Published : 19 Jun 2020, 08:57 PM
ভারত ও নেপালের মধ্যে সীমানা চিহ্নিতকরণসহ বেশ কিছু ব্যাপারে সম্প্রতি খানিক মন কষাকষির সূত্রপাত ঘটেছে। এর পেছনে কোনও কোনও বহির্শক্তির ইন্ধন আছে কিনা সেটি খতিয়ে দেখতে ভারত নাকি ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়েছে। তার ভিত্তিতে ভারত দাবি করছে, চীন এ ক্ষেত্রে নেপালকে রীতিমত মদদ জোগাচ্ছে। উল্লেখ্য, সুদীর্ঘকালব্যাপী পারিবারিক বন্ধন ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে বিরাজমান নিবিড় সাদৃশ্য ভারত-নেপালের মধ্যকার সম্পর্ককে উত্তরোত্তর গভীরতর করে তোলে।
কিন্ত ইদানিং সেই সম্পর্কে ফাটল ধরার আলামত দেখা যাচ্ছে। ভারতের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ লিপুলেখ, কালাপানি ও লিম্পিয়াধুরাকে সন্নিবেশিত করে নেপাল সম্প্রতি নতুন মানচিত্র তৈরি ও সেটি অনুমোদন দেওয়ায় দুই দেশের মধ্যে তিক্ততা সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া, ভারত থেকে নেপালে গমনকারী অনেকের দেহে করোনাভাইরাস সংক্রমণের প্রমাণ পাওয়ায় নেপাল ভারতের উপর নাখোশ|
এ কথা সত্যি যে, ভারত-নেপাল সম্পর্কের অবনতি হলে বাংলাদেশ খানিকটা অসুবিধায় পড়বে। বাংলাদেশ ও নেপালের মধ্যে চমৎকার সম্পর্ক বিরাজ করলেও, ভারতের সঙ্গে নেপালের বিরোধ বৃদ্ধি পেলে সেই সম্পর্কের উপরও তার খানিক আছর পড়বে।
যেমন, প্রথমত- নেপালের কার্নালি জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ভারতের গ্রিড ব্যবহারের বাংলাদেশ মাধ্যমে যে ৯০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে তা বাধাগ্রস্ত হবে নিশ্চয়ই !
দ্বিতীয়ত, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উদ্যোগে ভারত-বাংলাদেশ-নেপালের মধ্যে যে রেল লাইন নির্মাণের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়েছে সেটিও নির্ঘাত আটকা পড়ে যাবে বৈকি! অন্যদিকে আবার, ভারতের পশ্চিম বাংলার শিলিগুঁড়ির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের লাঙ্গলবন্দ ও নেপালের কংকড়াভিটায় দুই দেশের জন্য অত্যন্ত লাভজনক যে স্থলবন্দর এবং তাৎপর্যপূর্ণ বাণিজ্য রুট হতে যাচ্ছে সেটির ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত হয়ে পড়ার আশংকা দেখা দেবে।
মোদ্দাকথা, ভারত ও নেপালের সম্পর্কের অবনতিতে বাংলাদেশের বিপুল বাণিজ্যিক সুযোগ হাতছাড়া হবার আশঙ্কা দেখা দেবে। ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও নেপাল উভয়েই বাণিজ্যিকভাবে যে লাভ অর্জন করতে সক্ষম তা ভেস্তে যাবে যদি ওই দুই দেশের (ভারত-নেপাল) সম্পর্কের অবনতি ঘটে। সুতরাং, এক্ষেত্রে প্রত্যেকেরই স্বার্থ সমুন্নত রাখার প্রয়োজনেই ওই সম্পর্ক যাতে অবনতি না হয়, সেদিকে বিশেষ নজর দেওয়া সংশ্লিষ্ট সকলের আশু কর্তব্য বলেই প্রতীয়মান হয়।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ জানাচ্ছে, চীনের ইন্ধনে ভারতের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক গড়ে তুলে নেপালের ক্ষতি বৈ লাভ হবে না। ভুললে চলবে না যে, চীন করোনা-উত্তরকালে নেপাল, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারে তার বাজার সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে এ জাতীয় কূটচালের আশ্রয় নিচ্ছে।
ভারত-নেপাল সম্পর্কের পটভূমি ও স্বরূপ
