Published : 25 Jul 2020, 06:10 PM
পূর্বকথা
বর্তমানে শিক্ষা জগতের অন্যতম আলোচিত বিষয় হলো― পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি/পদোন্নয়নে প্রচলিত নিয়োগ প্রক্রিয়া। ২২ জানুয়ারি ২০১৮ তারিখে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন, তার ওয়েবসাইটে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি/পদোন্নয়ন অভিন্ন নীতিমালা-শীর্ষক একটি দলিল প্রকাশ করে। এই নীতিমালাটি প্রকাশিত হওয়ার পর, শিক্ষকদের একটি অংশ ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। এবং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমাজে এই নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা ও পর্যালোচনা। যদিও করোনাভাইরাস অতিমারীর বিস্তৃতির কারণে এই আলোচনা স্তিমিত হয়েছে, ভিতরে ভিতরে এই নিয়ে পর্যালোচনা অব্যাহত রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল একটি অংশ মনে করেন যে, আমলাগণ এই নীতিমালা তৈরি করেছেন এবং তারা এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের মর্যাদা, ক্ষমতা ও পারিতোষিকের ওপর হাত দিয়েছেন। অনেকে এই নীতিমালা তৈরিতে আমলাদের নাক গলানো নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে বিষোদাগার করছেন।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের নিয়োগ ও পদোন্নতি নীতিমালা নিয়ে জনগণের মধ্যেও কৌতুহল রয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই ফৌজ, আমলা অথবা খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের মধ্যেও এ নিয়ে কৌতুহল রয়েছে। এ বিষয়ে কৌতুহল থাকা খুবই স্বাভাবিক। কারণ শিক্ষকদের পদোন্নতির ব্যাপারটি যদি অস্বচ্ছ হয় অথবা দোষযুক্ত হয়, তাহলে শুধু যে শিক্ষক সমাজই ভোগান্তির শিকার হবে তা নয় বরং সারা জাতিই ভোগান্তির শিকার হবে। তারা মনে করেন যে, একজন শিক্ষক তার যোগ্যতা অনুযায়ী মর্যাদা, ক্ষমতা ও পারিতোষিক পাবে, সেটা তার অধিকার। কিন্তু শিক্ষক পদোন্নতির নীতিমালা এমন হওয়া উচিত নয় যে, সেই নীতিমালার ফাঁকফোকরে যে কেউ অধ্যাপক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হবে। কারণ একজন অধ্যাপক একটি প্রতিষ্ঠান, একটি জাতির পথপ্রদর্শক ও সর্বোপরি আলোকবর্তিকা বিশেষ। কিন্তু পদোন্নতির নীতিমালার শৈথল্যের কারণে যদি কেউ অধ্যাপক সমাজের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং তার জ্ঞানদীপ্তির মাত্রা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে; তখন বুঝতে হবে একজন আমলা অথবা একজন খেটে খাওয়া সাধারণ নাগরিক শুধু একজন অধ্যাপকের মর্যাদা, ক্ষমতা ও পারিতোষিক নিয়েই প্রশ্ন তুলছেন তা নয় বরং তিনি একটি জাতির বিবেককেই প্রশ্ন করছেন এবং একটি বিশৃঙ্খল উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কেই প্রশ্ন তুলছেন।
নিয়োগ ও পদোন্নতি নীতিমালার চালচিত্র ও বিভিন্ন ধন্দ
শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতিতে যে নীতিমালা বিদ্যমান রয়েছে তা সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ নিয়োগ ও পদোন্নতিতে সহায়ক নয়। কারণ এই নীতিমালা পাশ কাঁটানোর নানা কৌশল রয়েছে, যাকে আমরা নিয়োগ-পদোন্নতি প্রকৌশল (requirement-promotion engineering) বলে অভিহিত করতে পারি। এই নিয়োগ-পদোন্নতি প্রকৌশলটি হলো মূলত নিয়োগ-পদোন্নতির শর্ত, যেমন প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও প্রকাশনা ফাঁকি দেওয়ার অপকৌশল বিশেষ। এই নিয়োগ-পদোন্নতি প্রকৌশল নতুন নিয়োগের ক্ষেত্রে যেভাবে কাজে লাগানো হয়, তা হলো—প্রভাবশালী রাজনীতিবিদের প্রভাব খাটিয়ে ও ত্রুটিপূর্ণ নিয়োগ পরীক্ষা পদ্ধতির ব্যবহার করে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। আর নিয়োগ-পদোন্নতি প্রকৌশল পদোন্নতির ক্ষেত্রে তিনভাবে কাজে লাগানো হয়। প্রথমটি হলো, শূন্য পদ ব্যবহার করে অযোগ্য ব্যক্তিকে পদোন্নতির ব্যবস্থা করা। এই পদ্ধতিতে কোনো পদ শূন্য হলে প্রয়োজনীয় প্রকাশনা না থাকলেও, ইপ্সিত ব্যক্তিকে সে পদে নিয়োগ ও পদোন্নতি দেওয়া হয়। দ্বিতীয়টি হলো, প্রশাসনিক পদের অভিজ্ঞতাকে প্রকাশনার সমান গুরুত্ব দেওয়া। আর তৃতীয় পদ্ধতিটি হলো, প্রশাসনিক বা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অথবা কুম্ভীলক বৃত্তির মাধ্যমে প্রকাশনা তৈরি করা এবং সেই মানহীন প্রকাশনাকে নিয়োগ ও পদোন্নতির কাজে ব্যবহার করা।
নিয়োগ-পদোন্নতি প্রকৌশল খাটিয়ে নিয়োগ ও পদোন্নতিপ্রাপ্ত শিক্ষকগণ জ্ঞানচর্চা রাজ্যে, তাদের মতো করে ইতোমধ্যে একটি রেওয়াজ চালু করেছে। এবং তাদের এই জ্ঞানান্ধতা ও অর্বাচীনতার প্রভাব এখন ব্যক্তি পর্যায়ে, শিক্ষাঙ্গনে, জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানে ও বৃহত্তর জাতীয় পর্যায়ে নানা দৃশ্যপটে প্রতিফলিত হচ্ছে। তারা জ্ঞানচর্চা ও গবেষণায় ব্যপৃত শিক্ষকদের মধ্যে একটি অদৃশ্য দেয়াল তৈরি করে তাদের প্রাধান্য বজায় রাখতে সচেষ্ট থাকে এবং প্রশাসনিক পদে অধিষ্ঠিত হতে আগ্রহী থাকে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে জ্ঞানচর্চার বিষয়টি পাশ কাঁটাতে চেষ্টা করে। তার প্রতিফলন দেখা যায় তাদের লেখায়। তাদের লেখায় কতকগুলো ত্রুটি ধরা পড়ে। একটি গবেষণা সন্দর্ভের ভাষা ও গঠন সাধারণের জন্য লেখা নিবন্ধের চেয়ে ভিন্নতর হয়, কারণ এতে শাস্ত্রীয় জ্ঞানের পরিভাষা ব্যবহার করা হয় এবং এতে গবেষণার লক্ষ্য, কল্পানুমান, পদ্ধতি, তথ্য/উপাত্ত বিশ্লেষণ ও উপসংহার ইত্যাদি অংশ সন্নিবেশিত থাকে। অথচ পদোন্নতি প্রকৌশলে পদোন্নতিপ্রাপ্ত শিক্ষকদের লেখা বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে একটি পত্রিকার নিবন্ধের মতো হয়ে থাকে। একটি গবেষণা সন্দর্ভ একজন শিক্ষকের মেধা, মননশীলতা ও অধ্যবসায়ের প্রতিফলন বিশেষ। গবেষণা সন্দর্ভ রচনার মাধ্যমে নিজের চিন্তা ও মননশীলতা শানিত হয়, যার প্রতিফলন শ্রেণিকক্ষের বক্তৃতায়, জ্ঞানগর্ভ আলোচনায় ও শিক্ষার্থীদের পরিচালনায় দেখা যায়। কিন্তু এতসব