Published : 23 Mar 2020, 08:46 PM
সরকার বলছে দেশে পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ রয়েছে। সরকারের কাছে জানতে চাই- আপনারা যে মজুদের কথা বলছেন, তা কার কাজে দেবে?
এরই মধ্যে ঢাকাসহ সব জায়গায় বৈষয়িক কর্মকাণ্ড ধীরগতি পেয়েছে। ঢাকার রাস্তায় ছুটির দিনের মত আমেজ অনুভূত হচ্ছে। 'দিন আনে দিন খায়' মানুষের প্রাত্যহিক রোজগারে টান পড়েছে। সামনে ১০ দিন প্রাথমিকভাবে সবকিছু বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে সরকার। এতে খুব দ্রুতই বাজারে সাজানো কোনও জিনিস কেনার সামর্থ্য হারাবে গরিব মানুষ। ফলে মজুদ থাকার কোনো সুখবর তার কানে পৌঁছাবে না। এমন দুর্যোগ মুহূর্তে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সোমবারের প্রেস ব্রিফিংয়ে গরিবদের নিয়ে ভয়ানক কথা বলা হয়েছে। সেখানে জানানো হয়েছে, শহরে জীবন চালাতে অক্ষম নিম্ন আয়ের মানুষরা হয় তার গ্রামে গিয়ে নতুন রোজগারের উদ্যোগ নিক অথবা নোয়াখালীর ভাসানচরে চলে যাক। যেখানে এক লাখ মানুষের জন্য ব্যবস্থা রয়েছে বলেও জানানো হয়। এই ঘোষণা শুধু অদ্ভুতই নয়, খুব স্পষ্ট করে বলা হল- গরিব মানুষদের দায়িত্ব আদতে সরকার নিচ্ছে না! কী ভয়ানক তামাশা! বিশ্বযুদ্ধের দুর্ভিক্ষের সময়ে ব্রিটিশ শাসকদের নীতির কথা মনে পড়ে গেল।
গত ১৫ মার্চের তথ্যের হিসেবে খাদ্য মন্ত্রণালয় জানাচ্ছে- দেশে সরকারি গুদামে শস্য রয়েছে সাড়ে ১৭ লাখ টনের বেশি; যার সোয়া ১৪ লাখ টন চাল আর বাকিটা গম। ফলে সরকারিভাবে দেওয়া খাদ্য সংকট না হওয়ার আশ্বাসের সঙ্গে দ্বিমত করার সুযোগ নাই। তবে বেকার হয়ে পড়লে তা কেনার পয়সা কতজন মানুষের হাতে থাকবে? গত বছরের জরিপের হিসাবে পরিসংখ্যান ব্যুরো বলছে, সাড়ে ২০ শতাংশ দরিদ্র আর সাড়ে ১০ শতাংশ অতি দরিদ্র মানুষ এদেশে রয়েছে। জনসংখ্যা ১৭ কোটি হলে সাড়ে ৩ কোটির বেশি লোক সরকারি হিসেবেই দারিদ্র্য কবলিত। তাদের ২০১৬-১৭ সালের হিসেবে, বাংলাদেশে কৃষিতে ৪০ শতাংশ, শিল্পে ২০ শতাংশ আর সেবাখাতে প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ নিয়োজিত। সেখানে ব্যবস্থাপক, প্রফেশনাল, টেকনিক্যাল আর কেরানি মিলিয়ে ১০ শতাংশের কম মানুষ এসব স্তরে কাজ করেন। প্রাথমিক পর্যায়ের কর্মজীবী প্রায় ২০ শতাংশ, নানা রকম শ্রমিকও ২২ থেকে ২৩ শতাংশ, আর দক্ষ চাষাবাদে ৩২ শতাংশ এবং সেবায় প্রায় ১৭ শতাংশ লোক নিয়োজিত। এর মধ্যে কার কত টাকা আয়, আমরা অনুমান করে নিতে পারি এবং কাদের মাসখানেক বসে বসে খাওয়ার সামর্থ্য থাকতে পারে। ফলে চার কোটি দরিদ্র মানুষ ছাড়াও সাময়িক বেকার হওয়া বিশাল সংখ্যার মানুষও খাবার জোটাতে পারবে না। এই সত্য সরকারকে বুঝতে হবে।
