Published : 25 Mar 2020, 09:19 PM
আমি রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তি নই, কেবল সাধারণ একজন শিক্ষার্থী। স্নাতক করছি সাংবাদিকতার ওপর এবং সেই সুবাদেই আমি জানি যে সাংবাদিকতায় টাইমলিনেস অর্থ্যাৎ দ্রুততা বলে একটা পরিভাষা আছে। তো, গত কয়েকদিনের ঘটনাচক্র দেখে আমার এখন কেবলই এটা মনে হচ্ছে যে রাষ্ট্রের সর্বস্তরের নীতি নির্ধারকদেরকে নতুন করে ঐ টাইমলিনেসের (দ্রুততা) পাঠদান করাটা আবশ্যক হয়ে পড়েছে।
এর কারণ, গোটা পৃথিবী যখন কোভিড-১৯ আতঙ্কে নড়েচড়ে বসেছে, একে প্রতিহত করার জন্য সমস্ত দিন-রাত এক করে ফেলছে; আমরা তখনো পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছি। সেই প্রগাঢ় ঘুম বোধহয় আমাদের এখনো পুরোপুরি কাটেনি। তাইতো আমরা সবে আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠি উঠি করছি। বিষয়টা এমন যে রোম যখন পুড়ছিলো, নিরো তখন বাঁশি বাজাচ্ছিলো। কিন্তু সুখনিদ্রায় যাওয়ার কিংবা নিশ্চিন্তে মোহনবাঁশিটি বাজানোর উপযুক্ত সময় যে এটা নয়, এর জন্য আমাদের গোটা ভবিষ্যত পড়ে আছে; এ তাদেরকে কে বোঝাবে!
আমরা জানি যে কোভিড-১৯ বা করোনাভাইরাসে এ এখনো পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ, মৃত্যের সংখ্যা ২০ হাজার ছুঁই ছুঁই করছে। এদিকে বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত আক্রান্তের সংখ্যা ৩৯, মৃতের সংখ্যা ৫। কিন্তু এ তো গেলো কাগজ-কলমের হিসেব, কাগজ-কলমের বাইরের হিসেবটা যে ঠিক কত; তা আমরা কল্পনাও করতে পারছি না। অথচ দেখা যাচ্ছে যে ঈশ্বরের পরে যাদের আসন, সেই ডাক্তারদেরই আজ কোনো রক্ষাকবচ নাই, পর্যাপ্ত টেস্টিং কিট নাই, নাই কোয়ারেন্টিন সেন্টার এবং আরও হাজারটা সমস্যা। মোদ্দাকথা, এতটুকু পরিমাণ পূর্বপ্রস্তুতি আমাদের ছিল না। কিন্তু কেন? প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য পর্যাপ্ত সময় কি আমরা পাইনি?
আমরা যদি একটু পেছনে তাকাই, তাহলে দেখতে পাবো যে কোভিড-১৯ এর প্রথম সংক্রমণ শুরু হয় চীনের উহানে, ২০১৯ সালের ১ ডিসেম্বর। এদিকে বাংলাদেশে প্রথম করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হয় ২০২০ সালের ৮ মার্চ। মাঝে তফাৎ দীর্ঘ ৩ মাস। পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করার জন্য ৩ মাস অর্থ্যাৎ ৯০ দিন কিন্তু খুব একটা কম সময় না! কিন্তু ধরে নিলাম যে আমরা পূর্বপ্রস্তুতি গ্রহণ করিনি, ঘুম যথাসময়ে না ভাঙ্গলে প্রস্তুতি গ্রহণ সম্পন্ন হবে না, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ঘুম ভাঙ্গার পর চারদিকের আবহাওয়া দেখে ঘটনার ভয়াবহতা আঁচ করে তাৎক্ষণিকভাবে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা তো যেতেই পারে। আসলে যেতে পারে না, বরং পারা উচিত ছিল।
ডেটা বলে, কোভিড-১৯ বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১৯০টিরও বেশি দেশে তার ডালপালা ছড়িয়েছে। সবথেকে বেশি ভয়াবহতা বিরাজ করছে গোটা ইউরোপ জুড়ে। কিন্তু ইউরোপের অধিকাংশ দেশের আয়তনের তুলনায় জনসংখ্যা অনেক কম, তবুও সেখানে মৃত্যুর ঢল বইছে। সেক্ষেত্রে ১ লক্ষ ৪৭ হাজার ৫৭০ বর্গ কিলোমিটারের আমাদের এই ছোট্ট ভূখণ্ডে ১৭ কোটি মানুষের বসবাস এবং এখানে যদি কোভিড-১৯ তার রাজ্যপাট পাকাপাকিভাবে গুছিয়ে নিতে শুরু করে, তাহলে এ তল্লাটের চিত্র কেমন হবে তা ভাবা যায়! মৃত্যুর মিছিল লেগে যাবে। এই এতটুকু কেন আমরা শুরুতেই ভাবিনি! ভাবলেও যথাযথ গুরুত্ব কেন দেইনি!
যদি গুরুত্ব সহকারে ভেবে থাকি, তবে আজ এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে আমাদের কর্তা স্থানীয় ব্যক্তিবর্গ এমন হুটহাট করে ভুলভাল সিদ্ধান্ত নিতেন না যে সিদ্ধান্তের মাঝে এতটুকু দূরদর্শিতার আভাস মাত্র পাওয়া যায় না। প্রশ্ন উঠতে পারে কিসের ভিত্তিতে আমি তাদের সিদ্ধান্তকে ভুলভাল হিসেবে আখ্যা দিচ্ছি। সেক্ষেত্রে আমার ব্যাখ্যা-
০১) সরকার গতপরশু হঠাৎ টানা ১০ দিনের সাধারণ ছুটির ঘোষণা দিলো। সরকারি-বেসরকারি, সবার জন্য। নিঃসন্দেহে এটা সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত, এই ছুটিটা বরং আরও আগে দেয়ার দরকার ছিল। কিন্তু সে যাই হোক, সার্বিক বিবেচনায় সরকারের এই ১০ দিনের ছুটির সিদ্ধান্ত কি আদৌ প্রশংসনীয় কিছু ছিল? ছিল না, বরং সরকারের কৌশলগত বিশাল এক ত্রুটি ছিল এখানে।
মানুষকে ছুটি দেয়া হয়েছে স্ব স্ব স্থানে গৃহবন্দী হয়ে থাকার জন্য, ছুটি পেয়ে সেটাকে 'ঈদের ছুটি' মনে করে আনন্দ ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ার জন্য না। কিন্তু মানুষ বেছে নিয়েছে দ্বিতীয়টাই। 'রাখে আল্লাহ মারে কে' বলে রেলস্টেশন, বাসস্টপেজ, সদরঘাটে টিকেট কাটার ধুম লাগিয়ে দিয়েছে তারা; বাড়ি ফেরার তাড়নায়। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এটাই কি স্বাভাবিক চিত্র নয়! আমাদের নীতি নির্ধারকদেরও তো এ কথা অজানা থাকার কথা না যে এরকম লম্বা ছুটি দিলে এই প্রবল আবেগপ্রবণ জাতিকে কোনোভাবেই আর চার দেয়ালের মাঝে আটকে রাখা যাবে না। সাত সমুদ্র তের নদী পাড়ি দিয়ে হলেও তারা তাদের পরিবারের কাছে ছুটে যাবে।
তাহলে সরকার কেন সর্বপ্রথম সব ধরণের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করার ঘোষণা না দিয়ে দুম করে ১০ দিনের সাধারণ ছুটির ঘোষণা দিয়ে দিল? কিন্তু সেই তারা যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন ঠিকই, তবে বড়সড় অঘটন ঘটে যাওয়ার পর। একটা বৃহৎ সংখ্যক মানুষ ইতোমধ্যে হুড়োহুড়ি করে গতকালই নিজ নিজ পরিবারের কাছে চলে গিয়েছেন এবং যা কিছু ছড়ানোর, পুরো দেশব্যাপী তা ছড়িয়েও দিয়েছেন। তাহলে এখন যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে কি লাভ আসলে?
এ তো গেল গতকালের আলাপ৷ কিন্তু এরকম কাহিনী আমাদের নীতি নির্ধারকরা গত কয়েকদিনে অসংখ্যবার করে গেছেন। সেক্ষেত্রে ১৬ মার্চের কথা স্মরণ করা যাক। ঘোষণা এলো, ৩১ মার্চ পর্যন্ত সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। সবাই তো ভীষণ খুশি, দলবল মিলে ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বেড়িয়ে পড়া যাবে। আমার নিজেরই কিছু বন্ধুবান্ধব তক্ষুণি ভ্রমণ পরিকল্পনা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল যে ছুটিতে তারা কোথায় যাবে, সাজেক নাকি সেন্টমার্টিন?
তো, পরবর্তীতে দেখা গেলো যে সরকার সমস্ত পর্যটন কেন্দ্র বন্ধ ঘোষণা করেছে ঠিকই; কিন্তু ততক্ষণে হাজার হাজার শিক্ষার্থী দেশের বিভিন্ন পর্যটন কেন্দ্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছে এবং যা অঘটন ঘটার, তাও ঘটে গিয়েছে। কিন্তু আমার অবাক লাগে এটা ভেবে যে ক্ষমতার চূড়োয় বসে আমাদের কর্তাস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ কি তাদের জনগণের পালস রেট আসলেই পড়তে পারেন না? পড়তে পারলে তো বারবার এমন লোক হাসানোর প্রতিযোগিতায় একাধিকবার অংশগ্রহণ করতেন না।
০২) প্রতিদিন পৃথিবী জুড়ে শয়ে শয়ে মানুষ কোভিড-১৯ দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ তাদের ফ্লাইট বন্ধ করে দিচ্ছে। আর আমরা করেছি উলটো। দেশের বাইরে থেকে দেদারসে লোক এসেছে এবং আমরা তাদের নামমাত্র স্ক্রিনিং করে হোম কোয়ারেন্টিনে থাকার পরামর্শ দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি।
কিন্তু কেন? আমরা কি জানি না ঐ পরামর্শ শুনে চলার মতো মানসিক, পারিবারিক এবং সামাজিক সক্ষমতা আমাদের নাই? আমরা ইউরোপ আমেরিকার মতো উন্নত জীবনব্যবস্থায় অভ্যস্ত নই। আমি হলফ করে বলতে পারি যে যদি জরিপ চালানো হয় তবে দেখা যাবে যে আমাদের দেশের অধিকাংশের বাড়িতে নিজেকে আলাদা একটা ঘরে রাখার মতো ব্যবস্থা নাই। তাছাড়া যেখানে সামান্য শহর থেকে কেউ গ্রামে এলে আশেপাশের দশ গ্রামের আত্মীয়স্বজন এসে ভীড় করে তাকে এক নজর দেখার জন্য, সেখানে কেউ বিদেশ বিভূঁই থেকে এলে ঐ অতি উৎসাহী কিন্তু অতি সহজ-সরল, আবেগপ্রবণ, অতিথিপরায়ণ আত্মীয়, পাড়া-প্রতিবেশী, গ্রামবাসীকে আপনারা রুখবেন কী করে! এর থেকে কি এটাই সমীচীন ছিল না যে শুরুতেই তাদের দেশে আসার পথটা সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়া? এলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে বাধ্যতামূলকভাবে ১৪ দিন কোয়ারেন্টিনে রাখা? কিন্তু এবেলায়ও আমরা ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইট বন্ধ করলাম ঠিকই, কিন্তু ততদিনে অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে।
