Published : 15 Apr 2020, 05:11 PM
পৃথিবীতে প্রাণের জন্মের পর থেকে বড় বড় পাঁচটি 'মহা বিলোপ' বা ম্যাস এক্সটিঙ্কশনের ঘটনা ঘটেছে যা পৃথিবীর সমস্ত জীবকুলকে প্রায় ধ্বংস করে ফেলেছিল। প্রায় সাড়ে চারশো মিলিয়ন বছর আগে শুরু হওয়া অরডোভিসিয়ান থেকে শুরু করে ডায়নোসরের বিলুপ্ত হওয়ার কাহিনি আমরা কমবেশি সবাই জানি। মানব জন্মের পর থেকে বিশ্বে তেমনি নানান রোগ বিভিন্ন সময়ে মহামারী বা বিশ্বমারীর আকার নিয়ে মানবগোষ্ঠীর অস্তিত্বকে প্রায় বিপন্ন করে তুলেছে যার ইতিহাসও অনেক পুরানো। মানুষের এই বিপন্ন অস্তিত্বের মধ্যে সংগ্রাম আর বিজয়ের ইতিহাস তাই মানুষকে করে তোলে এক অনিবার্য সম্ভাবনার আকরে।
গুটি বসন্ত (Small Pox): সবচেয়ে পুরানো ইতিহাস এই মহামারীটির। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে গুটি বসন্ত বিদ্যমান ছিল এই পৃথিবীতে; যদিও সবচেয়ে পুরনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া যায় মিশরীয় মমির মধ্যে যা তিন হাজার বছর আগের। খ্রিষ্টপূর্ব ১০ হাজার বছর থেকে মানুষের মধ্যে অস্তিত্ব ধরলে বলা যায় এই রোগ ১২,০০০ বছর ধরে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন (৫০ কোটি) লোকের মৃত্যু ঘটিয়েছে। এখন এটি পৃথিবী থেকে একেবারে বিদায় নিয়েছে টিকার কারণে। সর্বশেষ রোগী ছিল ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের রহিমা বানু নামে তিন বছরের একটি শিশু কন্যা। ১৯৮০ সালের ৮ মে বিশ্বকে গুটি বসন্ত মুক্ত ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
প্লেগ (Plague): খ্রিষ্টপূর্ব ৪৩০ থেকে শুরু করে ছয় ছয়বার প্লেগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় ইউরোপে, আফ্রিকায়, এশিয়ায় কিন্তু ৫৪১-৫৪২ সালে এই মহামারীতে ২৫ মিলিয়ন লোকের মৃত্যু হয়েছে ইউরোপে যা 'প্লেগ অব জাস্টিনিয়ান' নামে পরিচিত। প্লেগ মহামারীর কারণ ছিল একটি ব্যাকটেরিয়া, যা ইঁদুরের শরীর থেকে কোনো সংক্রমিত করাল মাছি দিয়ে কামড় খেয়ে বা মানুষের যদি কোনো সংক্রমিত ইঁদুর নাড়াচাড়া করতে গিয়ে নিজের শরীরে প্রবেশ করে তা থেকে ছড়িয়ে পড়েছিল। এই সময়কালে কনস্টান্টিনোপল আক্রান্ত হয় প্লেগে। সেসময় এটি ছিল সম্রাট জাস্টিনিয়ানের অধীনস্ত পূর্ব রোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী। এই মহামারীর সময় ইউরোপের জনসংখ্যার অর্ধেকের মৃত্যু ঘটেছিল। প্লেগ অব জাস্টিনিয়ান বা জাস্টিনীয় প্লেগ নামে পরিচিত এই রোগটি ৭৫০ খ্রিস্টাব্দের আগ পর্যন্ত নির্মূল হয়নি। অন্যদিকে বিউবোনিক প্লেগে ১৩৪৬-১৩৫৩ সালের মধ্যে ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার কিছু দেশে প্রায় ৭৫ থেকে ২০০ মিলিয়ন (সাড়ে সাত থেকে বিশ কোটি) লোকের মৃত্যু হয় যা 'ব্ল্যাক ডেথ' নামে পরিচিত।
কলেরা (Cholera): বিশ্বে কলেরা মহামারী অনেকবার হয়েছে কিন্তু বিশ্বমারী বা প্যান্ডেমিক আকার ধারণ করেছিল সাত বার। যার মধ্যে ১৮১৭ থেকে ১৮৬০ পর্যন্ত ভারতীয় উপমহাদেশে ১৫ মিলিয়ন এবং ১৮৬৫ থেকে ১৯১৭ পর্যন্ত ২৩ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু ঘটে। রাশিয়াতে এই সংখ্যা ছিল দুই মিলিয়ন। কলেরার ধাক্কা এশিয়া ছাড়িয়ে ইউরোপ এবং মেহিকো পর্যন্ত গড়িয়েছিল। কলেরার মহামারী বিশ্বে জনস্বাস্থ্যের সাফল্যের একটি উল্লেখযোগ্য মাইল ফলক। আমি এখনও আমার ক্লাসরুমে হবু চিকিৎসক, তরুণ চিকিৎসক বা জনস্বাস্থ্য নিয়ে যারা উচ্চতর ডিগ্রি করতে আসে তাদেরকে নানান রকমের মহামারীর পরিসংখ্যা দিয়ে অংক কষতে দিই যে কীভাবে এপিডেমিওলজি তত্ত্বের ব্যবহার করে রোগটি কী কারণে হচ্ছে, কাদের মধ্যে হচ্ছে তা যেন নির্ধারণ করতে পারে। কলেরা মহামারীর সময়েই এইসব তত্ত্ব অনেক বেশি পরিণতি পেয়েছিল।
ফ্লু (Flu): ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের সংক্রমণকে ফ্লু বলা হয়। গ্রীক চিকিৎসক মেডিসিনের জনক হিপোক্রেটিস সেই খ্রিষ্টপূর্ব ৪১২ সালেই ইনফ্লুয়েঞ্জার বর্ণনা করেছেন। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের দু'টি জাত ইনফ্লুয়েঞ্জা এ, এবং ইনফ্লুয়েঞ্জা বি। ইনফ্লুয়েঞ্জা এ'র আবার কয়েকটি উপজাত আছে যেমন H1N1, H2N2, H3N2 ইত্যাদি। প্রতি বছরই একটি নির্দিষ্ট সময়ে এর প্রাদুর্ভাব হয়ে থাকে, যেখানে ২-৬ লক্ষ লোক মারা যায়। তাছাড়া বিভিন্ন উপজাত দিয়ে মহামারী হয়ে থাকে যেমন স্প্যানিশ ফ্লু (H1N1): ১৯১৮-২০ সালে ৫০০ মিলিয়ন লোক আক্রন্ত হয়েছিল যার মধ্যে ২০-১০০ মিলিয়ন লোকের মৃত্যু হয়, প্রথম ছয় মাসেই মারা গিয়েছিল ৫০ মিলিয়ন মানুষ। স্প্যানিশ ফ্লু নামে পরিচিত এই মহারারীর পেছনে একটি রাজনৈতিক ইতিহাস আছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে মূল দেশগুলো চায়নি যে তাদের শত্রুপক্ষ জেনে ফেলে তারা এই রোগে আক্রান্ত, তাই জার্মানি, অষ্ট্রিয়া, ফ্রান্স, বৃটেন এবং আমেরিকা তাদের সংক্রমণের সংখ্যা লুকিয়ে স্পেনের ওপরে চাপিয়ে দিয়েছিল। অন্যদিকে এত লোক মারা যাওয়াতে কোনো সুপার ভাইরাস দায়ী মনে করা হলেও আসলে ভাইরাসটি অন্যান্য এলাকার সংক্রমণের মতো শক্তিশালী, শুরু যুদ্ধাবস্থা, পরিবেশ, পুষ্টিহীনতা ইত্যাদির কারণে বেশি মৃত্যু ঘটিয়েছিল। এশিয়ান ফ্লু (H2N2): ১৯৪৭-৫৮ সালে প্রায় ১ বিলিয়ন লোক আক্রান্ত হয় যার মধ্যে ১-৪ মিলিয়ন লোক মারা যায়। হংকং ফ্লু (H3N2)t ১৯৬৮-৬৯ সালে প্রায় ১ বিলিয়ন লোক আক্রান্ত হয়ে ১-৪ মিলিয়ন লোক মারা যায়। প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট সময়ে টিপিক্যাল ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়, যেমন আমেরিকায় অক্টোবর থেকে মে পর্যন্ত সময়টাকে ফ্লু সিজন বলে, তবে সবচেয়ে বেশি হয় ফেব্রুয়ারি মাসে।
এইডস (AIDS): এইচ আই ভি ভাইরাস থেকে এইডস রোগ হয়, ১৯৮১ সালে এই রোগটি আসার পর এ পর্যন্ত প্রায় ৭৫ মিলিয়ন লোক আক্রান্ত এবং ৩২ মিলিয়ন লোকের মৃত্যু ঘটেছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো সাব সাহারান আফ্রিকায়। আফ্রিকায় এমনও পরিবার আছে যাদের সব প্রাপ্তবয়স্করা এইডসে মারা গেছে আর শিশুরাও বেঁচে আছে এইচ আইভি ভাইরাসকে শরীরে বহন করে।
করোনাভাইরাস (Coronavirus): ২০০৩ সালে SARS (Severe Acute Respiratory Syndrome) যা SARS-CoV নামে পরিচিত। এর প্রার্দুভাবে ৮,০০০ লোক আক্রন্ত হয় যার মধ্যে ৭৭৪ জন মারা যায়। ২০১২ সালে MERS (Middle East Respiratory Syndrome) Coronavirus যা MERS-CoV নামে পরিচিত । এর প্রাদুর্ভাবে ২,৪৯৪ জন আক্রান্ত হয়ে ৮৫৮ জন মারা যায়। এর উৎপত্তি ছিল সৌদি আরবে। মৃত্যু হার ছিল ৩৪%।
২০১৯ সালের নভেম্বরে SARS-CoV2 ভাইরাসটি যা COVID-19 নামে রোগের জন্ম দিচ্ছে, চীনে উৎপত্তি হয়ে দ্রত বিশ্বের ২১০টি দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। এ র্পযন্ত প্রায় দুই মিলিয়ন মানুষ আক্রান্ত হয়ে ১১০,০০০ জন মারা গিয়েছে। এই বিশ্বমারী আরও মৃত্যু ঘটাবে এরকম আশঙ্কা করাটা অসমীচীন হবে না।
এইসব বড় বড় মহামারী, বিশ্বমারী ছাড়াও আছে হাম (Measles), ২০১২ সালে এর প্রাদুর্ভাবে ১২২,০০০ লোকের মৃত্যু হয়। ইবোলা ভাইরাস (Ebola Virus), ২০১৪-২০১৬ সালে এর প্রাদুর্ভাবে পশ্চিম আফ্রিকায় ১১,৩০০ লোকের মৃত্যু হয় যেখানে মৃত্যু হার ছির ৪০%। তাছাড়া আরও অনেক রোগ মহামারী আকারে বা বিশ্বমারী আকারে মানুষের মধ্যে আসবে এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। নতুন করোনাভাইরাসটি যেহেতু এখন বিশ্ব মহাকারীর কারণ, একটু বিশদভাবে জেনে নেয়া যাক;
'ভাইরাস' শব্দটি যে ল্যাটিন শব্দ থেকে এসেছে তার অর্থ পয়জন বা বিষ। ভাইরাস অতিক্ষুদ্র এক অনুজীব যা খালি চোখে তো দূরের কথা, সাধারণ অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও দেখা যায় না। ভাইরাস দেখতে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ লাগে। পৃথিবী ভাইরাসময়; সাগরে পানির প্রতি মিলিলিটারে মিলিয়ন ভাইরাল পার্টিকল থাকে। ব্যাপারটা এভাবে বললে ভাল বোঝা যাবে; এই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এককোষী প্রাণী যা চোখে দেখা যায় না, কিন্তু সংখ্যায় এতো বেশি যে একটার পর একটা সারিবদ্ধ করলে পৃথিবী থেকে ২০০ আলোকবর্ষ দূরে যে গ্রহ পাওয়া গেছে, যার নাম K2-155d বা 'সুপার আর্থ' সেখান পর্যন্ত লম্বা হবে।
ভাইরাসের বেঁচে থাকতে অন্য কোনো প্রাণী দেহের কোষের ভেতরে নিজেকে বৃদ্ধি করতে হয়, না হলে মারা যাবে। ভাইরাস কেবল মানুষকে নয়, সকল প্রাণীকে আক্রান্ত করে। গাছও এ থেকে রক্ষা পায় না, এমনকি রক্ষা পায় না অন্য অণুজীব। যেমন ভাইরাস ব্যাকটেরিয়াকে আক্রমণ করে। দিমিত্রি ইভানোস্কি নামের একজন রাশান উদ্ভিদবিদ ১৮৯২ সালে লক্ষ্য করেন একপ্রকার ব্যাকটেরিয়া-অনুরূপ ছত্রাক তামাক পাতাকে খেয়ে ফেলছে। তার এই আবিষ্কারের মাধ্যমে মানবজাতি প্রথম জানতে পারে ভাইরাস নামের এক ভিন্ন অণুজীব আছে, যা ব্যাকটেরিয়া নয়। ১৮৯৮ সালে ফরাসী জীববিজ্ঞানী মার্টিনাস বাইজেরনিক একে একটি পূর্ণাঙ্গ ভাইরাস হিসেবে আবিষ্কার করেন। এটিই ভাইরাসশাস্ত্রে বহুল আলোচিত টোবাকো মোজাইক ভাইরাস নামে খ্যাত। মার্টিনাস ৫০০০ ভাইরাসের বর্ণনা লিপিবদ্ধ করেন। কিন্তু মানুষের মধ্যে প্রথম ভাইরাস আবিষ্কার করেন ওয়াল্টার রিড, ১৯০১ সালে যাকে বলা হয় ইয়েলো ফিভার ভাইরাস। ভাইরাসে থাকে (১) একটি জিনেটিক উপাদান, ডিএনএ (DNA) বা আরএনএ (RNA)-র একটা লম্বা অনু, যার ভেতরে একটি প্রোটিনের গঠন বা স্ট্রাকচার লিপিবদ্ধ (২) জেনেটিক বস্তুটিকে ঢেকে রাখা একটি প্রোটিন আবরণ (capsid) (৩) একটি ফ্যাট বা লিপিডের আবরণ।
ভাইরাস কীভাবে পৃথিবীতে এলো তা নিয়ে জীববিজ্ঞানীদের মধ্যে মতভেদ আছে। কেউ বলে ব্যাকটেরিয়া থেকে এর জন্ম, কেউ বলে প্লাজমিডস নামক কোষ থেকে কোষে চলাচলকারী ডিএনএ থেকে এর উদ্ভব। বিবর্তন প্রক্রিয়ায় ভাইরাস কিন্তু এক অত্যাশ্চর্য ভূমিকা পালন করে। আমরা যাকে বলি জিনেটিক ডাইভারসিটি বা জীববৈচিত্র্য তা সম্ভব হয় হরাইজেন্টাল বা আনুভূমিক জিন ট্রান্সফারের মাধ্যমে।
করোনাভাইরাস কী? বিজ্ঞানীরা বলছেন, ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের নিচে এই ভাইরাস ফেললে মনে হয় এরা মাথায় মুকুট পরে আছে। ল্যাটিন ভাষায় একে বলে 'করোনাম' (Coronam)। যে কাঁটাকাঁটা অংশ দেখা যায় সেগুলি আসলে স্পাইক গ্লাইকোপ্রোটিন (spike glycoproteins)। এদের মূল কাজ হল মানুষের শরীরে গ্রহীতা প্রোটিনকে খুঁজে নেওয়া। বাহক কোষের প্রোটিনের সঙ্গে জুটি বেঁধে এরা কোষের মধ্যে ঢুকতে পারে। প্রকৃতিতে কিন্তু হাজার হাজার করোনাভাইরাস আছে যা অন্যান্য প্রাণীতে রোগ সৃষ্টি করে যেমন বাঁদর, বাদুড়, উট, বিড়াল ইত্যাদি। কিন্তু এইসব প্রাণী থেকে যখন মানুষের মধ্যে চলে আসে এবং রোগ সৃষ্টি করে তাকে বলে "জুনোসিস"। এখন পর্যন্ত মাত্র সাতটি করোনাভাইরাস মানুষের মধ্যে রোগ সৃষ্টি করে বলে জানা গেছে। মানুষের শরীরে যে ভাইরাস বাসা বাঁধে, ১৯৬০-এর দশকে প্রথম তার প্রকারভেদ জানতে পারা যায়। জানা যায়, মানুষের শরীরে ছড়িয়ে পড়তে পারে এমন মোট সাত ধরনের করোনাভাইরাস রয়েছে যার প্রথম চারটি সাধারণ ঠাণ্ডা বা কম মারাত্নক রোগ সৃষ্টি করে; বাকি তিনটা মারাত্নক রোগ তৈরি করে যার মধ্যে সর্বশেষটি আজকের বিশ্ব মহামারী "কোভিড ১৯" রোগের জন্যে দায়ী।
১. 229E (আলফা করোনাভাইরাস) ২. NL63 (আলফা করোনাভাইরাস) ৩. OC43 (আলফা করোনাভাইরাস) ৪. HKU1 (বেটা করোনাভাইরাস) ৫. MERS-CoV (বেটা করোনাভাইরাস): ২০১২ সালে সৌদি আরবে প্রথমবার এই ভাইরাসের নাম শিরোনামে উঠে এসেছিল। যারা এই ভাইরাসে আক্রান্ত তাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করলে MERS-CoV ঢুকে পড়তে পারে অন্যের শরীরে। ৬. SARS-CoV: ২০০৩ সালে এশিয়ায় এই ভাইরাস মহামারী আকার ধারণ করেছিল। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপেও ছড়িয়ে পড়েছিল এই মারণ ভাইরাস। বহু মানুষ প্রাণ হারিয়েছিলেন। তবে ২০০৪ সালের পর এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আর কোনো রিপোর্ট সামনে আসেনি। ৭. SARS-CoV-2: এই ভাইরাসই করোনাভাইরাস নামে পরিচিত। করোনার CO, ভাইরাসের VI এবং ডিজিসের D নিয়ে হয়েছে COVID-19। ২০১৯ সালে ভাইরাসটি প্রথম ধরা পড়ায় 19। এটি প্রথম চিনের ইউহানে আবির্ভূত হয়।
ভাইরাস বহুভাবে ছড়িয়ে পড়ে। গাছ থেকে গাছে ছড়িয়ে পড়ে বৃক্ষরস ( plant sap) খায় এমন পতঙ্গের মাধ্যমে। এ রস হতে পারে কান্ড, পাতা ফুল বা ফলের। অসুস্থ প্রাণীর দেহ থেকে রক্তপায়ী পতঙ্গের, যেমন মশার মাধ্যমে। ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস ছড়ায় হাঁচি বা কাশি থেকে, করোনাভাইরাসও তাই। তবে তা হাত থেকে স্পর্শের মাধ্যমে চলে আসতে পারে নাক বা চোখে বা গলায়। নরোভাইরাস বা রোটাভাইরাস ছড়ায় খাবার ও পনির মাধ্যমে। এইডসের ভাইরাস, আমরা জানি ছড়িয়ে পড়ে যৌনমিলন বা রক্ত পরিবহনের মাধ্যমে। সুখের খবর হলো ভাইরাস মানবদেহকে আক্রান্ত করলে মানবদেহ সঙ্গে সঙ্গে একটি প্রতিরোধ ব্যবস্থা (immune system) গড়ে তোলে। ফলে বেশিরভাগ ভাইরাস কাবু হয়ে পড়ে, কোনো ক্ষতি করতে পারে না। করোনাভাইরাস হয়তো আমাদের অনেকের দেহেই প্রবেশ করেছে, কিন্তু যাদের ইমমিউন সিস্টেম শক্তিশালী তারা হয়তো সামান্য কাশি বা সর্দি ছাড়া তেমন টের পাননি। কেবল যাদের ফুসফুস নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত বা দুর্বল, প্রতিরোধ ব্যবস্থা দুর্বল, যেমন বৃদ্ধদের বা যারা অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত তারাই শিকার হচ্ছেন নতুন করোনার। যদিও অল্প বয়সী এবং শিশুরও মৃত্যু ঘটেছে কিন্তু হয়তো জানা যাবে তাদের শরীরে অন্য কোনো ইমিউন বা রোগ প্রতিরোধের অসুখ বা বৈকল্য ছিল কিনা। তবে কোনো কোনো ভাইরাস যেমন HIV, ভাইরাল হেপাটাইটিস ও HPV সংক্রমণ আমাদের দেহের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে পরাস্ত করে বিজয়ী হয়। এখন পর্যন্ত মানব শরীরের এই নতুন ভাইরাসকে পরাজিত করার শক্তিই বেশি দেখা যাচ্ছে।
করোনাভাইরাসের কোনো ভ্যাকসিন বা টিকা না থাকাতেই মানবজাতি ঝুঁকির মুখে আছে। সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা অবশ্য জোর লড়াই করে যাচ্ছেন করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কারের জন্য। তারা সফল হবেনই। লক্ষ্য করুন, ১৯৮১ সালের জুন মাসে এইডসের প্রথম কেসের পর প্রায় দুই বছর লেগেছিল মানুষের মৃত্যুর কারণ হওয়া এই এইচআইভি ভাইরাসটি শনাক্ত করতে। কিন্তু কোভিড-১৯ প্রথম কেসের সংবাদ পাওয়া যায় ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসের ৩১ তারিখে। আর মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই মানে জানুয়ারির ৭ তারিখেই ভাইরাসটি কী এটা আইডেন্টিফাইড হয়ে যায় এবং দশম দিনে এর জিনোম সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়। ইতোমধ্যেই জানা গেছে যে- এটা গ্রুপ ২বি'র সার্স ফ্যামিলিভূক্ত নতুন করোনাভাইরাস যাকে SARSCoV2 নাম দেয়া হয়েছে । আর রোগটিকে বলা হয় COVID-19। জেনেটিক এনালাইসিস এর মাধ্যমে এর ন্যচারাল অরিজিন সম্পর্কে জানা গেছে। এর মিউটেশন রেইট খুব বেশি না। ভাইরাসের জিনোম, অরিজিন সম্পর্কে জানার পর এখন আমরা ভাইরাসটি কিভাবে ডিটেক্ট করতে হয়- তাও জানি। আক্রান্ত ৮০% শতাংশ রোগীর অবস্থা একেবারেই মাইল্ড। অনেকেই বিনা চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে যাচ্ছেন। তবে এটা সাধারণ ঠাণ্ডা এমনকি ইনফ্লুয়েঞ্জার চেয়েও মারাত্নক। কোনো কোনো দেশে মৃত্যুহার বেশি কারণ সেই দেশের লোকসংখ্যার বেশির ভাগ বয়স্ক, যেমন ইতালি। আবার কোনো কোনো দেশের জনগোষ্ঠী বয়স্ক হলেও খুব ভাল স্বাস্থ্যব্যবস্থা এবং জনসচেতনতার জন্যে মৃত্যুহাড় শতকরা একেরও নিচে, যেমন জার্মানি। শতকরা ১৪% রোগীর নিউমোনিয়া বা ৫% রোগীর অবস্থা খুবই খারাপ হওয়া সত্ত্বেও মৃত্যুহারের পরিপূর্ণ সঠিক রূপটি কত তা বলা যাচ্ছে না। এই মুহুর্তে এই কোভিড-১৯ বিস্তাররোধ করাই সর্বোত্তম পন্থা। বিষয়টি আমরা নিচের গ্রাফটি দিয়ে বুঝিয়ে থাকি। যেকোনো সংক্রমণের গতি প্রকৃতি বুঝতে এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এটাকে এস (সাসসেপ্টিবল, নীল রং দিয়ে নির্দেশিত), আই (ইনফেকটেড, যা লাল রং দিয়ে নির্দেশিত) এবং আর (রিমুভড, যা সবুজ রং দিয়ে চিহ্নিত) মডেল বলে। যেমন এখানে সার্স করোনাভাইরাস-২ ধনী-গরীব, কালো-সাদা, বাদামি, ছোট-বড় সবাইকে আক্রমণ করছে যার অর্থ পৃথিবীর সাত বিলিয়ন মানুষই সাসসেপ্টিবল বা সংক্রমণযোগ্য। যেহেতু এই রোগটি একেবারেই প্রথম ধরা পড়েছে, কোনো ভ্যাক্সিন নেই, ইমিউনিটি নেই তার অর্থ সবুজ লাইনটি শুধু ধারণ করছে যারা ইনফেক্টেড বা সংক্রমিত হয়ে ভাল হচ্ছে তাদের দিয়ে। একারণেই কিন্তু সামাজিক দূরত্ব, প্রতিরোধমূলক আচরণ দিয়েই (আই)কে বন্ধ করতে হবে। অন্যদিকে জনসংখ্যার একটি অংশ যখন শরীরে প্রতিরোধ তৈরি করে, তা ভ্যাক্সিন দিয়ে হোক আর সংক্রমণ দিয়ে হোক তার একটি নির্দিষ্ট সংখ্যার পর বাকি মানুষেরা এমনিতেই সংক্রমণ থেকে বেঁচে যান, এটাকে বলে হার্ড ইমিউনিটি, যা কোভিড-১৯ এর বেলায় এখনও নেই।
এ তো গেল ভাইরাস বা অন্যান্য রোগ নিয়ে কিছুটা বিজ্ঞানের আলোকে কথা; কিন্তু মানব সভ্যতায়, জ্ঞান বিজ্ঞানে, সামাজিক ইতিহাসে এইসব মরণব্যাধী নিয়ে কিন্তু কুসংস্কার, রাজনীতি কম হয়নি। সেইসব ঘটনাও আমাদের মূল একটি দার্শনিক প্রশ্নের দিকে নিয়ে যায়। মানুষ জন্ম নেয় আবার মৃত্যুবরণ করে; এই মৃত্যু কখনো মোটামুটিভাবে নির্ধারিত, কখনো অনির্ধারিত এবং আকস্মিক। মৃত্যুর অনিশ্চয়তার সঙ্গে মিলিয়ে মানুষ তাই নানান দার্শনিক প্রশ্ন জুড়ে দিয়েছে মানব ইতিহাসের জ্ঞানকাণ্ডের পরিক্রমায়। সবচেয়ে বড় প্রশ্নটি হল 'দ্য মিনিং অব লাইফ' বা জীবনের অর্থ কী? আরিস্তাতল (গ্রীকঃ আরিস্তোতাইলিস) তার বিখ্যাত হিউম্যান ফাংশন বা মানব ক্রিয়া যুক্তিতে বলেন, মানুষের ভালোত্ব আবিষ্কার করতে হলে আমাদের মানব ক্রিয়াকে চিহিত করতে হবে। মানুষের যুক্তিসংগত কাজ হলো পুণ্যবান কাজ করা। বলাইবাহুল্য সেই সময়ের চিন্তা ধর্ম দিয়ে পরিপূর্ণভাবে আক্রান্ত থাকায় ভার্চু বা পুণ্য ছিল র্যাশনাল বা যুক্তিসঙ্গত কাজ। এই পথ ধরেই থমাস একুইনাস 'বিয়েটিফিক ভিশন' নামের ঈশ্বরকে পাবার সরাসরি সংযোগের কথা বলেন। ইমানুয়েল কান্ট এই ধারাবাহিকতায় নতুন উপাদান নিয়ে আসেন যা 'হাইয়েস্ট গুড' বা সর্বোচ্চ ভালোত্বের সঙ্গে মানুষের গুণাবলী, নৈতিকতা এবং আনন্দকে জুড়ে দেন। এভাবেই মানব জীবনের অর্থ অতিপ্রাকৃত ঈশ্বর ও আত্মাকেন্দ্রিক হয়ে ওঠে।
