Published : 05 Nov 2014, 10:23 PM
আমার এক সম্পাদক বন্ধু তাঁর কিছু অপকর্মের জন্য বেশ পরিচিত। তবে তাঁর একটা কথা আমার কাছে সত্যি মনে হচ্ছে। তাঁর মতে, ''বাংলাদেশে দুর্নীতি কোনও ব্যাপার নয়। ওটা একবার করে ফেলতে পারলে গ্রহণযোগ্য হয়ে যায়।''
আমাদের মতো দেশের জন্য এটা কিন্তু বড় একটা অর্জন! একসময় আমাদের এই ভূখণ্ডটি ইতিহাসের এমন এক জমিনে ঘুরপাক খেয়েছে যেখানে নীতি-আদর্শের বড়াই করা হত। আর এখন? গত কয়েক বছরে চুরি-দুর্নীতি এ সবই আমাদের সবার মনোযোগ কেড়ে নিয়েছে। এমন আশঙ্কাও দেখা দিয়েছে যে এ নিয়ে কোনও বিতর্কও যেন চলবে না। এখন কি আমাদের আর সেই জাতি বলা যাবে যারা মহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে একটি রাষ্ট্র পেয়েছিল? বরং আমরা তো এখন সেই জাতি যাদের 'মহান চোর' হিসেবে আখ্যা দেওয়া যায়। এমনকী চুরিবিদ্যা ভালোভাবে শিখেছি বলে আমাদের লজ্জিত হওয়া উচিত কিনা সেটুকু বোঝার ক্ষমতাও আমরা যেন হারিয়ে ফেলেছি!
ওই শহীদদের এখন ধন্যবাদ দেওয়া উচিত যারা একাত্তরে প্রাণ দিয়েছিলেন। কারণ এ জন্যই তো আমরা একটা স্বাধীন দেশ পেয়েছিলাম যেখানে চোরেরা নির্বিঘ্নে চুরি করতে পারছে!
বছর দুয়েক ধরে সবচেয়ে আলোচিত তিনটি চুরির 'গল্প' পর্যালোচনা করে দেখুন। ড. ইউনূসের গ্রামীণ-কেলেঙ্কারি, আবুল হোসেনের সেতু-কাহিনী এবং হলমার্কের মুহিত-ম্যানেজ ও ব্যাংক-লুটের কেচ্ছা। একেকটা কাহিনী একেকভাবে আমাদের আলোড়িত করেছে।
প্রথম কাহিনীতে দেখুন- বাংলাদেশের ইতিহাসে আর কোনও ঘটনা নিয়ে কি এত আলোড়ন হয়েছে? সাধারণের দৈনন্দিনের সংলাপ থেকে শুরু করে প্রিন্টেড ও ইলেকট্রনিক সব মাধ্যমকে দখল করে রেখেছে এই বিষয়টি। মজার বিষয় হল, গ্রামীণ কেলেঙ্কারি ফাঁসের পর দেড় বছর পার হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে কোনও আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আনা হয়নি। তাঁর দুর্নীতি নিয়ে কোনও সুনির্দিষ্ট অভিযোগও সরকার গঠন করেনি। যা হচ্ছে তা হল- সরকারের পূর্ণ সমর্থন নিয়ে নানাভাবে ইউনূসকে অপদস্থ করা হচ্ছে। ড. ইউনূস যদি চুরি করেই থাকেন তবে আমাদের সবার জানার অধিকার আছে যে কত অংকের অর্থ কীভাবে তিনি চুরি করেছেন। তাঁর এই চুরির আসল রূপটাই বা কী সেটাও সরকারকে জানাতে হবে।
একজন সিনিয়র সম্পাদক বলছিলেন, ''ইউনূসকে ধরা জাতীয় স্বার্থেই প্রয়োজন।'' আমি মনে করি, ইউনূসের ঘটনায় দুর্নীতি মূল সমস্যা নয়- রাজনীতিই আসল কারণ। তাই ইউনূসের পেছনে সরকার যত সময় দিচ্ছে ততটা অন্য কারও পেছনে নয়। সরকার চেষ্টা করেছে ইউনূসকে বাংলাদেশের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত লোক হিসেবে চিহ্নিত করতে। মিডিয়াও এ ইস্যুতে আলোচনাটা কেন্দ্রীভূত রেখেছে। আমার কথা হল- দুর্নীতি করে থাকলে ইউনূসকে অবশ্যই অভিযুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি অন্য দুর্নীতিবাজদের বেলায়ও দরকার একই নীতি পালন করা।
সবচেয়ে দৃষ্টিকটু লেগেছে এটাই যে, এ ক'দিন ধরে পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র ড. ইউনূস-কাহিনীতে বুঁদ হয়ে আছে। ওদিকে নির্বিঘ্নে চুরি করে গেছে অন্যরা। ইউনূসকে ধরাটাই কি সরকারের প্রধান ও একমাত্র দায়িত্ব, না চোরদেরও ধরা প্রয়োজন? নাকি এই উসিলায় অন্য চোরদের দিক থেকে আমাদের মনোযোগটা ঘুরিয়ে দেওয়া গেছে?
