Published : 08 Jan 2020, 10:51 PM
ইংরেজি নতুন বছরকে বরণ করার রেশ কাটতে না কাটতেই শীর্ষ ইরানি সেনা কমান্ডার কাসেম সোলেমানি মার্কিন ড্রোন হামলায় নিহত হল। আর অকস্মাৎ এ ঘটনায় আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যকার দ্বন্দ্ব অনেক কিছুকে ছাপিয়ে একেবারে সামনে চলে আসে। ইরাকের রাজধানী বাগদাদের কাছে ইরানি কুদস বাহিনীর প্রধান ও দেশটির ক্ষমতাধর এ সেনা কর্মকর্তা সম্মুখ সমরে নিহত হবার খবরটি ওয়াকিফহাল মহলের কাছে তীব্র ঝাঁকুনি হয়ে আসে। ইলেক্ট্রনিক, প্রিন্ট ও সোস্যাল মিডিয়া ফলাও করে প্রচার করতে থাকে, যার মধ্যে বিবিসি, সিএনএন, আলজাজিরা এবং ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন লাইভ টেলিকাস্ট করতে থাকে। কাসেম সোলেমানিকে হত্যার নেপথ্য কারণ, হত্যাকাণ্ডের হুকুমদাতা হিসেবে ট্রাম্পের স্বেচ্ছায় সামনে চলে আসা, ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনইয়ামিন নেতানিয়াহু'র সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফেরা, প্রভাবশালী বিশ্বনেতাদের প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি বিষয় টক অব দ্য ওয়ার্ল্ডে পরিণত হয়।
সোলেমানি হত্যাকাণ্ড যে ইরান-মার্কিন সম্পর্ককে যুদ্ধাবস্থায় নিয়ে যাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। এবং ইতিমধ্যে তার অনেক কিছু স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। ইরান ইতিমধ্যে বহুপাক্ষিক পারমাণবিক চুক্তি থেকে বেরিয়ে যাবার ঘোষণা দিয়েছে। ইরাক তার দেশ থেকে মার্কিন সৈন্য সরিয়ে নেয়ার জন্য চাপ দিয়েছে। অন্যদিকে ইরান-ইরাকের ইরবিল ও আল-আসাদে মার্কিন সামরিক স্থাপনায় আঘাত হেনেছে। বলা যায়- যুদ্ধ, পাল্টাপাল্টি হুমকি এবং কূটনৈতিক তৎপরতা যুগপৎভাবে চলছে।
কিন্তু এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে কেন এতো তোলপাড়, কেনই বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে হত্যা করে খোলাখুলিভাবে সফলতা দাবি করছে, এ নিয়ে বিবদমান দেশ দুটির বিরোধ এবার কোন পর্যায়ে গিয়ে দাঁড়াবে, একটি যুদ্ধ কি তবে আসন্ন, বিষয়টি নিয়ে পরাশক্তি চীন-রাশিয়া-ফ্রান্স-ইংল্যান্ড এবং জার্মানির ভূমিকা কী হবে ইত্যাদি সম্পর্কে কোনও দিক থেকেই সুষ্পষ্ট ধারণা পাওয়া না গেলেও উদ্ভূত পরিস্থিতি যে পূর্বের যেকোনো সময়ের চেয়ে জটিল এবং এর ফলাফল যে ভয়াবহ কিছু হবে সেটা আন্দাজ করতে কারুরই অসুবিধা হচ্ছে না। দেশ দুটির মধ্যে বিদ্যমান দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপট, সাম্প্রতিক উত্তেজনার নিয়ামক কারণসমূহ এবং সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ফলে দুইপক্ষের পরিবর্তিত মনস্তত্ব, আর এর সম্ভাব্য পরিণতি নিয়ে কয়েকটি বিষয়ে আলোকপাত করাই নিবন্ধটির উদ্দেশ্য-
এক. কাসেম সোলেমানিকে হত্যার সিদ্ধান্ত কেন নেওয়া হলো এবং সেটার সম্ভাব্য পরিণতি জেনেও ট্রাম্প কেন হত্যার হুকুম দিল সেটা- ব্যাপক কৌতূহলে'র বিষয় বৈকি! এ বিষয়ে একটি নাতিদীর্ঘ ধারণা পেতে ধর্মীয় অন্তর্দ্বন্দ্ব, ভৌগলিক বিরোধ ইত্যাদিকে কাজে লাগিয়ে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের চলে আসা ইতিহাসের রক্তাক্ত ক্যানভাসটির দিকে লক্ষ্য করতে হবে। শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে যে বিভাজন সেটাকে কাজে লাগিয়ে ইরাক-ইরান, ইরান-ইসরায়েল ও ইরান-সৌদি আরবের মধ্যে বিরোধ জিইয়ে রাখতে এ মার্কিন শক্তিই একনিষ্ঠভাবে কাজ করে চলেছে। এক্ষেত্রে তাদের দিক থেকে উদ্দেশ্যও খুব পরিষ্কার। মার্কিন বিদেশনীতির অন্যতম কৌশল হল ডিভাইড অ্যান্ড রুল নীতির মাধ্যমে বিবাদ উসকে দিয়ে অস্ত্র ব্যবসা, যুদ্ধাবস্থা তৈরি করে টার্গেটেড দেশটির জাতীয় অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করা এবং নিজেকে বিশ্ব মোড়লের ভূমিকায় আসীন রাখা। আর সেদিক থেকে রিপাবলিকানদের বিদেশ নীতি বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য নীতি ডেমোক্র্যাটদের থেকে অনেকটাই ভিন্ন। যেখানে ডেমোক্র্যাটরা মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিগুলোকে আলাপ-আলোচনা, সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া এবং বহুপাক্ষিক চুক্তি ইত্যাদির মাধ্যমে মার্কিন আধিপত্য জারি রাখতে সচেষ্ট, সেখানে রিপাবলিকানরা সহিংস পথে তার আধিপত্য জারি রাখার পক্ষে। এ অঞ্চলে রিপাবলিকানরা চায়-আধিপত্যবাদী শাসন কায়েম রাখতে দেশে দেশে বশংবদ শাসকদের বসিয়ে রাখা, বিবদমান দেশসূহের নিকট মার্কিন অস্ত্র বিক্রি এবং সস্তায় তেল আমদানীর সুযোগ নিশ্চিত করা।
যাহোক, মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন আধিপত্যের অন্যতম বিরোধী শক্তি ইরান, যা মার্কিনিদের জন্য স্থায়ী চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আর ইরানের পক্ষে সেই শক্তির শীর্ষবিন্দু হিসেবে কাজ করেছে কমান্ডার কাসেম সোলেমানি। যার ইস্পাত কঠিন নেতৃত্বে ইরানি প্রতিরোধ জারি রাখা, একের পর এক আক্রমনে মার্কিন ও তার মিত্রদের ঘুম হারাম করে দেয়ার কাজটি সুচারুরূপে করে এসেছিল তিনি কাসেম সোলেমানি-ই। ফলে এটা খুবই স্বাভাবিক যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাঁর থেকে নিষ্কৃতি পেতে দীর্ঘদিন ধরে অপেক্ষা করছে। ফলে, যে কোনো মূল্যে তারা ইরানি বীর সোলেমানির রক্তে হাত রাঙা করতে উদগ্রীব ছিল। সন্দেহ নেই, এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পয়েন্ট অব ভিউ থেকে একটি তাৎপর্যপূর্ণ সফলতা। হত্যাকাণ্ডে হোয়াইট হাউসের সরাসরি দায় স্বীকার, ভিন্ন একটি সার্বভৌম দেশের সীমানায় ঢুকে এবং সংশ্লিষ্ট দেশটির অনুমতি ব্যাতিরেকে হত্যাকাণ্ড পরিচালনা কতোটুকু ন্যায়ানুগ হয়েছে- এ নিয়ে প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যানসি পেলোওসি যতই সমালোচনা করুক না কেন- সোলেমানিকে হত্যার বিষয়টি দিনশেষে মার্কিনীরা একটি মহার্ঘ্য অগ্রগতি বলেই বিবেচনা করবে।
দুই. এমন একজন চৌকস যোদ্ধা কাসেম সোলেমানি যাকে ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনী ''জীবিত শহীদ'' হিসেবে অভিহিত করতেন, যিনি ছিলেন দেশটি সর্বোচ্চ জনপ্রিয় একজন সামরিক ব্যক্তিত্ব এবং বিগত একযুগেরও অধিক সময় ধরে বিপ্লবী কমান্ডবাহিনী কুদস-এর শীর্ষ কর্মকর্তা। তাকে হারিয়ে ইরানের ক্ষতি যে অপরিমেয় সেটা বলাই বাহুল্য। তাকে হারিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের উপর ইরানের আধিপত্য বিস্তারের দীর্ঘ প্রচেষ্টা যার পর নাই ধাক্কা খেল। কাসেম সোলেমানি শুধু ইরানেই জনপ্রিয় ছিলেন সেটি নয়, সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে শিয়া মিলিশিয়া- যারা ইরাক, সিরিয়া, লেবাননসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দুধর্ষ যোদ্ধারা ইসরায়েল-সৌদি-মার্কিন সিন্ডিকেটকে চ্যালেঞ্জ করে আসছিল, সেখানে তিনিই ছিলেন সর্বোচ্চ অথরিটির নাম। লেবাননের হিজবুল্লাহ, ইরাকের বিপ্লবী বাহিনী, সিরিয়ায় আইএস-এর আক্রমণ রুখে দেওয়া ইত্যাদিতে সোলেমানি হাতে-কলমে সহায়তা করেছেন, দিয়েছেন প্রশিক্ষণ, অস্ত্র ও গোলা-বারুদ। ফলে তার চলে যাওয়া শুধু একজন সৈনিকের চলে যাওয়া নয়, বরং মার্কিন বিরোধী শক্তির পক্ষে অন্যতম একজন সমরনায়কের প্রস্থানও বটে।
তিন. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের যে নিরবিচ্ছিন্ন বিরোধ তা এ হত্যাকাণ্ডের ফলে নতুন মাত্রায় উন্নীত হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। রাজনৈতিক ও সামরিক বিশ্লেষকরা বলছেন- এর ফলাফল হবে বহুমূখী ও সুদূরপ্রসারী। যার সম্ভাব্য কিছু প্রভাব হতে পারে –
ক. মধ্যপ্রাচ্যে অন্যতম শক্তি হয়ে ওঠা ইরানের পক্ষে সোলেমানি হত্যাকাণ্ড একটি বড়সড় পরাজয়ের নাম। সামরিক বিশ্লেষকদের অনেকের মতে, সোলেমানির হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ ইরান যে নেবে, তা মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। তারা এও আন্দাজ করছেন, ইরানের দিক থেকে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুু হতে পারে ইরাকে অবস্থানরত মার্কিন দূতাবাস, দেশটিতে মোতায়েন সামরিক বাহিনীর সদস্য এবং সিভিল মার্কিনীরা। ইতিমধ্যে আমরা সেটি দেখেছি। এছাড়া দোহায় স্থাপিত মার্কিন সামরিক ঘাঁটি এবং সাধারণ মার্কিনীরা। এর বাইরে ইসরাইল, সৌদি আবর ইত্যাদিও আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হতে পারে। ফলে খুব স্বাভাবিক কারণে উক্ত সকল এলাকায় সংশ্লিষ্ট দেশের নাগরিক ও স্পর্ষকাতর স্থাপনায় জরুরী অবস্থা বিরাজ করবে, সাধারণের মধ্যে আতংক বিরাজ করবে যার অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব নেতিবাচক হতে বাধ্য।
খ. ইরানের পারমাণবিক কার্যক্রম সীমিতকরণ বিষয়ক বহুপাক্ষিক চুক্তি থেকে গত ২০১৮ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বের হয়ে যাওয়া এবং এর ফলে চুক্তির অপরাপর পক্ষগুলোর নিকট থেকে যে ক্ষতিপূরণ আশা করেছিল তা পায়নি। ফলে ইরানও চুক্তি থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়ে পারমাণবিক কার্যক্রম খুব জোরেসোরে যে শুরু করবেই সেটাও অনুমেয়। ফলে বিশ্ব পারমানবিক অস্ত্রের আরও মারাত্মক হুমকির মধ্যে পতিত হবে।
গ. গত সেপ্টেম্বরে সৌদি আবরের সরকারি তেল শোধনাগার আরামকো-তে আক্রমণ হলে সৌদি-মার্কিন পক্ষ ইরানকেই দায়ী করে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, খুব নীচু রেঞ্জে লক্ষ্যবস্তুতে ক্ষেপনাস্ত্র আক্রমনে সক্ষমতা ইরানকে আবারও আগ্রাসী করবে। ফলে সৌদী আরব ও ইরানের সম্পর্ক আরও বিরোধর্পূণ হয়ে উঠবে।
ঘ. উক্ত সকল আশংকা সত্য হলে শিয়া-সুন্নি বিরোধ আরও বৃদ্ধি পাবে ফলে একদিকে মুসলিম ঐক্য যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে তেমনি অন্যদিকে বিরোধীশক্তি ইসরাইল উদ্ভূত যে কোনো পরিস্থিতির সুযোগে নিপীড়িত-বঞ্চিত প্যালেস্টাইনিদের উপর আরও চড়াও হবে।
৪. ইরানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা যতই বাড়ুক, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার খাতিরে মধ্যপ্রাচ্যে তারা আরও শক্তি প্রয়োগ করবে। কারণ লেবানন, ইরাক, সিরিয়া এবং আরও কিছু ছোট ছোট অঞ্চলে ইরানের মিত্রদের শক্ত উপস্থিতি রয়েছে। আর সেগুলোকে কাজে লাগিয়ে ইরান আরও আগ্রাসী হবে বলে মনে করা অসংগত নয়।
৫. কাসেম সোলেমানি হত্যা কেবল ইরানের বিরোধিতা বা শক্তি খর্ব করার মিশন হিসেবে অনেকেই দেখছে না। তারা মনে করছেন এটি নির্বাচনী বৈতরণী পার হবার ক্ষেত্রে ট্রাম্পের একটি কৌশল। তাদের ভাষ্য, ক্ষয়িষ্ণু জনপ্রিয়তা আর ইম্পিচমেন্টের ধকল কাটাতে আর তার দিকে ভোটারদের দৃষ্টি ফেরাতে মার্কিনীদের সার্বিক নিরাপত্তার ইস্যুটিকে কাসেম সোলেমানি হত্যার সাথে জুড়ে দিয়েছেন। আর এটি যে অনেকাংশে সত্য তারও প্রমাণ ইতিমধ্যে পাওয়া যাচ্ছে। বাবাক ওবামার দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচনের সময় ওবামা নাকি মার্কিনীদের নিরাপত্তার ইস্যুটিকে সামনে এনে ভোটারদের মন জয় করতে চাচ্ছেন বলে সে সময়ে ট্রাম্পের দিক থেকে উত্থাপিত অভিযোগ সোস্যাল মিডিয়ায় ফলাও হয়েছে। যাতে দুইয়ে-দুইয়ে চার মিলিয়ে অনেকেই মনে করছে সেই কপটতা আর মিথ্যাচার থেকে সুবিধা নিতে ট্রাম্প আগামী দিনগুলোতে যে আরও যুদ্ধংদেহী হবে এ আশংকা উড়িয়ে দেয়া যায় না।
প্রশ্ন হচ্ছে- ক্ষমতার লোভ, ভোগবাদিতা, আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক বিরোধে জিঁইয়ে রেখে মার্কিন আধিপত্যবাদ জারি রাখতে ঘৃণ্য এ মানসিকতাকে থামাবে? বিশ্ব কি তবে দেখেই যাবে মার্কিন অপশক্তির এ অসভ্য নৃত্য?