Published : 08 Jan 2020, 04:39 PM
দাবানলে পুড়ছে অস্ট্রেলিয়া। তবে জানা দরকার এটি মহাদেশ সমান একটি দেশ। যে কারণে বলা হয় Biggest country in the smallest continent. এই দেশে এক রাজ্যের সাথে আরেক রাজ্যের সময়ের ব্যবধানও অনেক। তিন চার ঘন্টা ব্যবধান যেমন ফিজির সাথে তেমনি পার্থের সাথে সিডনির। এই দেশে আগুন লেগেছে মানে এক রাজ্য বা দুই রাজ্যে লেগেছে। এবার অবশ্য কম-বেশি তিন রাজ্যের বন পুড়ে ছাই। সবচেয়ে বেশি জানমালের ক্ষতি হয়েছে নিউসাউথ ওয়েলস অঙ্গরাজ্যে। যার রাজধানী সিডনি। বিগত দুই দশক ধরে এই রাজ্যে বসবাস করি আমি। সেই যে অভিবাসন নিয়ে এসেছিলাম মূলত সিডনিতেই বসবাস আমাদের। আমি যেমন দেখিনি তেমনি এখানকার প্রাচীন অধিবাসীরাও দেখেননি এমন অগ্নিকাণ্ড। মাঝে মাঝে কাজের খাতিরে আমাকে যেতে হতো পুড়ে যাওয়া অঞলে। তখনকার বুশ ফায়ার দগ্ধ এলাকা আর এবারের এলাকায় আকাশ-পাতাল তফাৎ।
ক'দিন আগেও সিডনি দুনিয়ার সবচেয়ে বসবাসযোগ্য শহরগুলোর ভেতর প্রথম হয়েছিল। এসব জরিপে সিডনি, মেলবোর্ন সবসময় প্রথম দুই, তিন বা পাঁচের ভেতর থাকে। সে শহরের আকাশ এখন কালো। এমন দিনও গেছে পুরো আকাশের রঙ হয়েছিল কমলা। যে হাওয়া বিশুদ্ধ বলে আমরা গর্ব করতাম যাতে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিলে ফুসফুস চাঙ্গা হতো আজ তার অবস্থা করুণ। ক'দিন আগে তাপমাত্রা যখন ৪৫, অফিস থেকে বের হয়ে দেখি এক পা-ও হাঁটা যাচ্ছে না। মুখে মাস্ক লাগিয়েও নিস্তার নাই। একটু গিয়ে যে বাস ধরবো তাও অসম্ভব। অগত্যা ছেলেকে ফোন করে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যেতে বলে সে যাত্রা বেঁচেছিলাম। আমরা দিন শুরু করছি মেঘের মতো কালো পুরু স্তরের ধোঁয়ার আকাশ দিয়ে। একেক দিন বাতাস এত গরম আর এত আগুনের হলকা থাকে যে মুখ পুড়ে যেতে চায়। গত শনিবারে সিডনির তাপমাত্রা ছিলো দুনিয়ায় সর্বোচ্চ। আরব দেশগুলোকে ছাপিয়ে তা পৌঁছেছিল ৫০-এ। মনে রাখতে হবে আরব বা গরমের দেশগুলোতে যেসব ব্যবস্থা থাকে বা নেয়া নিয়ম তা এখানে নেই। যেমন বাড়িতে সবার এসি নেই, অনেক গাড়ীতে এসি নেই। শপিং বা অন্য কোথাও রাত-দিন থাকতে পারে না কেউ। ফলে যে দুর্বিষহ অবস্থা তা সত্যিকার অর্থে দোজখ বা নরকতুল্য। সেদিন সন্ধ্যায় হাওয়া ও গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি না হলে কি হতো ভাবা মুশকিল!
এবারের বুশ ফায়ার বা আগুনে সবচাইতে ক্ষতি হয়েছে পশু ও বন্য প্রাণীর। যেসব ছবি এখন পর্যন্ত বিশ্ব মিডিয়া বা সামাজিক মিডিয়া তোলপাড় করে তুলেছে তা হলো প্রাণীকুলের ছবি। চোখের জল ধরে রাখা দায়। সবাই জানেন এদেশের ইউনিক প্রাণী বলতে বোঝায় ক্যাঙারু, কোয়েলাদের। এরা সমুদ্র ডিঙাতে জানে না বলে আর কোনো দেশে যেতে পারে না। অন্য দেশে চিড়িয়াখানা ছাড়া আর কোথাও পাবেন না এদের। সেই হেরিটেজ প্রাণীরা আজ অসহায়। নিরীহ কোয়েলারা ফায়ার ফাইটারদের পা জড়িয়ে ধরে আছে। তারা বুঝতে পারছে এই মানুষটি যদি উদ্ধার না করে তো মৃত্যু নিশ্চিত। ক্যাঙারু তৃণভোজী প্রাণী। তাদের না আছে খাবার, না বাঁচার কোনো আশ্রয়। মন আকুল করা চোখ সজল করা এক ছবিতে সামাজিক মিডিয়া সয়লাব। এই ছবিতে মা ক্যাঙারুর গলা জড়িয়ে আছে সন্তান। আহারে বাঁচার আকুতি। মানুষ ও মারা গেছে অনেক। ধনী নামে পরিচিত এই সমাজে এখন আবেদন জানানো হয়েছে সাহায্যের। যে যা পারছে সেভাবে পাশে দাঁড়াচ্ছে। কাপড় থেকে খাদ্য জমা নেয়ার সেন্টার খোলা হয়েছে নানা জায়গায়। সময়ের চাকা হয়তো এভাবেই ঘোরে। কোন দেশে বা সমাজে কখন কোন সাহায্যের দরকার পড়ে কেউ তা জানে না।
আমি বরাবর দেখেছি এসব দেশের মানুষ কতটা সাহায্যপ্রবণ। আমরা মুখে নিজেদের মায়ার দেশ বলি বটে ভাবতেও পারি না কতটা উদার এরা। শেষ কপর্দক পর্যন্ত দান করে কেউ কেউ। হবে না, হবে না করে ব্যবসার লোকসান আর ইমেজের কথা মাথায় রেখে শেষপর্যন্ত হয়ে গেল ৩১ ডিসেম্বরের সিডনি আলোকসজ্জা। নববর্ষের সে আলোকসজ্জা থেকে সাহায্যের জন্য এক রাতে পাওয়া গেছে ২ মিলিয়ন ডলার। মানুষ এখানে দেয়ার সময় কারো মুখের দিকে তাকায় না। আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি শেষ কপর্দকও দান করতে তৈরি এরা। ক্রিকেটার শেন ওয়ার্ন তার মাথার টুপি তুলেছেন নিলামে। এখনো সময় শেষ হয়নি। ইতোমধ্যে ত্রিশ হাজার ডলার দাম উঠেছে এই টুপির। সরকারপ্রধান আছেন তোপের মুখে। ঘটনার শুরুতে তিনি ছিলেন হাওয়াই। ছুটি কমিয়ে তাড়তাড়ি ফিরলেও সমালোচনা কমেনি। সেদিন গেছিলেন এক সফরে। উপদ্রুত এলাকার মেয়েটি তার সাথে করমর্দনেও রাজী ছিলো না। এটা আমাদের দেশ না যে মানুষকে জোর করে নিয়ে যাওয়া হবে। বা পুলিশ মিলিটারি ঘিরে রাখবে কাউকে। মেয়েটির হাতটি জোর করে নিয়ে করমর্দন করলেন মরিসন। এই দৃশ্য দেখিয়েছে সবগুলো মিডিয়া। এখন বিলিয়ন ডলারের প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার।
এতসব নেগেটিভ ঘোষণার ভেতর যে ক'টি পজেটিভ ঘটনা মানুষের মন ছুঁয়ে গেছে তার ভেতর আছে নিরীহ প্রাণীদের সাথে ফায়ার ফাইটারদের ছবি। কোথাও তারা প্রাণীদের জীবন বাঁচাচ্ছেন, কোথাও পানি খাওয়াচ্ছেন। কোথাও কোলে করে নিয়ে যাচ্ছেন নিরাপদ আশ্রয়ে। নারীর কোলে নিশ্চিত অগ্নিদগ্ধ কোয়েলা মানুষকে কাঁদিয়ে ছাড়ছে। সবকিছু ছাপিয়ে দৃষ্টি কেড়েছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী টনি অ্যাবট। টনি স্বেচ্ছাসেবক ফায়ার ফাইটার। লন্ডনের কুইনস কলেজে পড়াশোনা করেছেন। তারপর সিডনি ইউনিভার্সিটিতে পড়েছেন। দীর্ঘসময় ধরে সরকারি দল লিবারেল পার্টির নেতা টনি ছিলেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী। দলীয় কোন্দলে পদত্যাগ করেন ২০১৫ সালে। তিনিও আগুনের এলাকায় যেতে পারতেন হেলিকপ্টারে বা গাড়িতে। যেভাবেই যেতেন সংবাদ হতেন। কিন্তু টনি যে ফায়ার ফাইটার। তিনি লড়ছেন ফ্রন্ট ফন্টে। আগুনের কঠিন এলাকায় কাজ করা ফায়ার ফাইটারেদের পোশাক পরিহিত টনি এখন মানুষের মনে আশার প্রতীক। খবরে দেখলাম তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এমন এলাকায় কাজ করছেন যেখানে বিপদে পড়া জীবন হারানো মূহুর্তের ব্যাপার। তার এই ত্যাগ আর আন্তরিকতা যে পদকে থোড়াই কেয়ার করে সেটাই প্রমাণ করলেন তিনি। ভাবা যায়? আমাদের দেশগুলোর কেউ এমন করবেন?
শত বিপদেও মানবিকতা এভাবেই বড় করে তোলে মানুষকে। মনে করিয়ে দেয় আমরা মানুষরাই পারি কিছু করতে। এই আগুন সহজে নিভবে না। বলা হচ্ছে আরো দু'মাস থাকবে এর দাপট। জানি না ততদিনে কোনদিকে মোড় নেবে ঘটনা। মনেপ্রাণে সবাই আশা করছে, প্রার্থণা করছে তুমুল বৃষ্টি এসে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে সবকিছু। এটা এখন প্রমাণিত প্রকৃতি বা নিয়তির কাছে কতটা অসহায় মানুষ। কতটা অসহায় মানুষের সব প্রযুক্তিগত বিদ্যা। অস্ট্রেলিয়ার এই আগুন দেশের অর্থনীতি ও সমাজে যে দাগ রেখে যাচ্ছে তার নিরাময় সহজ কিছু না। এতদিন ধরে অস্বীকার করা পরিবেশ পরিবর্তনসহ অনেক ইস্যু এখন মানুষ বুঝতে শিখছে। কিন্তু এর যে মূল্য তার বেশিরভাগ চুকালো নিরীহ প্রাণীজগত আর কিছু অসহায় মানুষ। আশা করা আর ধৈর্য ধরা ছাড়া এখন আর বিকল্প নেই আমাদের।