Published : 15 Jun 2020, 05:16 PM
''আমার করোনাভাইরাস পজিটিভ শনাক্ত হওয়ার পর থেকে গ্রামের মানুষ আমার পরিবারের লোকজনকে আলাদা করে দেয়। কেউ তাদের সাথে মেশে না। আমার এক বন্ধু আমাকে হাসপাতালে দূর থেকে দেখে যাওয়ার পর তার পরিবারের লোকজনের কাছেও তাকে নানা কথা শুনতে হয়েছে। আমার বন্ধুকে তার পরিবারের লোকেরা বলেছে, 'তুই করোনা রোগীকে দেখতে গেছিলি। তোরও করোনা হইছে। তুই বাড়িতে ঢুকিস না।' করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবার খবরে আমার অনেক বন্ধু আমার সাথে ফোনে কথা বলাও বন্ধ করে দেয়।" এই কথাগুলো ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কোভিড-১৯ এর আইসোলেশন ইউনিটের ভেতরে বলছিলেন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত সোহাগ হোসেন জয়। তিনি গাজীপুরে একটি গার্মেন্টসে কাজ করতেন।
করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর তার পরিবার নানাভাবে হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে জানান সোহাগ। সোহাগ বলেন, "গত ১৮ মে আমি গাজীপুর থেকে ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জে এসে সরাসরি সরকারি কোয়ারেন্টিনে উঠেছিলাম। এরপরে সেখানে করোনার নমুনা দিয়ে আমার রেজাল্ট না আসা পর্যন্ত সেখানেই থাকি। তিনদিন পর আমার করোনা রেজাল্ট পজিটিভ আসে। এরপর আমাকে হাসপাতালের আইসোলেশনে আনা হয়।''
তিনি বলেন, ''আমি তো বাড়িতেই ঢুকিনি। সরকারি কোয়ারেন্টিনে উঠেছিলাম। তারপরেও মানুষ নানা গুজব ছড়িয়েছে। এমনিতেই তো মানসিকভাবে আমার এবং পরিবারের লোকজনের অবস্থা ভালো ছিল না। মানুষজন সাত্ত্বনা না দিয়ে উল্টো আমাদের হয়রানি করেছে। আমি তো করোনা রোগী। সমাজের মানুষ আমার পরিবারকেও রোগী বানানোর চেষ্টা করেছে।''
সোহাগের মতো প্রায় একই রকম কথা জানিয়ে রায়হান আলী নামে আরও একজন করোনাভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি বলেন, ''আমিও ঢাকা থেকে এসে সরকারি কোয়ারেন্টিনে ছিলাম। এরপর নমুনা দেওয়ার পর করোনা ধরা পড়ে। আমার বাড়ির লোকজনও হয়রানির শিকার। এলাকার বেশ কয়েকজন আমার ছবি ফেইসবুকে দিয়ে আমার করোনা হয়েছে এটা ছড়িয়ে দেয়। আমার বাড়ি লকডাউন করে দেওয়ার কথাও কেউ কেউ তোলে। বাড়ি থেকে বের হতেও দেওয়া হয়নি আমাদের পরিবারের মানুষজনকে। আমার অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে কিছু মানুষ আমার পরিবারের লোকজনকেও মানসিকভাবে অসুস্থ করে দিয়েছে।''
সোহাগ ও রায়হান আমার করোনাকালের বন্ধু। আমি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে তাদের সাথেই ছিলাম আইসোলেশনে। এখানেই তাদের সাথে আমার পরিচয়-আলাপ। আইসোলেশনের ভেতরে গল্পে-গল্পে তারা তাদের এই হয়রানি কথা আমাকে জানায়।
আমাদের স্কুল জীবনে যেমন বন্ধু থাকে, তেমনি কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়েও বন্ধু থাকে। অনেক সময় কর্মস্থলেও নতুন নতুন মানুষের সাথে বন্ধুত্ব হয়। বন্ধুত্বে সম্পর্কটা গড়ে ওঠে একসঙ্গে বেশ কিছুদিন সময় চলার পর। আইসোলেশনের ভেতরেও আমার সাথে সাগর, রায়হান ও সোহাগের সাথে বন্ধুত্ব।
