Published : 07 Jul 2020, 10:50 PM
মহাত্মা গান্ধী তার অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বিষয়ক লেখায় সমগ্র ভারতবর্ষের (ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ) অর্থনৈতিক কাঠামো গঠন ও উন্নয়ন বিষয়ে সবসময়ই গ্রামীণ অর্থনীতিকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এমনকি তার প্রযুক্তির চিন্তাও গ্রামীণ কাঠামোর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে। গ্রামকে অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু না হোক, অর্থনীতির একটা বড় কেন্দ্র ধরেই তিনি এই এলাকার অর্থনীতি এগিয়ে নেওয়ার বিষয়েই নানান পরিকল্পনা দিয়েছেন। এমনকি বড় বড় প্রযুক্তিগুলোকে ছোট আকারে এনে আমাদের গ্রামগুলো ও গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে তৈরি করার জন্যেই প্রযুক্তিবিদদের পরামর্শ দিয়েছিলেন বিভিন্ন সময়। গান্ধীর জন্মের দেড়শ বর্ষে এসে ভারতে গান্ধীবাদী প্রযুক্তিবিদ রঘুনাথ এ মসলকার বর্তমান ভারতসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে গান্ধীর এই প্রযুক্তি চিন্তা গ্রহণ করার জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ লেখা লেখেন। অন্যদিকে, গত প্রায় সত্তর বছর যাবৎ সারা পৃথিবীর গান্ধীবাদী অর্থনীতিবিদরা সবসময়ই গান্ধীর অর্থনৈতিক চিন্তা চেতনার পক্ষে প্রচুর লেখালেখি করেছেন। গান্ধীবাদী অর্থনীতিবিদ অম্লান দত্ত বাংলা ভাষায় গান্ধীর এই অর্থনৈতিক চিন্তা নিয়ে সারাজীবনই লেখালেখি করে গেছেন। তিনি সবসময়ই দরিদ্র এবং জনঘনত্বপূর্ণ দেশগুলোকে গান্ধীর অর্থনৈতিক চিন্তা গ্রহণের জন্যই বলতেন।
রঘুনাথ এ মসলকারের 'গান্ধীয়ান ইঞ্জিনিয়ারিং' শিরোনামে লেখাটি কয়েকমাস আগে প্রকাশিত হয়। তার লেখাটি পড়ার মাস দুয়েক পরেই আফ্রিকার একটি দেশের একটা সত্য ঘটনা নিয়ে চলচ্চিত্র 'দ্য বয় হু হার্নেস্ট দ্য উইন্ড' দেখি। ওই চলচ্চিত্রের মূল ঘটনা হলো- আফ্রিকার এক কিশোর একটি বাইসাইকেলের চাকা ও সাইকেলের লাইট জ্বালানো ডাইনামো দিয়ে একটি কাঠের তৈরি উইন্ড মিল বানিয়ে তার গ্রামকে খরা থেকে রক্ষা করে। সিনেমাটি দেখতে দেখতে আমার রঘুনাথ এ মসলকারের গান্ধীর প্রযুক্তি চিন্তার কথাই মনে পড়ছিল। গান্ধীর প্রযুক্তি চিন্তার অনেক বাস্তবায়ন ভারতের ছোট ছোট শহরগুলোয়ও দেখতে পাই। যেমন- তারা ছোট একটা ফ্লাটের জন্য খুব সহজ প্রযুক্তিতে ছোট একটা লিফট তৈরি করে নেয়। এমনকি কোন কোন এলাকায় এত সহজ কিছু ডোর বেল দেখেছি যা দেখে অনেক সময় হাসিরও উপক্রম হয়েছে।
গান্ধীর এই অর্থনীতি চিন্তার কাছাকাছি অর্থনীতির চিন্তা আগেই করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের অর্থনীতি চর্চা আমাদের বাংলাদেশে বেশ পরিচিত। আশির দশকে অধ্যাপক সনৎ কুমার সাহা রবীন্দ্রনাথের অর্থনীতি চিন্তা নিয়ে বেশ কয়েকটি চমৎকার লেখা লিখেছিলেন। তবে সত্য, বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের অর্থনৈতিক চিন্তাকে অনেকটাই এককভাবে পরিচিত করেছেন অর্থনীতিবিদ ও সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান। তিনি বাংলাদেশের টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে গ্রাম পর্যায়ে রবীন্দ্রনাথের অর্থনৈতিক চিন্তা বাস্তবায়নের জন্য গত কয়েক দশক ধরেই এককভাবে লেখালেখি করে আসছেন।
তবে এর পরেও সত্য হলো, গান্ধী বা রবীন্দ্রনাথের অর্থনৈতিক চিন্তা নিয়ে গান্ধীবাদী ও রবীন্দ্রভক্ত অর্থনীতিবিদরা গত ছয়-সাত দশকে রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে খুব প্রভাব ফেলতে পারেননি। এমনকি দেশের মূল ধারার অর্থনৈতিক চিন্তা চেতনার ক্ষেত্রেও তারা স্থান গেড়ে বসতে পারেননি। এর মূল কারণ এই উপমহাদেশের তিনটি দেশ ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ যতই দরিদ্র, জনঘনত্বপূর্ণ এবং গ্রামনির্ভর দেশ হোক না কেন এখানে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সবথেকে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে শহর কেন্দ্রিক শিল্প। এখানে সবসময়ই পশ্চিমা দেশগুলোকে অনুসরণ করে বড় বড় শিল্পের কথা চিন্তা করা হয়েছে। এমনকি শ্রমিক নির্ভর গার্মেন্টস শিল্পের মত যে শিল্প গড়ে উঠেছে সেগুলোকেও গ্রামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে স্থাপন করার কৌশল নেওয়া হয়নি। বরং গ্রাম থেকে শ্রমিক শহরে এনে বড় শিল্পের স্টাইলে শহরকেন্দ্রিক করা হয়েছে। আর অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে সবসময়ই টেকসই অর্থনীতি গড়তে শহরকেন্দ্রিক শিল্প গড়ে তোলার দিকেই নজর দেওয়া হয়েছে।
যারা গত সাত দশক ধরেই গান্ধীবাদী বা রবীন্দ্রনাথের অর্থনৈতিক চিন্তাধারার পক্ষে কথা বলছেন তারা আসলে কখনোই রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারকদের খুব বেশি আকর্ষণ করতে পারেননি। এই গত সাত দশকে বিভিন্ন সময়ে অনেক বড় মাপের অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারকগণ, এমনকি আমাদের মত সাংবাদিকরাও খুব বেশি তাদের দ্বারা প্রভাবিত হইনি। বরং রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারকদের চিন্তা চেতনার সাথে মিল রেখে আমরাও পশ্চিমা অর্থনীতির ধারাকে ভারতীয় উপমহাদেশের মতো জনঘনত্বপূর্ণ দরিদ্র এলাকার উন্নয়নের মডেল মনে করেছি। কখনো কখনো সরাসরি না হলেও গান্ধীয়ান অর্থনৈতিক চিন্তা বা রবীন্দ্রনাথের অর্থনৈতিক চিন্তাকে একটু অতীতমুখী বলা হয়েছে। আবার অন্যদিকে এটাও সত্য এই উপমহাদেশের মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেছে গ্রাম; তারপরেও প্রতিটি গ্রামেই একটা শহরমুখী স্রোত আছে। যে কারণে এখানে শহরগুলোতে বস্তি গড়ে উঠে শহরের সস্তা শ্রমের একটি বাজার হয়। কিন্তু ওই শ্রম গ্রামে বিনিয়োগ করলে সে বিনিয়োগ থেকে কি ফিরে আসে সেটা খুঁজে দেখা হয় না। বা সে বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করা হয়নি। এছাড়া আরো সত্য, গ্রামের যে গুরুত্ব আছে এটাও যেন মানুষের চিন্তা থেকে দূরে সরে গেছে। এবং সেটা এমন পর্যায়ে গেছে যে গ্রামের জনপ্রতিনিধিরাও এখন নিজেদেরকে শহরকেন্দ্রিক করে ফেলেছে। এই যখন বাস্তবতা এমনি একটা সময়ে সবকিছু হঠাৎ করে বদলে দিল কোভিড-১৯ বিশ্ব মহামারি। বাস্তবে কোনও মহাদুর্যোগ যে এমন করে সত্যকে টেনে বের করে আনে তা এই বিশ্ব মহামারী আসার আগে কোনমতেই বোঝার উপায় ছিল না। করোনাভাইরাস সংক্রমণের এই চার মাসের আঘাতেই ইতিমধ্যে শুধু ঢাকা নয় বাংলাদেশের নানান শহর ছেড়ে আর্থিকভাবে বাঁচার জন্য গ্রামের দিকে ছুটছে হাজার হাজার মানুষ। ভারতের বিভিন্ন শহর ও শহরতলীর অনেকেরই সঙ্গে কথা বলে যা ধারণা পাওয়া যায় সেখানেও একই অবস্থা। নিম্নমধ্যবিত্তরা শহর ছেড়ে গ্রামে যেতে চায়। পাকিস্তানের এক সাংবাদিক বন্ধুর সঙ্গে ভারত ও বাংলাদেশের এই অবস্থা নিয়ে কথা বলছিলাম। তিনি করাচির অধিবাসী। তিনি বললেন করাচিতেও এর ব্যতিক্রম হবে না। করোনাভাইরাসের এই আঘাতের ফলে অনেক মানুষকেই শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যেতে হবে।
