Published : 07 Apr 2020, 08:45 PM
মেয়েটির বয়স প্রায় ১০ বছর। ছবিতে হাস্যোজ্জ্বল। হাসির কারণ, ত্রাণ সামগ্রীর একটি প্যাকেট সে পেয়েছে। তাই মনের আনন্দে ক্যামেরার সামনে এভাবেই নিজে ফ্রেমবন্দি হয়েছে। এমনি করে ত্রাণ সামগ্রী হাতে নেওয়া নিম্ন আয়ের মানুষের খুশিমনের ছবিগুলো একদিকে ভালো মনে হলেও অন্যদিকে বাংলাদেশ এখনও তার নাগরিক মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে পারেনি- এটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কারণে পুরো বিশ্ব আজ অবগত। সেই সাথে ত্রাণ বিতরণ করতে আসা ব্যক্তি ও সামাজিক সংগঠন নানান তিক্ত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন। এ যেন ত্রাণ সামগ্রী একপ্রকার ছিনতাই করার মতন!
বিশ্বব্যাপী মহামারী করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবে বাংলাদেশও আজ আক্রান্ত। বিশ্বজুড়ে সর্বশেষ (৭ এপ্রিল, ২০২০) তথ্য অনুযায়ী প্রায় ১৪ লাখ সংক্রমিতদের মধ্যে ৩ লাখ মানুষ সুস্থ হয়ে বাড়িতে গেলেও এ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন প্রায় সাড়ে ৭৬ হাজার মানুষ। যার মধ্যে বাংলাদেশের ৭০ জন আক্রান্তদের মাঝে ৩০ জন সুস্থ হয়েছেন আর করোনাভাইরাসের কাছে পরাজয় বরণ করে মৃত্যুবরণ করেছে ৮ জন। ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে দিন দিন বাড়ছে আক্রান্তদের সংখ্যা। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এপ্রিলের মাঝামাঝিতে বাংলাদেশও করনোভাইরাসের মরণঘাতী আগ্রাসনের ভয়াবহতা লক্ষ্য করা যাবে।
ইতোমধ্যে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় অব্যবস্থাপনার নানা প্রতিচ্ছবি দেখা দিয়েছে। সেসাথে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, আইইডিসিআর ও সরকারের নির্দেশনা অমান্য করে হোম কোয়ারেন্টাইন ভঙ্গ করে একশ্রেণির মানুষ অবাদে হাট-বাজার ও রাস্তা-ঘাটে চলাফেরা করেছে, করছে। ফলে অনেককে স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করার দায়ে জরিমানাও করা হয়েছে।
হোম কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন, সামাজিক দূরত্ব একশ্রেণি মানুষের কাছে ভয়-আতঙ্ক হলেও আরেকশ্রেণির মানুষ আবার রাজনৈতিক ফায়দা নিতে ধর্মীয় আবেগপ্রবণ মানুষদের নিজেদের আয়ত্বকরণ করতে- মসজিদে আসা ও নানা রকমের ফতোয়ার মধ্য দিয়ে করোনাভাইরাস 'প্রতিষেধ সচেতনতা'র বিধিবিধান ভঙ্গ করতে উৎসাহ দিয়েছে, দিচ্ছে। মহামারী কোভিড-১৯ এর এই সময়েও (৩ এপ্রিল) জুম্মার নামাজ পড়তে মসজিদে মসজিদে হাজার হাজার মানুষ। এ যেন অন্যান্য শুক্রবারের চেয়েও এবার একটু বেশিই প্রতীয়মান হয়েছে। আবার কতিপয় বিশ্ব বিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে সংবাদকর্মীও তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আইইডিসিআর-এর করোনাভাইরাসের সর্বশেষ তথ্য নিয়ে মৌন সন্দেহ তুলে ধরার মাধ্যমেও এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করতে কাজ করেছে। সাথে যুক্ত হয়েছে নামমাত্র ডোমেইন-হোস্টিং নিয়ে তথাকথিত নিউজপোর্টাল নামের কতিপয় অনলাইনও।
করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবে ব্যক্তিগত ও সামাজিক উদ্যোগগুলোকে সরকারের ব্যবস্থাপনা বা সমন্বয়ের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা উচিত। যেকোনো দুর্যোগকালে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারী নানা সংস্থা ও সংগঠন, এমনকি ব্যক্তিগত উদ্যোগেও ত্রাণ বিতরণ করার রীতি পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই রয়েছে। বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশের অতীত অভিজ্ঞতা যেমন ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যা প্রায় নিয়মিত প্রতিটি দুর্যোগ বা ক্রান্ত্রিকালে সফলতার সঙ্গে ত্রাণ বিতরণের অভিজ্ঞতা রয়েছে। বিশেষ করে শেখ হাসিনা সরকারের সময়ে দুর্যোগে বিপন্ন ও বিপর্যস্ত মানুষের মাঝে সুচারুরূপে ত্রাণ বিতরণ সম্পন্ন করার সফলতা আমাদের সবারই জানা।
করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবে ঘরে থাকার জন্য সরকারের ছুটি ঘোষণার পর মূলত শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষের প্রতিদিনের খাদ্য সংগ্রহ অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়েছে। সরকার এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ সজাগ ও সচেতন বলেই অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তালিকা তৈরি করে সমন্বিতভাবে ত্রাণ বিতরণের নির্দেশ দিয়েছেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
বিজ্ঞপ্তিতে স্পষ্ট করে বলা হয়, সারাদেশে করোনাভাইরাসের কারণে শহর ও গামে কর্মজীবী মানুষ কর্মহীন অবস্থায় আছেন। যে সকল কর্মজীবী মানুষ কর্মহীন হয়ে খাদ্য সমস্যায় আছে প্রধানমন্ত্রী সে সকল কর্মহীন লোক (যেমন- ভিক্ষুক, ভবঘুরে, দিনমজুর, রিক্সাচালক, ভ্যান গাড়িচালক, পরিবহন শ্রমিক, রেস্টুরেন্ট শ্রমিক, ফেরিওয়ালা, চায়ের দোকানদার) যারা দৈনিক আয়ের ভিত্তিতে সংসার চালান তাদের তালিকা প্রস্তুুত করে খাদ্য সহায়তা দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া সিটি কর্পোরেশন/পৌরসভা/ইউনিয়ন পর্যায়ে ওয়ার্ডভিত্তিক কৃষি শ্রমিকসহ উপাকারভোগীদের তালিকা প্রস্তুত করে খাদ্য সহায়তা প্রদান করতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ের বিত্তশালী ব্যক্তি/এনজিও কোন খাদ্য সহায়তা প্রদান করতে চাইলে জেলা প্রশাসক প্রস্তুতকৃত তালিকার সঙ্গে সমন্বয় করবেন যাতে দ্বৈততা পরিহার করা যায় এবং কোন উপকারভোগী বাদ না পড়ে।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা সময় উপযোগী নির্দেশনা দিলেও সরকারি, বেসরকারি, সামাজিক সংগঠন ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণে সমন্বয় অতি জরুরি। এখানে আমাদের আরেকটি অভিজ্ঞতার কথা স্মরণে রাখা যেতে পারে। রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠনসহ ব্যক্তিগত উদ্যোগে রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সামগ্রী বিতরণেও শুরুর দিকে নানা রকমের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়েছিল। সরকার খুব দ্রুততার সাথে সকল ত্রাণ সামগ্রী সরকারের উদ্যোগে সমন্বয় করে বিতরণের ব্যবস্থা করায় অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব হয়েছে।
করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবে নিম্ন আয়ের মানুষের মাঝে নানা উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণের সময় ত্রাণ সামগ্রী নিতে আসা মানুষের মাঝে হাতাহাতি থেকে আরম্ভ করে কোনও রকমের স্বাস্থ্যবিধি ও শৃঙ্খলা না মেনে নিজেরাই গাড়িতে উঠে ত্রাণ সামগ্রীর প্যাকেট রীতিমত লুটপাট করে নিয়ে যাওয়ার সংবাদ গণমাধ্যমসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। করোনাভাইরাস ঝুঁকির পাশপাশি অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হচ্ছে, ভালো উদ্যোগ বাস্তবায়নের পথে সমালোচনা হচ্ছে।
এখানে সরকার সমন্বিতভাবে ত্রাণ বিতরণের সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিলেও এক্ষেত্রে বেসরকারি উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণে সমস্যা দেখা দিয়েছে। স্বল্প আয়ের মানুষের পাশে ত্রাণ নিয়ে দাঁড়িয়েছে অসংখ্য ব্যক্তি ও সংগঠন। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে ত্রাণ বিতরণ, মানুষের মধ্যে নিয়ম না মানার প্রবণতা ভয়াবহ করোনাভাইরাস ঝুঁকির জন্ম দিয়েছে, দিচ্ছে। আবার কোথাও কোথাও অপ্রীতিকর পরিস্থিতিও দেখা গিয়েছে। 'হোম কোয়ারেন্টাইন' বা 'ঘরে থাকা'র কর্মসূচী সফল করতে কর্মহীন ও নিম্ন আয়ের মানুষকে ত্রাণ সহায়তা দিতে সরকারী-বেসরকারী উদ্যোগগুলো সমন্বয় একান্ত প্রয়োজন। এখানে দলীয়, সামাজিক, পেশাজীবীসহ বিভিন্ন সংগঠনের ত্রাণ সামগ্রী সমন্বয় করে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসন বা সেনাবাহিনীর দায়িত্বরত অফিসারের মাধ্যমে বিতরণ করা সম্ভব হলে বিশৃঙ্খলা রোধ করার পাশাপাশি করোনাভাইরাস স্বাস্থ্যঝুঁকি ও সামাজিক দূরত বজায় রাখার সম্ভব হবে।
ত্রাণ বিতরণে সমন্বয় না থাকলে বিশৃঙ্খলা বা অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হবেই। এ জন্য সরকারী উদ্যোগেই ত্রাণ বিতরণ কাঠামো তৈরি করতে হবে। একদিকে ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াতে উচ্চবিত্তদের উৎসাহ প্রদান, অন্যদিকে ত্রাণ বিতরণেও সমন্বয় করতে হবে। ইতোমধ্যেই নিম্ন আয়ের মানুষগুলো ত্রাণ সামগ্রী সংগ্রহ করতে এসে নিজের পাশাপাশি অন্যের স্বাস্থ্যঝুঁকিও সৃষ্টি করেছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সোশ্যাল মিয়াতে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি ও মহল তুলে ধরেছে।
আমাদের সচেতনতাই করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক। আর সেটা সরকারি ও বেসরকারি নানামুখী উদ্যোগের মাধ্যমে সফলতা আনতে হবে। নিম্ন আয়ের মানুষের পাশে আমাদের সবাইকে মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে দাঁড়াতে হবে। তবে তা অবশ্যই স্বাস্থ্যঝুঁকি ও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি পরিহার করার মাধ্যমে। যেকোনও জাতীয় দুর্যোগে অতীতে ন্যায় বিশ্বব্যাপী মহামারী করোনাভাইরাস বা কোভিড-১৯ কেও আমরা পরাজিত করে বাঙালি ও বাংলাদেশকে সুরক্ষিত রাখবো। আর এটাই বাঙালির ইতিহাস, এটাই বাংলাদেশ।