Published : 12 Apr 2020, 04:14 PM
জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য মোতাবেক নভেল করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ এর আক্রমণে আজকে পর্যন্ত সমগ্র পৃথিবীর ১৮৫টি দেশে মোট আক্রান্তের সংখ্যা মোটামুটিভাবে ১৭,৭৮৫৬২ ছাড়িয়েছে যার মধ্যে মৃতের সংখ্যা ১,০৮৯৯৪ জন। বাংলাদেশের সরকারি পরিসংখ্যান নিয়ে আমার মতো অনেকের সংশয় থাকলেও শুধুমাত্র বাংলাদেশের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর) এর তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশেও মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৬২১ জন, মৃত্যু হয়েছে ৩৪ জনের (শতকরা ৫.৪৭%) এবং সুস্থ হয়েছেন মাত্র ৩৯ জন। বাংলাদেশে গত কয়েকদিনের পরিসংখ্যান হতে আমরা দেখতে পেয়েছি এই বৃদ্ধির হার অনেকটা সূচকীয় বক্ররেখার (exponential curve) মতো এবং অনেকটাই উলম্ব আকৃতির।
করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের উপরোক্ত পরিসংখ্যান দেখলে মাথা ঘুরে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়! বাস্তবতা হচ্ছে সমগ্র পৃথিবীর মানুষ লিঙ্গ, শ্রেণি, জাতি, ধর্ম, বয়স, সংস্কৃতি নির্বিশেষে করোনাভাইরাস মহামারীতে আক্রান্ত হচ্ছে। লিবিয়ার প্রধানমন্ত্রী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন, বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী করোনার কারণে আইসিইউতে ছিলেন, সৌদি রাজপরিবারের ১৫০ জন সদস্য করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এবং ইতোপূর্বে কানাডার সরকারপ্রধানের স্ত্রীসহ অনেকেই করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। আমেরিকার মতো শক্তিশালী যুদ্ধবাজ অর্থনীতিও এর প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। শুধুমাত্র আমেরিকাতে একদিনেই দুই হাজারের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়েছে এবং সেখানে ৫ লাখের চেয়ে বেশি মানুষ আক্রান্ত হওয়ার খবর সংবাদপত্র মারফত পাওয়া গেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার যুক্তি মতে, আক্রান্তদের মধ্যে কারাগারের মতো বদ্ধ জায়গায় আক্রান্ত হওয়ার হার অনেক বেশি। এবং সেটা সাধারণ মানুষের তুলনায় প্রায় ৫০% এর বেশি। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন কারাবন্দিরা মহামারীতে বেশি আক্রান্ত হয়? কারণ হিসেবে আমরা বিভিন্ন রিপোর্ট থেকে দেখতে পাই, পৃথিবীর বেশিরভাগ কারাগারে ধারণক্ষমতার তুলনায় অনেক বেশি কয়েদি রাখা হয়। যেমন, ধারণক্ষমতার তুলনায় ফিলিপাইনে তিনগুণ, কম্বোডিয়ায় দ্বিগুণ, বাংলাদেশে দ্বিগুণ ও শ্রীলঙ্কায় প্রায় দ্বিগুণ অপরাধী রাখা হয়েছে। এজন্যই করোনাভাইরাস ও মহামারীর ভয়াবহতা নিয়ে মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ফৌজদারী অপরাধের প্রফেসর সঞ্জা র্স্ট্রা বলেন, 'যদি একবার এই ভাইরাস কারাগারে ছড়ায় তবে তা মুহূর্তের মধ্যেই দাবানলের মতো ছড়ায়। কারাগার ও জেলে ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত কয়েদির ঘিঞ্জি ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাসের কারণে কোনোভাবেই সেখানে 'সামাজিক দূরত্ব' নিশ্চিত করা সম্ভব নয়'।
অতিরিক্ত কয়েদির পাশাপাশি আরও অনেক বিষয় আছে যার কারণে কারাগারে মহামারী ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা বেশি। যেমন, দাহ্যবস্তু হওয়ায় কারাগারে কয়েদিদের হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করার সুযোগ নেই। বন্দি-কয়েদির অনেকের হাত ও পায়ে শিকল ও হ্যান্ডকাফ লাগানোর কারণে তারা প্রয়োজনে হাত ও মুখে রুমাল ও টিস্যু ব্যবহার করতে পারে না। বেশিরভাগ কারাগার অস্বাস্থ্যকর ও ঘিঞ্জি হওয়ার কারণে আগে থেকেই সেখানে ডায়াবেটিস, যক্ষ্মা ও শ্বাসকষ্টের রোগী বিদ্যমান আছে। দি গ্লোব এন্ড মেইলের প্রতিবেদনে জাস্টিন লিং নামে একজন গবেষক দেখান যে, কানাডার কারাগারে মোট অপরাধীদের মধ্যে বয়স্ক (২৫%), শ্বাসকষ্ট ও উচ্চ রক্তচাপের রোগী (১৫%) এবং যক্ষ্মা রোগী (১৫%)। আমি মনে করি বাংলাদেশের অপরাধীদের পরিসংখ্যান দেখলেও এর ব্যতিক্রম হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ কারা অধিদপ্তরের তথ্য মোতাবেক, এখানে মাত্র ১৪১টি পদের বিপরীতে মাত্র ৫ জন ডাক্তার কর্মরত এবং ৬৮টি কারাগারে মাত্র ৫টি থার্মাল স্ক্যানার বিদ্যমান আছে।
সেজন্যই গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, সাধারণ মানুষের তুলনায় কারাগারে মৃত্যুহার বেশি হওয়ার কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউএইচও) এর পরামর্শ হচ্ছে সেখানে বন্দি ও কয়েদিদের পরিবারের সদস্যদের সাথে সরাসরি যোগাযোগের বিপরীতে মোবাইলে যোগাযোগ, ভয়েস কল সার্ভিস ও ইমেইলে যোগাযোগের সুযোগ তৈরি। আশার কথা হলো যে, বাংলাদেশেও কয়েকটি কারাগারে বন্দিদের পরিবারের সাথে যোগাযোগের জন্য মোবাইল ফোন ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থার পরামর্শ হচ্ছে যে, কারাগার থেকে সহিংস অপরাধের সাথে যুক্ত নয়, কম মাত্রার ঝুঁকিপূর্ণ অপরাধী, বারবার অপরাধের সাথে যুক্ত নয়, তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ, গুরুতর অসুস্থ, ছোটখাট মাদক মামলায় অভিযুক্তদের মুক্তি দেয়ার ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া।
এসবের ফলশ্রুতিতে ইরানের মতো সর্বাত্মক রাষ্ট্রেও ১,৯০০০০ কয়েদির মধ্যে বিরোধী মতাদর্শের রাজনৈতিক বন্দিসহ প্রায় ১ লক্ষের বেশি বিচারাধীন ও শাস্তিপ্রাপ্ত বন্দিকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। ইতালির কারাগারগুলোতে বন্দিদের মুক্তি দেওয়ার জন্য বিদ্রোহ শুরু হয়েছে। ইতালির মডেনা কারাগারে করোনাভাইরাস মহামারীর আতঙ্ক থেকে মুক্তির জন্য দাঙ্গা ও বিদ্রোহে ৬ জন মারা গেছে। ভক্স নিউজের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ২.৩ মিলিয়ন অপরাধী আছে। তার মধ্যে নিউইয়র্কে রাইকার্স আইল্যান্ডের জেলে ২৩১ জন কয়েদি ও ২২৩ জন কর্মচারী ও স্টাফ ও ইলিনয়ের কুক কাউন্টি জেলে ১৩৪ জন ইতোমধ্যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। তাই নিউইয়র্ক, ইলিনয়সহ আমেরিকার বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যেগুলোর কারাগার থেকে প্রচুর পরিমাণ কয়েদিকে প্যারোল ও প্রবেশনে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। জরুরি অবস্থা বিবেচনা করে সেখানে বয়স্ক, কম ঝুঁকিপূর্ণ অপরাধী এবং অসুস্থ রোগীদেরকে প্রাধান্য দিয়ে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ এখনো ক্রিয়াশীল বলে সেখানে কালো, অভিবাসী ও অর্থনৈতিকভাবে নিঁচু অর্থনৈতিক শ্রেণিতে অবস্থানকারীরা এই সুযোগ কম পাচ্ছে বলে রিপোর্ট হচ্ছে এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাদা ও ধনীকরাই বেশি সুবিধা পাচ্ছে বলে অনেকে অভিযোগ করছেন।
ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তিনহাজার বন্দিকে মুক্তি দেওয়ার ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে উদ্যোগ নিতে বলেছেন। সরকারের এই সময়োচিত সিদ্ধান্তটি নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। কারা অধিদপ্তরের বরাদ দিয়ে প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী বন্দিদের মুক্তির ব্যাপারে ইতোমধ্যে একটি তালিকাও তৈরি হয়েছে বলে পত্রিকায় সংবাদ এসেছে। প্রশ্ন হচ্ছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ের নির্দেশে কারা অধিদপ্তরের করা তালিকায় কারা মুক্তি পাবে? প্রচলিত প্রথা ও বিধি অনুযায়ী, সাধারণভাবে ৬৫ বছরের বেশি বয়স্ক ও অসুস্থ (যৌন অপরাধী ও নিয়মিত, সিরিয়াল সহিংস অপরাধী বাদে), সহিংস অপরাধী নয় কিন্তু অনেকদিন ধরেই জামিন পাননি, যাদের দুই বছরের কম কারাদণ্ড হয়েছে এমন সাধারণ অপরাধী এবং যাদের শাস্তির ৭৫% এর বেশি সাজা খাটা হয়েছে এমন ব্যক্তিগণ। যদিও পাশ্চাত্যের মতো বর্ণবাদ কিংবা শ্রেণি প্রশ্ন যুক্ত না হলেও এখানেও প্রত্যেকটি সরকারের ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক বিবেচনা প্রধান হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছে। স্বাধীনতা পরবর্তী প্রত্যেকটি সরকারের আমলে এই বিবেচনা মূখ্য চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে। এমনকি মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামীর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু আমার যুক্তি মতে রাজনৈতিক বিবেচনা না হলেও প্রথানুযায়ী মুক্তি দিলেও বাংলাদেশে প্রায় কমপক্ষে ৩০ থেকে ৪০ হাজার বন্দি-কয়েদিকে মুক্তি দেয়া সম্ভব এবং সরকারকে এখনই তা বাস্তবায়নের জন্য জরুরি ভিত্তিতে কাজ করা উচিত।
প্রশ্ন হলো, কীভাবে? আমার মনে হয়, বাংলাদেশের কারা পরিসংখ্যানের কথা বিবেচনা করলেই সরকারের সিদ্ধান্ত ও বাস্তবতার সাথে আমার অবস্থানের পার্থক্য কতটুকু তা বুঝা যাবে! প্রথমত, কারা অধিদপ্তর ও ওয়ার্ল্ড প্রিজন ব্রিফ এর তথ্য মোতাবেক, বাংলাদেশে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের সর্বশেষ তথ্যানুযায়ী, ৬৮টি কারাগার ও জেলগুলোতে ৪০৯৪৪ জন ধারণক্ষমতার বিপরীতে মোট ৮৮০৮৪ জন অপরাধী আছে। এর মধ্যে বিচারাধীন বন্দি ৮১.৩%, মহিলা ৮.১% এবং কিশোর ও মাইনর অপরাধী ০.৭%। ধারণক্ষম ও অতিরিক্ত মোট অপরাধীর অনুপাত ১:২১৫। শতকরা হিসেবে পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিচারাধীন বন্দি আছে হলো বাংলাদেশে। যেহেতু বাংলাদেশের প্রচুর মামলার চাপ আছে এবং অনেকেই অনেক বছর ধরে শুধুমাত্র মামলার চাপে জামিন ছাড়া বিচারাধীন অবস্থায় আছে। ২০১৭ সালের তথ্য মোতাবেক, বিচারাধীন বন্দিদের শতকরা ৬৯.৬৭% (৩৮৩৪৯ জন) ৬ মাসের নীচে জেল/কারাগারে অবস্থান করছেন এবং সাজাপ্রাপ্তদের এক বছরের নীচে শাস্তি পেয়েছেন এর সংখ্যা ৭১১৭ জন (৩৯.৩৫%)। বাংলাদেশে যারা অপরাধের সাথে যুক্ত হয় তাদের মধ্যে বিচারাধীন বন্দিদের মাত্র ২৩.০৫% ও সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের মাত্র ৪৫.৩২% যথাক্রমে খুন, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, ডাকাতি ও অস্ত্র মামলার মতো মারাত্বক অপরাধের সাথে যুক্ত। আর বাকীরা বেশিরভাগই সহিংস অপরাধের সাথে যুক্ত নয়। বাংলাদেশে বিচারাবন্দিদের শতকরা ৫০.২৬% ও সাজাপ্রাপ্ত বন্দিদের ৬১.০৭% কেউই আগে কোনো অপরাধের সাথেই যুক্ত ছিলেন না (কারা জনসংখ্যা তথ্য ২০১৭, কারা অধিদপ্তর)। অর্থাৎ তাদের বেশিরভাগই পরিবেশগত প্রেক্ষাপট বিবেচনায় হঠাৎ করেই অপরাধের সাথে যুক্ত হয়েছে। কেউবা হয়তো দারিদ্র্যের কশাঘাতে অথবা ভুক্তভোগী হয়ে। যেহেতু এদের বেশিরভাগই সহিংস অপরাধের সাথে যুক্ত নয়, শাস্তির পরিমাণও এক বছরের বেশি নয় এবং এরা পেশাগত অপরাধী নয় ফলে এদের অনেককেই নিঃশর্ত মুক্তি, জামিন, প্রবেশন এবং পাশ্চাত্যের মতো সমাজসেবা অফিসারের আওতায় কমিউনিটি কারেকশনের আওতায় মুক্তি দেয়া সম্ভব।
দ্বিতীয়ত, বর্তমান সময়ে বিচারিক প্রক্রিয়া বন্ধ থাকায় জামিনের সুযোগও নেই সেহেতু এখনকার সময়ে গ্রেপ্তারের সংখ্যা শুধু দিনকে দিন বাড়ছেই। কিছু ব্যতিক্রম বাদে করোনাকালীন সময়ে বেশিরভাগই লকডাউন ও আইসোলেশনের নিয়ম না মানার মতো আইনশৃঙ্খলার ভঙ্গের সাথে জড়িত হয়ে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সরকারবিরোধী স্ট্যাটাস বা করোনাভাইরাস নিয়ে ভিডিও ছড়িয়ে অনেকেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার হয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে যদি এদের জামিন দেওয়ার সুযোগ না থাকে অথবা তাদের যদি দীর্ঘমেয়াদে কারাগারে রাখা হয় তবে কিন্তু তারা পরবর্তীতে ভয়ানক সহিংস অপরাধীতে রূপান্তরিত হওয়ার সুযোগ থেকেই যায়। অপরাধবিজ্ঞান ও শাস্তিবিজ্ঞানের সাথে জড়িত বিশেষজ্ঞ মাত্রই জানেন যে, কারাগার হচ্ছে অপরাধ তৈরির 'প্রজনন ক্ষেত্র বা ব্রিডিং গ্রাউন্ড'। ফলে স্বল্পমেয়াদী অপরাধীদের এবং যারা অনেকক্ষেত্রেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রণোদিত হয়ে গ্রেপ্তারের শিকার হয়েছেন তাদেরকে মুক্তি দেয়ার ক্ষেত্রে সরকার এখনই প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
তৃতীয়ত, সহিংস অপরাধ বিশেষ করে খুন, ধর্ষণ, সিরিয়াল খুন, এসিড নিক্ষেপ, অস্ত্রমামলা ও ডাকাতির মতো অপরাধের বাইরে অসহিংস ও স্থুল এবং স্বল্পমাত্রার অপরাধীদেরকে মুক্তি দেওয়ার ব্যাপারে সরকার ও কারা অধিদপ্তর কাজ করতে পারে। বিশেষ করে, বয়স বিবেচনায়, গুরুতর অসুস্থ, মানসিক রোগী ও শিশু-কিশোর ও তাদের মায়েদের সবাইকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার জন্য কাজ করতে পারে। কারা অধিদপ্তরের রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশের কারাগারে ৬৫ বছরের উর্ধ্বে বিচারাধীন আসামী ও সাজাপ্রাপ্ত বন্দির সংখ্যা যথাক্রমে ১০৭৫ জন (১.৯৫%) ও ৪৩৯ জন (২.৪১%)। পাঁচ বছরের নীচে শিশুসহ অপরাধী মায়ের সংখ্যা ৩২৫ জন এবং মানসিকভাবে অসুস্থ অপরাধীর সংখ্যা ৩৮৫ জন। এর বাইরে গুরুতর অসুস্থ রোগীদের সবাইকে মুক্তি দেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত জরুরি। কানাডার মতো জনবান্ধব দেশও মেডিকেল সুবিধাপ্রাপ্ত দেশেই যেখানে প্রায় ১৫%-২৫% এর মতো গুরুতর অসুস্থ রোগী আছেন সেহেতু আমাদের দেশের মতো এত স্বল্প হাসপাতাল সুবিধা ও ডাক্তারের ক্ষেত্রে এই রোগীর সংখ্যা আরো অনেক বেশি। আমি মনে করি, বিশেষ বিবেচনায় এদের সবাইকে মুক্তি দেওয়ার জন্য সরকারের জরুরি ব্যবস্থা নেয়া উচিত।
তবে করোনাভাইরাস মহামারীর সময়ে অপরাধীদের মুক্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনা বাদ দিয়ে আরো কয়েকটি বিষয়ে খেয়াল রাখা যেতে পারে বা উচিত বলে আমি মনে করি। কোনোভাবেই মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামী, মানবতাবিরোধী অপরাধী, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবাদের সাথে যুক্ত জঙ্গি-সন্ত্রাসী, সিরিয়াল খুনী ও ধর্ষক, গুরুতর ও ভয়ানক মাদক ব্যবসায়ী, গ্যাংয়ের নেতা, ব্যাংক লুটপাটকারী ও দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত রাঘববোয়াল, ভিভিআইপি ও ভিআইপি শ্রেণিপ্রাপ্ত বন্দি ও ক্যাম্পাসে সন্ত্রাস সৃষ্টিকারী ও হত্যা-খুনের সাথে জড়িত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে এর আওতায় মুক্তি দেয়া যাবে না। এক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদী নীতি ও পরিকল্পনা হিসেবে বয়স্ক, অসুস্থ, মানসিক অসুস্থ, শিশু-কিশোরসহ অপরাধী মা, সহিংস নয় এমন সাধারণ বন্দি-কয়েদি, রাজনৈতিক প্রতিহিংসাবশত গ্রেপ্তারের শিকার এবং প্রথমবারের মতো এবং বিশেষ কোনো কারণে অপরাধের সাথে যুক্ত হতে বাধ্য হয়েছেন এমন ৩০ থেকে ৪০ হাজার অপরাধীকে মুক্তি দেয়ার আশু সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত। কারণ অপরাধ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে অপরাধীকে সংশোধনের জন্য যেই কারাগার ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছিল তা বর্তমানে অংশত বা বিশেষক্ষেত্রে পুরোপুরি ব্যর্থ বলেই নেদারল্যান্ড, সুইডেন, সুইজারল্যান্ডসহ পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে তা ধারাবাহিকভাবে বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে। আমি মনে করি দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম হওয়া উচিত নয়। কারাগারগুলো থেকে অপরাধীদের মুক্তি দিয়ে সম্প্রদায়ভিত্তিক সংশোধনাগার ও রেস্টোরেটিভ জাস্টিস পদ্ধতি গ্রহণ করেই বাংলাদেশের অপরাধীদের সংশোধনের দীর্ঘমেয়াদি নীতি ও পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা উচিত।