Published : 08 May 2020, 07:12 PM
কবি নির্মলেন্দু গুণ পহেলা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে তার ফেইসবুক পৃষ্ঠায় কয়েক লাইনের একটি লেখায় রাজনৈতিক অবস্থান পুনর্বার পরিষ্কার করেছেন। পুনর্বার বলছি কারণ তার রাজনৈতিক অবস্থান লুকোছাপা কিছু না। তিনি তার ছাত্রজীবন ও কবিতার সঙ্গে সহযাত্রার শুরু থেকেই বাংলাদেশের জন্ম, আওয়ামী লীগের রাজনীতি, স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনৈতিক সঙ্কটে বঙ্গবন্ধু এবং তার দল আওয়ামী লীগ এর সঙ্গে নিবিড় যোগসূত্র রেখেছেন। এজন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন। ফেরারি জীবনযাপন করেছেন। এ প্রসঙ্গে পরে আরো বিশদ আলোচনা করা যাবে। এমন কি এই দল থেকে ১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন পর্যন্ত চেয়েছেন। এরপর নতুন করে কবি নির্মলেন্দু গুণ তার রাজনৈতিক অবস্থান পরিষ্কার করার জন্যে সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। তিনি এক কথায় বলেছেন, "আওয়ামী লীগ ও আমার সম্পর্ক ইতিহাস নির্ধারিত"। এতে দোষের কী আছে?
কবি গুণের এই মন্তব্য ঘিরে রীতিমত তোলপাড় শুরু করেছে একদল লেখক এবং পাঠক। এই তোলপাড় শিষ্টাচার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সৌন্দর্য ডিঙিয়ে কুৎসিত রূপ নিয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে আমার পর্যবেক্ষণ তুলে ধরতে চাই – কয়েকটা ঘটনা এবং ঐতিহাসিক সূত্র উল্লেখ করে।
কবি রফিক আজাদ বলেছিলেন, মানুষ রাজনৈতিক জীব। কবিরাও মানুষ। কোনো কোনো কবি রাজনীতি প্রসঙ্গে নীরব থাকেন। এই নীরবতাও এক ধরনের রাজনীতি।
আহমদ ছফা খালেদা জিয়ার সঙ্গে টেলিফোনে কথোপকথনে নেত্রীর আমন্ত্রণের জবাবে বলছেন, আপনি যদি নিজে রান্না করে খাওয়ান, তাহলে আসব। শেখ হাসিনা আমাদের নিজে রান্না করে খাইয়েছিলেন। সেই আহমদ ছফা বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক অবস্থান সমর্থন করে বলেছিলেন, তিনি যদি বুদ্ধিজীবীদের কথা শুনতেন, বাংলাদেশ স্বাধীন হত না।
এবার অন্য একটি প্রসঙ্গে আসি, প্লেটো তার কল্পিত রাষ্ট্র থেকে কবিদের নির্বাসন দিয়েছেন। সেটারও একটা ব্যাখ্যা আছে। ব্যাখ্যায় যাই থাকুক আমরা একবিংশ শতাব্দীতে এসে কোনো কল্পিত রাষ্ট্রে নাই। আমাদের বসবাস বাস্তব রাষ্ট্রে, আর এই বাস্তব রাষ্ট্রে বসবাস করে একজন কবি বাস্তবতাকে উপেক্ষা করেন না। এই বাস্তবতা রাজনীতি বিবর্জিত নয়। তাই কবির রাজনৈতিক অবস্থান যেমন থাকবে, তেমনি দলীয় সমর্থনও থাকতে পারে। তাতে দোষের কিছু নাই – তা যদি দেশপ্রেমের বিপরীতে বা দেশদ্রোহী না হয়।
এ পর্যায়ে আমরা যদি বড় দাগের উদাহরণ দি-ই, তাহলে স্মরণ করতে চাই মাও সেতুংকে। যিনি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির মূল নেতা যেমন ছিলেন, পাশাপাশি বড় কবিও ছিলেন। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে চাই, তার কবিতা বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন আমাদের আরেকজন রাজনীতির বড় কবি শামসুর রাহমান।
উদাহরণ আরো আছে, কম করে হলেও ভারতের দুইজন প্রধানমন্ত্রী বড় কবি ছিলেন। তারা হলেন, বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং এবং অটল বিহারী বাজপেয়ী।
আমরা অনেকেই জেনে থাকব, কবি এজরা পাউন্ড দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ইতালির একনায়ক মুসোলিনির সমর্থক ছিলেন। এই অপরাধে তিনি মার্কিন কর্তৃপক্ষের বিরাগভাজন হন। কারাবন্দি হন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে জাতিসংঘের দ্বিতীয় মহাসচিব দগ হেমারশল্ড গোপন কূটনীতি চালিয়ে এজরা পাউন্ডকে মুক্ত করেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, দগ হেমারশল্ড নিজেও একজন কবি। পাউন্ডের পক্ষে হেমারশল্ডের যুক্তি, এজরা পাউন্ডের মত একজন কবি মুসোলিনীকে সমর্থন দিয়ে ভুল করতে পারেন। তাই বলে তিনি অপরাধ করেছেন, সেটা মনে করার কারণ নাই। তিনি শুধু সমর্থন করেছেন। তিনি তো মুসোলিনির পক্ষে যুদ্ধাপরাধে অংশ নেননি। এজরা পাউন্ড প্রসঙ্গ এইটুকুই।
এবার রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গে কিছু কথা বলি। রবীন্দ্রনাথ কংগ্রেসের জনসভায় বক্তৃতা করেছেন, অন্য নেতাদের ইংরেজি বক্তৃতা বাংলায় অনুবাদ করেছেন। তিনি জনসভা মঞ্চে গানও গেয়েছেন। ভারতের কংগ্রেসের হাত ধরে তার লেখা গান সে দেশের জাতীয় সঙ্গীত হয়েছে।
এই দিকে বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগের হাত ধরে রবীন্দ্রনাথের লেখা গান বাংলাদেশেরও জাতীয় সঙ্গীত হয়েছে। এই জন্যে কী ভারতে কংগ্রেস বিরোধীরা আর বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ বিদ্বেষীরা রবীন্দ্রনাথ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবেন?
নির্মলেন্দু গুণ যেমন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু আর স্বাধীনতা নিয়ে কবিতা লিখেছেন। তেমনি রবীন্দ্রনাথও তার বন্ধু ভারতের স্থপতি মহাত্মা গান্ধীকে নিয়ে একটি বই লিখেছেন। গান্ধী শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের স্কুলের পেছনে অর্থসাহায্যও জুগিয়েছেন। যেমনটা নির্মলেন্দু গুণ তার কাশবন বিদ্যালয়ের জন্যে শেখ হাসিনা, তার দল ও সরকার থেকে সাহায্য ও সহযোগিতা পেয়ে থাকেন।
কাজী নজরুল ইসলামের রাজনৈতিক অবস্থানও পরিষ্কার ছিল, তার লেখায়। যে কারণে তিনি জেল পর্যন্ত খেটেছেন। তার দুঃসময়ে রবীন্দ্রনাথসহ অন্য লেখকদের সাহস ও অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। তিনি কংগ্রেসের হয়ে নির্বাচনও করতে চেয়েছেন। পরে নমিনেশন না পেয়ে স্বতন্ত্রভাবে দাঁড়িয়ে কম ভোট পেয়েছিলেন।
এমনকি আমাদের আদি কাব্য চর্যাপদের কবিরাও রাজনীতির বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন না। পাল বংশের পতনের পর সেন আমলের গোড়াপত্তনকালে চর্যাপদের কবিরা দেশ থেকে পালিয়ে বেঁচেছিলেন।
১৯৭৫-এর পর নির্মলেন্দু গুণ হুলিয়া মাথায় নিয়ে বিপদ পাড়ি দিয়েছেন।
হলফ করে বলে দেয়া যায়- একজন কবির রাজনৈতিক অবস্থানের সঙ্গে একজন পাঠক একমত হতেও পারেন, নাও হতে পারেন। এই স্বাধীনতা একজন পাঠকের আছে।
আমার প্রশ্ন হল, নির্মলেন্দু গুণের রাজনৈতিক অবস্থানে যারা নাখোশ, তারা কারা? তাদের এত জ্বালা ধরে কেন? আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশের জন্মের সঙ্গে শামসুর রাহমানের কবিতা ছাড়াও কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতার সম্পর্ক ইতিহাস নির্ধারিত। এটা তিনি নিজে বললেও যেমন সত্য, না বললেও সত্য। নির্মলেন্দু গুণ ১৯৬০ দশকে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদর্শিতার সমর্থনে তাকে উৎসর্গ করে কবিতা লিখেছেন, কবিতাটি কারাবন্দী বঙ্গবন্ধু পড়ে খুশি হয়েছিলেন। এরপর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে নির্মলেন্দু গুণের সাক্ষাত হয় ১৯৭২ সালে। বঙ্গবন্ধু কবি গুণকে 'আপনি' সম্বোধনে কথোপকথন চালিয়েছিলেন। যা বঙ্গবন্ধু চিরাচরিত 'স্নেহশীল ঢঙ' এর বিপরীত ছিল। এ সাক্ষাতে কবি গুণের সঙ্গী ছিলেন কবি আহমদ ছফা, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, কবি মুহম্মদ নুরুল হুদা। এদের একজন বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, আপনি গুণকে তুমি বলতে পারেন। তিনি বলেছিলেন, গুণ তো কবি।
এবার কবি নির্মলেন্দু গুণের আওয়ামী লীগ নিয়ে মন্তব্য প্রসঙ্গে ফিরে আসি। তার মন্তব্যের জের ধরে কেউ কেউ তাকে মেরুদণ্ডহীন, দলকানা, চামচা সুযোগ সন্ধানী শব্দপদবাচ্যসহ নানা অপ্রকাশযোগ্য কুৎসিত শব্দচয়নে আক্রমণ করেছেন। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, করোনকালের অন্তরীণে, ঘরবন্দি থেকে যেন প্রাণে বেঁচে গেছেন কবি।
দেশের কোটি মানুষ আওয়ামী লীগকে, শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিলে আপত্তি না থাকলে, একজন কবি সমর্থন দিলে দোষটা কোথায়? আওয়ামী লীগ বা এর অঙ্গ সংগঠনের কিছু কিছু কর্মকাণ্ডে নাখোশ হবার কারণ থাকতে পারে। তাই বলে যে দলের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু, যে দল একটি স্বাধীন দেশ দিয়েছে, ধর্ম নিরপেক্ষ সংবিধান দিয়েছে, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করেছে, ১৯৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে, অর্থনৈতিক সামাজিক নানা ক্ষেত্রে অনেক ইতিবাচক সংস্কার ও উন্নয়ন সাধন করেছে, সেই দল তো অপাঙক্তেয় হযে যেতে পারে না। এই দল ভুলত্রুটির উর্ধ্বে সে দাবি কবি নির্মলেন্দু গুণও যেমন করেন না, সাধারণ আদমী হিসেবে আমিও করি না। তাই বলে দলটি কী অচ্ছুৎ হয়ে গেল?
তবে মোদ্দা কথা হল, একজন কবি যখন কোনো দলের সমর্থক তখন তিনি তার মাথাটা দলের কাছে বিক্রি করেন না। সেটা কবি নির্মলেন্দু গুণও করেননি, এই দলটি'র অনেক কর্মকাণ্ড বা সিদ্ধান্তের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে তিনি নিজের মতামত দিয়েছেন। এরকম উদাহরণও কম নয়। এক্ষেত্রে একজন কবি সব বিকল্প থেকে সম্ভাব্য ভাল বিকল্পটিই বেছে নেবেন। কবি নির্মলেন্দু গুণের অবস্থানও তাই। এখন আমার একটি সাদামাটা প্রশ্ন, ১৯৪৯ সালে আওয়ামী লীগের জন্মের পর থেকে দোষগুণ মিলিয়ে আজকের বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের চেয়ে ভাল বিকল্প কোনটি? আর এই দলের নেতা বা দেশের কর্ণধার হিসেবে শেখ হাসিনার চেয়ে ভাল বিকল্প কী?
প্রকৃত কবি সময়কে যেমন বোঝেন, ভবিষ্যতটাও তেমন দেখেন। এই ঘোরতর সঙ্কটকালে কবি নির্মলেন্দু গুণ বুঝেশুনেই আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার প্রতি তার সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন। এখানে পানি ঘোলা করে আঁতলামি করার কিছু নাই। আঁতলামি নিয়ে বেশি কথা নাই বা বললাম। সৌন্দর্য রক্ষা করে মতপ্রকাশের অভিপ্রায়কে স্বাগত জানাই। কবি নির্মলেন্দু গুণ যেমন বলেন, Let the dogs bark.