আমি আইসোলেশনে যেভাবে এলাম
গত ১৮ মে আমার শরীর থেকে নমুনা নিয়ে পরীক্ষার পর করোনাভাইরাসের অস্তিত্ব খুঁজে পান চিকিৎসকরা। আমাকে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হিসেবে ঘোষণা করা হয় ২১ মে। এরপর ২২ মে আমাকে হাসপাতালের আইসোলেশনে নেওয়া হয়। একটু পেছনের ঘটনাটা জেনে রাখা ভালো। আমি গত ১৭ মে ঢাকা থেকে মাইক্রোবাস যোগে আমার জেলা ঠাকুরগাঁওয়ে ফিরে সরাসরি সরকারি কোয়ারেন্টিনে উঠি। আমার সাথে আরও ৯জন ছিল। তারা প্রত্যেকে হোম কোয়োরেন্টিনে উঠলেও আমি যেহেতু গণমাধ্যমে কাজ করি, মানুষকে সচেতন করার কাজও করি। তাই পরিবারের সদস্যদের কথা চিন্তা করে সরকারি কোয়ারেন্টিনে থাকার সিদ্ধান্ত নিই। আমার মধ্যে করোনাভাইরাসের কোনো উপসর্গ ছিল না। কিন্তু আমি যেহেতু ঢাকা থেকে ফিরেছি এজন্য সরকারি কোয়ারেন্টিনে থেকে পরদিন করোনাভাইরাস পরীক্ষার নমুনা দিই। করোনাভাইরাস পরীক্ষার নমুনার রেজাল্ট না আসা পর্যন্ত সরকারি কোয়ারেন্টিনেই অবস্থান করি। এরপর ২১ মে করোনা পজিটিভ রেজাল্ট আসে আমার। ২২ মে অ্যাম্বুলেন্সে আমাকে নেওয়া হয় পীরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্খ্য কমপ্লেক্সের কোভিড-১৯ এর আইসোলেশন ওয়ার্ডের একটি কেবিনে।
করোনাকালের বন্ধুত্ব
আমার মধ্যে কোনো উপসর্গ নেই। অসুস্থতাও কাজ করছে না এইখানে আসার পর। তবে একাকিবোধ করছিলাম। আমার কেবিনের পাশে আরও দুই কেবিনের দুইজনকে বাইরে থেকে জানালা দিয়ে দেখলাম। তাদের সাথে পরিচিত হলাম। একজনের নাম বলল সাগর চৌধুরী, আরেকজনের নাম বলল রায়হান আলী। কথায় কথায় জানলাম তাদের মধ্যেও আমার মতো কোনো উপসর্গ নেই। তারপরেও করোনা পজিটিভ এসেছে। তারাও ঢাকা থেকে ফিরে সরকারি কোয়ারেন্টিনে উঠেছিল। এরপর নমুনা দেওয়ার পর করোনাভাইরাস পজিটিভ হিসেবে শনাক্ত হয়েছে। তাদের দেখে মনে হলো তারা শারিরীকভাবে সুস্থ হলেও মানসিকভাবে অসুস্থ হতে চলেছে। করোনায় মানুষের মৃত্যু তাদের কিছুটা দুঃশ্চিন্তায় ফেলেছে। এরপরে আমিও আমার কেবিনে চলে আসি। মানসিকভাবে আমারও অসুস্থতাবোধ শুরু হয়েছে। এদিকে আমার করোনাভাইরাস পজিটিভের খবর জানাজানি হওয়ার পর প্রথম দুই দিনে পরিবারের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু, সহকর্মীদের ফোন আমাকে অস্থির করে তোলে। সবাই আমাকে সাত্ত্বনা দিচ্ছে- ''আমার কিছু হবে না। সুস্থ হয়ে যাবে।'' আমিও তাদের বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে, ''আমি সুস্থ আছি। আমার কোনো সমস্যা নেই।'' কেউ কেউ তো ফোনে কান্নাকাটিও করল। করোনাভাইরাস পজিটিভের রেজাল্ট শোনার পরপরই আমি নিজেকে শক্ত করে নিয়েছিলাম। বিন্দুমাত্র ভয় আমার মধ্যে কাজ না করলেও উপসর্গ না থাকার বিষয়টা কিছুটা দুঃশ্চিন্তায় ফেলে। কয়েকজন চিকিৎসকের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, ৩০% থেকে ৪০% মানুষের মধ্যে কোনো উপসর্গ থাকবে না। আর আমার কোনো ভয় নেই, যেহেতু উপসর্গ নেই।