ইদানিং প্রায় ড. ইউনূসের মতোই বিখ্যাত হয়ে উঠেছেন সরকারের এক মন্ত্রী। নাম তাঁর আবুল হোসেন। এক নামে তাঁকে বলা যায়, 'পদ্মা সেতুর ঋণপ্রাপ্তি ঠেকানোর জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত' মন্ত্রী। শোনা গেছে, মন্ত্রিত্ব পাওয়ার জন্য এক 'রাজনৈতিক দৌড় প্রতিযোগিতায়' প্রথম হয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৬-২০০১ সালের আওয়ামী লীগ সরকার তাঁকে মন্ত্রিত্ব দিয়েছিলেন। পরে দেখা গেল ব্যক্তিগত ব্যবসার কাজে সিঙ্গাপুর ভ্রমণ করছেন তিনি। এরপর তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তাই বলে কখনও-ই তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে দূরে সরে যাননি। স্বভাবতই তাঁকে ছাড়া এবার কোনও মন্ত্রিপরিষদ গঠনই সম্ভব ছিল না। আমাদের দেশে দুর্নীতির যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে, তাতে আবুল হোসেনের মতো একজন যে সে সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠবেন এটাও খুবই স্বাভাবিক।
পদ্মা সেতুর ঋণ-কেলেঙ্কারিতে আরও জড়িয়ে গেছে অর্থ-উপদেষ্টা মশিউর রহমানের নাম। সাবেক এক বুরোক্রেটসহ আরও ক'জন কর্মকর্তার নামও উচ্চারিত হচ্ছে পাশাপাশি। কিছু ব্যবসায়ীর নাম তো প্রত্যাশিতভাবেই এসেছে। তাদের রাজনৈতিক যোগাযোগ নিয়েও খোলামেলা আলোচনা চলছে। তাতে কী? এ দেশে কখনও কি দুর্নীতির জন্য কারও বিচার হয়েছে? বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতাদের? আর দুর্নীতির বিচার করা সম্ভবই বা কীভাবে যখন দেশটা চলছে দুর্নীতিকে 'স্বাভাবিক ব্যাপার' মনে করেই?
দুর্নীতি দমন কমিশন হচ্ছে প্রেস কাউন্সিলের মতোই। এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান যে আছে সেটা লোকে জানে কিন্তু এ প্রতিষ্ঠানকে কখনও কোনও কাজে দেখা যায়নি। এই কমিশন কি কোনও ক্ষমতাসীন মন্ত্রী, কর্মকর্তা বা অন্য কোনও প্রভাবশালী লোকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির সুস্পষ্ট অভিযোগ গঠন করতে পেরেছে? মানুষকে ধোঁকা দেওয়ার জন্যই কমিশনটা গঠন করা হয়েছে। একমাত্র বাংলাদেশেই এ ধরনের একটি প্রতিষ্ঠান করা সম্ভব। এই কমিশন সব দুর্নীতি তদন্তের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত। এই দায়িত্ব পালনের (?) মাধ্যমে কমিশন সরকারের স্বচ্ছতার ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা করে মাত্র। জনসাধারণও সেটা বোঝে। শোনা যাচ্ছে যে, হলমার্ক-কেলেঙ্কারি তদন্ত করবে এই কমিশন। জনগণ কিন্তু ঠিকই বুঝেছে যে, সরকার তাদের সঙ্গে উপহাস করছে বৈ অন্য কিছু নয়।
