Published : 31 Jan 2020, 07:03 PM
সিটি নির্বাচনের কারণে একদিন পিছিয়ে দোসরা ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হচ্ছে এবারের মাসব্যাপী একুশে গ্রন্থমেলা। এবারের মেলা নানা দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা বছরটি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ। তাই সঙ্গত কারণেই মেলাটি জাতির জনকের স্মৃতির উদ্দেশে উৎসর্গ করা হয়েছে। এবারের মেলায় প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, 'বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে উদযাপনের অংশ হিসেবে বাংলা একাডেমি অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০', অনুষ্ঠিত হবে।
বেশ! এখন আমার একটি পর্যবেক্ষণ ১৯৯৯ সালের পূর্বের 'একুশে' এবং তার পরের একুশের মাঝে তাৎপর্যগত পার্থক্যটা আমরা খতিয়ে দেখতে পারি। কেননা ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেওয়ার পর এই দিবসটি আর আমাদের একার নয়। এটি হয়ে গেছে সকল দেশের, সকল মানুষের, পৃথিবীর সকল ভাষার মত ও পথের। আমাদের মোক্ষম সুযোগ ছিল একইসঙ্গে বইমেলাকে একটি 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা বই দিবস' ঘোষণা করার। এ ক্ষেত্রে বইমেলার বর্তমান কাঠামো ও উদ্দেশ্য অক্ষুণ্ণ রেখেই শুধু 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা'কে উপজীব্য করে বইমেলার একটা অংশ বর্ধিত করার সুযোগ রয়েছে। সেক্ষেত্রে বিদেশি অংশগ্রহণ, বিদেশি বিনিয়োগ ও পর্যটক আকর্ষণের বিস্তর সুযোগও আমরা নিতে পারি। পর্যটন মন্ত্রণালয় তো বটে এমনকি জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ও নগর সংস্থাও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা আয়োজনের ভাগিদার হতে পারে না কি? আমরা সেদিকে হাঁটিনি। দেখতে দেখতে ১৯৯৯ সালের পরে আমরা দুই দশক পার করে দিলাম। কিন্তু ২০২০ সালে এসেও আমরা এই সুযোগটা কেন নেব না?
এবারের বইমেলার নীতিমালা এক অর্থে চমৎকার, যুগোপযোগী এবং আধুনিক। কিন্তু একটা জায়গায় খটকা লেগে গেল। যেখানে বলা হয়েছে, 'অমর একুশে গ্রন্থমেলার অংশগ্রহণকারী প্রকাশকগণ কেবল বাংলাদেশের লেখকদের মৌলিক/অনূদিত/সম্পাদিত/সংকলিত বই বিক্রি করতে পারবেন'।
এখন আমার একটা সাদামাটা প্রশ্ন, এই ঘোষণাটি জাতিসংঘের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত একুশের চেতনার সঙ্গে কি যায়? পশ্চিমবঙ্গের বা ত্রিপুরার কিংবা আসামের কোনও বাঙালি লেখকের বই যদি কোনও প্রকাশক প্রকাশ করেন আর বইমেলায় হাজির করেন তার কী হবে? অথবা বিদেশে নতুন প্রজন্মের অনেক বাঙালি, এদের অনেকে বাংলাদেশের নাগরিক নাও থাকতে পারে। এদের কেউ কেউ বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অন্যান্য ভাষায় লিখে থাকতে পারে। তাদের বেলায় কী হবে? ঢাকায় থেকে ইংরেজিতে লিখে একদিকে আন্তর্জাতিক হবার জন্যে ভিক্ষুকের মত আত্মমর্যাদা বিকিয়ে দেব। অন্যদিকে যেটা নিয়ে আমরা সহজেই আন্তর্জাতিক হতে পারি নিজস্ব ঐতিহ্য, মর্যাদা আর পরিচিতিকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে সেটা আমরা করছি না। নতুন প্রজন্মের বাংলাদেশে নাগরিক নয়, এমন কোনও বাঙালি বা আদিবাসীর বইয়ের কী হবে?
এদের বই যদি কোনও প্রকাশক প্রকাশ করে বইমেলায় বিক্রি করেন, তার বেলায় কী হবে?
প্রশ্ন আরো আছে, বিদেশি লেখক বা প্রকাশক বা বইকে এই মেলায় স্বাগত জানাতে বাধা কোথায়? এজন্য সুনির্দিষ্ট স্পষ্ট নীতিমালা করে প্রয়োজনীয় ফি সাপেক্ষে আমরা বরং আন্তর্জাতিক দুনিয়াকে স্বাগত জানাতে পারি।
অপরদিকে, বিগত কয়েক বছর ধরে আমরা জাতিগত ন্যাকামো করে যাচ্ছি। ওষুধশিল্পের কর্পোরেট এক কবির ঠিকাদারে বিদেশি অতিথিদের আমরা ঠিকই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মঞ্চে বসিয়ে দিচ্ছি। আর তাদেরকে শিখিয়ে দেওয়া, তাদেরকে মুখে দুই একটি বাংলাবাক্য শুনে খুব আহলাদিত হচ্ছি। কেন? আমার মাথায় ঢুকে না।
আরো একটি কথা প্রসঙ্গক্রমে পুনরাবৃত্তি করে বলতে চাই, বাংলা একাডেমির ঘাড়ে এই মেলা চাপিয়ে রাখা আর কতদিন? বাংলা একাডেমি পর্যায়ের দুনিয়ার কোন একাডেমিকেই এরকম একটি 'ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট' বা অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপনায় লাগানো হয়নি। ফরাসি একাডেমি থেকে শুরু করে সুইডিশ একাডেমি কিংবা বাড়ির পাশের দিল্লির সাহিত্য একাডেমির খোঁজ নিয়ে দেখুন। সংশ্লিষ্টরা এ ব্যাপারটি আর কবে ভাববেন?
সে যাই হোক, এবারের বইমেলার নীতিমালায় কিছু সুন্দর কথা খুঁজে পেলাম। এককথায় দুর্দান্ত। কথাগুলো হচ্ছে, "অনুবাদের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণকারী প্রকাশকগণ বাংলাদেশে অনূদিত/ প্রকাশিত বই বিক্রি করতে পারবেন, তবে মূল প্রকাশক/ লেখকের অনুমতিপত্র থাকতে হবে"।
ধারণা করা যায়, বইমেলায় শত কয়েক অনুবাদের বই প্রকাশ পাবে। আয়োজকরা কি হলফ করে বলতে পারবেন সর্বোচ্চ বিশটি বইয়ের অনুমতিপত্র আছে?
প্রসঙ্গ যেহেতু বইমেলা, তাই গ্রন্থ এবং গ্রন্থাগার নিয়ে কয়েকটি কথা বলতে চাই। সম্প্রতি অধ্যাপক শিশির ভট্টাচার্য্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমে, 'আইসল্যাণ্ডের পুস্তক-বন্যা ও বাংলাদেশের পুস্তক খরা' শিরানামে একটি লেখা ছেপেছেন। উত্তর আটলান্টিকের সেই আইসল্যান্ডের জনসংখ্যা তিন লাখ ২৮ হাজার। তারা প্রায় সকলেই লেখক এবং পাঠক। দেশটির রাজধানী রেইকেভিক জাতিসংঘে ঘোষিত সাহিত্যনগরী। আমাদের একুশেমেলাও জাতিসংঘের সাহিত্যনগরীর স্বীকৃতি পাবার ব্যাপারে বড় একটা যুক্তি হতে পারে। সে ব্যাপারে আমাদের নগরের মেয়র মহোদয়রা বা সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কি সজাগ আছেন? নাকি আমাদের মেয়রগণ মশা মারতে কামান দাগাতেই বীর হয়ে থাকবেন?
আইসল্যান্ডের প্রসঙ্গে ফিরে আসি। বলেছিলাম, দেশটির প্রায় সকলেই লেখক এবং পাঠক। অবাক হচ্ছেন? দেশটির রাষ্ট্রপতি গুডনি ইউহানেসন একজন ইতিহাসবিদ এবং তার পত্নী এলিজা রেইড একজন বহুভাষী লেখক। বছর দুই আগে স্টকহোম নগরগ্রন্থাগারে একটি সাহিত্যসংলাপে এলিজার সঙ্গে সাক্ষাতের এবং লেখালেখি বিষয়ে তাঁর প্রাণবন্ত বক্তৃতা শোনার সুযোগ হয়েছিল। তখনই কল্পনা করতে পেরেছিলাম বইয়ের দেশ, পাঠকের দেশ, লেখকের দেশ- আইসল্যান্ড কেমনতর ভূখণ্ড।
এবার আমাদের বইয়ের খরার দেশে গ্রন্থ ও গ্রন্থাগারের হালহকিকত একটু ঝালিয়ে নেওয়া যাক। আমাদের জনসংখ্যা ষোল কোটির উপরে। সেখানে ইউনিয়ন তো দূরের কথা প্রত্যেক থানা সদর বা পৌরসভা পর্যায়েই গ্রন্থাগার নাই। তাহলে একুশে বই মেলায় মাস ধরে হাজার পাঁচেক নতুন বই ছেপে হবেটা কী? কিনবে কে? পড়বে কে? প্রত্যেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও গ্রন্থাগার নাই। গ্রন্থাগার থাকলেও বই পড়ার পাঠক নাই। পাঠক কেন নাই? যে দেশে 'বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না' এই প্রবাদবাক্যকে ভুল প্রমাণিত করার অনেক উদাহরণ রয়েছে, সে দেশে মানুষ বই কেন পড়বে? এবার কয়েকটি মামুলি প্রশ্ন করব। একেবারে মামুলি প্রশ্ন।
জাতীয় সংসদ থেকেই শুরু হতে পারে প্রশ্নগুলো, তিনশ পঞ্চাশ জন সংসদ সদস্যের কয়জনে বই পড়েন, বই কিনেন? তারা কী কী বই পড়েন? এবারে যারা মেয়র নির্বাচনে খাড়া হয়েছেন এরা কে কে বই পড়েন? কী বই পড়েন? এরপর আসব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিষয়ে? উনারা কয়জনে বই পড়েন, কী বই কিনেন? তারপর পত্রিকার সম্পাদক এবং দূরদর্শনের নির্বাহীদের ব্যাপারে। বিদেশে বিভিন্ন দূতাবাসে কর্মকর্তা এবং খোদ রাষ্ট্রদূতদের ব্যাপারে একই প্রশ্ন রাখতে চাই।
বই বিষয়ে তেমন কারো দৌরাত্ম্যই যে সুখকর নয় তা তাদের আমলনামা আর কথাবার্তা থেকে সহজেই প্রতিমেয়। বইয়ের খরার দেশে তরতর করে সাফল্যের চূড়ায় উঠতে বই পড়ার খুব একটা দরকার পড়ে না। সে দেশে শুধু তরুণদের আর বাচ্চাদের দোষ দিয়ে যাব- 'নতুন প্রজন্ম বই বিমুখ'। কথায় কথায় এদেরকে দোষী বানানো খুব সহজ। বড়রা করবে উল্টোটা আর দোষ দেব ছোটদের। বাহ!
গ্রন্থাগার বিষয়ে আরো দুই একটি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরতে চাই। শুধু বাংলাদেশে নয়, গোটা দুনিয়ার বড় একটা অংশ ডিজিটাল দৌড়ে ব্যতিব্যস্ত। ডিজিটাল স্লোগানে আমরা যখন অনেক বুলি আওড়াচ্ছি সেক্ষেত্রে আমাদের বই এবং গ্রন্ধাগার ব্যবস্থাপনা কোন পর্যায়ে? ডিজিটাল ব্যবস্থাপনায় কি বিনামূল্যে আমাদের পাঠকের আয়ত্বে আনতে পেরেছি? আইসল্যান্ডের একজন পাঠক দেশটির একলাখ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ভেতরে যেকোনও গ্রন্থাগারের মাধ্যমে নিজের দেশের তো বটে, অন্যান্য দেশের বইও ধার নিতে পারেন। কী বুঝলাম?
ডিজিটাল জোয়ারে আমাদের ডাক বিভাগের প্রয়োজন ও ভূমিকা সীমিত হয়ে আসছে। তাই সময় থাকতে সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ডাকঘরগুলোকে এক একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ ডিজিটাল তথ্যকেন্দ্র, ডাক ও বইঘরে রূপান্তর করতে পারি। সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার এ বিষয়ে যদি আগ্রহী হন, আমরা কিন্তু দুনিয়াকে একটা উদাহরণ সৃষ্টি করে দেখিয়ে দিতে পারি। পারি নাকি?