Published : 18 Apr 2020, 06:46 PM
কোভিড–১৯ গোটা বিশ্বকে তছনছ করে দিচ্ছে। মূত্যু–ভয়–আতঙ্কে ন্যুব্জ হয়ে পড়েছে পৃথিবীটা। দিন যত যাচ্ছে পরিস্থিতি ততই খারাপ হচ্ছে। বাড়ছে মূত্যুর মিছিল। ছোট–বড় সব দেশের ওপর দিয়েই বয়ে যাচ্ছে এই ঘূর্ণিঝড়।
মহামারী থেকে জান বাঁচাতে বিশ্ববাসী যে অবরুদ্ধ অবস্থা তৈরি করেছে, তাতে ওষ্ঠাগত অর্থনীতির প্রাণ, যা পৃথিবীকে ঠেলে দিচ্ছে আরেকটি মহামন্দার দিকে। করোনাভাইরাস সংকট ২০২০ সালে বিশ্বের অর্থনীতিকে ৩ শতাংশ ছোট করে আনবে বলে সতর্কবার্তা দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটি বলছে, ১৯৩০ এর দশকের মহামন্দার পর এমন সংকট বিশ্ব আর দেখেনি।
আর এই সংকট যত দীর্ঘায়িত হবে, বিভিন্ন দেশের সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে তত কঠিন পরীক্ষার মধ্যে পড়তে হবে।
চীন থেকে সংক্রমিত এক ভাইরাস বছরের শুরুতে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়ে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ হুমকির মধ্যে ঠেলে দেওয়ার সঙ্গে অর্থনীতির জন্যও বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যার ফলও ভোগ করতে হচ্ছে মানুষকেই।
ইতোমধ্যে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে দেড় লাখের বেশি প্রাণের বিনাশ ঘটিয়েছে নতুন নভেল করোনাভাইরাস, আক্রান্ত করেছে ২২ লাখের বেশি মানুষকে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, চীন ও জাপানের মতো বিশ্ব অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক দেশগুলো।
কিন্তু এই দুর্যোগেও থেমে নেই জীবন। থেকে নেই উদ্যোগ–পরিকল্পনা–যুদ্ধ। 'জীবন জীবনের জন্য' যুদ্ধে সামনের কাতারে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন চিকিৎসক–স্বাস্থ্যকর্মী, সাংবাদিক, আইন শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী ও সেনা সদস্যরা। উদ্যোগ–পরিকল্পনা নিয়ে যুদ্ধে নেমেছেন সরকার প্রধানরা।
বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। ইতোমধ্যে লাখ কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। অর্থনীতির উপর করোনাভাইরাস মহামারীর প্রভাব মোকাবেলায় তাৎক্ষণিক, স্বল্পমেয়াদী, মধ্যমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী– এই চারভাগে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে চারটি কার্যক্রম নিয়ে সরকারের কর্মপরিকল্পনা সাজিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
কোভিড–১৯ মোকাবেলার এই যুদ্ধ পরিস্থিতি বোঝানোর জন্য একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের উদাহরণ টেনেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ১৫ দিনের ব্যবধানে দুই দফায় জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে এসব পরিকল্পনা–প্রণোদনার অংক জানিয়ে মানুষকে সাহস জুগিয়েছেন।
বিরোধীদল বিএনপি এবং টেলিভিশন টকশোতে কিছু আলোচক সরকারের এসব উদ্যোগের সমালোচনা করলেও আমার বিবেচনায় এখন পর্যন্ত সরকার সঠিক পথেই এগোচ্ছে বলে মনে হয়। বিশেষ করে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতা–চেষ্টা–সাহস–উদ্যম নিয়ে আমার কোনও প্রশ্ন নেই।
পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশের মানুষের যে অন্তর্নিহিত শক্তি আছে, সেই শক্তি দিয়ে সাহসের সঙ্গে এই সংকট মোকাবেলা করে বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দেবেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা। যেমনটি দেখিয়েছেন, দশ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয়–খাদ্য দিয়ে; বাংলাদেশকে উন্নয়নের মডেল হিসেবে দাঁড় করিয়ে।
আমার মতো অনেকেরই সব চাওয়া–পাওয়ার একমাত্র জায়গা হচ্ছে এখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। অন্য কোনও মন্ত্রী বা নেতার কথা এখন দেশের মানুষ বিশ্বাস বা ভরসা করে কিনা– সে বিতর্কে আমি যাব না। তবে এটি বলতে পারি বঙ্গবন্ধুর কন্যার প্রতি মানুষের আস্থা বেড়েছে, ভালোবাসা বেড়েছে; বেড়েছে নির্ভরতা।
আর সেই নির্ভরতার জায়গা থেকেই এখন পর্যন্ত নেওয়া সরকারের পদক্ষেপগুলোর দুটি বিষয়ে আরেকটু ভেবে দেখতে বিনীত অনুরোধ করছি; পুনর্বিবেচনার দাবি জানাচ্ছি।
প্রথমেই বাংলাদেশের সব সময়ের প্রথম সারির যোদ্ধা, আমাদের অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখেন যারা, দেশের সবচেয়ে বড় বেসরকারি খাত, যাদের কল্যাণে এই কঠিন সময়েও খাদ্য নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করতে হচ্ছে না– সেই কৃষকের প্রতি আরেকটু সদয় হওয়ার অনুরোধ করছি।
কোভিড–১৯ মোকাবেলায় এক লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। এরমধ্যে রপ্তানি আয়ের প্রধান খাত তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকা এবং কৃষকদের জন্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার তহবিল গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এ দুই তহবিলের নীতিমালাও ঘোষণা করেছে।
আমার মোদ্দা কথা আসলে এই দুই তহবিল নিয়েই; তহবিলের সুদহার নিয়ে। করোনাভাইরাস মহামারীর ক্ষতি সামলে উঠতে গ্রামের ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষীদের জন্য যে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা তহবিল গঠন করা হয়েছে তার সুদের হার হচ্ছে ৪ শতাংশ।
আর পোশাক কারখানার শ্রমিকদের বেতন–ভাতা দিতে মালিকদের যে পাঁচ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হবে তা আসলে বিনা সুদেই; ব্যাংকগুলো মালিকদের কাছ থেকে মাত্র ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জ আদায় করবে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, কৃষকের ঋণের সুদের হার ৪ শতাংশ। আর পোশাক কারখানার মালিকদের ঋণের সুদের হার শূন্য।
আরেকটি বিষয় উল্লেখ না করলেই নয়, সেটি হলো সংকট মোকাবেলায় শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল জোগানের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল করা হয়েছে। এই ঋণে সুদের হার হবে ৯ শতাংশ। এর মধ্যে অর্ধেক, অর্থাৎ ৪ দশমিক ৫ শতাংশ পরিশোধ করবে ঋণগ্রহিতা শিল্প/ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। বাকি ৪ দশমিক ৫ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দেবে।
আর ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প এবং মাঝারি শিল্পে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল দিতে যে ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল করা হয়েছে তার সুদের হারও এই একই।
আমার ২৮ বছরের সাংবাদিকতা জীবনে দেখে আসছি, প্রভাবশালী ব্যবসায়ী–শিল্পপতি, যাদের 'অনেক আছে, আরও চাই, কিভাবে পাওয়া যায়' চিন্তা করতে করতে রাতে ঘুম হয় না, যাদের সরকারের উপরের মহলের লোকজনের সঙ্গে ওঠাবসা বেশি– তারাই সরকারের কাছ থেকে বেশি সুযোগ–সুবিধা পেয়েছেন।
চোখের সামনে দেখতে পেয়েছি, সোনারগাঁও হোটেলে অর্থমন্ত্রী–গভর্নরের সঙ্গে বৈঠক করে কর্পোরেট ট্যাক্স কমিয়ে নেওয়া এবং এডিআর (ব্যাংকগুলোর ঋণ–আমানত অনুপাত) বাড়িয়ে নেওয়ার নজিরবিহীন ঘটনা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের আপত্তি, বিশেষজ্ঞ মতামত এবং এমনকি বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের বিরোধিতা অগ্রাহ্য করে ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে জাতীয় সংসদে ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) বিল পাস করে 'ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র' পাকাপোক্ত করতেও দেখেছি।
ব্যাংক কোম্পানি আইনের ওই সংশোধনের ফলে এখন একই পরিবার থেকে চারজন কোনো ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে এবং একই সঙ্গে পরিচালক পদে টানা নয় বছর থাকতে পারছেন। এর সুবাদে বর্তমানে পাঁচটি ব্যাংকের চেয়ারম্যান হচ্ছে পিতা; ভাইস–চেয়ারম্যান পুত্র। অধিকাংশ বেসরকারি ব্যাংকে একই পরিবারের চার জন পরিচালক।
এই প্রভাবশালীদের প্রভাব খাঁটিয়ে 'বিশেষ' সুযোগ নিয়ে ঋণ পুনঃতফসিল করে 'খেলাপির দুর্নাম' ঘোচাতেও দেখেছি বার বার।
এই ২৮ বছরে দেখেছি, এই প্রভাবশালীরা একবারও তাদের নিজের ইচ্ছায় পোশাক কারখানার শ্রমিকদের বেতন–ভাতা বাড়াননি। মজুরি বাড়ানোর সময় আসলেই নানা টাল–বাহানা করেছেন। প্রতিবারই সরকার প্রধানকে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে।
দেখেছি, বাজেটে আসলেই এই প্রভাবশালী ব্যবসায়ী–শিল্পপতিদের দৌড়ঝাপ বেড়ে যায়। সত্য–মিথ্যা তথ্য দিয়ে সরকারের কাছ থেকে নানা সুবিধা আদায় করে নিতে।
দেখেছি, যারা যতো বেশি লবিং–তদবির করেছে তারাই সরকারের কাছ থেকে বেশি বেশি সুবিধা আদায় করে নিয়েছে। আর যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ফসল ফলিয়ে দেশের মানুষকে অন্ন দিচ্ছেন, তারা বরাবরই অবহেলিত থেকেছেন। কষ্ট করে ফলানো ফসলের ন্যায্য দামও পায়নি।
এই কঠিন সময়েও তার ব্যত্যয় দেখতে না পেয়ে অবাক হচ্ছি। প্রশ্ন জাগছে, পোশাক কারখানার মালিকরা বিনা সুদে ঋণ পেলে কৃষকরা কেনো পাবে না? কেনো বড় বড় উদ্যোক্তাদের ঋণের সুদের হার আর ছোট–ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণের সুদের হার একই হবে?
উত্তর মিলবে কিনা– জানিনা। তবে কৃষকের ৪ শতাংশ সুদের বিষয়টি দ্বিতীয় বার ভেবে দেখতে সরকারকে অনুরোধ করছি। এই বিশেষ সংকটের সময়ে কৃষকদের সুদহীন ঋণ দিতে অনুরোধ করছি। মনে রাখা প্রয়োজন, সামনের দিনে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে এক বড় চ্যালেঞ্জ। এই জন্য, কৃষি খাতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে এবং কৃষি উৎপাদন যাতে ব্যাহত না হয় তার জন্য সর্বত প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
আর যদি সেটা না হয়, তাহলে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাস্যরসাত্মক ও ব্যঙ্গধর্মী রচনার সংকলন 'কমলাকান্তের দপ্তর' গ্রন্থের উল্লেখযোগ্য রচনা 'বিড়াল' পড়েই যাব, পড়েই যাব…।
এ রচনায় কমলাকান্ত ও বিড়ালের মধ্যে কাল্পনিক কথোপকথনের মাধ্যমে তৎকালীন সমাজব্যবস্থার কঠোর নির্মম বাস্তবতা ফুটে উঠেছে। বিড়ালের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছে পৃথিবীর সব বঞ্চিত, নিষ্পেষিত, দলিতের ক্ষোভ–প্রতিবাদ। বিড়ালের তীক্ষ্ণ যুক্তির কাছে কমলাকান্ত অনেকটাই পরাজিত হয়েছে। যদিও সে তা স্বীকার করেনি। আত্মরক্ষার জন্য বিজ্ঞদের মতো নীতিবাক্য শুনিয়েছে। ওই প্রবন্ধে উঠে এসেছে 'তেলে মাথায় ঢালো তেল, শুকনো মাথায় ভাঙ্গো বেল' এমন সামাজিক কঠোরতা।
সাম্যবাদবিমুখ, ইংরেজশাসিত ভারতবর্ষের একজন সরকারি কর্মকর্তা হয়েও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একটা বিড়ালের মুখ দিয়ে শোষক–শোষিত, ধনী–দরিদ্র, সাধু–চোরের অধিকারবিষয়ক সংগ্রামের কথা শ্লেষাত্মক, যুক্তিনিষ্ঠ ও সাবলীল ভাষায় এ প্রবন্ধে উপস্থাপন করেছেন।
এই মহাদুর্যোগেও আমরা কি শুধু তেলা মাথায় তেল দিয়েই যাব? ক্ষমতাবানদের অযথা সাহায্য করেই যাব? নাকি সবার প্রতি সদয় হব?