Published : 28 Oct 2014, 06:37 PM
সম্প্রতি ইরানের তেহরানে জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) ষোড়োশোতম সম্মেলন হয়ে গেল। পঞ্চাশের দশকে আন্তর্জাতিক প্রাঙ্গণে ন্যাম যে শোরগোল তুলেছিল, অনেক অনেক বছর বাদে, আগষ্ট মাসের শেষের দিকের কয়েকটি দিনের শোরগোল প্রায় ভুলে যাওয়া সেই দিনগুলোর কথা আবার মনে করিয়ে দেয়। ন্যামের মূলমন্ত্র : আমরা (এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার উন্নয়নশীল দেশসমূহ) বামেও নেই, ডানেও নেই; আমরা 'জোট নিরপেক্ষ'। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর যুগে, ঠান্ডাযুদ্ধের প্রবৃদ্ধমান তীব্রতার সময় তখন; এশিয়া ও আফ্রিকার সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলো ঔপনিবেশিক প্রভাবমুক্তির পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে। সম্পদশালী, শিল্পভিত্তিক উত্তরের সঙ্গে সদ্যমুক্ত কৃষিপ্রধান দরিদ্র দক্ষিণের সম্পর্ক কেমন হবে – বিরাট এক প্রহেলিকা ও চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দেয়। 'জোট নিরপেক্ষ' শব্দটি ভি কে কৃষ্ণ মেনন প্রথম ব্যবহার করেন, ১৯৫৩ সালে, জাতিসংঘে। মেননের বন্ধু জওহরলাল নেহরু 'জোট নিরপেক্ষ' শব্দটি আবারো ব্যবহার করেন ১৯৫৪ সালে। কাগজে কলমে 'জোট নিরপেক্ষের' জন্মসাল ১৯৬১ সাল; এবং পোশাকী নাম 'জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন' ওরফে ন্যাম অর্জন করে আরো পরে, ১৯৭৬ সালে -মিসরের কায়রোতে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় প্রধানদের পঞ্চম সম্মেলনের সময়ে। ন্যামের ইতিহাসে ১৯৫৫ সালে ইন্দোনেশিয়ার বান্দুং- অনুষ্ঠিত য়ে-বান্দুং কনফারেন্স ছিল প্রথম গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এই কনফারেন্সেই সোয়েকার্নো(প্রচলিত উচ্চারণ সুকর্ন) বলেন, "অনেক প্রজন্ম ধরেই আমরা পৃথিবীতে ছিলাম বাকহীন। সেই মানুষগুলো, যারা অশেষ দারিদ্র্য ও অবমাননার মধ্যে রয়েছে, তাদের জন্য যারা সিদ্ধান্তগুলো নেয় তাতে তাদেরই স্বার্থ প্রাধান্য পায়"। ন্যাম আসলে নিজস্ব অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক আইডেনটিটি'র অন্বেষার বার্তা শোনায়। তাই ন্যাম অনায়াসে এমন মুক্ত বিশ্বের আহবান নাকচ করে, যে বিশ্বের অংশীদার বর্ণবৈষম্যবাদী দক্ষিণ আফ্রিকাও অন্তর্ভুক্ত। এই বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকার পতন ঘটে ১৯৯১ সালে। পরে সে ন্যামের সদস্য হয়; এবং বর্তমানে ব্রিকসভুক্ত দেশ একটি।
ন্যামের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সেই সময়কার পাঁচ বিশ্ব রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব : ইন্দোনেশিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট আখমেদ সোয়েকার্ণো, ভারতের প্রথম প্রধাণমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু, যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট ইয়োসিপ ব্রোয টিটো, মিসরের দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট গামাল আব্দুল নাসের ও ঘানার প্রেসিডেন্ট ডঃ কোয়ামে ন্ক্রুমা। পাঁচ দেশের এই পাঁচ নেতার সক্রিয় কর্মোদ্যোগ "পাঁচের উদ্যোগ" নামে পরিচিতি পায়। ন্যাম এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার উন্নয়নশীল দেশগুলোর গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা মঞ্চে পরিণত হয়। আকারের দিক দিয়ে বর্তমানে ন্যাম, জাতিসংঘের পরেই, দ্বিতীয় বৃহত্তম আন্তর্জাতিক সংস্থা। ন্যামের কাঠামোগত গঠণ এমন যে নিউইয়র্কে অস্থায়ী ঠিকানা ছাড়া কোন স্থায়ী কার্যালয় এর নেই। অর্থাৎ কাঠামোগতভাবে অত্যন্ত ঢিলেঢালা সংস্থা একটি।
ফলে, আপাতদৃষ্টে ষাট ও সত্তরের দশকে ন্যাম যে রাজনৈতিক আভা ও আকর্ষণের সৃষ্টিতে সক্ষম হয়, তার প্রভাব প্রতিফলিত হয় যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত বিভিন্ন দেশের ন্যাম সদস্যদেশগুলোর সঙ্গে দ্বি-পাক্ষিক ও বহু-পাক্ষিক অর্থনৈতিক চুক্তি সম্পাদনের মধ্য দিয়ে; আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, বিশ্বব্যাঙ্ক ইত্যাদির মতো আন্তর্জাতিক আর্থ-সংন্থাগুলোও ভূতপূর্ব উপনিবেশগুলোকে বুদ্ধিপরামর্শ ও সহায়সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। শেষোক্ত সংস্থাদুটো উন্নয়নশীল দেশের সেবার জন্যই মূলত প্রতিষ্ঠিত হয়। ঠান্ডাযুদ্ধের যুগে, ন্যামকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নতুন রূপে ও আদলে গড়ে ওঠে, প্রায় অলিখিতভাবে দুই শিবিরের 'প্রভাব বলয়'ও স্বীকৃতি পায়। অবশ্য বর্তমান মিলেনিয়ামে ইউরোপীয় অর্থনৈতিক বিপর্যয়কে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল, বিশ্বব্যাঙ্ক ইত্যাদির ভূমিকা পালনের রদবদল সুস্পষ্ট হতে থাকে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল 'প্রথম বিশ্বে'র বেইলআউটের ভূমিকা নেয়; 'প্রথম বিশ্ব' ও তৃতীয বিশ্বে'র চিরায়ত ধারণা বাতিল হয়ে সূচিত হয় 'দীনদৈন্যতার বিশ্বায়িত যুগের'।
বিগত শতাব্দির আশির দশকের শেষাশেষি ঠান্ডাযুদ্ধ-যুগের অবসানের সঙ্গে ন্যামের গুরুত্ব কমলেও, একেবারে বিলুপ্ত হয়নি, ঢিমেতালে কোনরকমে টিকে থাকে সে। এবং ন্যাম শেষ পর্যন্ত পশ্চিমের লাইম লাইটে আসে ২০১২ সালে, তেহরান ন্যাম সম্মেলনকে কেন্দ্র করে। এই প্রসঙ্গে পরে আসছি। সোভিয়েত ইউনিয়নের বিখন্ডায়নের দরুণ আপাতদৃষ্টে যুক্তরাষ্ট্র নিঃসঙ্গ সুপার পাওয়ার হিসেবে আবির্ভূত হয়। নতুন এক বিশ্ব-বিন্যাস সৃষ্টির সূচনা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে ইউরোপীয় ইউনিয়ন নিজেকে সংহত করার বিপুল কর্মে হাত দেয়। ইউরোপের অন্যতম বৃহত্তম ফেডারেশন, টিটোর যুগোস্লাভিয়ায় পর্যায়ক্রমে নৃতাত্ত্বিক ও র্ধমীয় সংঘাত তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। শেষপর্যন্ত ফেডারেশনটি খন্ড বিখন্ডিত হয়, একাধিক ছোট ছোট প্রজাতন্ত্রের জন্ম দেয়। সোভিয়েত অংশেও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। ঠান্ডাযুদ্ধোত্তরকালের এই নৃতাত্ত্বিক ও ধর্মীয় সংঘাতের মাধ্যমে প্রচ্ছন্নভাবে ইউরোপে ডারউইনিজম-য়ের ভিত্তি পাকাপোক্ত হয়। ন্যামের অন্যতম শরীক যুগোস্লাভিয়া তালিকাবিযুক্ত হয়, এবং ইইউ'র সম্প্রসারণ প্রকল্প অনুযায়ী প্রাক্তন ফেডারেশনের ছোট ছোট প্রজাতন্ত্রের অনেকেই হয় ইইউ'র পূর্ণ সদস্যপদ অর্জন করে বা সদস্যপদ প্রার্থি হয়। তাছাড়াও, ২০০৪ সালে মাল্টা ও সাইপ্রাস ইইউ'র সদস্য হয় ও ন্যাম বর্জন করে। তবে ন্যামে বাড়তি নতুন কিছু দেশের সংযোজনও হয় – কেউবা সদস্য হয়, কেউবা পর্যবেক্ষকের পদাধিকার পায়। যেমন, সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রের মধ্যে তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, আজারবাইজান, বেলোরুস; বা পর্যবেক্ষকের ভূমিকায় বসনিয়া ও হের্সিগোভিনা, সার্বিয়া (প্রাক্তন যুগোস্লাভ ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত ছিল), কিরগিজস্তান, তাজিকিস্তান, ক্রোয়েশিয়া, মন্টেনিগ্রো, ইউক্রেন ইত্যাদি দেশ। নতুন এই দেশগুলোর কোন কোনটির ইইউ'র, কারো বা ন্যাটো'র সদস্য হওয়ার ইচ্ছা রয়েছে, বা ন্যাটো'র সঙ্গে সহযোগিতা করছে, কারো বা নিজস্ব ভূ-খন্ডে যুক্তরাষ্ট্রের/ন্যাটোর সামরিক ঘাঁটিও রয়েছে। আবার ন্যামের সদস্য সৌদি আরব বা আফগানিস্তান ন্যাটোর "বিশেষ মর্যাদার (স্পেশাল স্টেটাস) অন্তর্ভুক্ত। বা সংযুক্ত আরব আমিরাত কি পাকিস্তান বা ওমান, কুয়েত, কাতার, জর্ডান যুক্তরাষ্ট্রের অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাষ্ট্র। পরিবর্তিত বিশ্ব-বিন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে, যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ – ট্রান্সআটলান্টিক জোট হিসেবে পরিগনিত হতে থাকে; এবং মধ্যপ্রাচ্যের পরিবারতান্ত্রিক দেশগুলো, যারা ন্যামেরও সদস্য, যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ'র সঙ্গে তাদের বন্ধুত্ব নিবিড় থেকে নিবিড়তম হয়। আশির দশকে আটবছর স্থায়ী রক্তক্ষয়ী ধ্বংসাত্মক ইরাক-ইরান যুদ্ধ ছিল ঐসব দেশের বন্ধুত্ব প্রকাশের প্রথম ব্যাপক বিস্তৃত দৃষ্টান্ত।
