Published : 06 May 2020, 12:44 PM
এটি ছিল বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। গত ডিসেম্বরে চীনে প্রথম যখন এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে তখন কেউ ঘুণাক্ষরেও কল্পনা করতে পারেনি, কি এক মহাবিপর্যয় অপেক্ষা করে আছে বিশ্ববাসীর জন্য। অল্প কিছুদিনের মধ্যে এই ভয়ঙ্কর জীবাণু ছড়িয়ে পড়ে সারা পৃথিবীতে। বিশ্বের ২০০টিরও অধিক দেশে প্রায় ৩.৫ মিলিয়ন মানুষ আজ কোভিড-১৯ নামক এই ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত, প্রাণ হারিয়েছেন ২ লাখেরও অধিক মানুষ। এর শেষ কোথায়? বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সতর্ক করে বলেছেন, সহসাই এই প্রাণসংহারী জীবাণুর হাত থেকে মুক্তি নেই মানুষের। সুতরাং, সকলকে ধৈর্য্য এবং সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে মোকাবেলা করতে হবে এই মহামারীকে।
এখন পর্যন্ত এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে যেহেতু কোনো প্রতিষেধক নেই, তাই প্রতিরোধই হচ্ছে এর থেকে বাঁচার একমাত্র উপায়। আর এই প্রতিরোধের অন্যতম অস্ত্র হচ্ছে, সামাজিক বা শারীরিক দূরত্ব নিশ্চিত করা। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এই সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে তাৎক্ষণিকভাবে লকডাউন বা মানুষ এবং যানবাহন চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। ফলে থমকে যায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। যেহেতু এই লকডাউন কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধারণার চেয়েও দীর্ঘায়িত হচ্ছে, এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে প্রান্তিক এবং নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর ওপর – যারা মূলত দিন আনে দিন খায়। এদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন, বন্ধ হয়ে গেছে তাদের আয়-রোজগারের পথ। ফলশ্রুতিতে, জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সংগ্রহ করা তাদের জন্য ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে। বিশ্বখ্যাত বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, "কিছু মানুষের ক্ষেত্রে, অনাহারের কারণ যথেষ্ট খাবার না পাওয়া। যথেষ্ট খাবার না থাকা এর কারণ নয়।" তবে কি আমরা ধীরে ধীরে ধাবিত হচ্ছি এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতির দিকে?
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) নির্বাহী পরিচালক ডেভিড বিসলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, বিশ্ব এখন এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি যা করোনাভাইরাস সৃষ্ট মহামারী থেকেও ধ্বংসাত্মক হবে। আমরা যদি এখনই প্রস্তুতি না নেই তবে প্রতিদিন আমাদের দেখতে হবে ৩০০,০০০ নিরীহ মানুষের প্রাণহানী! তিনি আসন্ন এই পরিস্থিতিকে আখ্যা দিয়েছেন ভয়াবহ এক মানবিক বিপর্যয় হিসেবে। ডব্লিউএফপি অবশ্য কোভিড-১৯ সৃষ্ট মহামারীর আগেই খাদ্যসংকট নিয়ে বিশ্বকে সতর্ক করেছিল। সিরিয়া, ইয়েমেন, লেবাননসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চলমান সহিংসতা; কঙ্গো, সুদান, ইথিওপিয়াসহ আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে পঙ্গপালের আক্রমণ এবং দীর্ঘস্থায়ী খরা পরিস্থিতি এই খাদ্য সংকটের কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। আর সাম্প্রতিক সময়ে মরার উপর খাড়ার ঘা হিসেবে যোগ হয়েছে করোনাভাইরাস সৃষ্ট তাণ্ডব।
অবিশ্বাস্য হলেও এটাই নির্মম বাস্তবতা যে, বিশ্বে এখনও প্রতিরাতে প্রায় ৮২ কোটি মানুষ খিদে পেটে ঘুমোতে যায়। এর মধ্যে ৫৫টি দেশের ১৩.৫ কোটি মানুষ রয়েছে চরম খাদ্য সংকটে অর্থাৎ এই সমস্ত অসহায় মানুষ একদম অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটান। ডব্লিউএফপি'র আশংকা, বর্তমানে চলমান মহামারীর কারণে সৃষ্ট সংকটের কারণে আরও প্রায় ১৩ কোটি মানুষ এই তালিকায় যুক্ত হবে। কোটি টাকার প্রশ্ন: করণীয় কী? সংস্থাটির মতে, অনুদানের অর্থ বাড়ানো যাতে করে বিনামূল্যে এই দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে খাদ্য সহায়তা দেয়া যায়, ধীরে ধীরে ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত বিঘ্নসমূহ কাটিয়ে ওঠা এবং স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করা।
খুব স্বাভাবিক কারণে প্রশ্ন জাগে, বিশ্বের এই কঠিন বাস্তবতার নিরিখে আমাদের অবস্থান কোথায়? চাহিদা এবং যোগান এই দুই আঙ্গিকে আমাদেরকে এই অবস্থা বিশ্লেষণ করতে হবে। প্রথমেই আসা যাক সরবরাহ বা যোগানের পরিস্থিতি কী? বাংলাদেশ বর্তমানে খাদ্যশস্য বিশেষ করে চাল উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। গত বছরে দেশে উৎপাদিত হয়েছে প্রায় ৩ কোটি ৭০ লক্ষ মেট্রিক টন চাল। আমাদের বার্ষিক চালের চাহিদা আনুমানিক ২ কোটি ৯০ লক্ষ থেকে ৩ কোটি লক্ষ টন। তবে, আমাদের গম আমদানি করতে হয় যার পরিমাণ প্রায় ৬০ লক্ষ টন। গম আমদানিতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান মিশর, ইন্দোনেশিয়া, আলজেরিয়া ও ব্রাজিলের পরে পঞ্চম স্থানে। আমরা বর্তমানে বছরে প্রায় ১২ লক্ষ টন গম উৎপাদন করি। আলু উৎপাদনেও আমরা উদ্বৃত্ত। ৭০ লক্ষ টন চাহিদার বিপরীতে আমাদের উৎপাদন হয় ১ কোটি টনের বেশি। আমাদের আরেকটি প্রধান খাদ্যশস্য ডাল উৎপাদনে ঘাটতি রয়েছে। মসুর ডালের বার্ষিক চাহিদা ৫ লক্ষ টনের বিপরীতে আমাদের এখানে বর্তমানে উৎপাদন হয় ২ লক্ষ ৩০ হাজার টন। অর্থাৎ আমাদের চাহিদার প্রায় ৫৪ শতাংশ আমদানি করতে হয়। পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ২৪ লক্ষ টনের বিপরীতে আমাদের উৎপাদন হয় ২৩ লক্ষ টন। তবে যেহেতু উৎপাদিত পেঁয়াজের প্রায় ৩০ শতাংশ স্বাভাবিক কারণে পচে যায় তাই ঘাটতি পূরণে আমাদের ৮ লক্ষ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। সবজি, মাছ, ডিম এমনকি মাংস উৎপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ।
কৃষি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন নিঃসন্দেহে ঈর্ষণীয়। চাল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ। চীন, ভারত এবং ইন্দোনেশিয়া রয়েছে বাংলাদেশের ওপরে। সবজি উৎপাদনে আমাদের অবস্থান তৃতীয়। আলু উৎপাদনেও বাংলাদেশ বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছে। কিছুদিন আগে যেখানে আলু আমদানি করতে হতো সেখানে এখন বাংলাদেশ রপ্তানি করছে। আলু রপ্তানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আরও সম্ভাবনা রয়েছে। বর্তমানে বিশ্বে আলু উৎপাদনে আমাদের অবস্থান অষ্টম। মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ রয়েছে চতুর্থ স্থানে। সুতরাং, সরবরাহ পরিস্থিতির নিরিখে এ কথা বলা যায়, বাংলাদেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে। তবে বিষয়টাকে বর্তমান মহামারীর আলোকে দেখতে হবে।
এবারও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় বোরোর বাম্পার ফলনের প্রত্যাশা করছে সকলে। আশা কর যায় দুই কোটি টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে। এক্ষেত্রে আমাদের যে সকল বিষয়ের উপর নজর দিতে হবে:
– ধান কাটার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক কৃষি শ্রমিকের সরবরাহ নিশ্চিতের লক্ষ্যে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মাথায় রেখে নিরাপদ পরিবহনের ব্যবস্থা করা।
– যেখানে সম্ভব কম্বাইন্ড হারভেস্টার যন্ত্রের মাধ্যমে দ্রুত ধান কাটার ব্যবস্থা করা।
– ধানসহ অন্যান্য ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করা। সরকার যে পরিমাণ ধান-চাল ক্রয় করে তা উৎপাদনের তুলনায় নিতান্ত নগণ্য। ফলে সরকার ঘোষিত ন্যূনতম ক্রয় মূল্য এক্ষেত্রে কার্যকরী হয় না। তাদের প্রধানতম সীমাবদ্ধতা শস্য সংরক্ষণ করার স্থান বা গুদামের স্বল্পতা। মাত্র ২০ লক্ষ টন খাদ্য মজুদ করতে পারে সরকার। অবিলম্বে মজুদ করার সক্ষমতা বৃদ্ধি কল্পে অবকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগ করতে হবে। আপৎকালীন ব্যবস্থা হিসেবে বেসরকারি বা ব্যক্তিগত পর্যায়ের গুদাম ভাড়া নেয়া যেতে পারে।
এ বছর কৌশলগত কারণে আউশ মৌসুমের উপর বিশেষ নজর দিতে হবে। আমাদের এখানে মাত্র ৯-১০ লক্ষ হেক্টর জমিতে আউশ চাষ হয়। কৃষকদের ব্যাপক প্রণোদনা ও উদ্বুদ্ধকরণের মাধ্যমে অন্তত দ্বিগুণ জমি আউশ ধানের চাষের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। আমাদের পরবর্তী প্রধান মৌসুম আমনের ফসল ঘরে উঠতে নভেম্বর-ডিসেম্বর হয়ে যাবে। এখন থেকে আগামী ছয় মাস আমাদের বাজারে খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে এই ক্রান্তিকালে কোনো অসাধু চক্র যাতে কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করতে না পারে। পাশাপাশি আমন মৌসুমে প্রান্তিক এবং ক্ষুদ্র চাষিদের বিনা অথবা হ্রাসকৃত মূল্যে সার, বীজসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
এবার আসা যাক চাহিদা ব্যবস্থাপনার আলোকে আমাদের করণীয় কী? দীর্ঘ প্রায় দুই মাস সাধারণ ছুটি বা লকডাউনের কারণে দেশের শ্রমশক্তির একটি উল্লেখযোগ্য অংশ, যাদের অধিকাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করেন, কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। এছাড়াও অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে লোকসানের কারণে শ্রমিক-কর্মচারী ছাটাই হবে। এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে সামাজিক সুরক্ষার আওতায় নিয়ে আসতে হবে যাতে করে তারা বিনামূল্যে জীবনধারণের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ পান। আমাদের অন্তত এক বছরের একটি সামাজিক সুরক্ষা পরিকল্পনা প্রনয়ণ করতে হবে।
বারবার হোঁচট খেয়েছে বাংলাদেশ। তবে প্রতিবারই ঘুরে দাঁড়িয়েছে এদেশের অদম্য মানুষ। "জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয়।" এবারও ঘুরে দাঁড়াবো আমরা। আগাম প্রস্তুতি, সঠিক পরিকল্পনা এবং সহানুভূতিশীল নেতৃত্ব নিশ্চই এই বিপর্যয় মোকাবেলায় আলোর দিশারি হয়ে পথ দেখাবে আমাদের।