Published : 23 May 2020, 09:34 PM
আমার দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে অর্থনীতির অন্যতম প্রধান সূচক রেমিটেন্স নিয়ে অনেক প্রতিবেদন করেছি। সে সব প্রতিবেদনে প্রবাসী ভাই-বোনদের পাঠানো অর্থ আমাদের অর্থনীতির চাকাকে কিভাবে সচল রেখে চলেছে তার বিশ্লেষণও করার চেষ্টা করেছি। এসব প্রতিবেদন করা নিয়ে আমার সহকর্মীরা অনেক সময় বিরক্তও হয়েছেন। বার্তা সম্পাদক জাহিদুল কবির ও মুনিরুল ইসলাম তো মাঝেমধ্যেই বলতেন, "আপনি এত বেশি রেমিটেন্স-রিজার্ভের রিপোর্ট দেন কেন?" অফিসের বাইরের সাংবাদিক বন্ধুরাও হাসি-তামাশা করেন আমার বেশি বেশি রেমিটেন্স-রিজার্ভ প্রতিবেদন নিয়ে…।
কিন্তু আমি থেমে থাকিনি। যখনই নতুন কোনও তথ্য পেয়েছি, সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবেদন করেছি। প্রতিবেদন লিখতে গেলেই চোখের সামনে ভেসে উঠেছে এক একটি মায়াবী মুখ; যাদের কষ্টার্জিত অর্থে কিভাবে ফুলেফেপে ভরে উঠেছে আমাদের বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার। আর সেই ভাণ্ডারের অর্থ দিয়ে পণ্য আমদানি করে আমরা খাচ্ছি; দেশের উন্নয়ন করছি; কোটি কোটি টাকার গাড়িতে চড়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছি; রাতে শান্তিতে ঘুমাচ্ছি…!
মন্দের কারণে এতো সুখ-শান্তি-বিলাস তাদের কথা কি একবারও ভাবছি? কি কষ্টটাই না করে তারা এই টাকাটা দেশে পাঠান? পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশসহ অনেক দেশ সফর করেছি। দেখেছি তাদের কষ্ট, সেই কষ্ট লিখে প্রকাশ করতেও কষ্ট লাগে। একইসঙ্গে তাদের চোখে দেখেছি দেশের প্রতি টান-ভালোবাসা-মমত্ববোধ।
তাদের এই প্রতিদান শোধ করার জন্যই আমি রিজার্ভ-রেমিটেন্স নিয়ে বেশি বেশি প্রতিবেদন করি; ভবিষ্যতেও করব। কেননা, এতে আমি তৃপ্তি পাই; শান্তি পাই; ভালো লাগে।
ওই যে কবি গুরু গাইতে বলেছেন না 'যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে। একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো রে।' আমি গেয়েই যাবো এ গান- 'তোরা যে যা বলিস ভাই'।
কোভিড-১৯ মহামারীতে প্রবাসী ভাই-বোনেরা ভালো নেই। তাদের কষ্ট আরও বেড়ে গেছে। একদিকে প্রাণঘাতী এই ভাইরাস থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা, কাজ ফিরে পাওয়ার শঙ্কা, অন্যদিকে দেশের পরিবার-পরিজনের চিন্তায় উদ্বিগ্ন দিন কাটাচ্ছেন তারা।
কিন্তু থেমে নেই তাদের আসল কাজ। দেশে পাঠিয়েই চলেছেন অর্থ। করোনাভাইরাস সংকটে রপ্তানি আয় তলানিতে নেমে আসলেও প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স আশার আলো জাগিয়ে রেখেছে।
ঈদ সামনে রেখে সবাইকে অবাক করে দিয়ে রেকর্ড পরিমাণ রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। চলতি মে মাসের প্রথম ১৯ দিনে ১০৯ কোটি ১০ লাখ ডলার তারা দেশে পাঠিয়েছেন, যা গত এপ্রিল মাসের পুরো সময়ের চেয়েও বেশি। এপ্রিলে ১০৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। রেমিটেন্সের এই উল্লম্ফনে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডারও ফের ৩৩ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে।
করোনাভাইরাস মহামারী গোটা বিশ্বকে সঙ্কটে ফেলে দেওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের রেমিটেন্সেও পড়েছে তার প্রভাব। আশঙ্কা করা হয়েছিল, রপ্তানি আয়ের মত রেমিটেন্সও তলানিতে নেমে আসবে। কিন্তু তেমনটি হয়নি।
গত মার্চ থেকে রেমিটেন্স কমে যাওয়ায় কপালে ভাঁজ পড়েছিল সরকারের নীতিনির্ধারকদের। কিন্তু ঈদের মাস মে-তে অতীতের যে কোনও ঈদের মাসের চেয়ে রেমিটেন্স প্রবাহ বাড়ায় কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরে এসেছে। মহামারীর কারণে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই সঙ্কট চলছে। এর মধ্যেই প্রতিবারের মত এবারও ঈদে পরিবার-পরিজনের জন্য বেশি রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে বিভিন্ন দেশে থাকা কোটি বাংলাদেশির পাঠানো অর্থ। জিডিপিতে এই রেমিটেন্সের অবদান ১২ শতাংশের মত। প্রতি বছরই ঈদের আগে রেমিটেন্সে গতি আসে। গত বছরের রোজার ঈদের আগে মে মাসে ১৭৪ কোটি ৮২ লাখ ডলারের রেকর্ড রেমিটেন্স এসেছিল। প্রথম ১৯ দিনে এসেছিল ১০৯ কোটি ৪০ লাখ ডলার। এবার করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে অনেক প্রবাসী শ্রমিককে দেশে ফিরতে বাধ্য হওয়ায় এবং যারা রয়েছেন, তাদেরও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কারণে তেমন রেমিটেন্স আশা করা হচ্ছিল না।
মার্চ থেকে বৈশ্বিক পরিস্থিতি ওলটপালট হয়ে যাওয়া ওই নিরাশার দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছিল। গত মার্চে ১২৮ কোটি ৬৮ লাখ ডলারের রেমিটেন্স এসেছিল, যা ছিল গত বছরের মার্চ মাসের চেয়ে ১৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ কম। পরের মাস এপ্রিলে রেমিটেন্স আরও কমে ১০৮ কোটি ১০ লাখ ডলারে আসে, তাও গত বছরের এপ্রিলের চেয়ে ২৪ দশমিক ৬১ শতাংশ কম।
কিন্তু মে মাসে চিত্র পাল্টাতে থাকে। প্রথম ১১ দিনে ৫১ কোটি ২০ লাখ ডলার রেমিটেন্স আসে, ১৩ মে পর্যন্ত আসে ৬৮ কোটি ৮০ লাখ ডলার। ১৪ মে পর্যন্ত আসে ৮০ কোটি ডলার। ঈদের ছুটির আগে ১৯ মে তা ১০৯ কোটি ১০ লাখ ডলারে গেল। গত বছরের ঈদের মাস মে মাসের প্রথম ১৯ দিনে যে পরিমাণ রেমিটেন্স এসেছিল, এই বছরের সেই সময়ে তার সমান রেমিটেন্স এসেছে।
গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরের ১ জুলাই থেকে ১৯ মে সময়ে এক হাজার ৪৩৯ কোটি ৭০ লাখ ডলার রেমিটেন্স এসেছিল। চলতি অর্থবছরের ১৯ মে পর্যন্ত এসেছে ১ হাজার ৫৯৫ কোটি ২০ লাখ ডলার। এ হিসেবে ১৯ মে পর্যন্ত রেমিটেন্স প্রবাহে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ দশমিক ৮ শতাংশ।
ঈদের পাশাপাশি গত ১২ মে রেমিটেন্সে ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনার শর্ত শিথিল করার প্রভাবও রেমিটেন্সে পড়ছে। এখন থেকে কোনো প্রবাসী পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার বা পাঁচ লাখ টাকা দেশে পাঠালে কোনো কাগজপত্র ছাড়াই ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা পাবেন। আর ৫ লাখ টাকার বেশি রেমিটেন্স পাঠালে প্রণোদনার জন্য দুই মাসের মধ্যে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দাখিলের সুযোগ পাবেন, যা আগে ছিল ১৫ দিন।
তবে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, এই কঠিন সময়ে উপার্জন বা কাজের টাকা খুব একটা দেশে পাঠাচ্ছেন না প্রবাসীরা। জমানো টাকা যেটা ছিল সেখান থেকেই অথবা অন্য কারও কাছ থেকে ধার করে পরিবারের-পরিজনের বিপদের দিনে পাঠাচ্ছেন। সেটা ফুরিয়ে গেলে আর পাঠাতে পারবেন না। সে কারণে পরিস্থিতি কতোদিনে স্বাভাবিক হবে তার উপর নির্ভর করছে বাংলাদেশের রেমিটেন্স প্রবাহ তথা প্রবাসী ভাই-বোনদের ভবিষ্যৎ।
