Published : 08 Jun 2020, 07:19 PM
ভাবশিষ্যদের অনেকেই ছিলেন তাদের মধ্যে একটি পরিবারের কথা শাকুর মজিদ লিখেছেন, 'রণেশ ঠাকুর, রুহী ঠাকুর, রবীন্দ্র ঠাকুর – তিন ভাই। সবার বড় রবীন্দ্র, তারপর রুহী ও রণেশ। এরা সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারের লোক, বাড়ি দিরাই থানার উজান ধল গ্রামে। এই বাড়ির পাশেই একটা ছোট্ট খাল, খালের ওপারে আবদুল করিমের বাড়ি। দুই ভাই রুহী আর রণেশ পড়ে থাকেন বাউল করিমের কাছে, গানের তালিম নেন। নিজেরাও গান বাঁধতে পারেন, লিখতে পারেন, কিন্তু লিখেন না, সুর করেন না, তাঁরা ওস্তাদ আব্দুলে করিমের গান করেন।'
ভাটির পুরুষ আব্দুল করিমের মৃত্যুর পর এই শিষ্যরাই বাউলের গানগুলো পরিবেশন করে আসছেন, লালন করে আসছেন। কবে কোন সন্ধ্যায় বা রাতের আসরে বাউল আব্দুল করিম বলেছিলেন, 'মানুষ ভজ পরম খুঁজো, সুরেই তাকে কাছে টানে।'
রণেশ ঠাকুররা শাহ আব্দুল করিমের কেতাবি ভক্ত নন। সেমিনার বা গানের চকচকে মঞ্চে দেখা দেন না, তারা হৃদয়ে ধারণ করেন। সুরের সেবা করেন। বলা যায় সুরের ধ্যান করেন। প্রাণকাড়া লোক সুর আর সহজিয়া জীবনের চেনাজানা সরল কথা। সেই কথাগুলোই সরাসরি আঘাত করে আমাদের দেশের সরলতায় ভরা কৃষক-শ্রমিকের প্রাণে। নতুন করে নয়। কয়েকশ' বছর ধরে সে ধারা বয়ে যাচ্ছে। যে ঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে তার বয়স বলা হচ্ছে ৪০ বছর। চার দশকের সাধনার ইতিহাস ওই কুঁড়েঘরের সাথে জড়িয়ে ছিলো। এখানে সেই হারমোনিয়াম ছিলো, যেটা বহুবার রণেশ ঠাকুরের গলার সাথে ওঠানামা করেছে। তবলা বা ঢোল ছিল। আর কি ছিল? যে কেউ বলতে পারেন, বড়জোর দু'চারটা বাঁশি, মন্দিরা, করতাল।
হ্যাঁ, অনেকেই বলতে পারেন এসব 'সামান্য যন্ত্রপাতি'ই ছিল। আরও ছিল রণেশ ঠাকুরের সাধের বেহালা। সেটাও হয়তো যে কেউ কিনে দিতে পারবেন। সেরকম প্রতিশ্রুতির কথা প্রচার পেয়েছে। আর যে টিনের ঘর সেটির জন্য কত টাকাই বা লাগবে। এরইমধ্যে রণেশ ঠাকুরের যে গানের ঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে তা আবার গড়ে দেয়ার এবং অন্য একজন যন্ত্রগুলো কিনে দিতে চেয়েছেন। নিশ্চয়ই দেবেনও।
উজানধল গ্রাম হিসেবে খুব একটা বড় নয় যে কেউ কাউকে চেনেন না, জানেন না। তাছাড়া গ্রামের মানুষ সবাই প্রায় সবাইকে চেনেন, খোঁজ খবর রাখেন। ওই নিভৃত গ্রামের কেউ জানলোই না কারা ওই ঘটনা ঘটিয়েছে বা ঘটাতে পারে? ঘটনার পরপর তো বাউল রণেশ ঠাকুরও কারও নাম পর্যন্ত বলেননি। আমি নিজে বিষয়টিকে মানতে পারছিলাম না, ভাবছিলাম কিছুই বলছেন না, নাকি বলতে চেয়েও পারছেন না। ক'দিনের মধ্যেই লেখক গবেষক শাকুর মজিদের লেখায় বিষয়টি কিছুটা আরও স্পষ্ট হলাম, 'রণেশ ঠাকুর ভয়েই প্রথমে কারও নাম বলেন নাই'। শাকুর মজিদ লিখেছেন- 'শুনলাম তাঁর বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ভয়ে তিনি সন্দেহজনক কারো নামও বলতে চাইছেন না, কারণ তিনি এটা জানেন, যারা এ কাজ করেছে, এরা শয়তান, শয়তানের সাথে ইনসান তো পেরে উঠতে পারে না।'
তার পরের ঘটনা আমরা জানি, কাঁদতে কাঁদতে সে বাউল একটা গান করেছেন। সেই গানেই তিনি তার অসহায়ত্বের কথা বলেছেন, 'মুখে কোন ভাষা নাই, মনের দুঃখ কার কাছে জানাই!'
