Published : 22 Jan 2020, 12:00 PM
রোহিঙ্গা ইস্যুতে যখন পশ্চিমা বিশ্ব মিয়ানমারের প্রতি মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিল, তখন প্রতিবেশি দেশটিতে বড় বিনিয়োগের ঝাঁপি নিয়ে হাজির হয়েছে চীন। ১৮ জানুয়ারি নেপিডোতে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচির সঙ্গে রাখাইনে গভীর সমুদ্রবন্দর ও অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠাসহ কয়েক শ কোটি ডলারের ৩৩টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই করেছেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। যেগুলো চীনের 'বেল্ট অ্যান্ড ওয়ান রোড' প্রকল্প সম্পর্কিত।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রবল চাপে থাকা মিয়ানমারের সঙ্গে এসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সইয়ের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরো জোরদার করেছে চীন। প্রস্তাবিত 'চীন-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডরের' মাধ্যমে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সঙ্গে চীন সংযুক্ত হচ্ছে। এর ফলে মালাক্কা প্রণালী দিয়ে সাগরপথে চীনের বাণিজ্য রুটের বাইরেও মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পৌঁছার পথ পাচ্ছে চীন। এটি তার জ্বালানি পরিবহন ও বাণিজ্যকে অনেক সাশ্রয়ী ও সুসংহত করবে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের কিয়াউকফিউয়ে চীনের গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণের ফলে সিতুয়ে ভারত নির্মিত বন্দরের গুরুত্ব কমে যাবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
চীনের এই নতুন বিনিয়োগ-চুক্তি কাদায় আটকে পড়া মিয়ানমারের জন্য 'সঞ্জীবনী সুধা' হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করা হচ্ছে। আর এর ফলে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গার মিয়ানমারে প্রত্যর্পণ ফের অনিশ্চয়তার ফাঁদে আটকে গেল! ইতিমধ্যেই রাখাইনে গণহত্যার অভিযোগ এনে মায়ানমারকে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (ICJ) দাঁড় করিয়েছে গাম্বিয়া। রোহিঙ্গা নিধন ও নির্যাতনের জেরে আন্তর্জাতিক দিক থেকে প্রচুর চাপে রয়েছে মিয়ানমার। আগামী ২৩ জানুয়ারি সেই মামলার রায় হওয়ার কথা। ঠিক সেই সময়ে চীনের প্রেসিডেন্টের এই সফরকে মিয়ানমারের জন্য 'রক্ষাকবচ' হিসেবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। গত বছরের শেষ দিকে আন্তর্জাতিক আদালতে গাম্বিয়া মামলা করার পর মায়ানমার চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও জোরদার করতে থাকে। রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের তাড়ানোর সময়ও চীনের ভূমিকা ছিল কার্যত মিয়ানমারের পক্ষেই। জিনপিংয়ের এই সফরের মধ্যে দিয়ে মিয়ানমারকেই চীন আরও কাছে টেনে নিল।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে গত বছরের ২২ অগাস্ট রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরুর দিন নির্ধারিত ছিল। কিন্তু রোহিঙ্গাদের আপত্তির কারণে প্রত্যাবাসন শুরু করা যায়নি। তারা মিয়ানমারের নাগরিকত্বসহ পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরে স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসনে অস্বীকৃতি জানান। এ সময় কক্সবাজারে মাঠ পর্যায়ে চীন ও মিয়ানমার দূতাবাসের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। তারা সার্বিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন। ২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর একই কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ভণ্ডুল হয়ে যায়।
একথা ঠিক যে, মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের গভীর সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। এর নেপথ্যে নানা স্বার্থ। মিয়ানমারের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক বলবর্ধকের আসনে প্রতিবেশী চীন। রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে মিয়ানমারের ওপর দ্বি-পক্ষীয়, আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি করেও ফল আসছে না। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদেও মিয়ানমারকে প্রোটেকশন দিচ্ছে চীন। এসব কারণে রোহিঙ্গা ইস্যুর সমাধানে চীনের সহযোগিতা লাভের জন্য বাংলাদেশ অনেক চেষ্টা করেছে। দ্রুত রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান না হলে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী তৎপরতা বেড়ে যেতে পারে। এতে বাংলাদেশে চীনের বিশাল ব্যবসা ও বিনিয়োগ ঝুঁকিতে পড়তে পারে-চীনকে এমন বার্তা দিয়ে আসছে বাংলাদেশ। কিন্তু, তাতে চীনের মন গলানো যায়নি। গত বছর জুলাই মাসে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফলে গেলে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে ভূমিকা পালনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন বাস্তবে খুব একটা দেখা যায়নি।
বাংলাদেশেও চীনের স্বার্থ কম নয়। বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ ৩ হাজার ৮০০ কোটি ডলারেরও বেশি। ২০১৬ সালে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ঢাকা সফর করার পর ২ হাজার কোটি ডলারের ঋণচুক্তি হয়েছে। বাংলাদেশকে আগে কখনোই একসঙ্গে এতো অর্থসহায়তা দেয়নি অন্য কোনো দেশ। কৌশলগতভাবে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান, ভারতের সঙ্গে তার ভৌগোলিক ও রাজনৈতিক নৈকট্য, সস্তা শ্রমের প্রাপ্যতা এবং বঙ্গোপসাগরের কাছাকাছি অবস্থান—এসব কিছুই চীনের আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি ও ভূ-অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু এসব স্বার্থকে ছাপিয়ে উঠেছে মিয়ানমারকে ঘিরে চীনের স্বার্থ। চীনা অর্থনীতি অনেকাংশে ভারত মহাসাগর দিয়ে আনা জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল। চীন মধ্যপ্রাচ্য থেকে যে পরিমাণ জ্বালানি আমদানি করে থাকে, তার ৮০ শতাংশই আসে মালাক্কা প্রণালী দিয়ে; এই সরু অংশটি ভারত মহাসাগরের সঙ্গে প্রশান্ত মহাসাগরের সংযোগ স্থাপন করেছে। এই মালাক্কা প্রণালী দিয়েই ইউরোপ, আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে চীন দ্রুততম সময়ের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারে। চীনের জ্বালানি চাহিদা ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে। ফলে তার কাছে এ অঞ্চলটির গুরুত্ব ক্রমেই বাড়ছে। এই অঞ্চলে প্রভাব বাড়ানোর পাশাপাশি এর ওপর অতি নির্ভরশীলতা কমাতে চীন ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী দেশগুলোকে বিনিয়োগ প্রস্তাব দিচ্ছে।
তা ছাড়া এ অঞ্চলে 'ভারতীয় আধিপত্যবাদের' বিপরীতে ভিন্ন কোনো পরাশক্তিকে স্বাগত জানানোর পরিবেশ আগে থেকেই তৈরি ছিল। চীন এই সুযোগটিই গ্রহণ করেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায়।
ভারতের আঞ্চলিক প্রভাব কমাতে তার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে চীন অস্ত্র বিক্রি করে নীরবে তাকে আটকে দিচ্ছে। চীন এখন বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অস্ত্র সরবরাহকারী, ২০১১-১৫ কালপর্বে দেশটি ৭১ শতাংশ অস্ত্র বিক্রি করেছে পাকিস্তান, মিয়ানমার ও বাংলাদেশে। এ সময়ে বাংলাদেশ ৮০ শতাংশ অস্ত্রই বেইজিংয়ের কাছ থেকে কিনেছে। কারও কাছে ভারী অস্ত্র বিক্রি করা মানে প্রশিক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতে রপ্তানিকারক দেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়া। এতে আমদানিকারক দেশটির ওপর যথেষ্ট প্রভাব পড়ে। চীন সহজ অর্থায়ন ও কম দামে ভারতের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে অস্ত্র বিক্রি করে ভারতকে নজরে রাখছে।
চীন এখন এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে 'ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড' প্রকল্পের মতো বড় কাজ হাতে নিচ্ছে। এখন পর্যন্ত এই ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্পই শি জিনপিংয়ের সবচেয়ে উচ্চাভিলাষী ও অর্থনৈতিক নীতি। নিজের দ্বিতীয় জমানাকে শক্তিশালীকরণ, ধীরলয়ের চীনা অর্থনীতিকে চাঙা করা এবং প্রতিবেশী দেশের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর জন্য তিনি ইতিমধ্যে জোরেশোরে এ প্রকল্পের প্রচারণা শুরু করেছেন। ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্প চীনকে এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে মুক্তবাণিজ্যের নতুন নেতা হতে সাহায্য করবে। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে টিপিপি থেকে সরিয়ে আনতেও এটি সহায়ক হবে। এ ছাড়া এটি ভূ-অর্থনৈতিকভাবে চীনকে তার অত্যধিক সামর্থ্য কাজে লাগাতেও সহায়তা করবে।
যদিও কাগজেকলমে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয় দেশের সঙ্গেই চীন ঘনিষ্ঠতা বজায় রেখে চলেছে। কিন্তু বাস্তব পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে যে, চীন রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের ওপর যে ধরনের চাপ সৃষ্টি করার কথা, নিজেদের কৌশলগত স্বার্থের কারণে তা করছে না। এতে বাংলাদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশের ঠিক আগেই চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিন পিং নেপিডোতে সরেজমিন উপস্থিত হয়ে মিয়ানমারকে নির্ভয়ের বার্তা দিচ্ছেন। এ মুহূর্তে চীন মিয়ানমারের সর্বোত্তম ত্রাতা বা রক্ষাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
আমাদের দুর্ভাগ্য যে, ঐতিহাসিকভাবে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক তেমন একটা মধুর কখনই ছিল না। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় অর্জন একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বিরোধিতাকারী চীন। তারা অর্থ-অস্ত্র দিয়ে পাকিস্তানকে সাহায্য করেছে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক তাই স্বাভাবিকভাবেই ইতিবাচক ছিল না। ৯০-এর দশকের পরে অর্থনৈতিক কারণে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা কিছুটা বাড়লেও তা নির্ভরযোগ্য হয়ে ওঠেনি। পরবর্তীকালে কারিগরি, অর্থ ও ঋণসাহায্যসহ বিভিন্ন ধরনের সহযোগিতার পসরা সাজিয়ে চীন বাংলাদেশের মিত্র হওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরাসরি মিয়ানমারের পক্ষ গ্রহণ করার কারণে আবারও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নড়বড়ে হয়ে গেছে।
মানবতাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো চীন সব সময়ই নিজস্ব স্বার্থ ও সুবিধা দ্বারা পরিচালিত হয়েছে। তারা সব সময়ই ভৌগলিক ও বাণিজ্যিক প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখতে মরিয়া প্রচেষ্টা চালিয়ে গেছে। মানবতার প্রতি দায়বদ্ধতা ও বিশ্ববিবেকের প্রতি শ্রদ্ধাবোধের ন্যূনতম নিদর্শন তুলে ধরতে তারা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। নির্মম নির্যাতনের শিকার রোহিঙ্গাদের কাছে মিয়ানমার যেমন এক 'কান্না'র নাম, ঠিক তেমনি চীন বাংলাদেশের জন্য এক হতাশা ও দীর্ঘশ্বাসের নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে!