Published : 17 Apr 2020, 03:07 PM
আমার একটা অন্ধ কেরালাপ্রীতি আছে। একটু ফুরসত পেলেই আমি কেরালা ছুটে যাই এবং বারবার যেতে চাই। কেন কেরালাকে 'God's Own Country' বা 'ঈশ্বরের গ্রামের বাড়ী' বলা হয় সেটি দেখতে হলেও কেরালা যাওয়া উচিত। কারণটা কি শুধুই নৈসর্গিক সৌন্দর্য্য? আমার মনে হয়, কেরালা রাজ্যের সবচেয়ে সৌন্দর্য্য এর চমৎকার অধিবাসীরা। এই রাজ্যের সরল, মায়াভরা, শিক্ষিত ও সদা হাসিমুখগুলি কেরালার শক্তি ও সুন্দরের উৎস। এরসাথে যোগ হয়েছে উন্নত রাজ্য ব্যবস্থাপনা।
ঈশ্বরের এই দেশটি নতুন করে বৈশ্বিক আলোচনায় এসেছে করোনাকে নিয়ন্ত্রণ করে। সারা বিশ্বের কাছে যেটি এখন 'কেরালা মডেল' নামে পরিচিত। ভারতের বিভিন্ন রাজ্য, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কেরালার কাছ থেকে জানতে চাইছে করোনাবধ মন্ত্র।
অথচ, ভারতের মধ্যে কেরালাই সবচেয়ে করোনাবান্ধব রাজ্য হওয়ার কথা। কারণ, এর প্রায় সাড়ে তিনকোটি জনসংখ্যার ১৫ শতাংশই বয়স্ক এবং জনসংখ্যার একটি বড় অংশ বিদেশে থাকে। উপরন্তু, প্রতিবছর ১০ লাখেরও বেশি বিদেশি পর্যটক কেরালায় ঘুরতে আসে। সবচেয়ে ভয়ের কথা, কেরালার কয়েক হাজার শিক্ষার্থী চীনে পড়াশুনা করে এবং শুধু উহানেই পড়াশুনা করে হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী। জানুয়ারির শেষে পুরো ভারতের প্রথম করোনাভাইরাস রোগী ধরে পড়ে কেরালাতেই এবং সেটা উহানফেরত এক ছাত্রের দেহেই।
মোটা দাগে, সবকিছুই ছিল কেরালার বিপরীতে। তারপরেও, এ মাসের ১৬ তারিখে এসে দেখা গেলো এই আড়াই মাসে কেরালায় করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগী মাত্র ৩৯৪ জন, যার মধ্যে ২৪৫ জনই (৬২.১৮ শতাংশ) সুস্থ্য হয়েছেন এবং মারা গেছেন মাত্র ২ জন (যদিও বিদেশী গণমাধ্যমগুলি মৃতের সংখ্যা বলছে ৩ জন)। এরপর এপ্রিলের দুই তারিখ থেকে করোনাভাইরাস আক্রান্তের গ্রাফ নিচের দিকে নামতে শুরু করে এবং ১৫ এপ্রিলে মাত্র ১ জন নতুন রোগী আক্রান্ত হয়েছেন।
এটা কিভাবে সম্ভব? ঈশ্বর কী তবে নিজের হাতে বাঁচিয়েছেন তার দেশকে? সম্ভবত চরম আস্তিক মানুষও এটা বিশ্বাস করবেন না।
কেরালার সাফল্যের মূল কারণ, রাজ্যটি করোনাভাইরাস মোকাবিলায় একই সঙ্গে মেডিকেল ও নন-মেডিকেল ব্যবস্থা নিয়েছে। জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে রাজ্য সরকার সচেতনভাবে আমলাতন্ত্রের পরিবর্তে ব্যবহার করেছে ধর্মীয় নেতা এবং সামাজিক সংগঠনগুলিকে। স্থানীয়ভাবে স্থানীয় সরকারের মাধ্যমেই করোনাযুদ্ধ করেছে এবং চমৎকারভাবে সবকিছু সমন্বয় করেছে। এই সমন্বিত পদ্ধতিই পরিচিত কেরালা মডেল নামে। মোটা দাগে দেখে নিই কেরালা মডেলের ভেতর-বাহির:
সমন্বয় কমিটি:
করোনাভাইরাস যখন উহানে, ইরানে এবং কোরিয়ায় আঘাত হানছে তখনই কেরালায় স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয় সেই জানুয়ারিতেই। করোনা প্রতিরোধে বিভিন্ন প্রকার কাজ ভাগ করা হয় এবং ১৭ জন বিশেষজ্ঞকে আলাদা করে বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব দেয়া হয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় এই কমিটি প্রতিদিন দুপুরে করোনাভাইরাস পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেন এবং পরের দিনের পরিকল্পনা ঠিক করেন।
বিদেশ ফেরতদের পরীক্ষা ও কোয়ারেন্টিন:
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় বিদেশ ফেরত যাত্রীদের প্রাথমিক চেকাপে। জানুয়ারির শেষদিকে উহান থেকে আসা প্রথম ফ্লাইট কেরালায় নামার আগে থেকেই কেরালার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরগুলিতে মেডিকেল টিম প্রস্তুত ছিল। বিমানবন্দরেই সকল যাত্রীর তাপমাত্রা পরীক্ষা করা হয়েছে এবং সামান্যতম উপসর্গ পেলেই তাদের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছিল করোনাভাইরাস আক্রান্ত নয়টি দেশের ক্ষেত্রে। এই দেশ থেকে যাত্রী আসা মাত্রই তাদের কোয়ারেন্টিন বাধ্যতামূলক করা হয়।
কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং:
এত কিছুর পরেও ফাঁক গলে বেরিয়ে যেতে পারেন অনেকেই। এক ইতালিয়ান দম্পতি সেটাই করেছিলেন। পরে তাদের খোঁজ নিয়ে দেখা যায় এই দম্পতি এরই মধ্যে ৯০০ জনের সংস্পর্শে এসেছেন। এদের সবার কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করে খুঁজে বের করে সবাইকেই কোয়ারেন্টিনে নিয়েছিল সরকার। খড়ের গাদায় এই সুই খুঁজে বের করতে কেন্দ্রীয় কন্ট্রোল রুম চালু হয় জানুয়ারিতে এবং প্রতি জেলার বিভিন্ন স্তরে দায়িত্ব দেয়া হয় বিভিন্ন কর্মকর্তাদের। এইসব কর্মকর্তারা যোগাযোগ করেছেন স্থানীয় পর্যায়ে।
সোশ্যাল ভলান্টিয়ার ফোর্স গঠন:
কেরালা কেন্দ্রীয়ভাবে স্বেচ্ছাসেবীদের একটি সংগঠন করেছে 'সান্নধ্য সেনা'। প্রায় চার লাখের এই ভলান্টিয়ার বাহিনীর মধ্যে ১৬ থেকে ৬৫ বছর বয়সী বিভিন্ন পেশার মানুষেরা আছেন। পুরুষের পাশাপাশি সান্নধ্য সেনায় রয়েছে নারী ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের অংশগ্রহণ।
ভলান্টিয়ারদের কার্যক্রমকে চারভাগে ভাগ করা হয়েছে। সেটা হলো কল সেন্টার অপারেশন, কাদের সাহায্য লাগবে সেটা বের করা, স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পণ্য কেনা এবং খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ঘরে ঘরে সরবরাহ। ভলান্টিয়ারের অবস্থান এবং দক্ষতা অনুযায়ী এই চারটি কাজে লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে। আর স্থানীয় পর্যায়ে ভলান্টিয়ার সমন্বয় হচ্ছে হোয়াটস্অ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে।
ঘরের কাছে করোনাভাইরাস পরীক্ষা:
এরপর প্রতিটি জেলায় একদম প্রত্যন্ত অঞ্চলে টেস্টের ব্যবস্থা করে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে টেস্ট রিপোর্ট দেয়া নিশ্চিত করে কেরালা সরকার। পিপিই বা সুরক্ষা সামগ্রীর সংকট ঠেকাতে চালু করে ওয়াক-ইন করোনাভাইরাস পরীক্ষা ব্যবস্থা। এই পদ্ধতিতে স্বাস্থ্যকর্মীরা স্বচ্ছ কাঁচের তৈরি বুথের ভেতর থেকে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা রোগীর কাছ থেকে নমুনা সংগ্রহ করবেন। এর ফলে পিপিই ছাড়াই স্বাস্থ্যকর্মীরা নিরবচ্ছিন্নভাবে পরীক্ষা করতে পেরেছেন। ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় সাড়ে সতের হাজার টেস্ট করেছে সরকার।
এরপরে ব্যাপকহারে কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করেছে সরকার। ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত ৮৮ হাজারের বেশি মানুষকে কোয়ারেন্টিনে রেখেছে। এর মধ্যে হাসপাতালে মাত্র ৫২৩ জন, বাকীরা সবাই হোম কোয়ারেন্টিনে।
করোনাভাইরাসের হটস্পট খুঁজে বের করা:
টেস্টের মাধ্যমে কোন কোন এলাকায় করোনা ছড়াচ্ছে তার একটি ডিজিটাল ম্যাপ তৈরি করে এবং ৭টি অঞ্চলকে হটস্পট ঘোষণা করে পুরো লকডাউন করে দেয় এবং ঐ অঞ্চলকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়।
কমিউনিটি কিচেন:
অন্যরাজ্য থেকে কেরালায় কাজ করতে যাওয়া শ্রমিক এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য স্থানীয় সরকার, সেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান, সমবায় সমিতি এবং সরকারের দারিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচির সহায়তায় কেরালা জুড়ে চালু হয়েছে ১২০০-এর বেশি কমিউনিটি কিচেন। এই রান্নাঘর থেকে প্রতিদিন প্রায় আড়াই লাখ মানুষকে রান্না করা খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে এবং এর ৯০ ভাগেরই বেশি বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে। বাকী ১০ শতাংশে যারা কিনে খাচ্ছেন, তাদের খাবার মূল্য মাত্র ২৫ রুপি বাসায় পৌঁছে দেয়াসহ।
কেরালার স্থানীয় সরকার (Local Self Govt.) এই কমিউনিটি রান্নাঘর পরিচালনা করে স্বাধীনভাবে। প্রতিটি এলাকার জন্য আলাদা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ আছে যার মাধ্যমে কমিউনিটি কিচেনের কাজগুলি সমন্বয় করা হয় এবং খাবার সরবরাহ করা হয়।
অতি দরিদ্র ও গৃহহীনদের পুনর্বাসন:
রাজ্য সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে অতি দরিদ্র এবং গৃহহীনদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেয় এবং তাদের বিনামূল্যে খাবারের ব্যবস্থা করে। এ কাজে তারা সাহায্য নেয় স্থানীয় সরকার এবং গ্রাম পঞ্চায়েতের। ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত ৬৫ হাজারের বেশি অতি দরিদ্র মানুষকে সহায়তা দেয় রাজ্য সরকার।
এর পাশাপাশি ৮৭ লাখ পরিবারকে প্রতি ১৪ দিন পরপর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের একটা প্যাকেট পৌঁছে দেয়া হচ্ছে বাসায়। এ প্যাকেটে মানুষের খেয়ে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় ১৭টি আইটেম রয়েছে। যার ফলে মানুষ আমাদের মতো ত্রাণ নিয়ে বাসার বাইরে আসছে না, তারা ঘরেই থাকছে এবং না খেয়ে মারা যাচ্ছে না।
মানুষ যাতে ঘরে থাকে এইজন্য আইএসপি বা ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলিকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে ইন্টারনেটের ব্যান্ডউইথ বাড়িয়ে দিতে।
মানসিক স্বাস্থ্যের দিকে লক্ষ্য রাখা:
আইসোলেশনে থাকা বা করোনায় সুস্থ হওয়া ব্যক্তিরা যাতে কোনো বৈষম্যের শিকার না হন, সেজন্য আলাদা মনোসামাজিক কাউন্সেলিং এর ব্যবস্থা করেছে কেরালা সরকার।
জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম:
গতবছর নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের সময় থেকেই কেরালাবাসীর একটি মানসিক প্রস্তুতি ছিল এবং সামাজিক দূরত্ব বা লকডাউন শব্দগুলি তাদের কাছে পরিচিত। এর সাথে যুক্ত হয়েছে রাজ্যের প্রচারণা। রাজ্যের সকল গণমাধ্যমে এগুলি প্রচারের পাশাপাশি প্রতিটি নাগরিকের হোয়াটসঅ্যাপে নিয়মিত করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বিভিন্ন বার্তা পাঠানো হতো।
কেরালা মডেল শিখতে গেলে কী করতে হবে?:
বিশ্বের অনেকেই কেরালার কাছে পরামর্শ চেয়েছেন। কেরালা মডেল শিখতে চেয়েছেন। কেরালা মডেল সম্পর্কে যদি এক কথায় জানতে চান তাহলে সেটা হলো- স্থানীয় সরকারকে শর্তহীনভাবে ক্ষমতায়ন করে, স্থানীয় রিসোর্স ও দক্ষতা তৈরি করা। কেন্দ্রের কাজ শুধু সমন্বয় করা, বাধাগুলি অপসারণ করা।
কিন্তু, কেরালা মডেল রাতারাতি গড়ে তোলা যায় না। এর পেছনে বহুবছরের বিনিয়োগ ও মেধার সমন্বয় লাগে। বহু আগে থেকেই কেরালায় সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করা হয় শিক্ষাখাত ও সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবায়। কেরালার ৯৪ শতাংশ সাক্ষরতা শুধু স্বাক্ষরে সীমাবদ্ধ নয়। আমরা যেটিকে স্থানীয় সরকার বা লোকাল গভর্মেন্ট বলি কেরালায় সেটিকে বলে লোকাল সেল্ফ গভর্মেন্ট। সেই ১৯৯৭ সালেই কেরালা রাজ্য সরকার আইন করে অর্থ ও ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করে স্থানীয় সরকারকে ক্ষমতায়ন করে। কমিউনিটি কিচেন, টেস্টিং, ভলান্টিয়ারসহ কেরালার করোনাযুদ্ধের প্রতিটি ফ্রন্টে স্থানীয় সরকার ভূমিকা পালন করছে। যার প্রতিদান কেরালা পেয়েছে এবং ভবিষ্যতেও পাবে। কেরালায় যতবার আঘাত আসবে প্রতিবারই কেরালা দাঁড়িয়ে যাবে, কারণ এর শক্তির জায়গা এর শেকড়ে। গতবার নিপাহ ভাইরাস আক্রমণ ঠেকিয়ে কেরালা ইতিমধ্যেই তার প্রস্তুতি ম্যাচ খেলে রেখেছিল।
করোনাভাইরাস পরিস্থিতি না থাকলে আমরা হয়তো কেরালা মডেল শিখতে উন্নত প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত কেরালা ট্যুর দেখতে পেতাম। যেহেতু সেই অবস্থা এখন নেই কোয়ারেন্টিন অবস্থায় শিক্ষাসফরের একটি ছোট্ট উপায় বাতলে দেই-
বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে কেরালার যুদ্ধ ও প্রস্তুতি বুঝতে হলে কেরালায় নির্মিত 'ভাইরাস' সিনেমাটি দেখা যেতে পারে। ২০১৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত মালায়ালাম ভাষার এ সিনেমাটি বাস্তব ঘটনার উপর ভিত্তি করে নির্মিত। ২০১৮ সালে কেরালাতে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেয় এবং ১৭ জন মানুষ মারা যায়। ওই সময়ে কেরালা কিভাবে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নেতৃত্বে মেডিকেল এবং নন-মেডিকেল শক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিল, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং করেছিল, আইসোলেশনে, কোয়ারেন্টিন থেকে সৎকার করেছিল এবং হাজারও জীবন রক্ষা করেছিল তার ডিটেইল বর্ণনা পাবে যাবে এই সিনেমায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ডাক্তার, ভলান্টিয়ার, লেবার ইউনিয়ন, পুলিশ, স্বাস্থ্য বিভাগ, রোগতত্ত্ব বিভাগ একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, এবং একই সুরে বেজেছিল।
বাংলাদেশে কি অবস্থা?:
রাষ্ট্রকে একটি কোম্পানির সাথে তুলনা করা হলে প্রধানমন্ত্রী হলেন সেই রাষ্ট্রের সিইও এবং ডিসিরা হলেন সেই কোম্পানির টেরিটরি ম্যানেজার। টেরিটরি ম্যানেজারা হলেন সিইও এর আঞ্চলিক চোখ। তাদের দায়িত্ব হলো তার এলাকার সঠিক অবস্থা এবং সমস্যা এবং ঘাটতির প্রকৃত চিত্র সিইওকে জানানো। করোনাভাইরাসের সময়ে আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে ডিসিদের যে ভিডিও কনফারেন্সিং হয়েছে সেটি দেখে হতাশই হয়েছি বলব। কারণ, প্রায় সব টেরিটরি ম্যানেজার তাদের সিইওকে আশ্বস্ত করে বলেছেন, তাদের কাছে কোনো কিছুরই ঘাটতি নেই, সবকিছুই পর্যাপ্ত আছে এবং প্রস্তুতি সন্তোষজনক। অনেক কিছুই যে সন্তোষজনক নেই সেটা ডাক্তার মঈনের মৃত্যু আমাদের মুখে চড় মেরে দেখিয়ে গেল। টেরিটরি ম্যানেজারদের তেল ছাড়া সরাসরি টপিকে কথা বলার অভ্যাস করতে হবে। আমি নিজে গত সপ্তাহে ঢাকার অন্যতম শীর্ষ সরকারি হাসপাতালের বহিঃবিভাগে একজন ডাক্তারকে সুরক্ষা সামগ্রী ছাড়া রোগী দেখতে দেখেছি। জিজ্ঞেস করলে তিনি জানালেন, "আজকে আমরা দুইজন ডিউটি করছি, পিপিই দিয়েছে একটা। আমি সেই পিপিইটা আমার জুনিয়রকে ডাক্তারকে দিয়েছি। জুনিয়রকে ঝুঁকিতে রেখে আমি তো পিপিই পরতে পারি না।" ওইদিকে সিইওকে বলা হচ্ছে, কোন সমস্যা নেই। তারা, কেউ তার সিইওকে ঘাটতি দেখাতে চান না, যার কারণে সিইও কিন্তু অন্ধকারেই থেকে যান এবং দেশ অন্ধকারে থেকে যায়।
বাংলার গ্রামেগঞ্জে একটি প্রচলিত আছে "ছেলেটা খেলে ভালো, কিন্তু বল পায় না" অর্থ অনেক পরিশ্রম করেও কাঙ্খিত ফল না পাওয়া। করোনাভাইরাস মোকাবেলায়ও আমরা সেখানেই যাচ্ছি। আমাদের প্রতিটি সেক্টরের করোনাযোদ্ধারা তাদের সেরাটা দিচ্ছেন- ডাক্তার, স্বাস্থ্যসেবা কর্মী, পুলিশ, ব্যাংকার, সাংবাদিক, সেনাবাহিনীসহ সবাই। কিন্তু, সারা মাঠ দৌড়েও বলটি পাচ্ছি না। কারণ, সময়মতো সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে না পারা। আমরা সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে সবকিছু বন্ধ করলাম এবং যানবাহন খোলা রাখলাম। সবাই উৎসবের উৎসাহে এটাকে ছুটি ভেবে আরামে বাড়ি চলে গেলো গাদাগাদি করে। এরপর গার্মেন্টস শ্রমিকদের বাড়ি পাঠিয়ে আবার গার্মেন্টস খুললাম। তারা চাকরি বাঁচাতে হেটে ঢাকায় চলে আসলে। এরপর আবার সিইও এর ধমক খেয়ে গার্মেন্টস বন্ধ করে ঢাকাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেললাম। যাতে যারা ঢাকায় এসেছে তারা আটকা পড়ে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী পাবলিকলি বললেন তিনি কমিটির প্রধান, অথচ তিনি জানেন না কিভাবে কি হচ্ছে।
এই লেখাটি যখন লিখছি তখন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একটি বিজ্ঞপ্তি চোখে পড়ল যেখানে সারা বাংলাদেশকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে এবং সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত সবার বাইরে বের হওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এমনটাই হওয়ার কথা ছিল। কারণ, আমরা ঈশ্বরের দেশ না। ইবনে বতুতার কথা মতো ধন-সম্পদে পরিপূর্ণ নরক। আমাদের ঘরে রাখা যাবে না, কোয়ারেন্টিনে রাখা যাবে না, আমরা হাসপাতালে মিথ্যে তথ্য দিয়ে ভর্তি হব, রাস্তায় ত্রাণ দিয়ে জনসমাগম ঘটাব। আর আশা করব, কিছুই হবে না।
করোনাভাইরাস একটি ম্যারাথন রেইস, দীর্ঘসময়ের প্রস্তুতি, সমন্বয় আর স্ট্যামিনা দরকার এই ম্যারাথন জিততে। করোনাভাইরাস অনেক দেশেরই স্বাস্থ্য ও ব্যবস্থাপনার ফুঁটো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে, আমাদেরও।
সময়টা ধন্যবাদ পাওয়ার লড়াইয়ের নয়, নয় শ্রেষ্ঠত্বের তুলনামূলক প্রতিযোগিতার। সময়টা একসাথে সমন্বিত পদ্ধতিতে কাজ করার এবং একই সুরে বাজার। দেরি হোক, যায়নি সময়।
তথ্যসূত্র: স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, কেরালা