ভারত ও নেপালের মধ্যকার সম্পর্ক বহু প্রাচীন। ১৯৪৭ এ ভারত স্বাধীনতা লাভ করলে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরু দেশ দুইটির মধ্যকার বিদ্যমান সম্পর্ক বজায় রাখার উদ্দেশ্যে নেপালের অর্থনৈতিক উন্নয়নের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেন এবং ভারতীয় সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীতে নেপালিদের নিয়োগ অব্যাহত রাখেন। উল্লেখ্য, ভারতে নেপালিদের জন্য কোনও ওয়ার্ক পারমিটের প্রয়োজন পড়েনা। ১৩০ কোটি মানুষের আবাসভূমি ভারতে ৭০ লাখেরও বেশি নেপালি বসবাস করেন যা কিনা নেপালের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক তৃতীয়াংশ। নেপালের প্রতিরক্ষা বাহিনীতে নেপালিদের মোট সংখ্যা ৯০ হাজার আর ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৭টি গোর্খা রেজিমেন্টে ৪০ হাজারেরও বেশি নেপালি কর্মরত রয়েছে | তাছাড়া, ভারতীয় পুলিশ বাহিনীতেও বিপুল সংখ্যক নেপালি কাজ করছে। অবসরে ভারতীয় সেনারা যে পরিমাণ ভাতা ও অন্যান্য অর্থনৈতিক সুবিধা পায় নেপালি সেনাদের ক্ষেত্রেও তা একইভাবে প্রযোজ্য। ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত প্রায় ৮০ হাজার নেপালি সৈন্য বর্তমানে এই অবসরকালীন সুবিধাদি পাচ্ছেন। তাছাড়াও, যুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে প্রাণ হারানো ১১ হাজার নেপালি সেনার বিধবা পত্নীদের ভরণ-পোষণের দায়িত্বও ভারতীয় সেনাবাহিনী পালন করে চলেছে। আসাম রাইফেলসের ১৭ হাজার অবসরপ্রাপ্ত নেপালি সেনার দেখাশোনার ভার ভারতীয় সেনাবাহিনীর উপর ন্যস্ত রয়েছে। ভারতকে নেপালি নাগরিকদের অবসরকালীন ভাতা ইত্যাদি পরিশোধ করতে বছরে ১২ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করতে হয়। নেপালের বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন করতেও ভারতকে কোটি কোটি ডলার দিতে হয়।
আরও জানা যায় যে, বছরে তিন হাজার নেপালি শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য ভারতে আসেন আর ভারত সরকার তাদের পুরো ব্যয়ভার বহন করে থাকে। নেপালের শতকরা ৪০ শতাংশ বিনিয়োগ আসে ১৫০টি ভারতীয় কোম্পানির মাধ্যমে। ভারতে নেপালের রপ্তানির পরিমাণ গত ১৯৯৬ সালের তুলনায় ২০১৬-তে এসে ৬৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়। ১৯৯৬ সালে এই রপ্তানির পরিমান ছিল ২৩০ কোটি আর ২০১৬-তে তা দাঁড়ায় ৩ হাজার ৭০০ কোটি।
১৯৫০ সালে নেপালের সঙ্গে ভারতের মৈত্রী চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর ভারত অব্যাহতভাবে নেপালের অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে বিমানবন্দর, স্বাস্থ্য, শিক্ষা খাতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা দিয়ে আসছে। ২০১৮ সালে ভারত নেপালকে একশ কোটি ডলার সাহায্য দেওয়ার ঘোষণা দেয়। বিগত দিনগুলির খতিয়ান নিলে দেঝা যায় যে, ভারত এ অবধি কখনই নেপালের প্রতি কোন প্রকার আগ্রাসী বা বিরূপ আচরণ করেনি। ১৯৭১ এ পাকিস্তান যুদ্ধে পরাজিত হলে ভারতের বিরুদ্ধে এ অপপ্রচার চালানো হয় যে, এবার ভারত হিমালয় দুহিতা নেপালকেও দখল করে নেবে। কিন্ত, বাস্তবে ভারতের তরফ থেকে এমন কোনও ভূমিকা না দেখে পরে অপপ্রচারকারীরা নিরব হয়ে যায়।
ভারতীয় পক্ষে অভিযোগ করা হয়েছে যে, ১৯৫০ সালে নেপাল ও চীনের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার পর থেকে চীন, নেপালকে ভারতের বৈরীরূপে দাঁড় করাবার অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। ১৯৭১-এ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে চীন নেপালের গোর্খা সেনাদের ভারতীয় বাহিনীর পক্ষ হয়ে না লড়ার পরামর্শ দিয়েছিল বলেও জানা যায়। যাইহোক, এই পরিস্থিতে ওয়াকিবহাল মহলের মতে, ভারত-নেপাল বৈরিতা নেপালের জন্য অত্যন্ত প্রতিকূল হয়ে উঠতে পারে!