Published : 08 Mar 2020, 01:31 PM
এবার নারী দিবসের প্রাক্কালে পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি রুবানা হক বলেছেন, 'আজকে নারী দিবস আমাদের জন্য বড় কোনো ব্যাপার না। মানুষের দিন চাই। মানুষ দিবস হওয়া উচিত, নারী না।' প্রতি বছর নারী দিবস আসে। শহরে-নগরে ঘটা করে নারী দিবস পালন করা হয়। আর রুবানা হকদের মতো একদল মানুষ তর্কে মেতে ওঠেন, 'নারী দিবস কেন? কোনো পুরুষ দিবস নেই?' কেন 'মানব দিবস' পালন করা হয় না। কেউ কেউ এমন কথাও বলেন যে, একটি বিশেষ দিন বরাদ্দ করে নারীর লড়াই মাপা যায় না। সমাজে সমানাধিকারের দাবিতে মেয়েদের কতখানি লড়াই চালাতে হয়, এক দিনের আলোচনায় সেটা ধরা যাবে না। বৈষম্যের রূপ কতখানি প্রকট, তা সকলের টের পাওয়া প্রয়োজন। প্রতিদিনই হোক নারী দিবস।
নারী দিবস পালন নিয়ে এ বিতর্ক নতুন নয়। এটা হয়তো অনন্তকাল চলবে। তবে নারীর জন্য একটা আলাদা দিন উদ্যাপনের জন্য বরাদ্দ থাকার আলাদা গুরুত্ব আছে। বিশেষভাবে সময় বরাদ্দ করা না থাকলে, বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজেও ভুল হয়ে যায়। ফলে মেয়েদের জন্য বিশেষ একটা দিন নির্ধারণ করাই ভালো। একথা ঠিক যে, আধুনিক সমাজে বদলেছে নারীর ভূমিকা। কিন্তু পরিবর্তিত পরিস্থিতিতেও কি বদলেছে নারীর মর্যাদা? সেটা ভাবার জন্যও ব্যস্ত জীবনে একটা নির্দিষ্ট দিন দরকার।
খাতায়-কলমের অধিকারগুলো বাস্তবে কতখানি ভোগ করতে পারছে, নারী দিবস সেটা খতিয়ে দেখার দিন। নারীদের কাজের পরিধি, আর্থিক ব্যবস্থায় অনেক বদল এসেছে ঠিকই। পরিবর্তিত সেই পরিস্থিতিতে অধিকারের লড়াই মাপার দিনও তো নারী দিবস। এ দিবসের বুনিয়াদি তাৎপর্যটা উপলব্ধি করা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। নারীকে সমানাধিকার পাওয়ার জন্য যে সুদীর্ঘ লড়াই লড়তে হয়েছে সেই ইতিহাস ভুলে গেলে চলে না। কখনও কাজের অধিকার, কখনও সমকাজে সমমজুরির অধিকার, কখনও সম্পত্তির অধিকার, কখনও ভোটাধিকার— একের পর এক অধিকার নারীকে অর্জন করতে হয়েছে সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে। ৮ মার্চ তারিখটা সংগ্রামের সেই সুদীর্ঘ ইতিহাসে একটা উল্লেখযোগ্য মাইলফলক তো বটেই। নানা সামাজিক নিগড়ের বিরুদ্ধে নারীর সংগ্রাম যে আজও চলছে, তাও অস্বীকার করা চলে না। অতএব বছরে একটা দিন সংগ্রামের যাত্রাপথটাকে স্মরণ করার আন্তর্জাতিক আয়োজনটির প্রয়োজন নেই, এমন কথা বলা যায় না।
সমাজ এগোচ্ছে। নারীর-অধিকার ও মর্যাদাও সমাজে বাড়ছে। কিছু লোকের নারী-বিদ্বেষও পাশাপাশি বাড়ছে। একদল তো ৮ মার্চ সমানুভূতির সর্ব দর্প চূর্ণ করে ঝাঁপিয়ে পড়েন সোশ্যাল মিডিয়ায়, 'মেয়েদের জন্য আস্ত একটা দিন কেন শুনি, অ্যাঁ? ছেলেরা কি কম খেটে মরে? ছেলেরাও অত্যাচারিত, বঞ্চিত! পুরুষের জন্য কোনও দিবস নেই কেন? আমাদেরও দিবস চাই' ইত্যাদি বলে কেঁদে-ককিয়ে একশা করবেন। ছেলেদের দোষ নেই। তাদের অনেকেই সম্ভবত দিনটির ইতিহাস ও প্রাসঙ্গিকতা জানেন না। আর পোশাকি উদযাপনের ঘটায় সে ইতিহাস গিয়েছে হারিয়ে। নারী দিবস এখন অনেক পোশাকের দোকানে ছাড়ের উৎসব! বিভিন্ন মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির গালভরা বিজ্ঞাপন!
নারী দিবসের ইতিহাসে গোড়ার কথাটি হল, শ্রমিক নারীর কাজের সময়, ছুটি, সম্মানজনক বেতনের দাবিতে আন্দোলন। ১৮৫৭-র ৮ মার্চ আমেরিকার বস্ত্রশিল্পের নারী শ্রমিকদের কাজের সময় কমানো ও মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে লড়াই পশ্চিমি দুনিয়ায় আলোড়ন তোলে। পরবর্তী কালে যুক্ত হয় মেয়েদের ভোটের অধিকারের দাবি। এই সমস্ত দাবি আদায়ের উদ্দেশ্যে ১৯১০ সালে কোপেনহাগেনে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে ৮ মার্চ নারী দিবস পালনের ডাক দেওয়া হয় এবং ১৯১১ থেকে তা পালন শুরু হয়। আমাদের দেশেও নারীর অর্থনৈতিক, সামাজিক অধিকারের দাবির পাশাপাশি যৌতুক, ধর্ষণ, মেয়েদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পাবারিক সহিংসতা, পরিবারে মেয়েদের অবস্থান ইত্যাদি বিষয় নারী আন্দোলনের দাবির অন্তর্ভুক্ত হতে থাকে এবং প্রতি বছর এই সব দাবি আদায়ের আওয়াজ তোলা হয় নারী দিবসে।
কিন্তু নারী দিবস যখন মূলধারার 'উৎসবে' পরিণত হলো, রাষ্ট্র থেকে করপোরেট, সবাই যখন নারী দিবস নিয়ে মাতামাতি শুরু করল, তখন এই সব 'অস্বস্তিকর' প্রশ্নকে সরিয়ে রাখা হল। নারী দিবসের পিছনে যে মেয়েদের সামাজিক-অর্থনৈতিক অধিকারের প্রশ্নটি আছে, সেটি সুচতুর ভাবে সবাইকে ভুলিয়ে দেওয়া হলো, কারণ মেয়েদের সামাজিক, অর্থনৈতিক বঞ্চনা আজও কমেনি। আইন যা-ই বলুক, আজও নারী-পুরুষ সমান কাজে সমান মজুরি পায় না, মেয়েরা সম্পত্তির ভাগ চাইতে আজও কুণ্ঠা বোধ করে, সম্প্রতি আমাদের দেশে অর্থকরী কাজে মেয়েদের অংশগ্রহণ পর্যন্ত কমতির দিকে। যৌতুক, পারিবারিক নির্যাতন, ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতন কোনও কিছুই স্বস্তিকর পর্যায়ে আসেনি। গত ত্রিশ বছর আগে মেয়েদের জীবনের যে সমস্যাগুলো তুলে ধরা হয়েছে, দেখা যাচ্ছে ত্রিশ বছর পর আজও তা প্রাসঙ্গিক।
সম্প্রতি ৮ মার্চকে যে রাষ্ট্র ও বহুজাতিক বাণিজ্যিক সংস্থাগুলো ছোঁ মেরে হাতিয়ে নিল, তার পেছনেও একটি রাজনীতির গল্প আছে। নারী দিবস যেহেতু পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে, নির্দিষ্ট ভাবে ধনতান্ত্রিক পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে ধারালো আন্দোলন গড়ে তোলার দিন হিসাবে ইতিহাসে জায়গা করে নিচ্ছিল, সেহেতু রাষ্ট্র এবং বাজার সম্মিলিত ভাবে দিনটির ঐতিহাসিক গুরুত্বকে ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য, আন্দোলনের পথ থেকে এই দিনটিকে সরিয়ে আনার জন্য কোমর বেঁধে লাগল। সুপরিকল্পিত ভাবে দমনের পথে না গিয়ে, ওই একটি দিন মেয়েদের চোখে রূপকথার কাজল পরানো শুরু হল। যে অভাগীকে রোজ ভোর পাঁচটায় উঠে বাচ্চাকে স্কুলের জন্য তৈরি করে, স্বামীর বিছানায় ধোঁয়া-ওঠা চা দিয়ে, রান্না সেরে দৌড়ে-দৌড়ে অফিস পৌঁছতে হয়, দু'দশ মিনিট দেরি হলে বসের কাছে, 'মেয়েদের দ্বারা কিচ্ছু হয় না' শুনতে হয় এবং বাড়ি ফিরেই ফের হেঁশেল ঠেলতে হয়, সেই মেয়ে যখন ৮ মার্চ ঘুম থেকে উঠে দেখেন বিজ্ঞাপনী ঢঙে স্বামী-সন্তান তার জন্য প্রাতরাশ সাজিয়ে রেখেছে, অফিসে ঢোকামাত্র অফিসের বস নারীকর্মী হিসাবে তার ভূয়সী প্রশংসা করছেন, এমনকি সন্ধেবেলার সিরিয়াল জুড়ে নারীর জয়গান গাওয়া হচ্ছে, তখন মেয়েদের চোখেও অসত্যের ঘোর লাগে, অনেক মেয়েই এই মিথ্যের বেসাতির সওয়ার হয়ে পড়েন।
তবে ধারণা এবং চেতনার অভাবটাই সব নয়। নারী দিবসের সঙ্গে নারীর অধিকারের যে সংযোগ, নারীর প্রতিবাদ-প্রতিরোধের যে সংযোগ এবং সর্বোপরি আজ নারীবাদের যে সংযোগ, সেটাই সম্ভবত পুরুষদের রাগিয়ে দিচ্ছে। বহু পুরুষ আছেন যারা 'নারীবাদ' শব্দটি শুনলেই তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠেন। তাদের কাছে নারী দিবস 'নারীবাদীদের' উৎসব। সত্যিই তো, পুরুষেরও দুঃখ, বঞ্চনা আছে, তাদেরও অফিসে বসের গাল খেতে হয়। কিন্তু একটা কথা তাদের বুঝতে হবে। আপাতদৃষ্টিতে নারী এবং পুরুষের অনেক সমস্যা এক মনে হলেও তার ফল মেয়েদের জীবনে সব সময় বহুমাত্রিক। মেয়েদের এবং ছেলেদের অবস্থানে আজও অনেক ফারাক।
তাছাড়া, বেশির ভাগ পুরুষের কাছেই এই বার্তা এখনও পৌঁছয়নি যে, নারীবাদ মানে নারী বনাম পুরুষের যুদ্ধ নয়। নারীবাদ ক্ষমতার সোপানতন্ত্র ভাঙতে চায়। ক্ষমতাবানের সঙ্গে ক্ষমতাহীনের লড়াই, প্রাতিষ্ঠানিক অচলায়তনের বিরুদ্ধে মুক্ত চিন্তার লড়াই-ই হল নারীবাদ। এই ক্ষমতার ভিত্তি হতে পারে লিঙ্গ, শ্রেণি, ধর্ম, জাতপাত, বর্ণ, যৌনতা, প্রতিবন্ধকতা ইত্যাদি বিভিন্ন পরিচিতি। নারীবাদী চিন্তা অনুযায়ী, পিতৃতন্ত্রে পুরুষও বঞ্চিত হয়, পুরুষকেও অনিচ্ছা-সত্ত্বে অনেক দায়ভার গ্রহণ করতে হয়। মা-বাবা মারা গেলে ছেলেরা প্রাণ খুলে কাঁদতে পারেন না, স্ত্রীকে সংসারের কাজে সাহায্য করলে তাদের 'স্ত্রৈণ' বলে খাটো করা হয়, যে ছেলে মেয়েদের ব্যাপারে সংবেদনশীল তাকে পিতৃতন্ত্র তাকে 'আলুরদোষ' হিসেবে অভিহিতি করে। নারীবাদ পুরুষকেও পিতৃতন্ত্রের বাঁধন থেকে মুক্তি দিতে চায়। নারীবাদ সমাজ-নির্মিত পৌরুষের ধারণার বিরুদ্ধে সরব। সেই জন্যই নারী দিবস পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার দিন, পুরুষের বিরুদ্ধে নয়। নারী দিবস শুধু নারীর দিন নয়, সমস্ত পিতৃতন্ত্রবিরোধী মানুষের উদযাপনের দিন।
সম্পদের পরিমাণ, পোশাকের বর্ণচ্ছটা, হাতে থাকা সেলফোনের আকার, বা আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিতি কিন্তু সভ্যতার সূচক নয়। সভ্যতার আসল সূচক হল চেতনার ঔজ্জ্বল্য, সমাজমানসের উদারতা, দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা। মানুষের চেতনাকে আলোকোজ্জ্বল করে তুলতে সক্ষম যে সমাজ, মানসপটে আকাশের রং লাগিয়ে দিতে সক্ষম যে সমাজ, দৃষ্টিপথ থেকে বিভাজন আর বিদ্বেষের পর্দাগুলো সরিয়ে দিতে সক্ষম যে সমাজ, সভ্য সমাজ তাকেই বলা যায়। সে সমাজে আমরা এখনও সর্বৈব পৌঁছতে পারিনি। যদি কোনও দিন পৌঁছতে পারি, তখন আর আলাদা করে নারী দিবস পালনের দরকার হবে না। আর তখন হয়তো 'নারীবাদ'ও হারিয়ে যাবে সমাজ থেকে। আপাতত তেমন সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সকলের অংশ্রগহণ চাই।