Published : 16 May 2020, 06:26 PM
''বন্যেরা বনে সুন্দর, সৈন্যরা ব্যারাকে'' লেখা পোস্টারে ছেয়ে গিয়েছিল চট্টগ্রামের দেয়ালগুলো। আনিসুজ্জামানের এক বক্তৃতা থেকে উদ্ধৃতি নিয়ে তখনকার ছাত্র সমাজ মুক্তির এই স্লোগান তৈরি করেছিল। এরশাদের স্বৈরাচারী শাসনকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে আনিসুজ্জামানের নির্ভীক উচ্চারণ, ''যদি মনে রাখি যে, বন্যেরা বনে সুন্দর, সৈন্যরা ব্যারাকে এবং পুষ্প উদ্যানে, তাহলে জীবন অনেক সুস্থ হয়।'' ঐ সময়ে অনেক প্রথিতযশাই আপোষের আস্তাবলে নিজেদের সপে দিতে দুবার ভাবেননি তখন তিনি স্বৈরশাসকের মুখোমুখি দাঁড়ানোর এক মহৎ প্রত্যয় নিয়ে মাথা উঁচু করে বেঁচে ছিলেন। অন্যদের বেঁচে থাকার তরিকা দেখিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু ইস্পাত কঠিন যাপনের জীবন কজনই বা অর্জন করতে পারে।
Autobiography is a wound where the blood of history does not dry, গায়ত্রী চক্রবর্ত্তী স্পিভাকের এই চিন্তার সাথে কি আশ্চর্যভাবে মিলে যায় প্রফেসর এমেরিটাস আনিসুজ্জামানের লেখা আত্মজীবনীটি। না শুকানো রক্তের ধারা, আরো নানা ধারা-উপধারা যা কিছু জীবন পরিক্রমায় পার করেছেন, তার ভেতর-বাহির, ঘটনা-অঘটন প্রায় সবই অংশ হয় সেই পরিক্রমার! আনিসুজ্জামানের 'বিপুলা পৃথিবী' সেই পরিক্রমারই ফলিত প্রকাশ! যেখানে কেবল নিজের জীবনকেই সত্য শব্দের বিন্যাসে মেলে ধরেননি, একই সমান্তরালে নতুন স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের সামাজিক মানস কাঠামোর নির্মোহ অন্বেষণেও তিনি সচেষ্ট ছিলেন। জীবনীকারের একান্ত জীবন স্রোতের সঙ্গে সদ্য স্বাধীন এক দেশের সূচনা কাল মিলেমিশে ইতিহাসের এক ভিন্নতর বয়ান তৈরি করেছে। আদতে এ যেন একের জীবনস্মৃতি সমবায় নয়, যেন বহুর জীবনের অংশ, সমষ্টির আত্মকথন!
নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উত্থানের পটভূমিতে আনিসুজ্জামানের 'বিপুলা পৃথিবী' আত্মজীবনীর শুরু, সেটি পরে বিস্তৃত দেশের ইতিহাসের তিন দশকের পটভূমি জুড়ে। ইতিহাসের বহু ঘটনা তিনি দেখেছেন ভেতর থেকে। বহু উদ্যোগে সক্রিয় থেকেছেন নিজেও। 'বিপুলা পৃথিবী'তে রয়েছে বাংলাদেশের এক অন্তরঙ্গ সামাজিক উচ্চারণ। বইয়ের শুরুতে জীবনীকারের 'নিবেদন' অংশ থেকে ধারাবাহিকভাবে পত্রিকায় প্রকাশমুহূর্তের এমন 'কৈফিয়ত' উদ্ধার করা যায়, "কেউ কেউ অবশ্য সাবধান করে দিয়েছেন এই বলে যে, যত কাছাকাছি সময়ের কথা বলতে যাবো, তা নিয়ে তর্ক তত প্রবল হবে। এই সাবধানবাণীর সত্যতা আমিও মানি। বিতর্ক এড়াবার একমাত্র উপায় কিছু না-লেখা। না-লিখতে মনটা সায় দিলো না। নিজের সম্পর্কে জানানোটা জরুরি নয়, কিন্তু যা দেখেছি যা শুনেছি, তার অনেকখানি গুরুত্বপূর্ণ। "
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বিদ্যায়তনিক যুক্ততার বাইরেও আর কতভাবে যে নিজেকে ব্যাপ্ত ও ব্যস্ত রেখেছিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়টায় ভারতে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান দায়িত্ব নেন শরণার্থী হয়ে যাওয়া প্রবাসী শিক্ষকদের সংগঠন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদকের। পরে অস্থায়ী সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে কাজ করেন।
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের শুরুতে যুক্ত হন দেশের সংবিধান তৈরির মহাযজ্ঞে। সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হওয়া সংক্রান্ত স্মৃতিচারণে তিনি লিখেছেন, "একটা অনাস্বাদিত শিহরণ জাগল দেহে মনে, এই আমার স্বাধীন দেশ, তার সংবিধান রচনার কাজে হাত দিয়েছি।" ড. কামাল হোসেন যে ইংরেজি মুসাবিদাটি তৈরি করতেন, ড. আনিসুজ্জামান, নেয়ামাল বাসির প্রমুখের হাতে তা বাংলায় অনূদিত হতো। সংবিধানের ইংরেজি পাঠটি ছিল মূল বাংলাটির অনুবাদ। এবং এও বলা হয়, 'বাংলায় এই সংবিধানের একটি র্নিভরযোগ্য পাঠ এবং ইংরেজিতে অনূদিত একটি র্নিভরযোগ্য অনুমোদিত পাঠ থাকিবে এবং উভয় পাঠ র্নিভরযোগ্য বলিয়া গণপরিষদের স্পিকার সার্টিফিকেট প্রদান করিবেন' (বাংলাদেশ সংবিধান অনুচ্ছেদ ১৫৩ (২) ); এরপর অনুচ্ছেদ ১৫৩ (৩) এ বলা হয়েছে, 'বাংলা-ইংরেজি পাঠের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে বাংলা পাঠ প্রাধান্য পাইবে।' নিবন্ধকারের মতো আরো অনেক আইনজীবীর পেশাজীবনে সংবিধানের পাঠ অনুধ্যানে এর বাংলা পাঠ যেন এক আন্তরিক সহায়।
তিনি চাইলেই উপরিভাসা অবলোকন প্রক্রিয়ায় দায় সারতে পারতেন। এই প্রসঙ্গে সংবিধানের বাংলা ভাষ্য প্রণয়নে উদ্ভূত বিতর্ক বা বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষানীতির কথা বলা যায়। তিনি ভ্রান্তি স্বীকারেও অকপট ছিলেন। যেমন সংবিধান প্রণয়ন কালে পার্বত্য জনগোষ্ঠীকে বুঝতে না পারার ব্যর্থতার কথাও বলেছেন তার লেখায়, "পাহাড়িদের নৃতাত্ত্বিক ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য যে সেদিন আমরা উপলব্ধি করতে সমর্থ হইনি, এ ছিল নিজেদের বড় রকম এক ব্যর্থতা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে প্রেরণা পেয়েও যে পাহাড়ি জাতীয়তাবোধের বা চাকমা জাতীয়তাবোধের সূচনা হতে পারে, এ-কথা একবারও আমাদের মনে হয়নি।" (বিপুলা পৃথিবী পৃষ্ঠা ৫৯)
'বিপুলা পৃথিবী' থেকে তার কথা মনে করেই শেষ করা যায়, "কথা ফুরোয় না, সময় ফুরিয়ে যায়। লেখায় ছেদ টানা যায়, জীবন কিন্তু প্রবহমান। জীবন ক্রমাগত সামনের দিকেই চলে। আমাদের পথচলা এক সময় থেমে যায়, জীবন থামে না।" ঠিক তাই, আনিসুজ্জামানের বিপুল কৃতির উজ্জ্বল উত্তরাধিকারীরা প্রজ্জ্বল রাখবে তার চিন্তা দীপ।