এর থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট হয় গত কয়েক দশকের শহরকেন্দ্রিক উন্নয়ন সাধারণ মানুষের জন্য মোটেই টেকসই হয়নি। মাত্র চার মাসের ধাক্কাতেই তাদের শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যেতে হচ্ছে। এরপরে নিশ্চয়ই রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারকগণসহ সকলেরই অর্থনৈতিক চিন্তায় একটা বদল আনা অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। এই চার মাসের মহামারীতে স্পষ্ট হয়ে গেছে জনঘনত্বপূর্ণ দরিদ্র দেশকে গ্রামীণ অর্থনীতি উন্নয়ন করেই টেকসই উন্নয়ন করতে হবে। শহরের শততলা বিল্ডিং আর মেট্রোরেল এই ধরনের দেশগুলোর উন্নয়নের সবটুকু নয়। বাংলাদেশের সরকার ও দেশের নেতা শেখ হাসিনার আচরণ থেকে বোঝা যাচ্ছে তিনি কিছুটা হলেও বিশ্ব মহামারীর প্রায় শুরুতেই সেটা উপলব্ধি করেছেন। তিনি এবারের বাজেটে কৃষিখাতে সবমিলিয়ে প্রায় ২৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করেছেন। এছাড়া অনেক প্রকল্পকে গ্রামমুখী ঘুরিয়ে দিয়েছেন। এমনকি বঙ্গবন্ধু জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের সকল অর্থ তিনি দরিদ্র জনগোষ্ঠি ও গ্রামীণ উন্নয়নের খাতে নিয়ে গেছেন। এর থেকে বোঝা যায় করোনা পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক মন্দা কাটাতে এবং টেকসই অর্থনীতির দিকে এগোনোর ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির একটা বদল আসতে পারে। আর সেটা অনেকটা গান্ধীবাদী বা রবীন্দ্রনাথের অর্থনৈতিক চিন্তাধারায় গ্রামকে অর্থনীতির অন্যতম কেন্দ্র করা।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাকশাল নীতির অর্থনৈতিক চিন্তাধারার ওপর ওইভাবে লেখালেখি হয়নি ঠিকই তবে অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুশারফ হোসেন বাকশাল অর্থনীতি নিয়ে কয়েকটি লেখা লিখেছিলেন। তার ওই সব লেখা থেকে বোঝা যায় বঙ্গবন্ধুও গ্রামীণ অর্থনীতিকে টেকসই অর্থনীতির করার ক্ষেত্রে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তাই এই করোনাভাইরাস মহামারীর পরবর্তীতে ভারত ও পাকিস্তান গান্ধীর অর্থনৈতিক চিন্তা গ্রহণ করবে কিনা সেটা বলা যায় না। তবে আমরা অতি সহজেই ওই একই ধারার চিন্তা চেতনা অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধী থেকে বঙ্গবন্ধু যে টেকসই অর্থনীতির জন্য গ্রামীণ অর্থনীতির চিন্তা করেছেন সেটাকেই সহজে গ্রহণ করতে পারি।
রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে এই পরিবর্তন আনতে হলে অবশ্যই একটি কাঠামো দাঁড় করানো দরকার। বিশেষ করে একটি অর্থনৈতিক নীতি নির্ধারণী ফোরাম বা কমিটি যে নামেই হোক অবিলম্বে করা দরকার। যারা এই মুহূর্ত থেকেই এমন একটি কাঠামো বা রূপরেখা তৈরির কাজে নিয়োজিত হবেন। যে রূপরেখার মাধ্যমে দেশ গ্রামভিত্তিক টেকসই অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলতে পারবে। যে কাঠামোর অন্তত এই শক্তিগুলো থাকতে হবে, গ্রাম ছেড়ে ভবিষ্যতে মানুষকে শহরে এসে অসহায় হতে হবে না। দুর্যোগের আঘাতেই ট্রাকে তৈজসপত্র ভর্তি করে তাদেরকে গ্রামে ফিরতে হবে না। সর্বোপরি, গ্রামের ছেলে শিক্ষিত হয়ে সে ইচ্ছে করলে গ্রামেই কাজের মাধ্যমে উন্নত জীবন-যাপন করতে পারবে। বাংলাদেশের এই গ্রামভিত্তিক অর্থনৈতিক রূপরেখা তৈরীর জন্য কোন কোন অর্থনীতিবিদ যোগ্য সেটা সরকারই ভালো বুঝবেন। তবে একটা কথা বলা যায় যা আগেও উল্লেখ করেছি, বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতি নিয়ে চিন্তার ক্ষেত্রে এ মুহূর্তে অগ্রগণ্য ব্যক্তি অর্থনীতিবিদ ও সাবেক গভর্নর আতিউর রহমান। সরকার মনে করলে তার নেতৃত্বে এ কাজের যাত্রা শুরু করতে পারেন। তার অর্থনৈতিক লেখা ছাড়া এ মুহূর্তে বাংলাদেশের আর কারো লেখায় গ্রামভিত্তিক অর্থনীতি গড়ার তাগিদ অত বেশি দেখা যায় না। তাছাড়া এই কোভিড -১৯ কালে তিনি গ্রাম ও কৃষি অর্থনীতি নিয়ে অনেক প্রয়োজনীয় লেখা লিখেছেন। সব মিলিয়ে তিনি শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এ কাজ শুরু করলে হয়তো দেশ ভবিষ্যতের একটি সঠিক রূপরেখা পেতে পারে।