পদোন্নতি প্রকৌশল প্রয়োগ করে পদোন্নতি প্রাপ্ত শিক্ষকদের মননশীলতা ও জ্ঞানদীপ্তি প্রাথমিক পর্যায়ের রয়ে যায়। মননশীলতা ও জ্ঞানদীপ্তির এই অসম্পূর্ণতা সামাজিক ও রাজনৈতিক পর্যায়েও প্রতিফলিত হয়। তারা বৃহত্তর কোনো সামাজিক সমস্যা সমাধানে একজন সাধারণ শিক্ষিত অথবা একজন সাংবাদিকের মতো কথা বলে থাকেন। তাদের মধ্যে দেশখ্যাত কলাম লেখকগণও আছেন। জনগণ ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে না যে, এসব কলাম লেখক বুদ্ধিজীবীগণ বিশ্ববিদ্যালয়ে তার জন্য প্রযোজ্য গবেষণাটি করছেন না বা সে বিষয়ে তার কোনো গবেষণা সন্দর্ভ নেই।
পদোন্নতি প্রকৌশলের সৃষ্টি জ্ঞানান্ধতার এই প্রতিফলন জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানেও পরিদৃষ্ট হতে দেখা যাচ্ছে। বিশ্বের বিভিন্ন জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান গবেষণা ও উদ্ভানের প্রাণকেন্দ্র হিসাবে গড়ে ওঠে। দেশের মানুষের কাছে সেসব জাতীয় প্রতিষ্ঠান আশা-আকাঙ্খার প্রতীক হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশে এসব প্রতিষ্ঠানকে একটি সাধারণ অফিস ঘরের বাইরে আর কিছু মনে হয় না। এ ধরনের জাতীয় প্রতিষ্ঠানের মধ্যে অন্যতম হলো-বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল এন্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ, পরামাণু শক্তি কমিশন, বাংলা একাডেমি ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট। এসব অফিসে গেলে মনে হয় নির্জীব এক জগতে প্রবেশ করেছি। কিন্ত উন্নত দেশে এ ধরনের জাতীয় প্রতিষ্ঠানে জাতির বর্তমান ও ভবিষ্যত নিয়ে গবেষণা ও পর্যালোচনা হয়ে থাকে। এ সব প্রতিষ্ঠান থেকে জাতির ভবিষ্যত নির্মাণের স্বপ্ন দেখানো হয়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোর এই যে নির্জীব অবস্থা বিরাজিত রয়েছে, তা মূলত বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থায় যে জ্ঞানান্ধতার আবহ তৈরি করা হয়েছে তারই প্রতিফলন বিশেষ।
স্বায়ত্বশাসিত শিক্ষা প্রশাসন বনাম স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা
উপরের আলোচনা থেকে একথা স্পষ্ট হয়েছে যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানচর্চা ও গবেষণা কার্যক্রমের বিপর্যয় ঘটেছে এবং শিক্ষার মানে অধোগতি চলছে। নতুন স্থাপিত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ শুরুই হয়েছে জ্ঞানচর্চা ও গবেষণা কার্যক্রমের বিপর্যয় দিয়ে।
কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থায় বিপর্যয় রোধে শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতি প্রক্রিয়াটি এমন স্বচ্ছ হওয়া উচিত যেন শুধু মেধাবী, অধ্যাবসায়ী ও জ্ঞানদীপ্ত শিক্ষকরাই পদোন্নতি পায়। আর কোনো কারণে নীতিমালা পাশ কাঁটিয়ে নিয়োগ ও পদোন্নতিপ্রাপ্তরা ধরা পড়লে যেন পদোবনমনের মতো শাস্তি পায়। সেজন্য স্বায়ত্বশাসনের অপব্যবহার করে অধ্যাপক বানানোর প্রক্রিয়াটিকে জবাবদিহিতায় আনা প্রয়োজন। আর তা