Published : 06 Jan 2020, 02:28 PM
অস্ট্রেলিয়ায় চলছে প্রচণ্ড দাবানল। আর এই দাবানলে মারা যাচ্ছে মানুষ, পুড়ে ছাড়খার হয়ে যাচ্ছে বনভূমি, বসতসবাড়ি আর কোটিকোটি পশুপাখি, প্রাণী। অনেক পশুপাখি প্রায় বিলুপ্ত হওয়ার পথে আছে। কি এক অসহায় অবস্থা অস্ট্রেলিয়াজুড়ে। প্রতিদিন খবরের কাগজে, টেলিভিশনের পর্দায় আগুনের লেলিহান শিখা দেখতে দেখতে এক ভয়ানক অবস্থার মধ্যে পার করছে অস্ট্রেলিয়ার মানুষজন। সিডনির বাতাসে যেমন ধোয়ার আস্তরণ পড়েছে তেমনি অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী ক্যানবেরাতেও বায়ুদূষণের মাত্রা রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এ যেন এক অসহায় সময় পার করছে অস্ট্রেলিয়া। চোখে দেখলেও যেন কিছুই করার মত অবস্থায় নেই।
অস্ট্রেলিয়ায় দাবানল এই প্রথম আঘাত হেনেছে তা কিন্তু না, এর আগেও এমন হয়েছে। কিন্তু এবারের তীব্রতা যেকোনো সময়ের চেয়ে মারাত্মক। দাবানল বেশ কিছুদিন থেকে শুরু হলেও গত কয়েক সপ্তাহ থেকে প্রচণ্ড গরম, শুষ্কতা আর বাতাসের জন্য এই দাবানল আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। তবে এই আগুন লাগার প্রধান কারণ প্রাকৃতিক যেমন প্রচণ্ড গরম এবং শুষ্ক আবহাওয়া, তাপদাহ ইত্যাদি। কোনো কোনো জায়গায় তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রির বেশি দেখা যায়। তবে এই দাবানলের জন্য ব্যতিক্রম হিসেবে মাঝে মাঝে মানুষও দায়ী হয়। যেমন সিএনএন-এর তথ্য অনুযায়ী গতবছর নিউ সাউথ ওয়েলসে ১৯ বছর বয়সী একজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে আগুন লাগানোর সন্দেহে।
এই দাবানল সিডনী আর মেলবোর্নের মতো শহরকেও বিপদে ফেলে দিয়েছে। সিডনির বিখ্যাত নীল পাহাড়কেও ক্ষতিগ্রস্ত করেছে এই দাবানল। সিএনএন-এর তথ্যমতে এখন পর্যন্ত প্রায় ২৪ জন মানুষ মারা গেছে এই দাবানলে, ৬টি রাজ্যের প্রায় ৫.৯ মিলিয়ন হেক্টর জায়গা দাবানলে পুড়ে গেছে। শুধুমাত্র নিউ সাউথ ওয়েলস রাজ্যেই প্রায় ১৩০০ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এদেশের আগুন নেভানোর কাজে নিয়োজিত দক্ষ কর্মীদেরকে রাত-দিন বিপদের মুখে থেকেও কাজ করতে হচ্ছে। কখনো আগুনের সাথে যুদ্ধ করে জীবন দিতে হচ্ছে। আমেরিকা, কানাডা, নিউজিল্যান্ড থেকে ফায়ার ফাইটার্সরা অস্ট্রেলিয়াকে আগুন নেভাতে সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে।
দৈনিক পত্রিকা, সোশ্যাল মিডিয়া সব জায়গায় এখন শুধু মৃত প্রাণীদের ছবি। এই ছবিগুলো দেখলে যে কারোরই মন খারাপ হয়ে যাবে। প্রাণীগুলো মানুষ দেখলে যেন কাছে ছুটে আসছে বাঁচার জন্য– এরকম ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে শেয়ার করা হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ানরা এমনিতেই অনেক প্রাণী ভক্ত। কিছুদিন আগে এক মহিলা তার নিজের জামা খুলে এক কোয়ালাকে বাঁচাতে গিয়েছে। একজন মানুষ তার নিজের খাবার পানি কাঙ্গারুকে পান করাচ্ছে, আরেকজন কৃষক মৃত্যুযন্ত্রণায় ছটফট করা পশু প্রাণীদের যন্ত্রনা থেকে মুক্তি দিতে গুলি করে মেলে ফেলছে, আগুনে পুড়ে ক্যাঙ্গারুর দেহ সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই রকম হৃদয় বিদারক ছবি এখনকার প্রতিদিনের চিত্র।
অস্ট্রেলিয়ার আয়ের একটা বড় খাত হচ্ছে পর্যটন। মানুষজন যেমন অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন হৃদয় জুড়ানো হ্রদের পাড়ে ঘুরে বেড়াতে ভালোবাসে তেমনি বনভূমির কাছেও বেড়াতে যায় নিয়মিত। দাবানলে আক্রান্ত এসব এলাকা এখন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, বিদেশী পর্যটকদের নিরাপদে সরে যাওয়ার জন্য ইতিমধ্যে বলা হয়েছে। যেসব স্থানীয় অধিবাসীরা ছোট ব্যবসা করতেন তাদের এখন আর আয়ের কোনো উপায় থাকলো না। তাদের ঘুরে দাঁড়ানো হবে আরেকটা চ্যালেঞ্জ। সরকারের জন্যও আরেকটা কঠিন বিষয় হতে যাচ্ছে ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনের পুনর্বাসন করা। অস্ট্রেলিয়া ধনী দেশ, আর্থিকভাবে হয়তো কাটিয়ে উঠতে পারবে কিন্তু মানসিক ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা একটা কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়াবে।
অস্ট্রেলিয়া সরকারের প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছেন আগুন নিয়ন্ত্রণে নেয়ার মত পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে। তাছাড়া দাবানলের সময়ে হাওয়াইয়ে ছুটি কাটানোর জন্যও সমালোচনার শিকার হয়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজনকে দেখতে গিয়ে পড়েছেন প্রচণ্ড তোপের মুখে। সব হারানো স্থানীয় অধিবাসীরা তার সাথে হাত পর্যন্ত মেলাতে চাননি। অবস্থা খারাপ দেখে তিনিও বেশি সময় না থেকে সরে পড়েছেন। বিরোধীদলের নেতৃবৃন্দ সরকারের সমালোচনায় প্রতিনিয়ত মুখর হয়ে আছেন। এক কথায় বলা চলে সরকার বেশ বেকায়দায় পড়েছে। আর তা সামাল দিতে সরকার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। এমনকি সেনাবাহিনীর সহায়তা নিচ্ছে সরকার এই সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য। যাই হোক, অস্ট্রেলিয়ান সরকার ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। যারা আগুন নেভানোর কাজে নিয়োজিত রয়েছেন তাদেরকেও আর্থিক সহায়তা দেয়ার কথা ঘোষণা করেছে। তাছাড়া মানুষজন নিজে থেকে অর্থ সংগ্রহ করে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসছেন। মানুষ মানুষের জন্য সহমর্মিতার হাত বাড়াচ্ছেন।
এই দাবানলের কারণে আবার সবার সামনে চলে আসছে 'ক্লাইমেট চেঞ্জ' বা জলবায়ু পরিবর্তনের মতো ইস্যু। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী এমনিতেই জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়টাকে এককভাবে দাবানলের সাথে সম্পর্কিত হিসেবে তেমন গুরুত্ব দিতে চান না। আবার পরিবেশবাদীরা এই ইস্যুটাকে গুরুত্ব না দেয়ার জন্যই মূলত এরকম হচ্ছে বলে বলছেন। তবে সেটা যে জন্যই হোক, এইরকম ভয়াবহ ক্ষতির হাত থেকে বাঁচার জন্য সরকারের যেমন আরও প্রস্তুতি নেওয়া দরকার, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিৎ আরো বেশি করে সাহায্যের হাত বাড়ানো। একইভাবে মানুষজনকেও অনেক ধৈর্য্যের সাথে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে।
তবে এই দাবানল যে কবে কমবে সে বিষয়ে কেউ কিছু বলতে পারছে না। তাই ক্ষতির পরিমাণ হয়তো আরো বাড়তে পারে। প্রাকৃতিকভাবে বৃষ্টি হয়তো এর ভয়াবহতা থেকে কিছুটা হলেও বাঁচাতে পারে।