Published : 10 Jun 2020, 11:11 PM
মারুফ রহমান। নোয়াখালি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষক। বয়স তিরিশ। মারুফ আমার নিজের সন্তানের মত। নিজের সন্তানের মত হলেও তাকে প্রথম একবার নতুন করে চিনি গণজাগরণ মঞ্চের সময়। তখন রাতে পত্রিকার কাজ শেষে প্রতি রাতে গনজাগরণ মঞ্চের ওখানে যেতাম। হাজার হাজার তরুণ প্রাণের মিলন সেখানে। সে ছিল একটা আলাদা জগত। একপাশে ঘণ্টা খানেক দাঁড়িয়ে থেকে নানান তরুণদের সঙ্গে কথা বলে চলে আসতাম। পরিচিত অনেকেই কাছে আসত। কেউবা এসে পরিচয় দিত। হঠাৎ দেখি একদিন আমার গা ঘেঁষে অনেকটা আদর নেওয়ার জন্য এক তরুণ দাঁড়িয়ে। মুখে খোচা খোচা দাড়ি। চিনতে কয়েক মিনিট দেরি হলো- এমন তার অবস্থা।
তারপর তাকে জড়িয়ে ধরে বলি, মারুফ, তোমার এ অবস্থা কেন? তোমাকে তো চেনা যাচ্ছে না।
পাশে দেখি আরো আট-দশটা ছেলেমেয়ে, সকলেরই একই অবস্থা। ও সানন্দে হেসে বলে, আমরা গত এগারদিন ধরে রাত-দিন এখানেই আছি। বুঝলাম এই কদিন ওদের গোসলাদি কিছুই হয়নি। ওখানকার খাওয়া আর ভ্রাম্যমান টয়লেটেই ওদের জীবন কেটেছে। মারুফকে বুকে জড়িয়ে ধরে চোখের পানি আটকাতে পারিনি। আর মনে মনে ভেবেছিলাম, আমার এ প্রিয় বাংলাদেশ চিরকাল পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে থাকবে- এমনই মারুফদের কারণে। এর পরে বেশ কয়েক বছর কেটে গেছে। মারুফ এখন নোয়াখালি প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক। ওর সঙ্গে প্রায় ইংরেজি সাহিত্য, বিশেষ করে ইংরেজি কবিতা নিয়ে আলোচনা হয়। কবিতাকে সে সত্যি প্রাণে ধারণ করে। কবিতার প্রাণের ভেতর সে প্রবেশ করে অতি সহজে। তাই ওর কবিতাপ্রাণ নরম মনটি আমার কাছে অনেক পরিচিত। কিন্তু তার পরেও ওকে আমি আরেকবার চিনলাম, এবারের এই কোভিড-১৯ এর দুঃসময়ে। এর ভেতর একদিন সে আমাকে ফোন দিয়ে বললো, 'আমার শ্বশুরের কোভিড পজিটিভ। বাসায় থেকে চিকিৎসা নিচ্ছে।' ওর স্ত্রী নাভিলা নওরিন বৃষ্টি ডাক্তার। তাই আমি তাকে বলি, তুমি বৃষ্টি মাকে বলো, ডা. আব্দুল্লাহ ভাইকে আমার কথা বলে ফোন করতে। উনি ভালো চিকিৎসা দিচ্ছেন।
ওরা সেভাবে চিকিৎসা নেয়। দিন দুই পরে ডা. আব্দুল্লাহ রোগীর অবস্থা দেখে বলেন, উনাকে একটি হাসপাতালে ভর্তি করালে ভালো হয়। বৃষ্টি অনেক কষ্ট করে তার কোভিড আক্রান্ত মুক্তিযোদ্ধা বাবাকে মুগদা কোভিড হাসপাতালে ভর্তি করায়।
এই মুগদা কোভিড হাসপাতালে ভর্তি হবার পরে আমি মারুফকে আরেকবার নতুন করে চিনলাম। সে আমাকে বলে, 'আমি তো কোভিড হাসপাতালে রোগীর সঙ্গে তার দেখাশোনা করার জন্যে যাবো।'
যেখানে সবাই কোভিড রোগী থেকে দূরে থাকছে সেখানে মারুফের মুখে আমি এ কথা শুনে কিছুটা সময় স্তব্ধ হয়ে গেলে- সে ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলে, "আমাদের বয়স কম, আমরা যদি ওপেন না হই, সিনিয়র রোগীদের সঙ্গে না থাকি তাহলে সেটা তো ঠিক নয়। বৃষ্টি এখন ক্যারি করছে। তাই ওর যাওয়া উচিত নয়। ওদের যেহেতু কোন ভাই নেই। আমরা উনার মেয়ের জামাই হিসেবে দেখাশোনা করবো।'
বৃষ্টির অপর বোনের স্বামী রিয়াজকে আমি চিনি না। শুনেছি ছেলেটি একজন ব্যাংকার। তার বয়স ৩৩ এর মত। মারুফ প্রতিদিন রাত বারোটার পরে হাসপাতাল থেকে ফিরতো। সে গোসল করে ফ্রেশ হওয়ার পরে আমি তাকে ফোন করতাম বা সে আমাকে ফোন করতো। শুনতাম মারুফ রোগীর বিছানায় বসে, পাশে বসে তার অক্সিজেন দিয়েছে। অক্সিজেন পরিমাপ করেছে। রোগীকে স্যালাইন থেকে শুরু করে অন্যান্য খাবার খাইয়ে দিয়েছে। রোগী এখন হাসপাতালে আছেন। সুস্থ হয়ে উঠেছেন। নিজে নিজে সব কাজ করছেন। তবে এই হাসপাতালে যাতায়াতের সময় একদিন রাত দুটোর দিকে হাসপাতাল থেকে ফিরে মারুফ একটি ফেইসবুক পোস্ট দেয়, তার ইংরেজি পোস্টটির বাংলা এমন ছিল- 'বাস্তবে আমরা যে মানবতার কথা বলি, এই কোভিড হাসপাতালে গেলে তা মিথ্যে বা আরোপিত মনে হয়।' ওই রাতে আর মারুফকে ফোন করিনি।
পরের দিন তাকে ফোন করে বলি, কেন হাসপাতালে গিয়ে তোমার এমনটি মনে হলো?
সে বলে, 'অধিকাংশ রোগীই সহজে সুস্থ হয়ে যেত যদি তারা একটু পরিচর্যা পেত। অধিকাংশই পরিচর্যা পাচ্ছে না। প্রায় সবই বয়স্ক রোগী। পঞ্চাশের থেকে পঁচাত্তর তাদের বয়স। কারো কারো তার থেকে বেশি হবে। সে বলে দু একজন রোগীর পরিচর্যার জন্যে সঙ্গে লোক আছেন ঠিকই তবে তারা বয়সে তরুণ নয়। যে কজন আমি দেখেছি তারা সবাই তাদের স্ত্রী। হয়তো ষাট বছরের রোগী, আর তার পরিচর্যা করছেন পঞ্চান্ন বছরের স্ত্রী। যিনিও বয়সের দিক থেকে বিপজ্জনক অবস্থানে।"
মারুফ আরও বলে, "তাছাড়া, কোথাও আমি ছেলে বা মেয়েকে দেখিনি পিতা-মাতার সঙ্গে। কেন, এমন হবে! আমার বাবা মা কেউ কোভিড আক্রান্ত হলে হাসপাতাল থেকে মারধর করেও কেউ আমাকে নিয়ে আসতে পারতো না।"
এর পরে মারুফ আমাকে যা বলে সেটা সত্যি ভেবে দেখার বিষয়। ও আমাকে বলে, 'কেন এমনটি হলো? কেন দেশের ও দেশের মানুষের এই দুর্যোগের সময় তরুণরা এগিয়ে আসছে না!' পৃথিবীর সব দুর্যোগে তো তরুণরা এগিয়ে আসে।
যেমন সে আমাকে বলে, 'আপনি কি কলেরা আক্রান্ত এলাকায় সেবার জন্যে কাজ করেননি?'
তখন আমি তাকে বলি, হ্যা কলেরা আক্রান্তদের সেবার জন্যে আমি কলেরা আক্রান্ত গ্রামে কাজ করেছি, পুরানো ঢাকায় কাজ করেছি। এমনকি আশির দশকেও পুরানো ঢাকায় কাজ করেছি।
সে বলে, 'আপনার বাবাদের জেনারেশন কি প্লেগ আক্রান্তদের জন্যে কাজ করেনি?'
আমি বলি, বাবার মুখে শুনেছি, তিনি বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্সের সদস্য হিসেবে তিনি প্লেগ আক্রান্ত এলাকায় কাজ করেছেন। তখন তাদের শত শত সঙ্গীরা কাজ করতো।
মারুফ তখন আমাকে বলে, 'তাহলে এখন কেন তরুণরা বাড়িতে বসে থাকবে? আমাদের জাতীয় জীবনে এর আগে যত দুর্যোগ এসেছে সেখানে সিনিয়ররা নেতৃত্ব দিয়েছে। এবার তরুণদের নেতৃত্ব দেবার সুযোগ আছে। কারণ, এই করোনাভাইরাস দুর্যোগে তরুণরা সুবিধাজনক অবস্থানে আছে। তরুণদের জন্যে মৃত্যু ঝঁকি অনেক কম। তারা কেন তাদের সিনিয়রদের এই বিপদে পাশে গিয়ে দাঁড়াবে না!'
সপ্তাহ দুয়েক আগে আমি 'দ্য হিল টাইমস' ও শ্রীলংকা গার্ডিয়ানে লিখেছিলাম, কোভিড-১৯ মূলত বিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগের ও একবিংশ শতাব্দীর এই দুই দশকের জ্ঞান বিজ্ঞানের অগ্রগতির প্রতিটি বিষয়ে যারা দক্ষ হয়ে উঠেছিল সেই দক্ষ জনগোষ্ঠির একটি বিরাট অংশকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে। এতে মূলত পৃথিবী 'জ্ঞান সম্পদ' হারাচ্ছে। এই প্রজ্ঞাবান জনগোষ্ঠি মারা যাবার ফলে পৃথিবী অনেক পিছিয়ে যাবে। কারণ তরুণদের এগিয়ে যাবার জন্যে প্রজ্ঞাবান ব্যক্তির সহযোগিতার প্রয়োজন হয়। তরুণ জাকারবার্গেরও তার ফেইসবুককে কম্পানিতে রূপান্তরিত করতে কম্পানি জ্ঞানসম্পন্ন সিনিয়রদের প্রয়োজন পড়েছিল। বাংলাদেশেও এর বাইরে নয়। তাই এখন মনে হয় সময় এসেছে তরুণদের কিছু না কিছু দায়িত্ব নেয়া। ইতোমধ্যে অবশ্য আমার কাছে ফেইসবুকের মাধ্যমে কয়েক তরুণ তাদের ছোট ছোট গ্রুপের নাম পাঠিয়েছে, তাদের ইচ্ছে জানিয়েছে- এই দুঃসময়ে তারা কোভিড আক্রান্তদের সেবা দিতে অর্থাৎ হাসপাতালে নেওয়া, হাসপাতালে পরিচর্যা করা এমনকি যে সকল সিনিয়র সিটিজেন বাসায় অবস্থান করছেন, তাদের সহযোগিতার কেউ নেই তাদের সব ধরনের সহযোগিতা করতে চায়।
বাস্তবে এর আগে প্লেগ, ফ্লু, পক্স, কলেরা প্রভৃতি মহামারী আবার ঘূর্ণিঝড়, বন্যার মত দুর্যোগে তরুণরা পাড়ায় পাড়ায় দল বেঁধে বা ক্লাবভিত্তিক এগিয়ে আসতো। ১৯৭১ সালে শরণার্থী শিবিরে দেখেছি ভারত সেবাশ্রমের তরুণদের দল বেধে কলেরা আক্রান্ত শরণার্থীদের সেবা করতে। ডা. দিলীপ মহালনবীশের নির্দেশিত ওরস্যালাইন খাওয়াতে তখনই দেখেছি। ওই প্রথম জেনেছি কলেরা বা ডায়েরিয়া হলে ওরস্যালাইন খাওয়ানো হয়। স্বাধীনতার আগে ও পরে ছাত্র সংগঠ গুলোর অনেকে এমন অনেক কাজ করেছে। মানুষের সেবার কাজে ছাত্র ইউনিয়ন সব সময়ই এগিয়ে ছিল। এখন ওই সংগঠনটির সেভাবে অস্তিত্ব নেই। তারপরে ছাত্রলীগসহ যে সব প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন আছে, তাদের মনে হয় এখন সময় এসেছে সিনিয়র সিটিজেনদের পাশে দাঁড়ানো।
পাশে দাঁড়ানোর সময় এসেছে ফেইসবুকভিত্তিক যেসব উদার তরুণদের গ্রুপ আছে তাদের। তারা যদি এখন এভাবে গ্রুপভিত্তিক, সংগঠনভিত্তিক প্রতিটি মহল্লায়, রোডে, এলাকায় মানুষের সহযোগিতায় এগিয়ে আসে তরুণরা তাহলে মানুষ সাহসী হবে। দেশের সিনিয়র সিটিজেনদের মনোবল বাড়বে। তারা বুঝতে পারবে, এদেশের সন্তানরা তাদের সিনিয়রদেরকে বাঁচিয়ে রাখবে। পরিস্থিতি তখন সত্যি বদলে যাবে। তখন আর কোনও সন্তান তার কোভিড আক্রান্ত বাবা-মাকে রাস্তায় বা জঙ্গলে ফেলে যাবে না। হাসপাতালেও মৃত্যুর হার কমে আসবে। বাস্তবে তারুণ্যে যদি প্রাণ না জেগে ওঠে মানুষের প্রতি তাহলে সে তো তারুণ্য নয়। তাই আজ এই ঘোর দুর্যোগে আশা করবো জেগে উঠুক আমাদের তারুণ্য প্রাণ নিয়ে। সাহস করে এগিয়ে আসুক তারা। প্রয়োজনীয় প্রটেকশন নিয়ে তারা সহযোগিতা করুক সকল সিনিয়র সিটিজেনকে, কোভিড আক্রান্ত মানুষদেরকে। এই অন্ধকার সময়ে তরুণের এ প্রাণের আলোতে সত্যিই দেশ আলোর পথ দেখতে পাবে কিছুটা হলেও। পাবো আলোর রশ্মি, বা বেঁচে থাকার উজ্জল তারার আলো। আর পৃথিবী আরেকবার দেখতে পাবে বাঙালি জাতিকে নতুন করে।