Published : 01 Feb 2020, 05:41 PM
আমেরিকানরা বলে থাকে গর্ভবতী মেয়েদের নির্বাচনী প্রচারণায় যেতে নেই, প্রতিশ্রুতিময় ভাষণ শুনতে নেই! কারণ কী? গর্ভের সন্তান 'জন্মগতভাবে মিথ্যেবাদী' হতে পারে!
তারা এটাও বিশ্বাস করে যে মিথ্যা সবসময়ে ঘরে থাকতে চায় শুধুমাত্র রাজনীতিবিদরা নির্বাচনের আগে তাদের ঘর থেকে বের করে আনে! নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির সবচেয়ে বড় উপাদান নাকি শিল্পিত মিথ্যে! কবিতায় আছে-'রণে ও রমনে মিথ্যে কেন যে নীরব শক্তিমান'!
প্রতিশ্রুতির ঘোড়া খুব দ্রুত বেগে ছোটে। তাই নির্বাচনের সময় যে ভোটাররা এই ঘোড়াতে চড়েন তারা তাল মেলাতে না পেরে ঘোড়া থেকে পরে যান। সমস্যা হলো রাজনীতিবিদদের অনেকেই প্রতিশ্রুতির এই ধাবমান ঘোড়াকে ভুলে গেলেও আম পাবলিক এসবকে দীর্ঘশ্বাসের সাথে মনে রাখতে চায়। যেমন- শহরের নির্বাচিত এক মেয়রের কাছে গেছে কয়েকজন এলাকাবাসী। একজন বললো- রাস্তা ঠিক করে দেবার কথা ছিল কিন্তু সেটা শুরুই হয়নি। আরেকজন বললো- সুয়ারেজ লাইন ঠিক করে দেবার কথা ছিল। আরেকজন বললো- বাসা বাড়ির পানি ব্যবহারের উপযোগী নয়। আপনি বলেছিলেন ছয়মাসের মধ্যে আপনি উদ্যোগ নিয়ে এসবের সমাধান করে দেবেন।
মেয়র লোকজনের মনোভাব বুঝে উত্তর দিলেন- আপনারা আসলে আমার নির্বাচনী প্রচারণা ও প্রতিশ্রুতির বিজ্ঞাপন দেখেছিলেন! মনে রাখতে হবে আমাদের, সবসময়ে বাস্তবতার ভেতরে বসবাস করা উচিত। সাবেক জার্মান চ্যান্সেলর অটো ফন বিসমার্ক এর মতে- মানুষ কখনই এতো মিথ্যা বলেনা যতটা তারা বলে যুদ্ধ আর নির্বাচনের সময়।
আসলে বাস্তবতা ও বিজ্ঞাপনী বাস্তবতার ভেতর ফারাক অনেক। তবু নির্বাচন এলে আম পাবলিক প্রতিশ্রুতির বিজ্ঞাপন দেখে আনন্দে মাতে আর নির্বাচনের পর তাদের দীর্ঘশ্বাসের মাত্রা বাড়ে। কিন্তু প্রতিশ্রুতি কখনো থেমে থাকে না। যেমন-
এক. বাংলাদেশি নির্বাচনী বাস্তবতার একটা গল্প প্রথমে উল্লেখ করা যায়। সম্ভবত বিচারপতি সাত্তার সেবার রাষ্ট্রপতি পদে দাঁড়িয়েছিলেন। সেবারের (১৯৮১ সন) ঘটনা। জনপ্রিয় উপস্থাপক প্রয়াত ফজলে লোহানী তার 'যদি কিছু মনে না করেন' অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী ওই ভদ্রলোকের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী ওই ভদ্রলোকের নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি ছিল দুর্নীতি দূর করার। তিনি বলেছিলেন- দুর্নীতিবাজদের রয়েল বেঙ্গল টাইগারদের দিয়ে খাওয়ানো হবে। যদি দুর্নীতিবাজদের সংখ্যা খুব বেশি হয় এবং সুন্দরবনের সব রয়েল বেঙ্গল টাইগার এদের খেয়ে শেষ করতে না পারে, তাহলে আফ্রিকা থেকে সিংহ আমদানি করা হবে!
দুই. এন্ডি ক্যাফ্রে ছিলেন ২০১২ সালের নির্বাচনে ক্যালিফোর্নিয়ার (অ্যামেরিকার এক অঙ্গ রাজ্য) কংগ্রেসের পদপ্রার্থী। ভদ্রলোক ঘোষণা দেন নির্বাচিত হলে তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার ডিস্ট্রিক্ট হলের সামনে দাঁড়িয়ে মারিজুয়ানা সেবন করবেন। পুরো আমেরিকায় সম্ভব না হলেও ক্যালিফোর্নিয়ায় মারিজুয়ানা সেবন বৈধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। নির্বাচনে তিনি জিততে পারেন নি। হারার পর কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেছিল, অ্যামেরিকানরা গাঁজা বা মদ পান করা পছন্দ করলেও গাঁজাখোর বা মদখোর কোন নেতাকে তারা নির্বাচিত করতে চায় না।
তিন. মার্কিন ইতিহাসের সবচেয়ে 'উম্মাদতম' রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প। ভদ্রলোক নির্বাচনের আগে বলেছিলেন- মেক্সিকোর সীমান্তজুড়ে উনি দেয়াল তুলবেন আর মেক্সিকো থেকে আসা বিস্কুট এবং পানীয় খাওয়া বাদ দেবেন। ভদ্রলোক টাকিলা (বাংলাদেশে কেরু কোম্পানির মদের মতো মেক্সিকোর প্রধান পানীয় বা মদ হচ্ছে টাকিলা যা সারা বিশ্বে পরিচিত) খাওয়া বাদ দিয়েছেন কিনা তা এখনও জানা যায় নি।
চার. আফ্রিকার এক দেশের রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী জনসভায় গিয়ে বলতে লাগলেন জনগণ যা চাইবে তিনি তাই করবেন। একবার এক জনসভা শেষে হাজারও জনতা দাবি তুললো পাশের নদীটা সাঁতরে পার হতে পারলেই তারা তাকে ভোট দিয়ে রাষ্ট্রপতি বানাবেন। রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী নদীতে ঝাঁপ দিলেন। কিন্তু নদী পার হবার আগেই তার মৃত্যু হলো।
পাঁচ. সিনেটর জন এডওয়ার্ড ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জন কেরির রানিং মেইট অর্থাৎ তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। আইন পেশায় পারদর্শী হলেও ভদ্রলোক নির্বাচনে নেমে ডাক্তারি করতে চেয়েছিলেন। ঘোষণা দিয়েছিলেন আলঝেইমার, ডায়াবেটিস ও পারকিনসন্স রোগ নিরাময়ের। সুপারম্যানখ্যাত অভিনেতা ক্রিস্টোফার রিড-কে (যিনি অসুস্থ হয়ে হুইলচেয়ারে চলাচল করতেন) ইঙ্গিত করে বলেছিলেন, এই তিনরোগে ভোগা কাউকে আর হুইলচেয়ারে চলাচল করতে হবে না। আমেরকিার মানুষ এটাকে আলঝেইমার, ডায়াবেটিস ও পারকিনসন্স রোগীদের প্রতি তুমুল ব্যঙ্গ ও উপহাস হিসেবেই ধরে নেয়। ফলাফল দুই 'জন' (জন কেরি ও জন এডওয়ার্ড) এর শোচনীয় পরাজয়।
ছয়. ক্লেভল্যান্ডের মেয়র ডেনিস কুসিনিস (১৯৭৭-৭৯) ২০০৪ ও ২০০৮ সালে অ্যামেরিকার রাষ্ট্রপতির পদে মনোনয়ন চেয়ে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ভদ্রলোক বার বার জর্জ ডব্লিউ বুশকে গ্রেপ্তারের হুমকি দিতেন। গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যাবার পর জেলে কী কী ঘটবে- ডেনিস তা শিখে নেবার জন্য বুশকে আহ্বান জানিয়েছিলেন। ভদ্রলোক অবশ্য মনোনয়নই পান নি।
সাত. ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দে (ভদ্রলোক এর পিতামাতা বাংলাদেশ থেকে ত্রিপুরা গিয়েছিলেন ১৯৭১-এ) ক্ষমতায় আসার আগে সরকারি কর্মচারীদের সপ্তম পে কমিশন বাস্তবায়নের কথা বলেছিলেন । প্রথম মন্ত্রী সভার বৈঠকেই এটা পাশ হবার কথা ছিল। দুই বছর কেটে গেলেও সেটা বাস্তবায়ন হয়নি। উল্টো বিপ্লবের সরকার ঘোষণা দিয়েছিল পয়লা জুলাই ২০১৮ থেকে যারা সরকারি চাকরিতে যোগ দেবে তারা প্রভিডেন্ড ফান্ড এবং পেনশন পাবেন না। আর তাই 'সপ্তম' শব্দটা ত্রিপুরায় এক নিন্দাময় শব্দ বলে পরিচিতি পেয়েছে। কেউ সপ্তম শব্দটা উচ্চারণ করলেই সরকারি সমর্থকরা তার দিকে চোখ কুচকে তাকায়। ত্রিপুরায় এইডস (aids -acquired immune deficiency syndrome) রোগকে এখন সেইডস (saids-seven acquired immune deficiency syndrome) নামে ডাকা হচ্ছে!
গত কয়েক বছরে অবশ্য বিপ্লবের কিছু কথা ভাইরাল হয়েছে। যেমন- আমাজন নদী নাকি আফ্রিকায় অবস্থিত। বিখ্যাত পর্যটক হিউয়েন সাং নাকি সাংবাদিক ছিলেন আর চানক্য সেন নাকি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন! তিনি এখানে থেমে গেলেও ভাল করতেন। কিন্তু দুম করে একদিন বলে বসলেন- মহাভারতের যুগেও নাকি ইন্টারনেট আর প্লাস্টিক সার্জারী ছিল! প্লাস্টিক সার্জারীর কারণেই নাকি শিশুর মুখ কেটে সেখানে গণেশের মুখ বসানো গিয়েছিল। পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী বিপ্লবকে বলেছেন 'পাগল'। আর মমতাকে দুই ঘণ্টা করে মন্দিরে সময় কাটানোর উপদেশ দিয়েছেন বিপ্লব কুমার দে।
সারা পৃথিবীতে নির্বাচনের আগে ও পরে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির এমন পসরা দেখা যায়। গণতন্ত্রের জন্য সব নির্বাচনই নাকি গুরুত্বপূর্ণ। যদিও অখণ্ড রাশিয়ার প্রভাবশালী রাষ্ট্রনায়ক (সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন) জোসেফ স্ট্যালিনের বিখ্যাত উক্তি হচ্ছে- যারা ভোট দেয় তারা কখনো নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন করতে পারে না, কোন সিদ্ধান্ত তৈরি করতে সক্ষম হয় না। যারা ভোট নেয় এবং গণনা করে তারাই সবকিছু পরিবর্তন করে।
যাই হোক সবশেষে দুটো গল্প শুনে বিদায় নেই। বলে রাখা ভালো যে এই লেখা বা গল্পের সাথে ২০২০ সালের ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের সাথে কোন সম্পর্ক বা মিল নেই!
প্রথম গল্পটা বহুল প্রচলিত। আমেরিকার আটলান্টায় একবার এক বিমান দুর্ঘটনা ঘটলো। বিমানের তেইশ আরোহীর ভেতর পনের জনই মারা গেল। বিমান দুর্ঘটনা যেখানে ঘটেছিল সেখানে প্রচুর লোক জমা হলো। যে সাতজন বেঁচে ছিলেন তারা জনতার উদ্দেশ্যে বলতে লাগলেন- আমরা রাজনীতিবিদ। নির্বাচনী প্রচারণায় এসেছি। আমরা বেঁচে আছি, মরিনি। পুলিশ এসে দেখলো এলাকার জনগণ তেইশ জনকেই কবর দিয়ে ফেলেছে। পুলিশ একজন এলাকাবাসীর কাছে জানতে চাইলো-সাতজন তো বেঁচে ছিল, ওদের কেন কবর দিলেন? ওই লোক উত্তর দিলো- নির্বাচনের আগে যখন কেউ কোনও কথা বলে তখন বুঝে নিতে হবে যে সে সত্য বলছে না। তাই উনারা যখন বলছিলেন যে আমরা বেঁচে আছি উপস্থিত জনগন সেটা বিশ্বাস করেনি!
আর দ্বিতীয় গল্পটা ২০১৯ এর।
খুলনার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোট দিতে গেছেন ৯২ বছর বয়সের এক বৃদ্ধ। তিনি ভোট কেন্দ্রে যেয়ে ভোট দেবার আগ্রহ প্রকাশ করলেন। পোলিং এজেন্ট বলল- দাদু আপনিতো ভোট দিয়ে গেছেন কিছুক্ষণ আগে। সম্ভবত ভুলে গেছেন। বৃদ্ধ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। পোলিং এজেন্ট আবারও বললো দাদু শুধু আপনি না, দাদীমাও ভোট দিয়ে গেছেন। বৃদ্ধ হাউমাউ করে কান্না শুরু করলেন। তারপর কোনমতে কান্না থামিয়ে বললেন- ও তো দশ বছর আগেই মারা গেছে। দশ বছর পরে ফিরে সে সরাসরি ভোটকেন্দ্রে আসলো, আমার সাথে একবার দেখাও করলো না! আমাকে সাথে নিয়ে ভোটও দিলনা!
হায় ভোটাভুটি। হায় নির্বাচন! হায়রে প্রতিশ্রুতি!