Published : 22 May 2020, 09:55 PM
আমার চার দশকের বাদ্যযন্ত্র,
গানের খাতা নথিপত্র,
পুড়াইয়া করেছে ছাই,
মনের দুঃখ কার কাছে জানাই
ও ভাইরে ভাই —
বাউল রণেশ ঠাকুরের গানটি ফেইসবুকে ফিরছে কান্না, আক্ষেপ আর বেদনার তুমুল হাহাকার নিয়ে। রাতের আাঁধারে আসর ঘরটি আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে দুর্বৃত্তেরা। এমন কাজটি কারা করতে পারে? ভেবে পায় না রণেশ ঠাকুর। কারও সাথে বিরোধ হয়েছে কিনা, নিজের অজান্তেও কারও মনে কষ্ট দিয়েছে কিনা, মনে করার চেষ্টা করেন। ঠিক মনে করতে পারেন না। কাউকে সন্দেহ করতে মন সায় দিচ্ছে না। এমন নির্বিরোধী মানুষ তিনি।
গত চল্লিশটি বছর ধরে তিল তিল করে সংগ্রহ করা সঙ্গীত সাধনার জন্য প্রয়োজনীয় অনুসঙ্গই ছিল একমাত্র সম্বল তার। গানের বই, খাতা, বেহালা, দোতরা, ঢোল, ছইট্টা, হারমোনিয়াম এসব নিয়ে সাজিয়েছিলেন প্রিয় ঘরটি। নাম দিয়েছিলেন 'আসর ঘর'। সপ্তাহে, মাসে আসর বসতো কাছে দূরের পথ থেকে আসা সতীর্থ সঙ্গীত পিপাসু বাউলদের নিয়ে। প্রতিদিন নিয়ম করে শিল্পীদের গলা সাধতে হয়। নিয়ম করে নতুন শিল্পীরা আসতেন গান শেখার জন্য। ঘরটি ছিল দেবালয়ের মতো। এ ঘরে এলে কেমন যেন পবিত্রতায় উদ্ভাসিত হত মন।
গুরুর শেখানো গানগুলো আজও কেমন জীবন্ত! মনে হয় গুরুজী বাউল-সম্রাট শাহ আবদুল করিম যেন এখনও নিত্য আসরে যোগ দেন! নতুন নতুন তৈরি করা গানগলো গুরুর চরণে উৎসর্গ করে আনন্দে ভরে যেত মন। একেকদিন সুরের আবেশ আর বাদ্যযন্ত্রের ঝঙ্কারে সঙ্গীতের মুর্চনায় বিভোর হয়ে যেত সবাই। মানুষের কথা, জীবনের কথা, ধর্মের নিগূঢ় বাণী-সত্য ও সুন্দরের কথাই তো তার গানের মূল উপজীব্য, তাহলে কেন এমন হলো, ভেবে পান না রণেশ। তার মন ভেঙ্গে খানখান হয়ে যায়।
রণেশ ঠাকুর এটাও জানেন যে পৃথিবীর সবকিছু তো তার গানের মতো সুন্দর ও পবিত্র নয়। এখানে মানুষ আছে, মানুষের উপর মানুষের নিষ্ঠুর শোষণ আছে, আছে জাত-পাতের ব্যবধান। মানুষের স্বার্থপরতা আছে। সত্য সুন্দর মানবধর্মের বিপরীতে আছে ধর্মের নামে কুৎসিত অধর্ম।
এইতো মাত্র কয়েক বছর আগের কথা। রাজবাড়ির পাংশায় ২৮ জন বাউলের চুল দাড়ি কাঁচি-দা দিয়ে কেটে ফেলা হয়েছিল। ঘটনার দিন মোহাম্মদ ফকিরের বাড়িতে অতিথি হয়ে দূরদূরান্ত থেকে আমন্ত্রিত বাউলরা এসেছিলেন। এলাকার প্রভাবশালী লোকজন এই বাউলদের জোর করে ধরে নিয়ে যায় মসজিদে, বলা হয় বাউলরা ধর্মচ্যুত হয়ে গেছে। সুতরাং জোর করে তওবা পড়ানো হয়, তাদের লম্বা লম্বা চুল দাড়ি জোর করে দা দিয়ে, কাঁচি দিয়ে কেটে দেওয়া হয়। দা দিয়ে কাটতে গিয়ে একজনের ঘাড়ের কাছে কেটে রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছিল । হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছিল।
লজ্জায়,অপমানে ষাটোর্ধ্ব মোহাম্মদ ফকির বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলেন। ভয়ে এলাকার কোন লোক প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি, বাউলদের বিরুদ্ধে এমন কুৎসা রটানো হয়েছিল যেন কেউ তাদের পক্ষ নেওয়ার কথা ভাবতে না পারে। ওখানকার প্রশাসনের লোকজন এবং তৎকালীন এমপি জিল্লুর হাকিমের ভাষ্য ছিল এমন যে, বাউল নির্যাতনের বিষয়টা 'একটা তুচ্ছ ঘটনা '।
তুচ্ছ ঘটনা তো বটেই। দয়া করে এখনও যে পৃথিবীতে জীবিত রাখা হয়েছে তাদের!
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শফিউল আলম ছিলেন লালন ভক্ত একজন চিন্তাশীল মানুষ। ২০১৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিয়ে বাসায় ফেরার পথে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় তাঁকে। লোকটি বিভিন্ন জেলায় ঘুরে ঘুরে লালনের গান সংগ্রহ করতেন, আখড়ায় বাউল শিল্পীদের সাথে কথা বলতেন, নিমগ্ন থাকতেন লালন সাধনায়।
এ ধরনের মানুষদের হত্যা করার পর কিছু কমন কথা প্রচার করা হতো। যেমন 'ইনি নাস্তিকতা প্রচার করতেন', 'ফেসবুকে আল্লাহ রসুলের বিরুদ্ধে কটূক্তি করতেন', তার ক্লাসে মেয়েদের বোরখা পরা নিষিদ্ধ করেছেন' ইত্যাদি। শফিউল আলমের ক্ষেত্রেও এ ধরনের প্রচারই হয়েছিল। কিন্তু তার ক্লাসের ছাত্র ছাত্রীরা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষকেরা প্রতিবাদ করে বলেছিলেন,'এসব একেবারেই মিথ্যাচার'।
মিথ্যাচারই হল বাউল নিপীড়কদের প্রধান অস্ত্র।
মিথ্যাচারের এই অস্ত্রটি তারা ব্যবহার করে সর্বত্র। যেমন করেছে নেত্রকোনার কেন্দুয়ায়। এই উপজেলার বাসিন্দা আবদুল হালিমের বাড়িতে লালন ভক্তদের নিয়মিত আসর বসতো, যেখানে লালন গানের বাইরে নানা বিষয়ে আলোচনা হতো।
২০১৬ সালের নভেম্বর মাসে আয়োজিত সেই আসরের বার্ষিক অনুষ্ঠানটি পুলিশ বন্ধ করে দিয়েছে। 'হেফাজতে ঈমান' নামের একটি সংগঠন লিফলেট বিলিয়ে অপপ্রচার চালায়। ইউএনও'র কাছে অভিযোগ করে 'বাউলরা অনৈসলামিক কাজ করে'। অনৈসলামিক কাজের একটি উদাহরণ; বাউলরা 'জয় গুরু বলে'। তো এই গুরুতর অভিযোগ পেয়ে মহান পুলিশবাহিনী সদর্পে চড়াও হয় অনুষ্ঠান আয়োজকদের উপর।
প্রশাসন আর তথাকথিত ঈমানের হেফাজতকারীরা যখন একই সুরে কথা বলে, তাকে চ্যালেঞ্জ করে অনুষ্ঠান করার শক্তি কী গ্রামের সেই নিরীহ বাউলদের থাকে?