নতুন বিশ্ব-বিন্যাসের গড়নপ্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে; ১৫ সদস্যের ইইউ সম্প্রসারিত হয়ে ২০০৬ সালের মধ্যে ২৭ সদস্যের বিশাল এক রাজনৈতিক "সুপ্রা-ন্যাশনাল" পরিচিতি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। হয়ত বলা বাহুল্য হবে না যে "লিসবোন চুক্তি" পরবর্তীকালে ইইউ'কে পুঁজিভিত্তিক "সমাজতন্ত্রতুল্য" ব্লকের দিকে ঠেলে দেয়। ওয়ারস' চুক্তির বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে ন্যাটো'রও বিলুপ্তির সমঝোতা অগ্রাহ্য করে ইউরোপের পূর্বদিক বরাবর দেশগুলোকে সদস্যভুক্ত করে ন্যাটো আরো বৃহৎ হতে থাকে। অবশেষে রুশ হস্তক্ষেপ ইউক্রেণ ও জর্জিয়া'র ন্যাটোভুক্তিতে বাধ সাধে। ন্যাটো'র সম্প্রসারণের সঙ্গে তাল রেখে সম্প্রসারিত ইইউ'ও নিজস্ব 'স্ট্যান্ডিং সেনাদল' ব্যাটল গ্রুপস গড়ে তোলে। এবং পরবর্তীকালীন ঘটনাবলীতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউ'র সমন্বয়ে গঠিত ট্রান্স-আটলান্টিক জোটের প্রবল প্রাধান্য লক্ষ্যণীয় হয়ে ওঠে। ন্যামের জীবনীশক্তির সলতেও টিপ টিপ করে জ্বলা অব্যাহত থাকে। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ন্যামের সভাপতিত্বের পদটি ছিল দক্ষিণ আফ্রিকা, মালয়েশিয়া, কিউবা ও মিসরের হাতে; ২০১২ সালে ইরান পরবর্তী তিন বছরের জন্য ন্যামের সভাপতিত্ব গ্রহণ করে। অনেক অনেক বছর বাদে ন্যামের ইরানি সভাপতিত্ব পশ্চিমে মহা সোরগোলের সৃষ্টি করে। শোরগোলের কারণ : ন্যাম ও ইরানকে অভিন্ন স্বরূপ হিসেবে দেখা হয়। জাতিসংঘের সাধারণ সম্পাদক বান কি মুনকে ন্যাম সম্মেলনে না যাওয়ার উপদেশও দেয়া হয়। প্রধাণ পরামর্শদাতা ও মুখপাত্রের ভূমিকা পালন করে কানাডা। স্থানীয় অধিবাসীদের ওপরে ডারউইনিজম নীতির সফল প্রয়োগকারী দেশগুলোর অন্যতম হিসেবে কানাডা সুপরিচিত। পরিবর্তিত বিশ্ব-বিন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে কানাডা তার "শাক্তিরক্ষকের ভূমিকা থেকে শাক্তির্নিমাণকারী"র ভূমিকায় অবতীর্ন হতে থাকে। ইরাক যুদ্ধে কানাডা পরোক্ষভাবে অংশ নেয়, কিন্তু লিবিয়ার ধ্বংসকর্মে প্রত্যক্ষ ভূমিকা নেয়। কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রী "ইরানের কুখ্যাত মানবাধিকার রেকর্ডের" বরাত দিয়ে বান কি মুনকে লেখেন যে "ইরান আসলে তার উদ্দেশ্য হাসিলের ধান্দায় রয়েছে। তাঁর এই তেহরান ভ্রমণ প্রশাসনের বৈধতা ও অপরাধ মোচনের সহায়ক হবে, যা নাকি কানাডার দৃষ্টিকোণে বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তার প্রতি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একক এক কারণ", তাই তাঁর ন্যাম সম্মেলনে যোগদান মোটেই ঠিক হবে না। কিন্তু বান কি মুন তা অগ্রাহ্য করেন ও সম্মেলনে যান। দিনকয় আগে কানাডা ইরানের সঙ্গে কূটনৈতিক সর্ম্পক ছিন্ন করেছে।
নতুন বিশ্ব-বিন্যাসকে বিশেষভাবে ত্বরান্বিত করে একাধিক আন্তর্জাতিক ঘটনা : নাইনএলেভেনের ঘটনা; বিশ্বায়িত অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও মন্দা; খাদ্য সামগ্রীর বিশ্বায়িত অপর্যাপ্ততা, ও আরবীয় বসন্ত। নাইনএলেভেন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে "হয় আমাদের সঙ্গে আছ, নয়ত আমাদের বিরুদ্ধে তুমি" নীতির মাধ্যমে বিশ্ব রাজনীতিতে নিরপেক্ষতাকে একেবারেই নাকচ করে দেয়া হয়। সারভাইভ্যাল ফর দি ফিটেস্টে'র আরেক যুগের সূচনা করে। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাস বিরোধী নীতির অধীনে প্রথমে আফগানিন্তানে ও পরে ইরাকে যুদ্ধ পরিচালিত হয়। এর প্রায় অব্যবহিত পরপরই বাকি পরিস্থিতিগুলো ঘটতে শুরু করে। উন্নয়নশীলদেশগুলো বিভিন্ন পরিমাণে ও বিভিন্ন স্তরে নেতিবাচকভাবে আক্রান্ত হতে থাকে। আরবীয় বসন্তের ঝাপ্টায় মাগরেবভুক্তদেশগুলোতে রাজনৈতিক টর্নাডো ঘটে যায়; পরিবারতান্ত্রিকদেশগুলো অলৌকিকভাবে টর্নাডোকে ঠেকিয়ে রাখে, কিন্তু সিরিয়া ঘায়েল হয়। ইত্যবসরে বিশ্বায়িত অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে ইউরোজোনভুক্ত গ্রিস আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের কাছে সহায়সাহায্যের আবেদন করে নতুন আর্থ-বিপর্যয় যুগের সূচনা করে; আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল ও ইইউ প্রধাণত ইউরোজোনের সমস্যা সমাধানে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। আপাতদৃষ্টে বৈশ্বিক অর্থনীতির এই নিশ্চলতা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে প্রান্তিক অবস্থায় নিয়ে আসে। অপরদিকে উদীয়মান অর্থনীতি ও অধিকতর উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বিশ্ববাজারে সুপ্রতিষ্ঠিত হতে হলে, বাকিসব উন্নয়নশীল দেশকে (১৩৭টি দেশ) যে পরিমাণে 'রেডি' অবস্থায় থাকলে ভাল হত, সেই পরিমাণে 'রেডি' অবস্থায় তারা নেই (অর্থাৎ, কনসাম্পশন বা খরচ করা, বিনিয়োগ করা ও রফতানি করা – তিনের মধ্যে সমন্বয়ের অসম্পূর্ণতা)।
উপরোক্ত ঘটনাগুলো বিশ্ব-বিন্যাসকে বহুমুখি মেরুকরণের দিকে নিয়ে আসে। ফলে, পরিবর্তিত অবস্থার সঙ্গে ন্যামেরও খাপ খাইয়ে নেয়ার প্রয়োজন অনিবার্য হয়ে পড়েছে। ন্যাম আগের মতোই ইতিবাচকভাবে নন-এক্সক্লুসিভ মৈত্রীবন্ধনকে উৎসাহিত করতে পারে। যেমন, তুরস্ক, সৌদি আরব, দক্ষিণ আফ্রিকা, মিসর, ইরান বা অন্য কোন দেশ আঞ্চলিক শক্তি'র মারাত্মক প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরিবর্তে নন-এক্সক্লুসিভ মৈত্রীবন্ধনের পথ বেছে নেবে। বা ন্যামের প্রতিষ্ঠাতা দেশ ভারতের কথাই ধরা যাক। ভারত ব্রিকস (ব্রাজিল, রাশিয়া, ইন্ডিয়া, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা)ভুক্ত অন্যতম দেশ একটি। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং-য়ের যুক্তরাষ্ট্রপ্রীতি সুবিদিত, কিন্তু তিনি তেহরানে যান সবচেয়ে বড়ো প্রতিনিধির দল নিয়ে। ইরানি তেলের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আরোপিত নিষেধাজ্ঞাকে পাশ কাটিয়ে ভারত ইরানি তেল কিনছে, আবার আফগানিস্তানেও জনহিতৈষী সহায়সাহায্য দিয়ে যাচ্ছে। ২০১৪ সালে ন্যাটো সৈন্য চলে যাওয়ার পরে আফগানিস্তানে ভারতের ভূমিকা আরো বৃদ্ধি পাবে। অপরদিকে ২০০৫ সালে ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ঐতিহাসিক পারমানবিক চুক্তি সই করে বটে কিন্তু অস্ত্রশস্ত্রের বিরাট অংশ কেনার সময়ে আনুকূল্য দেয়া হচ্ছে ফ্রান্সকে; বা পারমানবিক প্ল্যান্ট নির্মাণ হচ্ছে রুশদের সহযোগিতায়। ভারতের প্রথম সারির বুদ্ধিজীবিরা ও ভাষ্যকাররা ২০১২ সালের শুরুর দিকে ভারতের বৈদেশিক নীতির ওপরে একটি দলিল তৈরি করেন; ইচ্ছাকৃত প্ররোচনা সঞ্চারের জন্যই হোক বা স্রেফ কোন কারণ ছাড়াই হোক, লেখকের দল দলিলটির নাম দেন : জোটনিরপেক্ষ ২.০. (ননএলাইনমেন্ট ২.০.)। দলিলের এক জায়গায় রয়েছে: "আমাদের অবশ্যই এমন এক অবস্থান অর্জন করতে হবে যেখানে অন্য কোন দেশ এমন অবস্থানে থাকবে না যে আমাদের ওপরে অনায়াসে অসমীচীন অন্যায় প্রভাব প্রয়োগ করবে – বা আমাদের উত্তম বিচারবুদ্ধি ও ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাদেরকে ভিন্ন জিনিস করতে বাধ্য করবে"।
জোটনিরপেক্ষ ২.০.-য়ের উপরোক্ত বাণী হয়তবা প্রেরণার মন্ত্রও হতে পারে। কার্যকর ক্ষেত্রে এই বাণী এক অর্থে অসম্ভাবিত অংশীদারিত্ব ও মৈত্রীত্বের কথা বলছে। যেমন, সিরিয়া প্রশ্নে ন্যামের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা দেশ এবং যুক্তরাষ্ট্রেরও ঘনিষ্ঠ বন্ধু দেশ মিসরের প্রেসিডেন্ট মোহম্মদ মরসি সৌদি আরব, তুরস্ক ও ইরানকে নিয়ে "কনট্যাক্ট গ্রুপ" গঠণের প্রস্তাব দেন। মরসি'র প্রস্তাবটি হয়তবা জাতিসংঘে পশ্চিমের হস্তক্ষেপমূলক ভূমিকা এবং চীন ও রাশিয়ার প্রতিবন্ধকতামূলক ভূমিকার মধ্যবর্তী একটি রফার ঈঙ্গিতবহ। একই সঙ্গে, বিগত কয়েক দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়সাহায্যের ওপর মিসরের নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে যত্নশীল মরসি। তেহরান সম্মেলনে যোগদানের আগে মরসি প্রথমে চীনে যান নতুন বিনিয়োগের সন্ধানে; মরসি'র এই রিব্যালান্সের অন্বেষার অর্থ : মধ্যপ্রাচ্যে ও সুয়েজ ক্যানালে চীনের অভিগম্যতা সম্ভব করা। আর্থিক প্রয়োজনের স্বার্থে মরসি'র মিসর আন্তর্জাতিক আর্থ-ব্যবস্থাকে পুনর্বিন্যাসের পথ বেছে নিয়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে মিসর রাশিয়া ও পারস্য উপসাগরীয় অন্যান্য দেশের বিনিয়োগকেও গ্রহণ করবে বলা যায়।