করতে হলে, নিয়োগ ও পদোন্নতি প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করা হলে নিয়োগ বা পদোন্নতির বিষয়টি বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন পর্যায়ে নিশ্চিতকরণের ব্যবস্থা প্রবর্তন করা প্রয়োজন। বর্তমানে স্বায়ত্ত্বশাসনকে অপব্যবহার করে নিয়োগ-পদোন্নতি প্রকৌশলীগণ শিক্ষা প্রশাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে রয়েছেন, তারা এখন নিজেদের প্রাধান্য বজায় রাখতে সচেষ্ট। আর যারা জ্ঞানান্বেষণী ও আলোকিত শিক্ষক, যারা জ্ঞানচর্চা-গবেষণায় আগ্রহী; তারা নিজেরা যেমন জ্ঞানদীপ্ত হয়ে উঠতে সর্বদা সচেষ্ট, তেমনিভাবে শিক্ষার্থীদেরকেও জ্ঞানদীপ্ত হিসাবে গড়ে তুলতে সচেষ্ট থাকেন। কিন্তু এই ঘরাণার শিক্ষকগণ শিক্ষা প্রশাসনের কাছে জিম্মি থাকেন। তারা তাদের অধ্যবসায়ের ফসল থেকে বঞ্চিত হন। তারা শিক্ষাপ্রশাসন থেকে যেমন মূল্যায়ন পান না, তেমনি সরকারের নিকট থেকেও কোনো মূল্যায়ন পান না। কারণ জ্ঞানবিমুখ শিক্ষা প্রশাসন তাদের গুরুত্বটা সরকারের কাছে পৌঁছাতে দেয় না। ফলশ্রুতিতে শিক্ষা-গবেষণায় অধিকতর অবদান রেখেও, তারা প্রশাসনে অধিষ্ঠিত অযোগ্য শিক্ষকদের সমান মর্যাদা, ক্ষমতা ও পারিতোষিক পান না।
উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থাকে এখান থেকে উঠে দাঁড়াতে হলে, শুধু নীতিমালা দিয়ে এখন আর কিছু হবে না। এখন প্রয়োজন বৈপ্লবিক পরিবর্তন। আর বৈপ্লবিক পরিবর্তন সংঘটিত করতে প্রয়োজন জ্ঞানদীপ্ত অধ্যাপকদের সমন্বয়ে গঠিত একটি পর্ষদ। এ প্রসঙ্গে এখানে অন্য একটি বিষয়ের অবতারণা করছি। আমরা হাল আমলে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা অথবা প্রকৃত রাজাকারদের তালিকা প্রণয়নের কথা শুনেছি। বৈপ্লবিক পরিবর্তন যখন লক্ষ্য হবে তখন অনুরূপভাবে প্রকৃত অধ্যাপকের তালিকা প্রস্তুত করা যেতে পারে। তালিকায় উঠে আসা জ্ঞানদীপ্ত শিক্ষকদের সমন্বয়ে গঠিত পর্ষদ বাংলাদেশে একটি (কমপক্ষে) বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনে ও জাতীয় গবেষণামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোকে গবেষণার প্রাণকেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলতে কাজ করবে।
শেষকথা
বাংলাদেশে বিরাজিত বর্তমান উচ্চশিক্ষা সংশ্রয় দিয়ে দেশ ও জাতি কোনোভাবেই এগুতে পারবে না। সেজন্য এই ব্যবস্থার সংস্কার ও উন্নয়ন করা প্রয়োজন। এই জ্ঞানবিমূখ শ্রেণির ছোঁয়ায় শিক্ষাঙ্গনে জ্ঞানচর্চার প্রক্রিয়াটি ব্যহত হচ্ছে, ফলে দেশে জ্ঞানদীপ্ত জনগোষ্ঠি গড়ে উঠছে না। ফলশ্রুতিতে দেশ ও সমাজের নানা স্তরে এই জ্ঞানান্ধতার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। জাতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো গভীর ঝিমুনিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। এই অবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে যা প্রয়োজন, তা হলো জ্ঞানদীপ্ত অধ্যাপকদের প্রয়াস ও জাতীয় পর্যায়ের নেতৃত্ব।