শেষোক্তটি, মানে সোনালী ব্যাংকে হলমার্কের হরিলুটের ঘটনাটি অতীতের এমন আরও অনেক লুটের কাহিনীর তুলনায় বড় কিছু নয়। ভবিষ্যতেও এর চেয়ে বড় বড় ঘটনা ঘটবে। সমস্যাটা তৈরি করেছে সরকার। তাদের ভাবখানা এমন ছিল যে এটা নিয়ে এত উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাহেবের একটি বক্তব্য ইতিহাসে স্থান করে নেয়ার যোগ্য। 'চারশ' বিলিয়ন টাকা কিছুই নয়'- দেশের এতগুলো টাকা একজন ব্যক্তির পকেটে যাওয়ার পর একজন অর্থমন্ত্রী এ কথা বলতে পারেন এটা বিশ্বাসেরও অযোগ্য।
বোঝাই যাচ্ছে জিডিপি'র ২ শতাংশ যদি লুটেরাদের পকেটে চলে যায় সেটা তাঁর কাছে কোনও ব্যাপার নয়। কারণ লোকে তো বলছে, জিডিপি'র এক-তৃতীয়াংশই লুট হয়ে গেছে! তাই যদি হয় তাহলে হলমার্ক যা নিয়েছে তা তো সামান্যই। বিষয়গুলো নিয়ে মুহিত সাহেব কি নিজেই বিব্রত নন? হওয়াটাই স্বাভাবিক। কারণ তিনি তো জানেন, আসলেই কত অর্থ লোপাট করা হয়েছে।
কিন্তু আমরা কেউ-ই জানি না এ সব হরিলুটের ফলে আমাদের ব্যাংকিং সিস্টেমের কী ক্ষতি হবে। আমরা কিছু করতেও পারব না, কারণ ক্ষমতাই তো নেই আমাদের। মুহিত খুব উদ্ধতভাবে এটাও বলে দিলেন যে, শুধু সোনালী ব্যাংক নয়, আরও অনেক ব্যাংক এ ধরনের অর্থ-কেলেঙ্কারিতে জড়িত। এমন একটি তথ্য দেওয়ার জন্য অর্থমন্ত্রীকে ধন্যবাদ! বাংলাদেশে তো প্রতারকের সংখ্যা গোবরের মতোই 'কমন।' শুধু তাই নয়, এ দেশে প্রায় সবাই 'প্রতারক।' এর মাধ্যমে সব ব্যাংক পরিচালককে সরকারের পক্ষ থেকে পুনরায় নিশ্চিত করা হল যে- ''সবকিছুই ঠিকঠাক চলছে। আপনাদের চিন্তিত হওয়ার কোনও কারণ নেই। এতদিন কোনও ভয়-ভীতি ছাড়া যেভাবে কাজ করে যাচ্ছিলেন তাই করুন!''
''আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।'' আমাদের জাতীয় সঙ্গীত যখন গাই, তখন বুকের ভেতরটা কেমন যেন মোচড় দিয়ে ওঠে। দেশের জন্য, মাটির জন্য ভালবাসার নদীটার পানি দু'কুল ছাড়িয়ে যেতে চায়। চার দশক আগেও এমন করে কত-কত পূর্ণিমার চাঁদজাগা রাতে নির্জনতা ভেঙ্গে কাঁপা-কাঁপা কণ্ঠে দেশের জন্য যুদ্ধ করতে আসা মানুষগুলো গেয়ে উঠতেন সোনার বাংলার এই গান। এই মানুষদের অনেকেই হয়তো যুদ্ধ করতে করতে মুত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ যে শেষ পর্যন্ত অর্জিত হয়েছিল সেই কথাটা ওরা জেনেও যেতে পারেননি।
তাই এটা তো কোনও দুর্ঘটনা নয় যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ কিছু 'আবুল'কে দেশপ্রেমিক আখ্যা দেবেন! আর যা-ই হোক- আমাদের দেশের এই 'সোনার বাংলা' টার্মটা দেশের আপামর জনসাধারণের চেয়ে ওই সব আবুলদের কাছেই তো সত্যিকার অর্থে ধরা দিয়েছে। ওদের জন্য সত্যিই 'সোনাফলা' এই দেশ। তাই এই মাটিকে ওরা অনেক-অনেক ভালবাসবেন এটাই তো স্বাভাবিক। চোরদের কণ্ঠে সোনার বাংলার গানটা সত্যিই পুরোপুরি ভিন্ন একটা তাৎপর্য বহন করবে।
জয় বাংলা। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
আফসান চৌধুরী: নির্বাহী সম্পাদক, বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম।