Published : 22 May 2020, 06:06 PM
রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, অন্তরে অতৃপ্তি রবে/সাঙ্গ করি মনে হবে/শেষ হয়ে হইল না শেষ! যদিও ছোটগল্পের সংজ্ঞায় এই কবিতার বহুল ব্যবহার লক্ষণীয়, কিন্তু হাল আমলেও এই কবিতা অপ্রাসঙ্গিক নয়। করোনাকাল শেষ হইয়াও শেষ হচ্ছে না। ঝুলে থাকছে! দফায় দফায় ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হচ্ছে। ২০২০ সনের মার্চের শেষ কয়দিন, পুরো এপ্রিল আর মে মাসের ১৬ তারিখ পর্যন্ত ছিল করোনাভাইরাসের জন্য অন্তরীণ বা লকডাউন থাকার মেয়াদ। এই ছুটিও ৩০ মে পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। মে মাসের শেষ সপ্তাহে ঈদুল ফিতর। এরপরও ছুটি হয়তো বাড়বে, খানিক খোলামেলা আকারে খুলে দেয়া হবে দোকানপাট, কলকারখানা বা যানবাহন। সবকিছু 'সীমিত'-এর এই সময়ে শুধু করোনাভাইরাস নির্ভর 'সৃষ্টিশীলতা' সীমিত আকারে চালু নেই বরং এটা সবকিছু ছাপিয়ে যাচ্ছে! এই সৃষ্টিশীলতা শুনে বা জেনে মানুষের দিনকাল হয়তো খানিক ভাল কাটছে অন্তরীণ জীবনে। কয়েকটা উদাহরণ দেয়া যাক-
এক. স্বামীর যত্ন: ডাক্তারকে টেলিফোন করে এক ভদ্রমহিলা বলছেন, আমার স্বামী বাইরে থেকে বাড়ি ফিরলে জুতো, জামা, প্যান্ট ডেটল আর সাবান জলে পরিষ্কার করে ওকে পুরো গোছল করিয়ে দেই। এরপর এক মিনিট ধরে হাত ধোয়াই। গলা পরিষ্কারের জন্য লেবুর শরবৎ খাওয়ানোর পর লবনের সাথে গরম জল মিশিয়ে গারগল করাই। ডাক্তার সাহেব আর কী করতে পারি? ডাক্তার উত্তর দিলেন, প্রেসার কুকারে ঢুকিয়ে দুই তিনটা সিটি বাজিয়ে নিতে পারেন!
দুই. বিজ্ঞাপন: করোনা নিয়ে টেনশন আর নয়। কারণ বিজ্ঞাপন বেরিয়েছে। বিজ্ঞাপনের ভাষা এমন, আর নয় ভয়/হবে করোনা জয়/বেরিয়েছে করোনা থেকে বাঁচার জন্য বিশেষ তাবিজ-যোগাযোগ…,,,
বিজ্ঞাপনে একটা মোবাইল নম্বরও দেয়া হয়েছিল। জানি না যিনি বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন বিভ্রান্তি ছড়ানোর জন্য তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে কিনা! নাকি কেউ ফান করার জন্য ফেসবুকে এসব ছড়িয়েছিল?
তিন. নতুন ভাবার্থ: আগে 'লকআপ' (lock up) মানে ছিল পুলিশের হেফাজতে থাকা। ইদানিংকালে লকডাউন (lock down) মানে হচ্ছে-বউয়ের হেফাজতে থাকা!
চার. নতুন বন্ধুত্ব: করোনাভাইরাস স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্কের নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। যেমন, স্বামীর সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন সাংবাদিক। সাংবাদিক জানতে চাইলেন সম্পর্কের নতুন দিগন্তটা কেমন? স্বামীর উত্তর, একেবারেই অন্যরকম। বউয়ের সাথে এত ঘনিষ্ঠ ভাবে কখনো দিন কাটাইনি। বন্ধুত্ব এতই গভীর হয়েছে যে পুরোনো গার্লফ্রেন্ডের সাথে আমার সম্পর্কের ভেতর-বাহির শেয়ার করেছি বউয়ের সাথে। সাংবাদিক জানতে চাইলেন বউয়ের প্রতিক্রিয়া কী? স্বামী দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, সে এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। আমি বুঝতে পারছি না এটা ঝড়ের আগের পূর্বাভাস কিনা!
পাঁচ. নতুন প্রার্থনা: সীমিত পরিসরে দোকানপাট-মার্কেট খুলে দেবার সরকারি ঘোষণার পর (যদিও ঢাকার বসুন্ধরা, যমুনা বা নিউমার্কেট নাকি খুলবে না) দেশের তাবৎ স্বামীরা নাকি প্রার্থনা করছেন ঈদের আগে কোনোভাবেই যেন মার্কেট খোলা না হয়!
ছয়. পাল্টাপাল্টি নতুন কবিতা: করোনাকালে নতুন করে এবং জোরালো ভাবে ফিরে এসেছে সেই পুরোনো বিতর্ক। বিশ্বাস আর অবিশ্বাস কিংবা বিজ্ঞান-অবিজ্ঞানের বিতর্ক। এসব নিয়ে দুটো কবিতা বেশ জনপ্রিয় হয়েছে-
ক. যদি বেঁচে যাও এবারের মতো/যদি কেটে যায় মৃত্যুর ভয়/জেনো বিজ্ঞান লড়েছিল একা/মন্দির মসজিদ নয়!
খ. ক্ষমা যদি পাও এবারের মতো/কেটে যায় যদি ভয়াল দিন/জেনো বিজ্ঞান অসহায় হয়ে/প্রভূকে ডেকেছে অন্তহীন!
সাত. নতুন প্যারোডি: করোনার কাল ও ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম নিয়ে নতুন প্যারোডি গানের দেখা মিলেছে। ময়মনসিংহ গীতিকার জনপ্রিয় লোকধাচের গান সখি আমার মন ভালা না এর অনুকরণে প্যারোডি গানের কথা এমন- গোডাউনে পিয়াজ বন্দী/চাউলে বন্দী ঘর/খাটের নীচে তেলবন্দী/গরীব তোরা মর/সখিগো আমার মন ভালা না… এসব নিয়ে বোধ করি খুব একটা বেশি লেখা ভালা না!
আট. নতুন কৌতুক:
ক. প্রেমিক প্রেমিকার চ্যাটিং হচ্ছে, প্রেমিক: জানু তোমার আব্বু কী চেয়ারম্যান?
প্রেমিকা: হুম ঠিক বলেছ। তুমি হবা চেয়ারম্যানের জামাই।
প্রেমিক: তাইলে জানু কষ্ট করে একটু টেলিভিশনের খবর দেখ। হবু শ্বশুর আব্বা 'চালচোর' হিসেবে গ্রেফতার হয়েছেন!
খ. জাতীয় পরিচয় পত্রে নাম দেয়া হয়েছিল 'কমলাকান্ত'। পরিচয় পত্র পাওয়ার পর দেখা গেল সেখানে লেখা 'করোনা আক্রান্ত!'
গ. স্ত্রী: লকডাউন উঠে গেলেও তোমাকে অফিসে যেতে দেব না ডার্লিং। বাসাতেই আদরে আদরে রাখব।
স্বামী: সত্যি বলছ?
স্ত্রী: হ্যা গো। কারণ তোমার হাতের কাজ কিন্তু বাসার বুয়ার কাজের চেয়ে অনেক ভাল! আমাদের আরও বেশি ভালবাসাবাসির সময় কাটাতে বুয়াকে বিদায় করে দিয়েছিলাম। তাকে আর ফেরত আনব না।
ঘ. ইতালি ফেরত একজনের করোনাভাইরাস পজেটিভ। তার পরিবারকে কোয়ারেন্টিনে রাখা হলো। এরপর প্রেমিকের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী জানা গেল তার গার্লফ্রেন্ড চার জন! বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর সবার সাথেই তার দেখা হয়েছে এবং প্রেমিক সাহেব তাদের গিফটও দিয়েছেন। ফলাফল চার গার্লফ্রেন্ডের পরিবারও কোয়ারেন্টিনের আওতায় এখন!
নয়. করোনার নতুন ব্যাখ্যা: করোনাভাইরাস নাকি অনেক রোগের চেয়ে ভাল! যেমন, ডায়াবেটিস ও ব্লাডপ্রেসার। একবার হলে থামে না, সারে না! সেই তুলনায় নাকি করোনাভাইরাস ভাল, ওয়ান টাইম! ক্যান্সারের চেয়ে নাকি করোনাভাইরাস ভাল কারণ এত ব্যয়বহুল না! এমনকি স্ট্রোকের মতো না যে বিছানায় পড়ে থাকতে হবে। এখন পর্যন্ত সরকারি হাসপাতালে করোনাভাইরাসের চিকিৎসা হয় যার মানে বেশি খরচ হয় না! বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা হয় না বললে চলে, সুতরাং ব্যয়বহুল না! করোনাভাইরাসের সমস্যা আসলে ১৪ দিনের! এক ১৪ দিন যায়, আরেক ১৪ দিন আসে, শুধু করোনাভাইরাসকে ১৪ শিকের ভেতর ঢোকানো যায় না!
দশ. নতুন সমস্যা: করোনাভাইরাস শেষে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে এক তরুণী। তার বাচ্চা হবে। ডাক্তার জানতে চাইলেন বাচ্চার বাবা কে? তরুণী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, চিনতে পারিনি! হাতে হাতমোজা আর মুখে মুখোশ পরে আসতো তো!
এগার. করোনা প্রতিষেধক: করোনাভাইরাসের সাথে লড়াই করতে হবে। ভয় পেলে চলবে না। বউকে ভয় পেতে হবে। লড়াই করলে হবে না। দয়া করে এই দুটোকে গুলিয়ে ফেলবেন না। কোনোটারই ওষুধ বের হয়নি।
বার. করোনাদায়িক (করোনা+সাম্প্রদায়িক) চীনারা টাচ ফোন বানালো। টাচ টিভি বানালো। টাচ ঘড়ি বানালো। এই পর্যন্ত ঠিক ছিল। কিন্তু শালারা শেষমেষ টাচ রোগও বানিয়ে দিল আমেরিকা যেটাকে বলছে চায়না ভাইরাস! সমস্যা হলো চীন ঠিকই সামলে উঠেছে কিন্ত আমেরিকায় করোনাভাইরাসে যত লোক মারা গেছে ভিয়েতনাম যুদ্ধেও তত লোক মারা যায়নি! আর তাই আমেরিকায় যে কৌতুক ছড়িয়ে পরেছে তা এমন- ট্রাম্প, পুতিন ও বরিস গেলেন দোজখে। পুতিন দোজখের প্রহরীর কাছে গিয়ে বললো, রাশিয়ায় একটা কল করতে হবে। সেখানে করোনার শেষ খবর জানতে হবে। কল করার পর প্রহরী জানাল টেলিফোনের বিল হয়েছে বিশ হাজার ডলার। এরপর বরিস কল করলেন ইংল্যান্ডে। তার বিল হলো পচিশ হাজার ডলার। এই দুই জনের দেখাদেখি ডনাল্ড ট্রাম্প কল করলেন আমেরিকায়। কল শেষে তার বিল এলো একশ ডলার। বরিস আর পুতিন দোজখের প্রহরীর কাছে জানতে চাইলেন ট্রাম্পের বিল এত কম কেন? দোজখের প্রহরী জানাল ক্ষমতায় আসার পর ট্রাম্প আমেরিকাকে নরকের চেয়েও খারাপ বানিয়ে ছেড়েছে। তাই ট্রাম্পের টেলিফোন বিল ছিল লোকাল কলের রেট অনুযায়ী!
তের. সীমিত বয়ান: সরকার যে সীমিত আকারে সবকিছু খুলে দিচ্ছে বা সীমিত আকারে লকডাউন শিথিল করছে তার প্রতিক্রিয়া কী সীমিত থাকছে নাকি করোনাভাইরাস আরও বেড়ে যাচ্ছে? সবশেষে তাই সীমিত বয়ান শুনে বিদায় নেই:
সীমিত টেস্ট
সীমিত আক্রান্ত
আর সীমিত লকডাউনের ভেতর-
সীমিত আকারে ব্যাংক চলছে
সীমিত আকারে দোকানপাট মার্কেট খুলেছে
সীমিত আকারে মসজিদ খোলা হয়েছে
সীমিত আকারে সরকারি অফিস আদালত আর ব্যাংক চলছে
সীমিত আকারে মানুষ বাড়ছে রাস্তায়
প্রতিদিন সীমিত আকারে বাড়ছে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা
তাহলে কী ভবিষ্যতে আমাদের বেঁচে থাকার সীমিত সম্ভাবনা
আরও সীমিত হয়ে আসছে?