আর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই যে তারা আগের মতো দেশে টাকা পাঠাতে পারবেন তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই। কেননা, ইতোমধ্যে অনেক দেশের সরকার তাদের দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীদের দেশে ফেরত পাঠানোর আওয়াজ তুলেছেন। এক্ষেত্রে জাতিসংঘের একটা জোরালো ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি। দীর্ঘদিন একটি দেশে অবস্থান করে, সেদেশে কাজ করে অর্থনীতিতে অবদান রেখে চলেছে যে মানুষটি তাকে এই কঠিন সময়ে দেশে ফেরত পাঠানো কোনোভাবেই মানবিক একটা কাজ হবে না। দশ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্ববাসীকে মানবিকতার যে উদাহরণ দেখিয়েছে এক্ষেত্রে সেই প্রসঙ্গটি আমি অবশ্যই উল্লেখ করতে চাই। আর জাতিসংঘকে বলতে চাই, এই সঙ্কটকালে যে যেদেশে অবস্থান করছে, তাকে সেই দেশে রাখতে এবং কাজের সুযোগ করে দিতে হবে। একটি বড় তহবিল গঠন করে হলেও এই কাজটি করতে হবে বিশ্ব সংস্থাটিকে।
পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে এবার রেমিটেন্স ২০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি নিয়েই অর্থবছর শেষ হত; এটা নিশ্চিত করে বলা যায়। কিন্তু সেটা আর হচ্ছে না। বাংলাদেশের রেমিটেন্সের বড় অংশ আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে। জ্বালানি তেলের দাম একেবারে কমে আসায় তেলনির্ভর অর্থনীতির ওই দেশগুলোতেও দেখা দিয়েছে বড় সঙ্কট। ফলে সব মিলিয়ে আগামী দিনগুলোতে রেমিটেন্সের জন্য খুব ভালো খবর আসবে বলে মনে হয় না। তবে এরপরও রেমিটেন্সে ১০/১১ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নিয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছর শেষ হবে বলে মনে হচ্ছে।
গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা, যা ছিল আগের বছরের চেয়ে ৯ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি ছিল আরও বেশি; ১৭ দশমিক ৩২ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত দশ বছর প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের পরিমাণ বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। আর রিজার্ভ তিন গুণের বেশি বেড়েছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে দেশে আসা রেমিটেন্সের পরিমাণ ছিল ৯ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার। ওই অর্থবছর শেষে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১০ বিলিয়ন ডলারের মত। এখন সেই রিজার্ভ ৩৩ বিলিয়ন ডলারের উপরে অবস্থা করছে। জুনে অর্থবছর শেষে রেমিটেন্সের পরিমাণ ১৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি হবে বলে প্রত্যাশা করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
গোটা বিশ্বের অর্থনীতিই ওলট-পালট এখন কোভিড-১৯ মহামারীতে; তার ধাক্কায় উল্টে গেছে বাংলাদেশের অর্থনীতির সব হিসাবনিকাশও।
ওলট-পালটের এই ধারায় বাংলাদেশে এই প্রথম কোনো মাসে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ বা রেমিটেন্সের চেয়ে পণ্য রপ্তানি আয় কম হয়েছে। শুধু কমই নয়, অর্ধেকে নেমেছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো রপ্তানি আয়ের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, গত এপ্রিল মাসে বিভিন্ন ধরনের পণ্য রপ্তানি করে মাত্র ৫২ কোটি ডলার আয় করেছে বাংলাদেশ। আর এই একই মাসে ১০৮ কোটি ১০ লাখ ডলারের রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন বিভিন্ন দেশে অবস্থানরত প্রবাসী বাংলাদেশিরা। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি যে রপ্তানি আয় রেমিটেন্সের চেয়ে কম হয়েছে।
এই অন্ধকারেও যারা আলোর মশাল জ্বালিয়ে রেখেছেন তাদের প্রশংসা করার ভাষা আমার জানা নেই। শুধু জানাই স্যালুট। স্যালুট তোমাদের! তোমরাই বাংলাদেশের হৃদয়!
শেষ করতে চাই কবি গুরুকে দিয়েই-
আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি
তুমি এই অপরূপ রূপে বাহির হলে জননী!
ওগো মা, তোমায় দেখে দেখে আঁখি না ফিরে!
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে।