঠানিক গলদ ও ঘাটতি কিছুটা বোধগম্য হলো বটে।
এবারে দক্ষিণ ঢাকার দুটো খবর নিয়ে কয়েকটি কথা বলে লেখাটি শেষ করতে চাই। প্রথম খবরটি হলো কুকুরের জন্ম নিয়ন্ত্রণ ও টিকাদান কর্মসূচিতে ব্যর্থ হয়ে নগর সংস্থা কয়েক হাজার কুকুরকে কেমনে কোথায় খেদাবে তা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। কোটি লোকের শহরে কয়েক হাজার কুকুরের কিংবা ফেরারি কুকুরের থাকার কী অধিকার নাই? একটি লোকালয় সার্থক ও সুন্দর জনপদ তখনই যখন প্রাণ-পাখি-প্রকৃতি-বৃক্ষ ও মানুষ একে অপরের পরিপূরক ও বান্ধব হয়ে বাস করে। আমরা সেই বাস্তবতা আর কল্পনা থেকে কত যোজন মাইল দূরে?
এই প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে ভাবতে বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকমে কাজী মোবারক হোসেনের ঢাকার বাংলাবাজারে ঐতিহ্যবাহী বিউটি বোর্ডিং নিয়ে 'আর কি প্রাণ ফিরবে বিউটি বোর্ডিংয়ে', শিরোনামের প্রতিবেদন পড়ে মনটা ভারী হয়ে গেল। যে বিউটি বোর্ডিং-এ রাজনীতিবিদ, লেখক, সাংবাদিক, শিল্পীসহ নানা পেশার ও নেশার মানুষের ভিড়ের ইতিহাস হয়েছে। আজ তার অস্তিত্ব হুমকির মুখে, তাও আবার স্বাধীনতার পাঁচ দশকে এসে। এখানে যারা আসতেন তাদের মধ্যে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, কবি শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, পল্লীকবি জসীম উদ্দীন, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, চলচ্চিত্রকার আবদুল জব্বার খান, কবি ফজল শাহাবুদ্দিন, কবি শহীদ কাদরী, আহমদ ছফা, সুরকার সমর দাশসহ অনেকে। বাঙালির শিল্পসাহিত্যের এমন এক ঐতিহ্য দখলের হুমকিতে থেকে কিভাবে তার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবে? আমার আম আদমী মাথায় কয়েকটা ভাবনা কাজ করছে।
প্রথমটা হতে পারে মুজিববর্ষে ঢাকা দক্ষিণ নগর সংস্থা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরকে সঙ্গে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের প্রয়োজনে ঢাকার যে সকল এলাকায় থেকেছেন নানা কর্মযজ্ঞের জন্যে বিচরণ করেছেন সেসব চিহ্নিত করে একটা ডিজিটাল মানচিত্র তৈরি করা। সেই মানচিত্র ধরে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিবিজড়িত স্থাপনাগুলো রক্ষা করার নিমিত্তে ডিজিটাল কর্মসূচি হাতে নেয়া।
এটা হতে পারে বিউটি বোর্ডিংকে লেখক জাদুঘর হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষে বর্তমান মালিকদের সঙ্গে সমন্বিত ব্যবস্থাপনায় বোর্ডিং এবং হোটেল ব্যবস্থা চালু রেখেই সংস্কার আর আকর্ষণীয় করা। সেই ক্ষেত্রে নিকটবর্তী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও এই নতুন সংস্কার পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। বিউটি বোর্ডিং সংস্কারের পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটিকে অতিথিশালা হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ নিতে পারে। সেই সঙ্গে এখানে নিয়মিত প্রতি সন্ধ্যায় সাহিত্য সংস্কৃতির নানা আয়োজনের ব্যবস্থাও করা যায়। মোটকথা ভাবতে হবে ইতিবাচক ভাবে, সৃজনশীল মনোভাব আর মানবিক কল্পনাশক্তি দিয়ে।
দুনিয়ার অনেক দেশে লেখক জাদুঘর থাকলেও আমাদের কেন নাই? যে নগরে কবির চেয়ে কাকের সংখ্যা বেশি সে নগরে বিউটি বোর্ডিংকে বাঁচাতেই হবে। এতে আমাদের সমূহ অনেক লাভ হতে পারে। তাইওয়ানের সাহিত্য জাদুঘরের কথা প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়।
আপনারা অনেকে জেনে থাকবেন দুনিয়ার ৩৯টি নগর ইউনেস্কো সৃজনশীল সাহিত্যনগরী মর্যাদা পেয়েছে। এই তালিকায় যদি যুদ্ধবিধস্ত ইরাকের বাগদাদ জায়গা করে নিতে পারে, বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষে এবং স্বাধীনতায় পাঁচ দশকে আমরা কি আলোচনাটাও শুরু করতে পারব না? আর এই আলোচনা শুরু হলে আমাদের গ্রন্থাগার ব্যবস্থা, বইয়ের দোকানের হালহকিকত, বিউটি বোর্ডিং-এর মতো ঐতিহ্যগুলোর দিকে নজর ফেরানো আর জাতির পথ দেখানো মনীষীদের স্মৃতিবিজড়িত স্থাপনার রক্ষণাবেক্ষণের প্রয়োজনীয় তাগিদ অনুভব করতে পারব। তাতে আমাদের কুকুর খেদানো নগর কর্তৃপক্ষ বিউটি বোর্ডিং রক্ষায় ফুরসৎ পেতে পারে। আমরাও ঢাকাকে ইউনেস্কো সৃজনশীল সাহিত্যনগরীর মর্যাদায় দেখে ধন্য হতে পারি।
এই মর্যাদা পেতে হলে নগর কর্তৃপক্ষকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সাহায্য নিয়ে ইউনেস্কো সদর দফতের আবেদন করতে হবে। যে নগরে বিউটি বোর্ডিং-এর মত স্থাপনা বইয়ের জগৎ বাংলাবাজার, অমর একুশে গ্রন্থমেলা, শতশত প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান, সাহিত্যের নানা উৎসব, বাংলা একাডেমি, শিশু একাডেমিসহ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মতো প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেই নগরের কর্তৃপক্ষ কেন ইউনেস্কো সৃজনশীল সাহিত্য নগরীর স্বীকৃতির জন্যে কেন উদ্যোগ নেবে না?
এই সৃজনশীল সাহিত্যনগরীর কর্মসূচির অধীনে শহরগুলো পরস্পরের সঙ্গে সাহিত্য বিনিময়ের দারুণ এক সুযোগ কাজে লাগাতে পারে। আমাদের মশা মারার এবং কুকুর খেদানোর নগর কর্তৃপক্ষ কী চেষ্টা করে দেখবে না?