সাগর চৌধুরী এখানকার জ্যেষ্ঠ করোনাভাইরাস রোগী। কারণ তার ১৫ মে পজিটিভ রেজাল্ট আসে। আমার ২১ মে আর রায়হানের ২০ মে পজিটিভ শনাক্ত হয়। ২২ মে হাসপাতালে আসার পর ২৩ মে আমার আবার নমুনা নেওয়া হয়। আমার সাথে নমুনা দিল সাগর ও রায়হান। যেহেতু কারো উপসর্গ নেই তাই আবারও নমুনা নেওয়া হলো। ২৮ তারিখ রেজাল্ট জানাল, আমার আর রায়হানের আবারও করোনা পজিটিভ। তবে সাগরের নেগেটিভ। আমাদের সাথে এরমধ্যে ২৩ মে আরও একজন উপসর্গ ছাড়া করোনাভাইরাস পজিটিভ ব্যক্তি এখানে এসেছেন। তার নাম জানালেন সোহাগ। তিনি দুঃশ্চিন্তায় ভুগছিলেন। আমি তাকে আশ্বস্ত করলাম যে, কিছু হবে না। টেনশন করবেন না। সাগর আর রায়হানকেও বললাম তার ভয় দূর করার জন্য। আমাদের কথায় কিছুটা ভয় দূর হলো সোহাগের।
আমরা যেহেতু চারজনেই হয়রানির শিকার হয়েছি। তাই আমি ভাবলাম, আমরা সবাই মিলে এখানেই একটা শর্টফিল্ম বানাতে পারি। আমি তাদের সাথে এবার বিষয়টা শেয়ার করলাম। আমাদের সাথে প্রথম থেকে এখন পর্যন্ত যা যা ঘটেছে সেটাই আমরা শর্টফিল্মে তুলে ধরব। মোবাইল দিয়েই আমি ভিডিও ধারণ ও সম্পাদনা করলাম শর্টফিল্মটি। নাম দেওয়া হলো 'করোনা পজিটিভ'।
এবার আমরা শর্টফিল্মটি আমার ফেইসবুকে এবং ইউটিউব চ্যানেলে আপলোড করলাম। অনেক মানুষ আমাদের প্রশংসাও করল। শর্টফিল্মের মাধ্যমে আমরা বুঝাতে চেয়েছিলাম করোনাভাইরাস রোগীরাও যে মানুষ। তাদের সাথে মানুষের মতো আচরণ করতে হবে সেটা বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম।
আমরা চারজনে ইতোমধ্যে বন্ধু হয়ে গেছি। বাইরে খাবার দিয়ে গেলে একে অপরকে ডেকে বলি। দূরত্ব বজায় রেখে আড্ডা দিই ঘন্টার পর ঘন্টা। সন্ধ্যার পর আমাদের আড্ডা শুরু হতো আমাদের ইউনিটের বারান্দায়। কোনোদিন আমরা আমাদের জীবনে প্রেম-ভালোবাসার গল্প একে অপরকে শুনিয়েছি। গানের আড্ডাও দিয়েছি। রায়হান আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো গান পারে। তার গানের কণ্ঠ ভালো। ট্রুথ এন্ড ডিয়ার গেইমও খেলেছি। কৌতুক ও গানের সাথে নাচও করেছি। বলে রাখা ভালো, আমাদের হাসপাতালের আলাদা একটি ইউনিটে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়। শুধু তালা খুলে তিনবেলা খাবার রেখে যাওয়া হয়। পরে আমরা সেখান থেকে খাবার যে যার কেবিনে নিয়ে আসি। চিকিৎসকরা মাঝে মাঝে গেটের বাইরে থেকে এসে কথা বলে যান। তারা পিপিই পরে আসলেও আমাদের কাছে আসেননি। শরীরের তাপমাত্রাও মাপা হয়নি। আমরা নিজেরা মুখে মুখে যা বলতাম তাই শুনে চলে যান।
এর মধ্যে আমার, রায়হান, সাগরের করোনাভাইরাস রেজাল্ট নেগেটিভ এসেছে গত ৪ জুন। সাগরের পর পর দুইবার নেগেটিভ আসার কারণে সে ছাড়পত্র পেয়ে বিদায় নিয়েছে। তাকে বিদায় দেওয়ার আগে আমরা দূরত্ব বজায় রেখে নাচও করেছি।
আমি আর রায়হান আবার নমুনা পরীক্ষা দিয়ে নেগেটিভ আসায় আমাদেরও ছেড়ে দেওয়া হয়। সবমিলিয়ে আমরা মানসিকভাবে সুস্থ থাকার চেষ্টা করেছি। আমাদের কারো মধ্যে প্রথম থেকেই এখন পর্যন্ত উপসর্গ ছিল না। তবে সমাজের মানুষের দ্বারা গুজব উপসর্গে আমরা কিছুটা অসুস্থ ছিলাম। সমাজের মানুষেরা মানুষ হয়ে উঠুক। বিপদে মানুষের পাশে মানুষ দাঁড়াবে, এটাই আমরা চাই।
ছবি ও ভিডিও: লেখক