Published : 30 Jan 2020, 03:37 PM
যে শিশুটি ১৯৫৪-এর এক শীতের সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জুনিয়র হাইস্কুলের বার্ষিক পরীক্ষায় অসাধারণ ফলাফল দেখিয়ে শিক্ষকদেরকে মুগ্ধতায় ডুবিয়ে দিয়েছিল এবং ওই মফস্বল শহরে ভুখা মিছিলের সামনে দাঁড়িয়ে সবাইকে চমকে দিয়েছিল সেই শিশুটিই সেলিম।
শৈশব থেকে সে হয়ে উঠেছিল অংকের যাদুকর। শিশু বয়স থেকেই মা ও মাতৃভূমি একটি বড় জায়গা করে নেয় শিশু সেলিমের মনে। লেখাপড়া ও খেলাধুলায় চৌকস শিশুটি বড় হয়ে ১৯৬৪ সনে ঢুকে পড়ে ফাদার টিম-এর স্নেহ ছায়ায়, নটরডেম কলেজে। সেখান থেকে ১৯৬৭-তে সে ভর্তি হয় রাজশাহী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে; মাঝখানে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি হয়েও শেষে তা ছেড়ে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগকে বেছে নেয় নিজের ভবিষ্যৎ হিসেবে। জ্যাভলিন, হ্যামার, ডিসকাস, হার্ডেল, সাঁতার; ফিল্ড ও ট্র্যাক- ইনডোর ও আউটডোরের একাধিক গেইমসে চ্যাম্পিয়ান ছিল সেলিম। ছাত্রলীগের নেতা হিসাবে যেমন ৬৯-এর আন্দোলনে সে অসাধারণ ভূমিকা রাখে, তেমনি মানবিক গুণে বন্ধুবাৎসল্যে রাজশাহীর মতিহারে সবার প্রাণের মণি হয়ে উঠে; প্রিয়ভাজন হয়ে উঠে নিজ কলেজের শিক্ষক এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর আসগর ও ড. জোহার কাছে। এই সেলিম নিজেকে উজাড় করে দেয় ৭০-এর নির্বাচনে এবং ওই সনের প্রলয়ঙ্করী জলোচ্ছ্বাসে মানুষের সেবায়।
৭১-এর শুরুতে এই সেলিমকে যেমন কখনও দেখা যায় ক্লাসে, কখনও লাইব্রেরিতে আর কখনও খেলার মাঠে। ৭১-এর ফেব্রুয়ারিতে যখন ক্লাসে তালা ঝুলছে সেই সব দিনে এক সাঁঝের দৃশ্যটি এমন-
শীতের শেষ, ফাগুনের গন্ধে মাতাল ধোঁয়াশাময় দিন, রাজশাহী অঞ্চলে অতিক্রান্ত শীতে সাংবাৎসরিক চিত্র এমনটা।
এমন এক দিনে মেঘে ঢাকা সূর্যটা হেলে গেছে পদ্মার চরে, সন্ধ্যে হতে অনেক দেরি, তবু মাঠ থেকে আলো সরে গেছে। কোথাও কাউকে দেখা যাচ্ছেনা, মিষ্টি বৈকালিক আলোছায়ায় পূর্ণ ঘাসের ডগা। হলের মাঠে কয়েকটি ছেলের জটলা, উত্তেজিত অবস্থায় নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে। শেষ মুহূর্তে বলের ড্রিবলিং করছে কেউ, আর কেউ গুটাচ্ছে ব্যাডমিন্টানের নেট- রাজশাহী শহরের এক প্রান্তে যে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ; সেখানে এমনটাই থাকে নিত্যদিনের দৃশ্য। সবুজ ট্র্যাকসুট পরে কখনও মাঠের একপ্রান্তে জ্যাভলিন ছুঁড়ে, আর কখনো ফুটবলের জার্সি গায়ে চড়িয়ে বারবার বলটা গোলে ঠেলে দেয় যে ছেলেটি তার নাম সেলিম। সংক্ষেপে স্যালি।
এই মাত্র সে খবর পেয়েছে চট্টগ্রাম আর ময়মনসিংহে বাঙালিদের উপর চোরাগুপ্তা হামলা হচ্ছে। ওই হামলাগুলো করছে বিহারীরা। ঢাকার মিরপুর, সৈয়দপুর ও খুলনার খালিশপুরে এর ছোঁয়া লেগেছে।
তখন কেমন এক শূন্যতা চেপে বসে দুর্দান্ত সাহসী ও অসাধারণ ভালোমানুষ স্যালির অন্তরে।
সে যখন নানা সংকটের কথা ভাবতে ভাবতে নিজ হলে ফিরছে, তখন এক ঝাঁক বেলে হাঁস আকাশ কালো করে উড়ে যাচ্ছে, হাঁসগুলো যেন বিষণ্ণ সুরে কেঁদে কেঁদে ঘরে ফিরে যাচ্ছে। শীতের শেষ, বসন্তের শুরু। প্রতি বছর পদ্মার চরে নেমে আসা পরযায়ী হাঁসগুলোকে সাথি করে নিয়ে ওরা উড়ে যায় উত্তরে। দৃশ্যটা সাংবাৎসরিক হলেও কেন যেন তা ওই মুহূর্তে এক অশনিসংকেত বলে মনে হল স্যালির কাছে।
তার হলের অনেকেই তখন খবরটা জেনে গেছে। সেখানেই দেখা হল বন্ধু জিলুর সাথে। "কতক্ষণ যে তোকে খুঁজছি, আর তুই এখানে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের খবর জানিস?" কথা পাড়তে না পাড়তেই স্যালি বলে উঠল, "রাতের মধ্যে লিফলেট লিখে ছড়িয়ে দে।" তিথি (ছদ্ম নাম) ধারেকাছেই ছিল। সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজী বিভাগের ছাত্রী। ছাত্রদের অনেকেই তার সহপাঠী। সে স্যালির কথাটা ধরে নিয়ে বললো, "অবশ্যই আমাদের লিখতে হবে, মানুষকে জানাতে হবে, ছড়াতে হবে আগুন। হটিয়ে দিতে হবে পাকিস্তানি সেনাদের।" হলের একটা ছেলে বলে উঠল, "আগামীকালকার পত্রিকাতেই এসব খবর থাকবে। অনেক সান্ধ্যপত্রিকায় হয়ত এসব খবর এসে গেছে, দেশের কোথাও না কোথাও।" অমিয় নামে স্যালির এক বন্ধু বলল, "ঝড় আসে, গোর্কি আসে, '৭০-এর মতন বানে ভাসে মানুষ। শকুনের খোরাক আর পত্রিকার সচিত্র সংবাদ হয়ে থাকে তারা। আমরা কিছু করতে পারিনা।" স্যালি বলল, "অনেক কিছুই পারিনা, আবার অনেক কিছুই পারি। দেখিসনি '৬৯-এ কীভাবে আইয়ুবকে হটালাম। ঐখানটাতে জোহা স্যার দাঁড়িয়েছিলেন। আমার মাত্র তিন গজ সামনে। কীভাবে সাহসী মানুষটা পাকিস্তানি সেনাদের সামনে বুক পেতে দিল, শিষ্যদের বাঁচাতে।"
পিনপতন নি:স্তব্ধতা। যেন সবাই ৬৯-এর সেই দিনে ফিরে গেছে। চোখের সামনে যেন জোহা স্যারের রক্তাক্ত দেহ পড়ে আছে। নিথর শরীর; সাদা কাপড়ে ঢাকা, মুখে অমলিন হাসি।
চাপা গলায় অনেকটা স্বগোক্তির মত স্যালি বলল, 'পত্রিকার পাতায় খবর থাকে, করণীয় ও দিকনির্দেশনা থাকেনা। নির্দেশনাটাই আমাদের জানাতে হবে।'
'৬৯-এর আন্দোলন ও '৭০-এর নির্বাচনের একনিষ্ঠ সংগঠক সেলিম ট্রেনে চড়ে ছুটে গেল ঢাকায়। সোজা ইকবাল হলে বন্ধুদের সাথে দেখা করে ফিরল তেজগাঁর বাসায়।
এরপর এল ৭ই মার্চ- বঙ্গবন্ধুর সেই আগুন ঝরানো ভাষণ। সেই ভাষণ শুনে সবাই উদীপ্ত, আর সেলিম যেন জ্বলন্ত অঙ্গারের মত জ্বলছে। তখন সে ঢাকাতে, যারা প্রাক্তন ইউওটিসির সদস্য তাদেরকে নিয়ে সে কমিটি তৈরি করছে। তরুণদের রাইফেল ট্রেনিং দিচ্ছে। সেলিম ও তার ছোট ভাই আনিস দুজনই ছিল অসাধারণ শুটার। সেই শৈশব থেকে তারা দুভাই লক্ষ্যভেদে যেন অর্জুন। নানা ক্রীড়া এবং জিমন্যাস্টিকসের বার এবং রোপেও তারা ছিল সেরা। ছাত্র-শিক্ষক ও মা-বাবা সবারই প্রিয় তারা। ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের প্রধান নাজিম সাহেব যিনি কিনা প্রিয়ভাষিণীর মামা ছিলেন তিনিতো একেবারে সেলিমের ভক্ত হয়ে উঠেছিলেন। যাহোক, সেলিম তার রাজশাহীর প্রিয়জনদেরকে ছেড়ে মার্চের শুরুতে ঢাকায় ছুটে এল। সে দিন সারাদেশে বাংলাদেশের পতাকা উড়ছে। এমনকি পিলখানাতেও। সেলিমের আনন্দ ধরে না। সে ছুটে গেল প্রথমে পিলখানা ও নিউমার্কেটে। সেখান থেকে ইকবাল হলে। রাজারবাগ, মালিবাগ, শান্তিনগরসহ ঢাকা শহরের নানা পরিচিত স্থানগুলোতে সে ছুটে বেড়ায় প্রতিরোধকেন্দ্রগুলো দেখবার জন্য। এরপর ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় আবার ছুটে গেল ইকবাল হলে। ইতোমধ্যে পিতার কর্তব্যস্থান সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরের ইকুয়িপমেন্ট সেন্টারে তৈরি হয়েছে এক ডজন বর্শা, সেই সাথে পাহারারত এক প্লাটুন পুলিশের কানে দেওয়া হয়েছে প্রতিরোধের মন্ত্র। যাইহোক, মায়ের উৎকণ্ঠা শেষ করে আগুনের তৈরি সেলিম ২৫ মার্চ রাত ৯টায় ঘরে ফিরে এল।
রাত সাড়ে ১১ টায় সমগ্র ঢাকা শহর যখন পাকিস্তানিদের আক্রমণে স্তম্ভিত, বিমূঢ় এবং ক্ষেত্র বিশেষে ভীতসন্ত্রস্ত তখন আগুনের তৈরি দুটি ভাই সেলিম ও আনিস এক প্লাটুন পুলিশ নিয়ে পাকিস্তানিদের রুখতে দাঁড়িয়ে গেল- পাকিস্তান সার্ভে অফিস, তেজগাঁ পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউট, সাতারাস্তার মোড় এবং সেন্ট্রাল মেডিকেল স্টোরের সামনে। সে এক অবর্ণনীয় ইতিহাস।
৩১ মার্চ এই সেলিম ও আনিস (ডা. এম এ হাসান) যোগ দেয় দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাথে। ২ এপ্রিল ৭১-এ সরাইল এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিরোধ যুদ্ধে শরীক হয় তারা ক্যাপ্টেন মতিনের সাথে। ১৪ এপ্রিল '৭১-এ লালপুরে পাকিস্তানির সাথে সম্মুখ সমরে প্লাটুন কমান্ডার হিসাবে অংশ গ্রহণ করে সেলিম ও আনিস। এরপর শাহাবাজপুর, শমশেরনগর, নাসিরনগর, তেলিয়াপাড়া, হরষপুর, বেলোনিয়া, পরশুরাম, মুকন্দপুরসহ অসংখ্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বীর মুক্তিযোদ্ধা সেলিম।
এই সেলিম তেলিয়াপাড়ার প্রতিরোধ যুদ্ধে যে অসাধারণ ভূমিকা রাখে তা ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণ অক্ষরে লেখার মতন। ৭১-এ এপ্রিলের শেষে ছোট ভাই লে. আনিস (ডা. এম এ হাসান) আর সুবেদার ইসমাইলকে নিয়ে যখন পাকিস্তানি পোস্টে হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে সেই সময় তারা আক্রান্ত হল আজাদ কাশ্মির রেজিমেন্টের পাকিস্তানি সেনা দ্বারা। ওই যুদ্ধে সুবেদার ইসমাইল নিহত হলে পাকিস্তানিরা যখন চারপাশ থেকে একের পর এক বাঙ্কার উড়িয়ে দিচ্ছে সেই সময় ক্যাপ্টেন মতিন ও সেলিম ছুটতে ছুটতে প্রতিআক্রমণে পরাস্ত করে আগ্রাসী সেনাদের। দখল করে নেয় ওদের ৩ টনের একটি ট্রাক। এরপর কোন কিছু পরোয়া না করে মাইনফিল্ডের উপর চালিয়ে ঐ ট্রাক নিয়ে ফিরে আসে নিজেদের সীমানায়। আর একদিন পাকিস্তানি গোলায় তেলিয়াপাড়া 'টি' গার্ডেনে বট গাছের নীচে পাঁচ পাঁচটি মুক্তিযোদ্ধা যখন শহীদ হয় আর লে. ফজলে হোসেন যখন আহত হয় সে তখন প্রতিআক্রমণে একেবারে ঢুকে পড়ে পাকিস্তানি বাঙ্কারে। হাতাহাতি যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে বিজয়স্মারক হিসাবে মৃত পাকিস্তানির পদকটি ছিনিয়ে নেয় সে (ওটি জমা রয়েছে মুক্তিযুুদ্ধ যাদুঘরে)।
হরষপুরে আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাবন্দিকরণে তার ভূমিকা ছিল অতি উজ্জ্বল।
নভেম্বরে বেলোনিয়ার যুদ্ধে যোগ দেবার পথে তার জীপটি উল্টে গেলেও তার অগ্রযাত্রা রুখতে পারেনি কেউ।
মাতৃভক্তিতে উদ্ভাসিত সেলিম পরশুরাম ও বেলোনিয়া যুদ্ধে বিজয়ের বীজ বুনে মাকে স্মরণ করে ডায়েরীর পাতায় চিঠি লিখে তা ছড়িয়ে দেয় আকাশে; সে লিখেছিল-
মা, পহেলা নভেম্বর নোয়াখালীতে যাবার হুকুম হলো। ফেনীর বেলোনিয়া ও পরশুরাম মুক্ত করার জন্য। ৬ই রাতে চুপচুপ করে শত্রু এলাকার অনন্তপুরে ঢুকলাম। পরদিন সকালে ওরা দেখল ওদেরকে আমরা ঘিরে ফেলেছি। ৮ই রাত্রে ঐ স্থান সম্পূর্ণ মুক্ত হলো। শত্রুরা ভয়ে তাদের আরো কিছু ঘাঁটি ফেলে পালিয়ে গেল।
পরদিন চিতোলিয়া আমরা বিনাযুদ্ধে সম্পূর্ণ মুক্ত করলাম। আস্তে আস্তে আরো এগিয়ে গেলাম। ২৭ শে যখন আমরা ঐ এলাকা থেকে ফিরে এলাম তখন আমরা ফেনী মহাকুমা শহর থেকে দেড় মাইল দুরে ছিলাম। শীঘ্রই মাগো! আবার তোমার সাথে দেখা করতে পারব, ভেবে মনটা আনন্দে ভরে গেল। জান মা এই যুদ্ধে আমরা ৬০জন শত্রু ধরেছি। আমার কোম্পানীর ৩জন শহীদ হয়েছে, আর একজনের পা মাইনে উড়ে গেছে। দোয়া করো মা- সেলিম
চিঠির শেষে গোটা গোটা অক্ষরে তার নাম ও পদবী (লেফটেন্যান্ট সেলিম মোঃ কামরুল হাসান, বাংলাদেশ) লিখে একটি অনুরোধের কথা সে জানায়- "এটি বাংলাদেশের সরকারের কাছে পৌছে দিও।"
৪ ডিসেম্বর আখাউড়া যুদ্ধে লে. বদি শহীদ হলে লে. সেলিম দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্রাভো কোম্পানির দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং আখাউড়া যুদ্ধ জয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। অত:পর শত্রু সেনাদের ঘাঁটির পর ঘাঁটি চুরমার করে ঢাকার নিকট ডেমরায় আসে সেলিম। ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১-এর পড়ন্ত বেলায় যে বীর বাঙলার মাটিতে প্রবেশ করে ১৭ই ডিসেম্বর লক্ষ লক্ষ জনতার মুখোমুখী হয়, যাকে এতটুকু ছোঁয়ার জন্য ব্যাকুল হল হাজার হাজার মানুষ, ভালোবাসার গোলাপে ছেয়ে দিতে উন্মুখ হল শত স্নিগ্ধ হাত, সেই মানুষটি সবাইকে অবাক করে দিয়ে উধাও হল স্বাধীন দেশে, স্বাধীনতার ৪৬ দিন পর মেঘের ওপারে।
বঙ্গবন্ধু হুকুম করেছিলেন অবরুদ্ধ মিরপুরে অবাঙালি এবং লুকিয়ে থাকা পাকিস্তানিদের কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধার করার জন্য। ক্যাপ্টেন হেলাল মোর্শেদ, লে. সেলিম, ডিএসপি লোদীসহ ৩০০ জন পুলিশ এবং ১৪০ জন সৈনিক মিরপুরে প্রবেশ করে ঐ ৩০ জানুয়ারি ১৯৭২-এ। মেজর জেনারেল মঈনুল 'দৈনিক ভোরের কাগজে' দেয়া তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'তিনি লে. সেলিমকে মিরপুর নামিয়ে দিয়ে এসেছিলেন ওই দিন।' ৩০ জানুয়ারি সকাল ১১টায় ঘটনাস্থলে সেলিম পৌছানো মাত্রই গোলাগুলি শুরু হল। ওই সময় ১২ নম্বর পানির ট্যাঙ্কের পেছন থেকে প্রথম গুলি ছোড়া হল। রাস্তার অপর পাশে কাঁঠাল গাছের ফাঁক দিয়ে একটা গুলি আসে এবং সেটা সেলিমের ডান বুকে লাগে। সেলিম প্রথমটায় লুটিয়ে পড়লে তাকে একটি ঘরে নিয়ে যায় হেলাল মোর্শেদ। কিছুক্ষণের পর জ্ঞান ফিরে এলে উঠে দাঁড়ায় সেলিম- কিংবদন্তির বীরদের মত, নিজের শার্ট দিয়ে বেঁধে ফেলে তার বুক। ঐশ্বরিক শক্তি যেন ভর করে তার দেহে। সৈন্যদের সে জানায়, "আমি বেঁচে থাকতে তোমাদের ছেড়ে যাচ্ছি না।" ঠাঁ ঠাঁ গুলিতে লাল হয়ে উঠে তার স্টেনগান। মুক্ত হল মিরপুর।
মিরপুর মুক্তিদাতা লে. সেলিম এ ভাবেই শেষ করল নিজের জীবন। বিকেলের দিকে জীবিত সেনাদেরকে নিয়ে কালাপানির ঢালের কাছে সে দাঁড়ায়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ফ্যাকাশে ও ক্লান্তসেলিম।
তবু সে সবাইকে উৎসাহ যুগিয়েছে বিল পার হয়ে ক্যান্টনমেন্টের দিকে যেতে। নিজে পানিতে নামেনি; বুকের ক্ষত পানিতে ডুবে যাবে এই কারণে। ক্লান্ত শরীরটা একটি গাছের আড়ালে রেখে একটা একটা করে গুলি চালাচ্ছিল ঘাতকের দিকে। কাভার ফায়ার দিয়ে সহযোদ্ধাদের সরে যেতে সাহায্য করছিল সে। হয়ত ভাবছিল সাহায্য আসবে। সেদিন রাতে চাঁদ ছিল মেঘে ঢাকা। ঝির ঝির করে বৃষ্টি ঝরছিল। হয়ত সেলিম সহযোদ্ধাদের কথাই ভাবছিল। না, কেউ তাকে উদ্ধার করতে যায়নি। এক সময় আকাশের ফ্যাকাশে চাঁদের দিকে তাকিয়ে বীরনক্ষত্র সেলিম চিরবিদায় নিয়েছে পৃথিবী থেকে। তখন ওর স্বপ্নে হয়ত অজস্র অশ্বারোহী। আগুনের মানুষ সেলিম ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে নক্ষত্র থেকে নক্ষত্রে ছুটে বেড়ায়। তার জ্বলন্ত উত্তরীয় আকাশে উড়ে।
সেলিমের মৃত্যুর পর আশ্বাস, প্রতিশ্র"তি, স্তুতি ও অনেক কিছু ছিল। কিন্তু এর কিছুই যেমন শহীদ সেনাদের ছুঁতে পারেনি, তেমনি তা তাদের পরিবারের ধরাছোঁয়ায় আসেনি। সেলিমের মৃত্যুর পর কয়েক টুকরা হাড় ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল তার পরিবারকে। চেনা যায় না, বোঝা যায় না এমন হাড়ের স্তুপ দেখতে চায়নি লে. আনিস (ডা. এম এ হাসান)। ক্যান্টনমেন্টের দাফনকৃত ঐ হাড়ের নমুনার সাথে বাবার দাঁত ও মায়ের রক্ত ও চুলের উঘঅ-এর মিল পায়নি ফরেনসিক অ্যানথ্রোপলজি নিয়ে কাজ করা ডা. এম এ হাসান। ভারতের সেন্ট্রাল ফরেনসিক ল্যাবের প্রধান ড. ভি আই কেশ্যপ আরো ৬টি দেহাবশেষ নিয়ে ঐ কাজটি সম্পূর্ণ করেছিলেন। এই কাজে পরামর্শক ছিলেন ইউনিভার্সিটি অব গ্লাসগো-র অধ্যাপক পিটার ভ্যানেজেস। সেলিমের মত ৪১ সেনা সদস্য ও পুলিশ বাহিনীর অফিসারসহ অনেকের দেহাবশেষ ১৯৯৯ পর্যন্ত ইতিহাসের অন্তরালে ছিল। সেনাবাহিনীর ৪৭ ব্রিগেডের খনন কাজের পর লেখকের নেতৃত্বাধীন পরীক্ষা নিরীক্ষা ও ইতিহাস উন্মোচন ভালভাবে নেয়নি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাওয়া সেলিমের সহযোদ্ধাগণ। তারা ওই সময় অর্থাৎ ১৯৯৯-এ নানা কল্প কথায় ভুলিয়ে দিতে চেয়েছে বীরের ত্যাগের ইতিহাস। এতে স্বভাবত শহীদ ও মৃত সৈনিকদের কেউ বিতর্কের ঝড় তোলেনি।
শত শত শহীদ পরিবারের মাঝে অন্তর্ভূক্ত হয়ে পর্দার অন্তরালে পরে থাকে স্যালির বৃদ্ধ বাবা আর মা। প্রতি রাতের কান্নায় ঝাপসা হয় মায়ের দৃষ্টি, আর অন্তহীন প্রতীক্ষায় কৃষ্ণ পাথর হয়ে উঠে তার হৃদয়। আর যাকে উদ্দেশ্য করে স্যালি লিখেছিল- "এই হাত শক্ত করে ধরতে জানে"; সে হারিয়ে গেল চির অন্তরালে।