ঠান্ডাযুদ্ধোত্তর কালজয়ী হয়ে ন্যাম টিকে রয়েছে; পরিবর্তিত বিশ্ব-বিন্যাসের ক্রান্তিকালে ন্যামের প্রয়োজন শেষ হয়ে যায়নি। বিবিধ কারণে তেহরান সম্মেলনকে ঘিরে পশ্চিমে যে শোরগোল ওঠে, তা ষাট ও সত্তর দশকের ন্যামের স্বর্ণযুগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তেহরান সম্মেলনে যেমন উপস্থিত ছিল যুক্তরাষ্ট্রের কৃপাহীন শত্রু কিউবা, উত্তর কোরিয়া, ভেনিজুয়েলা, আবার ভারত, পাকিস্তান, ফিলিপাইনের বা কেনিয়ার মত সুহৃদ বন্ধুরাষ্ট্ররাও ছিল। পশ্চিমের আশঙ্কা হল : আন্তর্জাতিকভাবে অস্পৃশ্য ইরান কি অন্যায়ভাবে ন্যাম সম্মেলনকে কেন্দ্র করে কূটনৈতিক সম্মান ও গৌরব অর্জনের চেষ্টা করছে না? একইভাবে, ন্যাম কি ট্রান্স-আটলান্টিক জোটের বিরুদ্ধে কূটনৈতিক ক্যু নয়? বা জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব এডভ্যান্সড ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের ডীন ভালি নাসরের ভাষায় :"সমেম্ললন অনুষ্ঠাণের মাধ্যমে ইরান তার ওপরে আরোপিত কূটনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ভাঙ্গার প্রয়াস পাচ্ছে"। তেহরান সম্মেলনে মিসর, লিবিয়া, তিউনেসিয়া, সিরিয়াও উপস্থিত ছিল। এরা সবাই যেমন ন্যামের র্দীঘদিনের সদস্য, আবার ঠান্ডাযুদ্ধোত্তরকালীন পশ্চিমের অর্থনৈতিক নীতিমালার দ্বারা গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্তও বটে। তেহরান সম্মেলনের প্রাক্কালে চীন আফ্রিকীয় দেশগুলোকে পরবর্তী তিন বছরে ২০ বিলিয়ন ডলার আর্থিক ঋণদানের অঙ্গীকার করে। অবশ্য চীনের এই পদক্ষেপে ইউরোপীয় নেতারা সমালোচনা মুখর; তাদের মতে চীন আফ্রিকার সম্পদে বাধাহীন অভিগম্যতা অর্জনের জন্য এই নীতি অবলম্বন করেছে। কিন্তু চীন আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের মাধ্যমে ইউরোজোনকে জলের উপরিভাগে ভেসে থাকতে সহায়সাহায্য দিয়ে আসছে।
জন্মলগ্নেই ন্যাম আসঞ্জনশীল বা কোহীসিভ অস্তিত্ব হিসেবে আবির্ভূত হয়নি। ন্যাম তার সেই আদি বৈশিষ্ট্য ধরে রেখেছে। ন্যাটো কি ইইউ বা ট্রান্স-আটলান্টিক জোটের সঙ্গে ন্যামের মূল পার্থক্য এখানেই। এইসব জোটের সদস্যদেশগুলো নিজেদের মধ্যে সলিডারিটি'র মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে সামরিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সহমর্মিতা ও সহধর্মিতার গঠণনির্মাণে প্রয়াসী, ও বাধ্যও বটে। ন্যাম বরং বিভিন্ন জোটভুক্ত দেশগুলোর অপ্রতিরোধ্য প্রভাবকে, সোয়েকার্ণো' বান্দুংয়ে যা বলেছিলেন, ঠেকানোর মাধ্যম হিসেবে আবির্ভূত হয়; ন্যামের দীক্ষামন্ত্র : প্রভুত্বব্যঞ্জক ক্ষমতার হুমকিকে প্রত্যাখ্যান করো। জোটনিরপেক্ষ ২.০. (ননএলাইনমেন্ট ২.০.) দলিলটির প্রেরণার উৎস জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন ওরফে ন্যাম। কোন কোন সদস্য দেশের অর্থনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটলেও ন্যাম তার গুরুত্ব বা আস্থা হারিয়েছে, বললে ঠিক হয় না। শক্তি, জলবায়ু, খাদ্য অপর্যাপ্ততার মতো ইস্যুও যে ন্যামকে একদিন সমাধান করতে হবে না, কে জানে?
নাদিরা মজুমদার: বিশ্লেষক, লেখক, সাংবাদিক।