বাংলাদেশের জন্য কভিড-১৯ ভাইরাস যতটা ভয়ঙ্কর, কাজ ছাড়া ঘরে বসে থাকা অধিকাংশ মানুষের জন্য প্রতিদিনের খাবার জোটানো তার চেয়েও বড় ভয়ঙ্কর। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষই সামাজিক নিরাপত্তা ও সঞ্চয়হীন। বড় বিপদ হলে ভিটা বেচা ছাড়া উপায় থাকে না তাদের। তবুও শুধু এই দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় চিকিৎসা সেবা নিতে বাংলাদেশের মানুষকে বেশি টাকা গুণতে হয়। 'দেশে চিকিৎসা ব্যয় বেশি' কথাটা করোনাভাইরাস সংক্রান্ত এক ব্রিফিংয়ে সিপিডি বলেছে। এ নিয়ে তথ্য মন্ত্রণালয় কোনো হৈচৈ করেনি।
অন্য দেশে যা দেখা যাচ্ছে, তাতে খুব দ্রুতই কয়েকটি সরকারি হাসপাতাল অসুস্থ মানুষ সামলানোর জন্য অপ্রতুল। মুদি দোকানদার জিনিসের দাম বেশি নিলে সাজা দিতে পারেন আর দেশের সব বেসরকারি হাসপাতাল সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেন না কেন? এ সময়ে সব হাসপাতালে চিকিৎসা বিল সরকারি হারে মেটানোর ব্যবস্থা কি খুবই অসম্ভব? দুর্যোগপূর্ণ বিশ্ব পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে মুনাফা করার সুযোগ থাকা উচিত না। দেশের সব ডাক্তার-সেবক-সেবিকার জন্য সরকারি হারে আপদকালীন বেতন-ভাতার ঘোষণা আসা দরকার। সব হাসপাতাল সরকারের আওতায় পরিচালিত হওয়া দরকার।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে যে প্রবীণজন মিরপুরে মারা গেলেন তার ছেলে ফেইসবুকে পোস্ট দিয়ে জানিয়েছেন, তার বাবাকে চিকিৎসা করাতে হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেছেন, কিন্তু সবাই দূর দূর করেছে। বোঝাই যায় হাসপাতালগুলো করোনাভাইরাস রোগীর সামান্য চিকিৎসা দিতেও দ্বিধাগ্রস্ত। কারণ গাল ভরা কথা ছাড়া, তাদের নিরাপত্তার কোনো ব্যবস্থা এখনও করাই হয়নি। এখন একটা দুটো মৃত্যুর খবর, কয়েক ডজন আক্রান্তের খবর সরকারিভাবে বলা হচ্ছে। কয়েক দিনের মধ্যে তা হাজার হাজার হয়ে পড়বে। ঢাল-তলোয়ারহীন ডাক্তার বাবুরা চিকিৎসা দিতে পারবেন না। এটা বোধগম্য যে হাজার হাজার অসুস্থ হতে শুরু করলে বাড়ি বসে মরা ছাড়া বিকল্প আর কিছু থাকবে না।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ওই প্রবীণের ছেলে আরও জানিয়েছেন, তার বৃদ্ধ বাবা মসজিদ ছাড়া বাড়ির বাইরে আর কোথাও যেতেন না এবং তাদের কোনো বিদেশফেরত স্বজন নাই। বোঝাই যাচ্ছে, শুধু বিদেশফেরতই নয় দেশের অনেকের মধ্যে ছড়িয়েছে এ ভাইরাস। আর এক শ্রেণির কাঠমোল্লা এখনও মসজিদ-সোশাল মিডিয়ায়-ওয়াজে রটিয়ে বেড়াচ্ছেন মুসলমানদের এ রোগ হয় না! একই কথা ইতালি ফেরত এক প্রবাসীকে হাজি ক্যাম্পের সামনে চিৎকার করে বলতে শুনেছি। তাতে অবশ্য মন্ত্রীর আঁতে লাগায় তাদের 'নবাবজাদা' বলে গালমন্দ করেছেন। অথচ যেখানে মক্কা-মদিনাসহ আরবে মসজিদ বন্ধ করে দিয়ে মানুষকে ঘরে বসে ইবাদত বন্দেগি করতে বলা হচ্ছে, সেখানে ইসলামিক ফাউন্ডেশন মিউমিউ করে অনুরোধ করেই যাচ্ছে-মসজিদে অল্প সময়ের জন্য যেতে পারেন! এই পরামর্শের অর্থ বোঝে এই ফাউন্ডেশনের হর্তাকর্তারা?
আপনারা দায়িত্ব নিলেন যে 'অল্পসময়ের জন্য মসজিদে গেলে কিছু হবে না।' আপনারাই মুসল্লিদের মৃত্যুর হুমকির মধ্যে ঠেলে দিলেন। অতিরিক্ত কেনাকাটার জন্য জিনিসের দাম বাড়ছে অজুহাত দিয়ে সরকার যেখানে অনিয়ন্ত্রিত বাজারের দায় ক্রেতাদের ঘাড়ে চাপাচ্ছে, সেখানে এই ফাউন্ডেশন আগ বাড়িয়ে কাঁধে তুলে নিচ্ছে দায়! ধর্মব্যবসায়ীদের ভীতির ছাপ মন্ত্রিপরিষদের প্রেসব্রিফিং-এও দেখা গেছে। মসজিদে যাওয়ার প্রশ্নে স্পষ্ট করে নিষেধ করতে পারেননি সচিব। এই ঝুঁকি মাপার ক্ষমতা শুধু মাওলানাই না অন্যান্য পেশার মানুষরাও রাখেন না। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা যা বলবেন সেটাই চূড়ান্তভাবে গ্রহণ করতে হবে। এখানে মওলানাসহ অন্য কানো কথা বলার অধিকার নাই।
স্ব-অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণের ঘোষণার পর আমাদের বুকের পাটা এতই উঁচু হয়েছে যে একশ-দুইশ কোটি টাকার কাজকে আর কাজই মনে হয় না- হাজার কোটি টাকার নিচে কথা বলাই ছেড়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। সেদেশে ডাক্তারদের 'পিপিই' নাই! ভাবতেই অবাক লাগে। তার চেয়েও বড় আশ্চর্যের নিরাপত্তা পোশাক বানানোর উদ্যোগ নিয়েছে এক কোম্পানি, বিনা পয়সার সরবরাহ করবে তারা। সেই পোশাক বানানোয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সায়-ও দিয়েছে। অথচ মাত্র ৬ কোটি টাকার এ কাজের জন্য তারা বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা তুলছেন! কেন? সরকারের কোষাগার কি শূন্য? বালিশ কেনার, মেডিকেল কলেজের পর্দা কেনার, ব্যাংক থেকে টাকা বেহাত হবার সময় তো অনেক অনেক টাকার কথা জানতে পারি। লাখ লাখ টাকার বাজেটের সেদেশের সে-ই সব টাকা আজ কোথায়?
খবর বেরিয়েছে, বেশ কয়েকটি হাসপাতালে সর্দি কাশি নিয়ে দু-চারজন রোগী গেলেও তাদের চিকিৎসা দিতে ভয় পাচ্ছেন তারা। সেখানে শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে রোগী যখন ভিড় করবে তখন কী হবে ভেবে দেখেছেন? সরকারিভাবে অপরীক্ষিত মৃতদের সৎকার করবে কারা? এরইমধ্যে ভীত সন্ত্রস্ত মানুষ বিভিন্ন জায়গায় প্রবাসীদের অবরোধ করছে নানা কারণে। গুজবে বিশ্বাসী জাতি যেকোনো মৃত্যুকে যেকোনো অসুখকে করোনাভাইরাস আক্রান্ত ভাবতে শুরু করবে না তার নিশ্চয়তা কে দেবে?
সত্তরের জলোচ্ছ্বাসে এদেশের এক কোণে ভোলায় ১০ লাখের বেশি মানুষের মারা গিয়েছিল। লাখো মানুষের মৃত্যুর ঘটনা পাকিস্তানি জান্তারা গুরুত্ব দেয়নি সেদিন। বঙ্গবন্ধুর বিশাল নেতা হয়ে ওঠার পেছনে এটাও বড় কারণ। এরপর একাত্তরে লাখ লাখ মানুষের আত্মদানের ইতিহাস ছাড়া আর এমন কোনো ঘটনা নাই যা অচিরেই দেশের সামনে হাজির হচ্ছে।
আরও মৃত্যুর খবর আসতে শুরু করলে আতঙ্কে মানুষ স্বেচ্ছায় গৃহবন্দি হবে। মধ্যবিত্ত যতদিন ঘরে বসে খেতে পারবে ততদিন গরিব পারবে না। এরশাদের কারফিউয়ের সময়ের এক গল্প জানি-রিকশা নিয়ে বেরিয়েছেন এক চালক। রাস্তায় কেউ নাই, তবু তিনি রিকশা নিয়ে যাত্রীর অপেক্ষা। আইনশৃংখলা বাহিনী তাকে ধরার পর তার একটাই কথা- 'গুলি করে মারেন, আমি একা মরব কিন্তু রিকশা না চালালে পরিবারের সবাই না খেয়ে মরবে।' তেমনই অসুখে মরার ভয়ে গর্তে লুকানো মানুষ ক্ষুধার তাড়ায় এক সময় রাস্তায় নামবে। চুরি, রাহাজানি ছাড়াও অনাহারী মানুষ বাঁধ ভেঙে নামার শঙ্কা অমূলক নয়। সে শঙ্কায় যারা শক্ত শাসনের পাঁয়তারা করছেন, তাদের আশা ভঙ্গ হবে আইয়ুবের মত। মরণ যখন পেছনে তাড়া করে, সামনের বুলেট তখন তুচ্ছ। খেপে গেলে হিতাহিতজ্ঞান শূন্য বাঙালিদের 'দাবায় রাখতে পারবা না।'
এরই মধ্যে দেশের কয়টি যৌনপল্লি বন্ধ করে সেখাকার সবাইকে ৩০ কেজি করে চাল বিনামূল্যে বিতরণের কথা গণমাধ্যমে এসেছে। দ্রুততার সাথে এ সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। তবে যৌনকর্মী না হয়ে অন্য পেশায় যাওয়া কি বাকি গরিবদের অপরাধ হয়েছে? তাই যত রসদ আছে, সব নিয়ে পরিস্থিতির মোকবেলায় নামুন- মানুষের ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দিন, ওষুধ ও চিকিৎসা দিন। খাবার খুঁজে নেওয়ার ব্রিটিশ ভাবনা ঝেঁটিয়ে বিদায় করুন। আর ঢাকা শহরে সরকারি ভবন থেকে বিয়েবাড়ির মতো সাজানো আলগা লাল-নীল বাতিগুলো সরান। বঙ্গবন্ধুকে এদেশের মানুষ নির্মাণ করেছে, তাকে নিয়ে তামাশা করার অধিকার পটকাবাজদের নাই। আশা রাখি, পদ্মা সেতু যখন পেরেছেন এটাও পারবেন। 'বুক বেঁধে তুই দাঁড়া দেখি' এ ডাক সরকার নাকি নিম্ন আয়ের মানুষ কে শুনবে- দেখার অপেক্ষা।