এ বছর জানুয়ারি মাসে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে শরিয়ত সরকার নামে যে বাউলকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এখনও সেই বাউল শিল্পী জেলে অন্তরীণ আছেন। পালা গানের নিয়ম অনুযায়ী আলোচ্য বিষয়ে বয়াতি বা শিল্পী তার নিজস্ব ঢংয়ে কিছু কথা বলেন। এদিন তিনি জানতে চেয়েছেন কোরানের কোন আয়াতে গান নিষিদ্ধ করা হয়েছে? চ্যালেঞ্জ দিয়েছেন,কেউ প্রমাণ দিতে পারলে তিনি গান ছেড়ে দেবেন এবং পঞ্চাশ লক্ষ টাকা পুরস্কার দেবেন।
তিনি যে প্রশ্ন এবং চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন তার জবাব পাওয়াতো দূরের কথা সেই শিল্পীকে গ্রেপ্তার করে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে এই স্বীকারোক্তি আদায় করে নেওয়া হয় যে, বাউল গানের অনুষ্ঠানে যা বলেছেন তার জন্য তিনি অনুতপ্ত!
বাউল নিপীড়নের জন্য সকল স্থানে যেন ওঁৎ পেতে বসে আছে কায়েমী স্বার্থবাদী এক শ্রেণির মানুষ। এর পক্ষে আছে রাষ্ট্রীয় কালাকানুন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিযোগকারী 'অনুভূতিতে' আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার কথা বলেন। ব্যস, তাতেই হয়ে যায়।
এরপরে আর কিছুই যেন বিবেচনায় নেওয়ার থাকে না। অনেক সময় পুলিশ নিজেই অনুভূতিপ্রবণ হয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে দেয়। এর পর অস্বাভাবিক দ্রুতগতিতে অভিযুক্তকে ধরে জেলে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
মজার ব্যাপার হচ্ছে বাউল নির্যাতনের মামলায় অভিযুক্তদের গ্রেফতারে পুলিশের তৎপরতা দেখা যায় না। কোথাও কোথাও ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে নিপীড়কদের গ্রেফতার করতে বাধ্য হলেও শুরু হয়ে যায় স্থানীয় প্রশাসন, এমপি ও ক্ষমতাসীন মহলের উদ্যোগে আপসরফার তৎপরতা।
এই যখন বাংলাদেশে বাউল শিল্পীদের অবস্থা তখন রণেশ ঠাকুর তার বাড়িতে অগ্নিকাণ্ডের জন্য বিচারপ্রার্থী হওয়ার জন্য মনোবল পান না।
রাতে অগ্নিকাণ্ডের পর গোটা দিন তিনি মনের দুঃখে কেঁদেছেন। খুব ভোরে খবর পেয়েই উদীচী দিরাই শাখার বন্ধুরা ছুটে গিয়েছেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন।
সুনামগঞ্জ জেলা উদীচীর সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বেশ কবার ফোনে কথা বলেছেন। বিকেলে যখন রণেশ ঠাকুরকে ফোন করি তখন বেচারা ক্লান্ত বিধ্বস্ত। ঠিকমত কথা বলতে পারছিলেন না। ধারণা করতে পারি সারা দিন নানা কিসিমের লোকজনের সাথে কথা বলে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলেন। থানায় অভিযোগ দেওয়ার কথা বলায় ইতস্তত করছিলেন।
উদীচী তার পাশে থাকার অঙ্গীকার করেছে শুনে গলার স্বরটা একটু একটু করে বাড়ছিল। আশপাশের শুভানুধ্যায়ী সতীর্থ বন্ধুরাও সাহস দিয়েছেন। সকলের পরামর্শ মেনে থানায় অভিযোগ দায়ের করেছেন। এখন দেখার বিষয় প্রশাসন কী ধরনের তৎপরতা চালায়।
