Published : 12 Jun 2020, 03:25 PM
এন্টিজেন, এন্টিবডি, প্লাজমা, আরটিপিসিআর, র্যাপিড টেস্ট কিট, ভেন্টিলেটর, লকডাউন, সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং ইত্যাদি পরিভাষা কোভিডকালে আমাদের দৈনিক শব্দ চয়নের অংশ হয়ে গেছে। কোভিড সংকট আমাদের চেতনায়, মানবিকতায় আর বিজ্ঞান সাংবাদিকতায় কতটুকু বিজ্ঞানমনস্কতার প্রলেপ লাগাতে পেরেছে জানা নেই, তবে লাইফ সায়েন্সের এই টার্মগুলো আমাদের মনে গেঁথে গেছে।
বাংলাদেশের মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচনায় এন্টিবডি, টেস্ট কিট টার্মগুলো অনেকটাই সেলিব্রেটি পর্যায়ে উন্নীত। আমাদের শরীর ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাসের মত বহিরাগত শত্রুর মোকাবিলায় প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করতে গিয়ে নিজে থেকেই কিছু সৈন্য তৈরি করে, এন্টিবডি হচ্ছে সেই সৈন্যদল। শত্রু নিধনে সৈন্যদলের বিভিন্ন গ্রুপের সক্ষমতা বিভিন্ন রকমের। এন্টিবডিগুলো মূলত প্রোটিন এবং এই প্রোটিনের জন্ম হচ্ছে প্রয়োজনে অর্থাৎ নির্দিষ্ট শত্রু/এন্টিজেনের উপস্থিতিতে শরীরের প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার সহজাত প্রতিক্রিয়া হিসেবে। প্রতিরক্ষামূলক আক্রমণে প্রথমে হাল্কা থেকে মাঝারী পরে তীব্র আক্রমণের জন্যে সৈন্য বিন্যাসের বিশেষ কৌশল থাকে। এন্টিজেন বা ভাইরাসের মত বহিরাগত শত্রুর মোকাবিলায় প্রথমে অ্যাকশনে যায় যে সৈন্যদল তারা ইম্যুনোগ্লোবিন M (IgM) নামক এন্টিবডি গোত্রের, যা ভাইরাসকে আটকে ফেলবার বা গ্রেফতারের চেষ্টা করে। সংক্রমণের প্রাথমিক পর্যায়ে এই চেষ্টার পর সপ্তাহখানেক গেলে আরো শক্তিশালী সৈন্যদল যারা ইম্যুনোগ্লোবিন G (IgG) নামক এন্টিবডি গোত্রের, তারা সাঁড়াশি আক্রমণ অর্থাৎ শত্রুকে শক্তভাবে বেঁধে ফেলবার মাধ্যমে খতম করার চেষ্টা করে। চেষ্টা সফল হলে রোগী ভাল হয়ে যায় এবং এই সব সৈনিক বা এন্টিবডির উপস্থিতি থেকে যায় রক্তে। এই এন্টিবডির উপস্থিতি থেকে জানা যায় সংক্রমণের ইতিহাস। স্থায়িত্ব বিভিন্ন রোগের বিভিন্ন রকম অর্থাৎ স্বল্প থেকে দীর্ঘমেয়াদী। তবে এন্টিবডির জন্ম আর কার্যকারিতা বেশ জটিল প্রক্রিয়া ফলে নতুন কোনো রোগের ক্ষেত্রে এর মেকানিজম বুঝতে হলে সময় সাপেক্ষ গবেষণার প্রয়োজন। পর্যাপ্ত তথ্য উপাত্তের অভাবে কোভিড-১৯ এর ক্ষেত্রে এন্টিবডি থেকে ইম্যুনিটি প্রাপ্তির বিষয়টিতে এখনো স্থির সিদ্ধান্তে আসার অবস্থা হয়নি। কোভিড সংকটে প্লাজপা থেরাপি নিয়ে আলোচনায় সম্প্রতি অনেকেই শুনে থাকবেন নিউট্রালাইজিং এন্টিবডির কথা। "টিট ফর ট্যাটের" মতই চিহ্নিত শত্রুরকে ধ্বংস করতে নির্দিষ্ট লক্ষ্যভেদী প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সৈন্যদের বলা হয় নিউট্রালাইজিং এন্টিবডি। এই এন্টিবডি জায়গামত বাইন্ড করে ভাইরাসটির সংক্রমণ সক্ষমতা নষ্ট করে দেয়, অনেকটা ডাইরেক্ট অ্যাকশনের মত। নিউট্রালাইজিং এন্টিবডির আধিক্য রোগ নিরাময়ে এবং প্লাজমা থেরাপিতে অন্যকে সুস্থ করতে মূল ভূমিকা পালন করে। নননিউট্রালাইজিং এন্টিবডি ভাইরাসকে আটকে ফেলে কিন্তু জায়গামত আটকাতে না পারার কারণে ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সরাসরি ভূমিকা নিতে পারে না। তবে নননিউট্রালাইজিং এন্টিবডি ভাইরাসটিকে আটকে ফেলে অনেক সময় ইমিউন সেলের কাছে ভাইরাসটি ধ্বংস করার অনুরোধের সিগন্যাল যায় এবং ইমিউন সেল এসে ভাইরাসকে ধ্বংস করে। আর কিছু এন্টিবডি আছে কোনো ভুমিকাই রাখে না। নিউট্রালাইজিং এন্টিবডির টেস্ট খুব ব্যয়বহুল আর সময় সাপেক্ষ, ফলে এন্টিবডি টেস্টের মূল ফলাফলটা সীমিত থাকে এন্টিবডি পজিটিভ না নেগেটিভ। পজিটিভ হলেও এর বিস্তারিত কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। সুতরাং দেখা যাচ্ছে এন্টিবডির মেকানিজম বেশ জটিল। এই জটিলতার কারণে এবং কোভিড সংকটে SARS-CoV-2 এর এন্টিবডি মেকানিজমটি সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের পরিষ্কার ধারণা না থাকায় দেশে দেশে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এন্টিবডি, প্লাজমা থেরাপি ইত্যাদি বিষয়ে যথেষ্ট সতর্ক এবং রক্ষণশীলতার সাথে মোকাবিল করছে। কোভিড এন্টিবডি টেস্টে "পজিটিভ বা নেগেটিভ" ফলাফলে অনেক অনিশ্চয়তা মূলত ফলস ফলাফলের আধিক্যজনিত কারণে। এই অনিশ্চয়তা কিন্তু স্থায়ী নয়, বিজ্ঞানকে সময় দিতে হবে অনিশ্চয়তা পেরিয়ে আশার আলো দেখাতে। প্রচুর গবেষণা হচ্ছে, আশা করা যাচ্ছে আগামীতে প্রচুর পিয়ার রিভিউড পাব্লিকেশনসহ অনেক তথ্য উপাত্ত নীতি নির্ধারণে ভূমিকা রাখবে।
এন্টিবডি টেস্টের অনিশ্চয়তা নিয়ে বৈশ্বিক চিত্রটি আপাতত হতাশাজনক। তাই বিশ্বের সকল দেশই একটি সিদ্ধান্তে স্থির যে রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে নিউক্লিক এসিড নির্ভর টেস্ট (আরটিপিসিআর) আর অন্যদিকে গবেষণা এবং পরিস্থিতি মূল্যায়নে সেরোলজিক্যাল বা এন্টিবডি টেস্ট। গবেষণা আর জরিপের কাজ ছাড়াও ভ্যাক্সিন উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এন্টিবডি টেস্ট গুরুত্বপূর্ণ। এই মুহূর্তে বিশ্বে শত শত প্রতিষ্ঠান এন্টিবডি টেস্ট কিট নিয়ে কোভিড যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত; শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই আছে এক শতেরও বেশি প্রতিষ্ঠান। যুক্তরাষ্ট্রে উপচে পড়া এন্টিবডি টেস্ট কোম্পানির মধ্যে কোনটি সঠিক বৈজ্ঞানিক তথ্য উপাত্তে যাচাই করা কঠিন আর এই অবস্থাকে এক ধরনের ওয়াইল্ড ওয়েস্টের সাথে তুলনা করছেন অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমিউনোলজির অধ্যাপক জেঙ্কো নিকোলিস জুগিচ।
এন্টিবডি টেস্টের বিষয়টি আপাতত খুব আকর্ষণীয়। স্বল্প পয়সায় একটু ব্লাড দিয়ে জানতে পারলেন আপনার কোভিড হয়েছে কিনা বা হয়েছিল কিনা। জানার পর আপনি মুক্ত বিহঙ্গের মত সমাজে মিশতে থাকলেন মাস্কসহ অন্যান্য প্রোটেকশন না নিয়ে। এই অবস্থাকে অনেকে বলেন ইমিউনিটি পাসপোর্ট। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আর বিশেষজ্ঞরা ইমিউনিটি পাসপোর্টের ভয়াবহ বিপদ নিয়ে ভীষণ উদ্বিগ্ন। একশত জনের একটি কর্মক্ষেত্রে যেমন হাসপাতাল ইত্যাদিতে, ইমিউনিটি পাসপোর্টধারী ৫ জন ঘুরে বেড়াচ্ছে কোনো প্রোটেকশন ছাড়া, তাদের ইমিউনিটি পাসপোর্ট যদি ভুল পরীক্ষার উপর হয়, তবে তো ঐ হাসপাতালটি ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেল। পেনসেলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজিস্ট স্কট হেন্সলে বলেন ১৪% ভুল ফলাফল মানেই হচ্ছে, পুরো টেস্ট মেথডটি বাতিলযোগ্য। ফলস পজিটিভ সমাজের জন্যে ভয়াবহ অবস্থা তৈরি করবে। মাত্র ৫% ফলস পজিটিভও উচ্চমাত্রায় ত্রুটিপূর্ণ, ফলে অনেক বিশেষজ্ঞ ভাবছেন উচ্চমাত্রার বিভ্রান্তিকর ফলাফলের টেস্ট পদ্ধতির চাইতে সঠিক পদ্ধতির অপেক্ষায় থাকা ভাল।
কোভিড সংকট পুঁজিবাদ আর নাম কেনার চরিত্রে পরিবর্তন আনতে পারেনি। তীব্র প্রতিযোগিতার চাপে বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের প্রটোকলে তথ্য, উপাত্ত, ডাটা, প্রমাণ, পাবলিকেশনের পথে না হেঁটে আগ বাড়িয়ে মিডিয়ার প্রচারণা বিষয়ে ফ্লোরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োপরিসংখ্যানবিদ নাতালি ডিন বলেন বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হবার আগে কোনো অবস্থাতেই উপসংহারে পৌঁছা উচিত নয়। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় আর সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা যুক্তরাষ্ট্রে দুটো বড় এন্টিবডি টেস্ট চালাচ্ছে সমাজে ইমিউনিটির মাত্রা বুঝতে। দুটো বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ এই টেস্ট নিয়েও উদ্বিগ্ন বিশেষজ্ঞরা ফলস নেগেটিভ পজিটিভের প্রভাব নিয়ে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মার্ম কিলপ্যাট্রিক এর মতে টেস্ট সঠিকভাবে না হলে সমাজে ভুল সিগন্যাল যাবে, ত্রুটিপূর্ণ ডাটা লকডাইনসহ সরকারের কোভিডপনা অকার্যকর করে দিতে পারে। ডাটার ভেলিডেশন এবং কনফার্মেশন ছাড়া গবেষণাখাতের বাইরে এন্টিবডি টেস্ট সহজলভ্য করে দেবার বিষয়ে উন্নত দেশগুলো এখনো প্রস্তত নয়। কানাডার মন্ট্রিয়লে একটি কোম্পানি ফেসবুকে ও অন্যান্য মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দিয়ে টেস্ট শুরু করতে গেলে কর্তৃপক্ষ এটি বন্ধ করে দেয়। নিউইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয় যুক্তরাজ্য চীনের দুটো কোম্পানির কাছ থেকে ২০ মিলিয়ন ডলারে ২ মিলিয়ন এন্টিবডি কিট কিনে বিপাকে পতিত হয়। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় প্রচুর ফলস রেজাল্ট আসার পর টেস্ট বাতিল করা হয়। এই ২০ লাখ কিটে এখন ধূলো জমছে। এন্টিবডি টেস্ট কিট নিয়ে কিছু দেশ একই ধরনের পরিণতি ভোগ করেছে। কমার্শিয়াল প্রোডাকশনে আছে এমন চাইনিজ কোম্পানির এই রকম ব্যর্থতার পটভূমিতে যারা গবেষণা পর্যায়ে আছে তাদের সতর্ক হওয়া উচিত। গবেষণায় প্রাথমিক সাফল্যের পর কাঁচামাল সংগ্রহ, স্কেল-আপ উৎপাদনের বিভিন্ন স্তরের মান নিয়ন্ত্রণের পদে পদে ঝুঁকি থাকে। বিশাল খরচ করে কমার্শিয়াল উৎপাদনের পর দেখা যায় কোনো এক সমস্যায় কিট কাজ করছে না। শুধু এন্টিবডি টেস্ট নয়, জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল টেস্টেও একই অনিশ্চয়তা। কানাডার স্পারটান কোম্পানির পোর্টেবল ডিএনএ ডিভাইস দিয়ে এন্টিজেন টেস্ট সরকারিভাবে গ্রহণ করে বিভিন্ন জায়গায় অসংখ্য ডিভাইস সাপ্লাই দিয়ে পরে দেখা গেল ল্যাব সেটআপে যেভাবে কাজ করছে, ফিল্ডে সেভাবে কাজ করছে না। সরকার সাথে সাথেই এই টেস্ট বন্ধ করে দেয়। আরটিপিসিআর এর বিকল্প হিসেবে এটি ছিল বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে প্রোমাইজিং টেস্ট মেথড।
এন্টিবডি টেস্ট কিট নিয়ে কর্তৃপক্ষের রক্ষণশীল বা ধীরে চল আচরণের পেছনে আরও অনেক কারণ আছে। অন্যান্য করোনাভাইরাস যেমন কমন কোল্ডের ভাইরাসটির ক্ষেত্রে বয়স যাদের ষাটের উপরে তাদের ক্ষেত্রে নিউট্রালাইজিং আর নননিউট্রালাইজিং বাইন্ডিং এন্টিবডির আধিক্য বেশি থাকে। কম বয়স্ক রোগীদের ক্ষেত্রে এন্টিবডি কম থাকে, হয়তো তাদের উচ্চ ইমিউনিটির নানা মেকানিজমে ভাইরাস আগেই কাবু হয়ে যায়। SARS-CoV-2 সহ করোনা গোত্রের ভাইরাসের লোড রক্তে খুব কম, ফলে এন্টিবডির কার্যকারিতা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের নানা প্রশ্ন আছে। কম মাত্রার এন্টিবডি দিয়ে সমাজের ইমিউনিটির হার নির্ধারণ বেশ কঠিন। তাছাড়া এন্টিবডি থাকার পরও ভাইরাস নিস্ক্রিয় করে দেবার সক্ষমতা আছে এমন এন্টিবডির উপর নির্ভর করবে ইমিউনিটির সফলতা। এন্টিবডির আয়ুস্কাল একটি বড় ফ্যাক্টর। SARS ভাইরাসের ক্ষেত্রে তিনবছরের মাথায় এন্টিবডি ২৫% কমে যায়, MERS এর ক্ষেত্রে ২ বছরের মাথায় প্রায় না থাকার মত। আবার মিসেলসের ক্ষেত্রে আজীবন থাকে এন্টিবডি। কোভিড এর ক্ষেত্রে এখনো এন্টিবডির কার্যকারিতা আর আয়ুস্কালের বিষয়ে কোনো গ্রহণযোগ্য ডাটার দেখা মেলেনি। কমন কোল্ডের জন্যে পরিচিত চারটি করোনাভাইরাসের যে কোনো একটিতে আক্রান্ত হলে এর ফলে উৎপন্ন এন্টিবডিকে ভুলে চিহ্নিত করে পজিটিভ হবার সম্ভাবনার বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক করেছে। SARS বা MERS এ আক্রান্ত হলেও পজিটিভ ফলাফল আসতে পারে। কিছু বিক্ষিপ্ত তথ্য আছে কোভিডে একাধিকবার সংক্রমিত হবার কয়েকটি ঘটনার। এত সব তথ্য উপাত্তে বুঝা যাচ্ছে যে কোভিডের এন্টিবডি টেস্ট নিয়ে বিশ্বব্যাপী বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোতে এক ধরনের অস্বস্তি রয়েছে। আগেই বলেছি যুক্তরাষ্ট্রে অসংখ্য কোম্পানি এন্টিবডি টেস্ট কিট উদ্ভাবনের দাবিদার। যুক্তরাষ্ট্রে এফডিএ ইমারজেন্সি ইউস অথরাইজেশন অ্যাক্টের অধীনে ক্লিনিক্যাল গবেষণাগারে কিছু সেরোলজিক্যাল টেস্টের অনুমোদন দিয়েছে। এফডিএ এন্টিবডি টেস্টের মান নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থানে। এন্টিবডি টেস্টের কিছু সীমাবদ্ধতা আগেই বলেছি। বর্তমানে সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি), এফডিএ, ন্যাশনাল ইন্সিটিউট অব হেলথ (এনআইএইচ), হেলথ আর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং হোয়াইট হাউস একাডেমিক আর মেডিক্যাল কমিউনিটির সাথে মিলে বের করার চেষ্টা করছে পজিটিভ এন্টিবডি টেস্ট আসলেই কোভিডে ইমিউনিটির সুরক্ষা দেয় কিনা?
সিডিসি গাইডলাইন অনুসারে এন্টিবডি টেস্ট রোগ নির্ণয়ে বা অ্যাকটিভ ইনফেকশন নির্ণয়ে ব্যবহার হবে না অর্থাৎ এটি আরটিপিসিআর এর বিকল্প নয়, এন্টিবডি টেস্ট হচ্ছে সংক্রমণের শেষের দিকে বা পূর্বের সংক্রমণ নির্ণয়ে পরোক্ষ পদ্ধতি। অনেকেই এন্টিবডি টেস্টকে আরটিপিসিআর এর সাথে তুলনা করেন বিশেষ করে দামের ক্ষেত্রে। বিষয়টি বিভ্রান্তিকর, বাদামের সাথে বাদামের তুলনা হয়, আপেলের সাথে নয়। সাধারণ এক্সরে তো সিটি স্ক্যান কিংবা এমআরআইয়ের সাথে তুলনা করা যাবে না। এন্টিবডি টেস্টে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানিগুলোও কয়েক ডলারেই কিট দিতে পারছে, আর চীনারা তো আরও সস্তা। দামের আর কোয়ালিটির ক্ষেত্রে এক দেশের কিটের সাথে আরেক দেশের কিটের তুলনা যুক্তিসংগত, আরটিপিসিআর এখানে প্রতিযোগী নয়। এন্টিবডি টেস্টের ক্ষেত্রে অতি উচ্চ নির্দিষ্টতা (specificity) এবং অতি উচ্চ স্পর্শকাতরতার (sensitivity) ন্যূনতম হারের মত কিছু জটিল বিষয় আছে যাতে টেস্টটির সঠিকতা নির্ভর করে।
এন্টিবডি টেস্ট পজিটিভ হলেই আমি মুক্ত বিহঙ্গ, সিডিসি গাইডলাইন কিন্তু তা বলে না। এন্টিবডি পজিটিভ হলেও বিজ্ঞান এখন পর্যন্ত গ্যারান্টি দিচ্ছে না যে আপনি ভবিষ্যৎ সংক্রমণ থেকে মুক্ত। এন্টিবডি টেস্টের ওপর ভিত্তি করে জনসমাগমে, স্কু্ল, ডরমিটরি বা কর্মস্থলে যাবার সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না।
রোগ নির্ণয়ে জাপানও অন্য দেশগুলোর মত বেছে নিয়েছে আরটিপিসিআরকে। জাপান সরকারের সমালোচনা আছে কম টেস্ট করার জন্যে। সরকার এখন দেখতে চাচ্ছে দেশে সংক্রমণ আর ইমিউনিটির মাত্রা। জাপানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সম্প্রতি দশ হাজার মানুষের এন্টিবডি টেস্ট করার প্রজেক্ট হাতে নিয়েছে। ডাটা নিয়ে বুঝতে চাচ্ছে সংক্রমণের পরিস্থিতি যাতে নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্তে সুবিধে হয়। টোকিও, মিয়াগি আর ওসাকায় চলছে এই টেস্ট। সরকারের নিয়ন্ত্রণে হচ্ছে এই টেস্ট যাতে এই টেস্ট থেকে সমাজে কোনো প্রকার ভুল সিগন্যাল না যায়।
কানাডার প্রধানমন্ত্রী আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন ইমিউনিটি হার বুঝবার জন্যে মিলিয়ন্স কানেডিয়ানদের সেরোলজিক্যাল বা এন্টিবডি টেস্টের মাধ্যমে টেস্ট করা হবে। কঠোর বৈজ্ঞানিক রিভিউ করার পর হেলথ কানাডা গত ১২ আর ১৪ মে দুটো সেরোলজিক্যাল টেস্টের অনুমোদন দিয়েছে শুধুমাত্র ল্যাবরেটরিতে গবেষণার কাজে ব্যবহারের জন্যে। দিয়াসরিন নামের একটি ইতালিয়ান মাল্টিন্যাশনাল বায়োটেক কোম্পানির কিটটি অনুমোদন পেয়েছে। এই কিটটি ইউএস এফডিএ এরও অনুমোদন পেয়েছে। হেলথ কানাডা বলছে আগামী দু বছরে অন্তত এক মিলিয়ন কানাডিয়ানদের টেস্ট করা হবে। সাধারণ পপুলেশন টেস্টের আওতায় আসবে তবে অগ্রাধিকার পাবে স্বাস্থ্যকর্মী আর সিনিয়র সিটিজেনরা। কানাডার প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা থেরেসা মে বলেছেন কানাডার বিভিন্ন অঞ্চলে সংক্রমণের হার সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে এই টেস্ট প্রজেক্ট থেকে। তবে তিনি সতর্ক করেন এই টেস্ট থেকে ব্যাক্তিগত পর্যায়ে ডাটা ব্যবহার আর ইন্টারপ্রিটেশনের ধারণা হবে অপরিপক্ক।
কোভিড সংকটে কোটি কোটি মানুষের রোগ নির্ণয় করে আরটিপিসিআর পদ্ধতি একটা বৈশ্বিক গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডের উপর দাঁড়িয়ে আছে। অন্যদিকে কোভিড সংকটে দেশে দেশে এন্টিবডি টেস্টের উপচে পড়া আয়োজনের মধ্যে থেকেও এর অ্যাকুরেসি আর গুণগত মান নিয়ে সংশয় আর আস্থাহীনতা এটিকে আপাতত সংকটোত্তর কোভিড ব্যবস্থাপনা অর্থাৎ ইমিউনিটি আর অতীত সংক্রমণের হার নির্ণয় সংক্রান্ত জরিপ আর গবেষণা কাজে ব্যবহারে উপযোগী ভাবছে বিশ্বের প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর রেগুলেটরি কর্তৃপক্ষ। বিজ্ঞান গবেষণাভিত্তিক তথ্য উপাত্তের প্রতুলতা সাপেক্ষে ভবিষ্যতে কোভিড সংক্রমণের ব্যবস্থাপনায় এন্টিবডি টেস্টের ভূমিকা পরিবর্তিত হলেও হতে পারে। এন্টিবডি টেস্টকে যারা ইমিউনিটি পাসপোর্ট ভাবছেন তাদের জন্যে আপাতত "চিন্তা কর ক্ষণকাল"।