০৩) পাঁচ ওয়াক্ত ঠিকঠাকমতো নামাজ না পড়লে কি হবে, হুজুর স্বপ্নে দেখেছে থানকুনি পাতা খেলে করোনায় ছুঁবে না। সুতরাং থানকুনি পাতা আমাদের খেতেই হবে। এমন ধর্মান্ধ জনতাকে ঘরে নামাজ পড়তে উৎসাহিত করার জন্য এই হুজুররাই হতে পারতো প্রধান মাধ্যম। হুজুররা যদি সমবেত হয়ে এই জনতাকে বোঝাতেন, 'মসজিদে নয়, ঘরে নামাজ পড়ুন', তাহলে জনতা তা আমলে নিতো। কিন্তু আমাদের হুজুররা আরও বেশি জ্ঞানী। তারা গত শুক্রবার বললেন, 'সুন্নত আর নফল নামাজ ঘরে পড়বেন তবে ফরজ এসে মসজিদে'। খুব লাভ হলো এতে। মুসুল্লিরা নিজেদের অজান্তেই একে অপরের নাকের ড্রপলেট ভাগাভাগি করে নিলো এবং কোভিড-১৯ গত শুক্তবারের জুম্মায় এক দফা ডালপালা বিস্তার করে নেয়ার সুযোগ পেলো।
০৪) তারপর এলো উপ-নির্বাচন। গোটা বিশ্ব যখন করোনার ভয়ে কাঁপছে, বাংলাদেশ তখন প্রস্তুতি নিতে থাকলো একাধিক উপ-নির্বাচনের জন্য। কিন্তু আমরা সেই নির্বাচনও বন্ধ করলাম ঠিকই, কিন্তু কিছু জায়গায় ঐ অঘটনটা ঘটানোর পরে।
০৫) সর্বোপরি, ডাক্তারদের সুরক্ষা ব্যবস্থা এবং কোয়ারেন্টিন সেন্টার। কোয়ারেন্টিন সেন্টার গড়ে তোলার দায়িত্ব আমরা দিলাম সেনাবাহিনীর হাতে, কিন্তু এই দায়িত্ব কি আরও আগে দিতে পারতাম না? নাকি আমরা ধরেই নিয়েছিলাম যে করোনা বঙ্গদেশে আসবে না? তারপর সেনাবাহিনী মোতায়েন করলাম কাল, জনগণ যাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলে। তা, যদি সেনাবাহিনীর ওপর আমাদের এত বেশি আস্থা থাকে, তবে তা আরও কিছুদিন আগে থেকে কার্যকর করার সিদ্ধান্ত কেন নিলাম না আমরা? তাহলে তো আজ এত জটিলতা সৃষ্টি হতো না।
বাকী রইলো ডাক্তার, যারা না বাঁচলে রোগী বাঁচবে না। সেই তাদের আজ মানসম্মত তো দূরের কথা, ন্যুনতম পিপিই পর্যন্ত নাই। ডাক্তারদের বাঁচাতে সরকারের আগে আজ মাঠে নামতে হচ্ছে বুয়েট অ্যালামনাইদের, বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের। কিন্তু এগুলি তো হওয়ার কথা ছিল না। মানছি আমরা হতদরিদ্র দেশ, তাই বলে এতটাও দুরবস্থা আমাদের যে, হাসপাতগুলিতে পর্যাপ্ত করোনা টেস্টিং কীট, পিপিই, মাস্ক, গ্লাভস দিতে পারি না! ৩ মাস সময় পাওয়ার পরও! অথচ আমরা হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে পদ্মাসেতু বানাতে পারি কিন্তু দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার এই হাল!
তো- যা নিয়ে আলাপ শুরু হয়েছিলো, ১০ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা। পুরো বাংলাদেশে এখন ছুটি ছুটি চলছে কিন্তু আমাদের লক্ষ লক্ষ গার্মেন্টসকর্মী নিপুণ হাতে এখনো পর্যন্ত তাদের কাজ করে যাচ্ছেন। এই গার্মেন্টসও আমরা ঠিক বন্ধ করব। কিন্তু সময় থাকতে না, ঐ অঘটন ঘটে যাওয়ার পর।
এত কথা বলার কারণ একটাই-
রাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকগণ,
হুটহাট নয়, বেলা হয়েছে, দয়া করে এবার অন্তত আপনারা গা ঝাড়া দিয়ে ঘুম থেকে উঠে বসুন, তামাম পৃথিবীর দিকে তাকান, আপনার দেশের মানষের নাড়ীর ভাষাকে পড়তে চেষ্টা করুন এবং তারপর সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নিন।