দর্শনের ধারাবাহিকতায় উনবিংশ, বিংশ এবং একবিংশ শতাব্দীতে প্রকৃতিবাদ যেখানে চিন্তাকে বেশি আচ্ছন্ন করেছে সেখানে অধ্যাত্মবাদী বা সাব্জেক্টিভিজম আক্রমণ করে এভাবে যে 'জীবনের অর্থ' তো ব্যক্তি বিশেষে আপেক্ষিক। এটা মানুষের আকাঙ্ক্ষা, পছন্দ, মানসিক অবস্থান যা প্রতিনিয়ত বদলায় তার ওপরে নির্ভর করে। তা ছাড়া জীবনের অর্থ অনেক বেশি বোধ হয় যখন কাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে। বলাই বাহুল্য বিংশ শতাব্দীর প্রয়োগবাদ, দৃষ্টবাদ, অস্তিত্ববাদ, মানবতাবাদ জোরালোভাবে এই ধারার চিন্তাকেই সমর্থন ও রসদ জুগিয়ে এসেছে। অন্যদিকে প্রাকৃতিক অব্জেক্টিভিজম বা বিষয়মুখতা মনে করে কোনো কিছুর 'অর্থ' মানব মনের বাইরে নির্ধারিত কিছু। যেমন কেউ মনের ভেতরে ঠিক বা বেঠিক বিশ্বাস বা ধারণা নিয়ে থাকল কী থাকল না তার সঙ্গে জীবনের অর্থ বদলাবে না; অন্যকথায় জীবনের অর্থ ব্যক্তির ইচ্ছা নিরপেক্ষ। এভাবেই অব্জেক্টিভিজম বা বিষয়মুখতা নৈতিকতার সঙ্গে সৃজনশীলতাকে যুক্ত করে। এই সৃজনশীলতা যুক্ত হওয়াতে মানুষের জ্ঞানভিত্তিক চিন্তা-চেতনা, আবেগ সম্বন্ধীয় গভীরতা যেমন সহমর্মীতা, এমন কি আত্নত্যাগের মধ্যেও জীবনের অর্থ খুঁজে পাওয়া যায়। সুজান উলফের সেই বিখ্যাত উক্তিটি এখানে প্রণিধানযোগ্য, "অর্থ উত্থাপিত হয় তখন, যখন অধ্যাত্মবাদী আকর্ষণ, উদ্দেশ্য বা বিষয়মূখী চটকের সঙ্গে সম্মিলিত হয়"। "Meaning arises when subjective attraction meets objective attractiveness" কথাটির যথাযথ মর্যাদা দিতে ইংরেজিও তুলে ধরছি যাতে আমার অনুবাদের ঘাটতি পাঠককে অর্থ উদ্ধারে ব্যহত না করে। পরের ঘরানার দার্শনিকেরা এমনকি জীবনের অর্থ খুঁজতে কোনো অতিপ্রাকৃতিক কিছুর অস্তিত্বেরও প্রয়োজন আছে কিনা তা নিয়েও বিস্তর আলোচনা করেছেন, যুক্তি দাঁড় করিয়েছেন। আমি ব্যক্তিগতভাবে জীবনের অর্থকে দেখি এভাবে- প্রতিটি মানুষের জীবনই একেকটা গল্প। সেই গল্পের ধারাবাহিকতা থাকবে, লক্ষ্য থাকবে, সেই লক্ষ্য অর্জনের সংগ্রাম থাকবে। এই সুবিশাল, অসীম অর্থপূর্ণ বিশ্বব্রহ্মান্ডের আমি একটি কণিকা মাত্র। আমার জীবনের সত্য কী তা জেনে সেই লক্ষ্য কাজ করে যাওয়াটাই জীবনের স্বার্থকতা। এই লক্ষ্য একেকজনের একেকরকম হবে, নৈত্যিক-অনৈতিক নিয়ে বিচার হবে যার মানদণ্ড আবার আলাদা, তাই সেই বিচার অর্থহীন। এখানেও বলা অসমীচীন হবে না যে মেটা-দর্শন দিয়ে প্রতিটি যুক্তিকেই আবার পুণঃবিচার করা যায়, যাবে।
তাহলে জীবনের এই অর্থ খুঁজতে গিয়ে মৃত্যু চিন্তা কীভাবে আসে? মৃত্যুই বা কী? এই যে কোভিড-১৯ এর মতো বৈশ্বিক মহামারী এসেছে আর একদল মানুষ মৃতুভীতি নিয়ে মানুষকে নানান ছবক দিয়ে যাচ্ছে এটা কি মানব ইতিহাসে নতুন কিছু? না, একেবারেই না। মানুষের আদি সময় থেকেই এই অনিশ্চিত এবং রহস্য ঘেরা অনিবার্য পরিণতি নিয়ে মানুষের কৌতূহলের শেষ নাই। বরং মানব দর্শনের বিশাল অংশ দখল করে আছে মৃতুচিন্তা এবং মৃত্যুচিন্তাজনিত দার্শনিক বোধ। ঈশ্বর বা সৃষ্টার ধ্যান ধারণার পেছনেও এই মৃত্যুচিন্তা এবং মৃত্যু পরবর্তী জীবনের উন্মোচন অভিলাষ। আমি এখানে ধর্মীয় আলোচনায় যাব না, কারণ, পৃথিবীর কয়েক হাজার ধর্মের মধ্যে এত বেশি ধারণা আছে যা নিয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসা কঠিন, অন্যদিকে প্রতিটি ধর্মই মনে করে যার যার বিশ্বাসই একমাত্র সঠিক। বরং দর্শন শাস্ত্রে মৃত্যু নিয়ে কী বলা হয়েছে তার একটা খুব সংক্ষিপ্ত রূপ তুলে ধরার প্রয়াস নেব। প্রাচীন গ্রীক দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো, আরিস্তোতল, এপিকিউরাস প্রমুখেরা মৃত্যু নিয়ে যা বলেছেন তা এখনকার দার্শনিকদের কাছে হাস্যকর মনে হতে পারে। যেমন, সক্রেটিস বলেছিলেন, মৃত্যু হলো একটি স্বপ্নহীন নিদ্রা। এপিকিউরাস বরং বলেছিলেন মৃত্যু যেহেতু মানব অস্তিত্বের শেষ, তাহলে মৃত্যু তো খারাপ হতে পারে না; কারণ, অস্তিত্বহীন মানুষ কোনোকিছুর অভিজ্ঞতা পায় না। এইসব দর্শনের হাত ধরেই আধুনিক দার্শিনিকেরাও মনে করেন, মৃত্যুর কোনো বিষয়ী অর্থ নেই; কারণ, এক অনিবার্য সত্য হল ব্যক্তির মৃত্যু ঘটে তার চেতনার পরিসমাপ্তিতে; তাই মৃত্যুর যতো কাছাকাছি যাওয়া হোক না কেন, ব্যক্তির চেতনা থেকে তা দূরেই রয়ে গেল। লুডভিক ভিটগেন্সটাইন যেমন বলেছিলেন, "মৃত্যু জীবনের কোনো অভিজ্ঞতা নয়" (Death is not an experience in life)।
মৃত্যু নিয়ে দু'জন দার্শনিকের দুই মেরুর অবস্থান আমাকে ভাবিত করে; প্লেটো মৃত্যু নিয়ে এত চিন্তিত ছিলেন যে এনিয়ে তিনি মেডিটেশন করতেন; অন্যদিকে স্পিনোজা বলেছিলেন, মৃত্যুর মতো ক্ষুদ্র বিষয় নিয়ে একজন জ্ঞানী মানুষের চিন্তা করা উচিত না। আমি ব্যক্তিগতভাবে এই দুই মেরুকেই অস্বীকার করি; কারণ, মৃত্যু চিন্তা একেবারে বাদ দিলে জীবন সম্পর্কে একটি ফাঁপা, মিথ্যা ধনাত্নক ধারণার জন্ম হবে; আবার মৃত্যু নিয়ে অধিক চিন্তা করে মানুষ জীবন-বিবর্জিত হয়ে যায়, অতিরিক্ত রিচুয়াল মানতে গিয়ে মনুষ্যত্ব, মানবিকতা হারায়। বরং আমি ফিরে যাই সেই ধারণায় – এই সুবিশাল, অসীম অর্থপূর্ণ বিশ্বব্রহ্মান্ডের আমি একটি কণিকা মাত্র। আমার জীবনের সত্য কী তা জেনে সেই লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাওয়াটাই জীবনের স্বার্থকতা।
এই মৃত্যুচিন্তা নিয়ে একান্ত নিজস্ব কথা বলি; জীবনের স্বার্থকতা আমার কাছে এরকম- জীবনের প্রতিটি কাজে, নিজের, পরিবারের কাছে থেকে দূরের মানুষের জন্যে এমন কাজ করা যা নিজেরও পরিতৃপ্তি আনবে। বলা যায় সাইকোলজিক্যাল ইগোইজমের বিপরীতে এথিক্যাল ইগোইম। মৃত্যুর পরও যেন জড় মানব-শরীর মানুষের কাজে লাগে। বাংলাদেশে সেই মেডিক্যাল কলেজে পড়ার সময় থেকে মরণোত্তর চক্ষু দান, কিম্বা মরণোত্তর দেহদানের জন্যে জোরালোভাবে কাজ করেছি। সন্ধানীর মাধ্যমে বাংলাদেশের কয়েকজন প্রথিতযশা ব্যক্তি যেমন সানজিদা খাতুন, জাদুকর জুয়েল আইচ এবং অনেকের দেহদানের আইনগত ব্যবস্থা তৈরি করতে কাজ করেছিলাম। আমি এবং আমার স্ত্রী আমরা দুজনেই আমার মরণোত্তর দেহ চিকিৎসাবিজ্ঞানে ব্যবহারের জন্যে দান করেছি। তা বাংলাদেশে হোক বা আমেরিকাতে হোক তাতে কোনো সমস্যা নেই। এজন্যেই কোভিড-১৯ আক্রান্ত হয়ে মরতে চাই না। কারণ, তাহলে আমার জীবনের পেশাগত জনস্বাস্থ্যের জন্যেই দেহটি জীবাণুমুক্ত ব্যাগে ভরে কবরে পাঠানো হবে। সেই দেহ আর চিকিৎসা বিজ্ঞানে ছাত্রছাত্রীদের ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। এই কারণটি ছাড়া মৃত্যু নিয়ে কোনো ভয় নেই, মৃত্যু হল জীবনের আরেকটি সেলিব্রেশন বা উদযাপন। এই ধারণাগুলো একান্তই আমার নিজস্ব, তাই কেউ আহত হবেন না, আপনাকে পালটাতে হবে এমন কোনো দিব্বিও কাউকে দেয়া হবে না। বরং বলবো জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।
সাধারণ তথ্যসূত্রঃ