Published : 09 Feb 2020, 09:12 PM
চীনা আর জাপানিদের চোখ ছোট হয় বলে তাদের অনেকেরই নাকি জিরো পাওয়ারের চশমা পরেন চোখ বড় দেখাতে। ছোট চোখের খেদ ভুলতে বড় চোখের ফ্যান্টাসি থেকেই নাকি তাদের সব অ্যানিমেশন কার্টুন বা সিনেমার কাল্পনিক ক্যারেকটারগুলোর চোখ হয় বিরাট পুকুরের মতো। তবে ভালো যে চোখ বড় করার কোনো ঝকমারি বিজ্ঞাপন ওরা প্রচার করেনি।
এই যেমন গত কয়েক যুগ ধরে বিজ্ঞাপন দেখিয়ে 'টলার' হওয়ার আকাঙক্ষা বেচাকেনা চলছে এদেশে। তারপরও একদিন চোখে পড়েই গেল খবরটা; আরটিভি দু-চার বছর আগে খবরটা অনলাইনে ছেপেছিল, বাংলাদেশের নাম নাকি বিশ্বের খাটোদের তালিকায় শুরুর দিকেই রয়েছে। এখন পর্যন্ত এ জাতির গড় উচ্চতা সাড়ে পাঁচ ফুটেরও কম। আমাদের মানসিক গত উচ্চতা কতটুকু তা কোনো জরিপে এলো কি না সেই খবরটা অবশ্য এখনো খুঁজে চলেছি।
'আগে দর্শনদারি পরে গুণবিচারি' প্রচলিত বাক্যের সারকথা ছিল 'দর্শনে'ই বিশ্বাস। এর সরলীকরণে বলা যায়, আত্মবিশ্বাসের সাথে নিজেকে গুছিয়ে উপস্থাপন করলে অন্যে তবেই আগ্রহী হবে আস্থা রাখতে। তো দর্শনে নিজের আত্মবিশ্বাস চাঙ্গা রাখতে পোশাকে যত্নবান হলো মানুষ, পরিচ্ছন্নতায় যত্নশীল হলো, সুগন্ধিতে বিনিয়োগ করলো, সময়ানুবর্তী হলো; তারপরও আত্মবিশ্বাস মার খেল গায়ের রঙে।
ব্রিটিশদের 'সাদা চামড়া' ডাকতে ডাকতে দুশো বছর পার করে উপমহাদেশের জনগোষ্ঠী এটা বুঝেছিল গোরা হলে রাজ করা যায়। শুরুতে ফর্সা হওয়ার প্রতিযোগিতায় অবশ্য ঠেলে দেওয়া হয়েছিল নারীদেরই। ফর্সা মেয়ের বিয়ে হয় ভালো ঘরে। রবীন্দ্রনাথ যতই 'কৃষ্ণকলি' নাম দিন না কেন, গাঁয়ের লোক তো তাকে কালোই বলে।
ঝাঁ চকচকে বিজ্ঞাপনে দেখালো গায়ের রঙটি চাপা হওয়াতে চাকরির ইন্টারভিউয়ে আত্মবিশ্বাস জুটছে না। তারপর ক্রিম ঘষতেই চাঁপাকলি গাত্রবর্ণ, আর তারপরই সোনার হরিণ চাকরি।
কয়েক বছর আগে একবার বনানীতে একটা খুব পরিচিত কসমেটিক ব্র্যান্ডের দোকানে ঢুঁ মেরেছিলাম।ত্বকের সুরক্ষায় ওদের বিশাল আয়োজন; দিনের বেলায় মাখার মলম, রোদে গেলে মাখার মলম, রাতের বেলায় এই মলমটা মাখতে হবে; শুধু মলম মাখলেই হবে না, সিরামও (তরল কসমেটিক) আলতো আলতো করে লাগাতে হবে। ব্যাপারটা অনেকটা ডাক্তারের প্রেসক্রিপশনের মত ঠেকলো; খালি পেটে উমুক ক্রিম মাখতে হবে, দুপুরে খাওয়ার পরে তমুক ক্রিম মুখে লাগাতে হবে। কিছু না কিনেই দোকান থেকে বেরিয়ে গেলাম।
বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া বোনের জন্য ভালো ক্রিম কিনতে গেলাম একবার। শপিং মলের অনেক কটা দোকান ঘুরে আসার পর সারমর্ম হলো, এখন বাজারে দুই রকমের ক্রিম হয়; একটি হোয়াটেনিং, অপরটি অ্যান্টি-এজিং। সেদিন আমাদের কোনো ক্রিম কেনা হয়নি আর।
নারীকে কেবল ইহকালেই ফর্সা হতে হবে তা নয়। ওয়াজে গলা ফাটিয়ে যে ওয়াজি পরকালের হুরদের রূপের বয়ানে বলে চলেছিলেন তারা 'এ্যাতো সুন্দর এ্যাতো সুন্দর', সেই সৌন্দর্য আসলে তাদের ফর্সা গায়ের রঙ। হুরপরীদের কাউকেই কালো ভাবার সুযোগ নেই। রবীন্দ্রনাথের 'কৃষ্ণকলি' গানটি পরকালে অচল!
এখন অবশ্য পুরুষরাও ফর্সা হওয়ার চাপ রয়েছেন। তারা মলম ঘষে ফর্সা হচ্ছেন এক সপ্তাহেই। (পরকালের পুরুষরাও এত্তো এত্তো ফর্সা হয় কি?)
হালে অন্টারপ্রেনিওর হওয়ার তালে ঘরে বসে অনলাইনে আয় করে নিতে ঝুঁকেছেন নারী-পুরুষরা। বেশিরভাগই আসলে ইমপোর্টার। চীন থেকে, ভারত থেকে, থাইল্যান্ড থেকে এটা-সেটা কিনে এনে ফেইসবুকে তুলে দেন। এরমধ্যে অনেকের ফলোয়ার ভালো। ফলে তারা লাইভে আসেন। এসবে বড় কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হচ্ছে, তারা কী বিক্রি করছেন- তাতে।
গয়না, জামা, ঘড়ি, চুড়িতে যে যার মত দাম হাঁকানো মেনে নেওয়াই যায়, কিন্তু অনেকেই মলম মানে বিদেশি ক্রিমও বেঁচেন লাইভে। ফুটপাতে-ঘাটে-মাঠে চুলকানির মলম বিক্রেতাদের মত ঝকঝকে লাইভে এসে উদ্যোক্তারা বলেন, এই ক্রিমটি মাখলে আপনাকে একদম বিদেশি দেখাবে। অথচ নিজ দেশের গণ্ডি পেরিয়ে ভিন দেশে সবাই এমনিতেই তো বিদেশি।
অনলাইনে স্বাস্থ্য-ত্বক বিষয়ক যা কিছু বিক্রি হয়, তা দেশের যথাযথ কর্তৃপক্ষের নজরে না আসার কারণ কী হতে পারে? হয় এই ডিজিটাল দেশে বাস করেও তারা ফেইসবুকে নজর রাখেন না, নয়তো তারাও ফর্সা হওয়ার মলমের ক্রেতা।
পরিবেশ অধিদপ্তর এবং এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন-এসডো তাদের এক গবেষণা প্রকাশ করে গত বছর বলেছিল, দেশের বাজারে রঙ ফর্সা করার যতগুলো ক্রিম রয়েছে, তার প্রায় সবগুলোতেই পারদের (মিথাইল মার্কারি) পরিমাণ গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি।
বাংলাদেশ ২০১৩ সালে মিনামাটা চুক্তিতে দস্তখত করে। এর অর্থ মানুষের শরীরে ক্ষতিকর পারদের ব্যবহার রোধ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে বাংলাদেশও। মিনামাটা একটি রোগ, যা পারদ থেকে হয়। পারদের বিষক্রিয়া শরীরে ছড়িয়ে স্নায়ুতন্ত্রকে নিস্তেজ করে দেয়। মিনামাটা চুক্তিতে সই করে বাংলাদেশ বিচক্ষণতার পরিচয় দিলেও চুক্তির বাস্তবায়নে কোনো হেল-দোল বুঝে আসছে না। যথাযথ কর্তৃপক্ষ মিনামাটা নিয়ে কেন মিনমিন করছেন কে জানে! নাদের আলী, জাতি আর কত ফর্সা হবে?
যথাযথ কর্তৃপক্ষকে একটু ঘাঁটানোর কারণ একটাই, ভারতও ঠিক পরের বছর মিনামাটা চুক্তিতে সই করেছিল। আগে সই করার সুবাদে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকার সুযোগটাও নিতে পারতো, কিন্তু ঘোষণাটা আগে এলো শো বিজনেস আর গ্ল্যামারে সফল দেশ ভারত থেকেই।
ভারতের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় তাদের আপত্তিকর বিজ্ঞাপন নিয়ে আইনের (Objectionable Advertisements Act, 1954) খসড়া সংযুক্তি করেছে যাতে বলা হচ্ছে, গায়ের রঙ ফর্সাকারী, যৌনশক্তিবর্ধক, বার্ধক্য রোধ, পাকা চুল কালো করার যে কোনো বিজ্ঞাপনে এখন থেকে জেল-জরিমানা হবে।
প্রিয় যথাযথ কর্তৃপক্ষ, এমন একটি আইন কবে হবে আমাদের দেশে? অনেকেই ভাবছেন, যথাযথ কর্তৃপক্ষ মানে তো সরকার-প্রশাসন। কিন্তু এখানে আরো অনেক সংস্থারও দায় আছে।
বিজ্ঞাপন নেওয়া ও দেওয়াতে আয়-উপার্জন জড়িত। আয়-উপার্জন যেন মানুষ, নৈতিকতা ও পরিবেশের জন্য অবৈধ অথবা ক্ষতিকারক না হয়, সেজন্য নীতিমালা বেধে দেওয়া সরকারের কাজ তো বটেই, তবে সরকারের আগেও এগিয়ে আসতে পারে অনেক সংস্থা।
ভারতের এনডিটিভি বেশ গর্ব করেই জানাচ্ছে, ২০১৫ সাল থেকে তারা রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের বিজ্ঞাপন প্রচার বন্ধ করে দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এই ঘোষণা দিতে আমাদের মিডিয়া কেন পিছিয়ে থাকবে?
সিগারেটের বিজ্ঞাপন যদি নিয়ন্ত্রণে আনা যায়, ধূমপানের বিজ্ঞাপনে তারকাদের অংশগ্রহণ যদি বন্ধ করা যায়, তবে রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের শুভেচ্ছাদূত হওয়া থেকে ক্রিকেট তারকারাও পিছপা হবেন আশা করি।
পাদটীকা
অনেক বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনায় শুনেছি, রূপচর্চাকেই নাকচ করে দেওয়া হয়। কারণ রূপচর্চা মানে গ্ল্যামার, শোবিজ, কসমেটিকস বাণিজ্য, বিউটি পার্লার-সেলুন; আর এসবকে পুঁজিবাদের পাল্লায় মাপা হয়।
সুন্দর থাকতে চাওয়া সব যুগে, সব বয়সে এবং সব অর্থনৈতিক দশাতেই না এড়িয়ে যাওয়ার মত নির্দোষ চাহিদা। এর জন্য সামর্থ অনুযায়ী পয়সা খরচ করলে সেটা যদি কোনো অর্থনীতি হয়ে ওঠে তবে তাতে দোষ নেই। দোষ হচ্ছে, কালোকে ময়লা বলা; অসুস্থতা হচ্ছে নিজেকে ফর্সা দেখানোর প্রাণান্ত চেষ্টা।
পরিচিত কাউকে কাউকে দেখেছি ক্ষতিকারক উপাদানে (কেমিকেল) ব্লিচ করে মুখের চামড়া গোলাপি করে ফেলেছেন। আসলে চামড়াই পাতলা হয়ে গেছে ব্লিচ করতে করতে। অথচ সময় পালটে গেছে শোবিজেও। সেখানে কৃষ্ণবর্ণের মডেলরা র্যাম্প মাতিয়ে দিচ্ছেন।
সামর্থ থাকলে সেরা পার্লারে গিয়ে গ্লানিহীন মনে দুই পয়সা বেশি দিয়ে স্পা করাতেই পারেন, তবে অবশ্যই তা প্রাকৃতিক হতে হবে।
বাংলাদেশি আর আমেরিকানের মধ্যে সম্পর্ক হলে এশিয়া ও আমেরিকা- দুই মহাদেশেই গাত্রবর্ণের দারুণ এক বিপ্লব ঘটে যাবে। কারণ মানুষের জিন গায়ের রঙের চিহ্ন ধরে রাখে। এটাই সায়েন্স! জন্ম যে গায়ের রঙে সেটাই অকৃত্রিম; একে খোলতাই করা যেতে পারে ভালো খাওয়া ও জীবনযাপনে। রঙ খোলতাই করা মানে ফর্সা হওয়া নয়, এর অর্থ ত্বকের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা; তাতে রঙ 'গোরি হো ইয়া কালি হো' আপনাকে দেখাবে উজ্জ্বল ও প্রাণবন্ত। এই উজ্জ্বলতা মানে আপনাকে তরুণ দেখাচ্ছে, আপনি তরুণ থাকবেন বহুদিন।
আর তাই কথা একটাই- ত্বকের যত্ন নিন।