শারীরিককভাবে নির্যাতন, একঘরে করে দেওয়া , হুমকি-ধামকি এসব এখন বাউলদের নিত্য উপহার।
অথচ ইউনেস্কো ২০০৫ সালে বাউলসঙ্গীতকে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে ঘোষণা করেছে। ইউনেস্কোর এই স্বীকৃতি বাংলাদেশের জন্যও এক বিরাট গর্বের বিষয়।
ইতোমধ্যে ইউনেস্কোর উদ্যোগ ও সহযোগিতায় বাংলাদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বাউল গানের বিশাল ভাণ্ডার থেকে প্রায় পাঁচ শ গান সংগ্রহ করে সংকলিত করা হয়েছে, যেখানে শতাধিক গানের ইংরেজি অনুবাদ ও দেড়শ গানের স্বরলিপি যুক্ত করা হয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলার অমূল্য সম্পদ বাউল গান সংরক্ষণের জন্য জরুরি ভিত্তিতে বাউলশিল্পী অধ্যুষিত অঞ্চল সিলেট, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, নাটোর প্রভৃতি অঞ্চলে ফিল্ড ওয়ার্ক শুরু করা উচিৎ। না হলে কালের গর্ভে অনেক গান এবং গানের সুর হারিয়ে যাবে।
একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, বাউলসম্রাট শাহ আব্দুল করিমের একনিষ্ঠ শিষ্য রণেশ ঠাকুরের বই, খাতাপত্র ও অন্যান্য সামগ্রী পুড়িয়ে দেওয়ার ফলে বিশ্ব ঐতিহ্য ও সভ্যতার এক বিরাট ক্ষতি করা হলো।
এটি সাধারণ কোনো অপরাধ নয়, বরং সামগ্রিকভাবে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক, উদার মানবিক সংস্কৃতির উপর এক বিরাট আঘাত।
মাটি, মানুষ, প্রকৃতি, জীবনবোধ, ধর্ম, প্রেম ও দেশের কথাই বেশিরভাগ সময় উঠে এসেছে বাউল সাধকদের কথায় গানে ও জীবনাচরণে। এর পাশাপাশি সকল অন্যায়, অবিচার, কুসংস্কার আর সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদের বিরুদ্ধে বাউলরা সকল সময়ে সোচ্চার থাকেন তাদের বাণী ও সুরে। আজ তাই এই তথাকথিত তুচ্ছ ঘটনাগুলোকে তুচ্ছ করে না দেখে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।
সমাজে যখন অমানবিকতার দাপট চলছে এমন সময়ে বাউলদের কাছেই আমাদের যেতে হবে। তারাই সমাজের প্রকৃত শিক্ষক ও বিবেকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে মানুষকে মানবিকতাবোধে উদ্বুদ্ধ করতে পারেন। তাই আক্রান্ত বাউলের পাশে দাঁড়ানো সমাজের সচেতন অংশের নৈতিক দায়িত্ব।
অবশ্য যারা সমাজের ঘটনা দুর্ঘটনায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার আগে সরকার বা বিশেষ দলের লাভক্ষতির হিসেব কষেন, যারা নিজেদের বিবেক ও হিতাহিত জ্ঞানকে সঁপে দিয়েছেন শাসকগোষ্ঠীর পদপ্রান্তে, তাদের কাছ থেকে নৈতিক অবস্থান গ্রহণের প্রত্যাশা করা যায় না।
আউল-বাউল লালনের দেশের বাদবাকি বিবেকবান ও হৃদয়বান মানুষেরা একতারার পক্ষাবলম্বন করবেন এটাই প্রত্যাশিত। পুড়িয়ে ছাই করে দেয়া 'ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ' কে দুই বান টিন আর বিশ হাজার টাকা দিয়ে মিটমাট করার চেষ্টা করলে দেশের মানুষ তা মানবে কেন?