এই গান ছাড়া বাউল আর কি বা করবেন? বাউল কি লাঠি নিয়ে দৌড়ে যাবেন প্রতিপক্ষের মাথা ফাটিয়ে ফেলতে? সেটা যে করবেন না তা সবারই জানা। তাদেরও জানা, যারা এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। তাই এ ঘটনাটি ঘটানো তাদের জন্য সহজ। খুবই সহজ। এরা কারা? এই শয়তানের দল তাহলে খুব অচেনা কেউ? নাকি আমরা চিনেও না চেনার ভান করে চুপ থাকি। নাকি অসহায় বাউলের মতো ভয়ে থাকি আমরাও?
আমরা বাউলের ঘর পুড়িয়ে দিলে চুপ থাকি, তাদের চুল দাড়ি কেটে দিলে চুপ থাকি, আমরা ধর্মীয় অনুভূতির নামে অন্যায় অত্যাচার করলেও চুপ থাকি, চুপ থেকেছি। তৎপরতা বলতে, সুনামগঞ্জের উদীচীর কথা শোনা গেছে, রণেশ বাউলের সরাসরি কথা শুনলাম অনলাইনে। অসহায়ত্ব, ভয়কাতরতা স্পষ্ট তার কথায়।
এরপর অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে আরেকটি আয়োজন চোখে পড়েছে, বাউল সংহতি। দেশবিদেশ থেকে বাউলদের উপর নির্যাতনের বিরুদ্ধে সংহতি জানিয়েছেন, এবং শিল্পীরা কোন যন্ত্র ব্যবহার না করে রণেশ ঠাকুরের সম্মানে গান করেছেন।
কিন্তু তাতে কি বিচার বা বাউলদের অসহায়ত্ব কমার ক্ষেত্রে খুব একটা ভূমিকা রেখেছে বা রাখবে? অর্থাৎ একটা অসহায় চেহারা স্পষ্ট। তাহলে, এই অসহায়ত্বটাই টেকসই হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশে?
এই প্রশ্ন করছি কারণ, আমরা কি মনে করছি যে, ঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, আবার সেটা তুলে দেয়া হয়েছে। সামান্য যে কয় টাকার যন্ত্রপাতি পুড়ে গেছে তাও কিনে দেয়া হয়েছে। কেউ কেউ স্বেচ্ছায় কিনে দিয়েছেন। কাজেই আর সমস্যা কী? সমাধান তো হয়েই গেছে।
তাহলে যে গানের খাতাগুলোয় বছরের পর বছর ধরে মেধা আর শ্রমে গান লেখা হলো সেগুলো? স্মৃতি থেকে কতটুকুই বা উদ্ধার করা যায়? আর বাউলরা দমবন্ধ পরিবেশে সেই গানগুলো পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করবেন কীসের জন্য? কাদের জন্য?
জানি এসব প্রশ্নের উত্তর জানা নাই। সত্যি বলতে, প্রশ্নটাই নেই কাজেই উত্তর তো নাই-ই।
আমাদের জীবনের ব্যস্ততা বেশি, শত ঘটনার মাঝে আমাদের জীবন। বলতে হয় আমাদের নিউজ হেডলাইন বা সোশাল মিডিয়ার টাইমলাইন থেকে সরে গেলেই আমরা ভুলে যাচ্ছি সব। কোন কিছুই স্থায়ী রেখাপাত করছে না। করছে না, কারণ আমাদের বোধ-বুদ্ধিতে কুলোচ্ছে না হয়তো। তাতে একদিন আমাদের অহংকার যাদের নিয়ে সেই বাউল শাহ আব্দুল করিমের মতো কোন কিংবদন্তী বাউল তৈরি হওয়া তো দূরে থাক তাদের গানের, সেই প্রাণের সুরের সাধনার জন্য কোন সাধক আর খুঁজেও পাওয়া যাবে না।
লকডাউনে আছি সবাই
এই সুযোগে মারলো ছোবল
কোন ওঝাতে বিষ ছাড়াই '
আমরা সুরে সুরে তাই আরেকটি গান গাই শুধু। শেষ পর্যন্ত আমরা চাই, ছোবল মুক্ত হোক সকল রণেশ ঠাকুর।