Published : 03 Jan 2020, 04:08 PM
২০০১ থেকে ২০০৬, এ সময়টির ভয়াবহতা বাংলাদেশের নতুন প্রজন্ম ঠিক ভালভাবে জানে না। অন্যদিকে, মানুষের স্বভাব অনুযায়ী আমরা অনেকেই ভুলে গেছি সেই দুঃসহ দিনগুলোর কথা। বিএনপি তখন তারেক রহমানের নির্দেশে মোটামুটি পরিপূর্ণ জামায়াতে ইসলামিতে রূপ নিয়েছে। অন্যদিকে, জামায়াতের দুই যুদ্ধাপরাধী তখন তাদের গাড়িতে মন্ত্রী হিসেবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়াচ্ছে। খালেদা জিয়া ২০০১ এর পয়লা অক্টোবরে নির্বাচনে জেতার পরপরই দুটি সিদ্ধান্ত স্থিরভাবে নেয়। এক, আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে অত্যাচারের মাধ্যমে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে আওয়ামী লীগের ভোট কমে যায়। দুই, নির্যাতন ও হত্যার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে নির্মূল করতে হবে। যার ধারাবাহিকতায় খুলনায় মনজুরুল ইমাম, নাটোরে মমতাজউদ্দীন, টঙ্গীতে আহসানউল্লাহ মাস্টার ছাড়াও শাহ এস এম কিবরিয়াসহ বড় বড় নেতাদের গুলি করে, গ্রেনেড ছুড়ে হত্যা করা হয়। আর সর্বোপরি শেখ হাসিনাসহ জাতীয় নেতাদের হত্যার জন্য ভয়াবহ একুশে অগাস্ট গ্রেনেড হামলা সকলেরই স্মরণে আছে। আর ভোলায় মায়ের সামনে দল বেঁধে কন্যাকে ধর্ষণ, রামশীলে স্বামীকে বেঁধে রেখে স্ত্রীকে ধর্ষণ, সর্বোপরি পাবনায় পূর্ণিমাকে গণধর্ষণ যা বিএনপি-জামাত জোটের চরিত্রের চিরকালের প্রকাশ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। বিএনপি সেই পাপে এখনও ভুগছে। তাদের এ পাপ ক্ষয় হবার নয়।
এই ভয়াবহ দিনে আওয়ামী লীগ কর্মীরা প্রতিবাদ থেকে দূরে সরে যায়নি। তারা প্রতি ক্ষেত্রেই তাদের সাধ্য অনুযায়ী প্রতিবাদ করে। রাজপথে নামে। ওই সময়ে আওয়ামী লীগের আন্দোলনে একটা নতুন মাত্রা দেখা দেয়, যুব মহিলা লীগ ও ছাত্রলীগের তরুণীদের সাহসী ভূমিকা। পুলিশের নির্যাতনের মুখে অবিচল থেকে রাজপথে আন্দোলন করতে থাকে তারা। ২০০৪ এর সম্ভবত এপ্রিল-মে মাসের দিকে এই মেয়েদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ যে নির্যাতন চালায় তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে জনকণ্ঠে একটি সাপ্তাহিক প্রচ্ছদ কাহিনী লিখি। এই লেখাটি তৈরি করতে গিয়ে পুলিশের হাতে নিগৃহিত যুব মহিলা লীগের অনেক কর্মীর সঙ্গে কথা বলি। তাদের ওপর পুলিশি নির্যাতন এমনই পাশবিক ছিল যার সবটুকু তাদের পক্ষে আমার কাছে বলা সম্ভব ছিল না। আমার পক্ষেও সরাসরি তাদের কাছে শোনাও সম্ভব ছিল না। তাই সে সময়ে আমার সহকর্মী দুজন মহিলা সাংবাদিককে বলি তাদের নির্যাতনের ওই বিষয়গুলো শুনে লিখিতভাবে যেন আমার কাছে দেয়। তারা লিখিতভাবে যে পৈশাচিক নির্যাতনের বর্ণনা দিয়েছিল তার খুব কম অংশই আমি আমার লেখায় ব্যবহার করতে পেরেছিলাম। বাস্তবে লেখায়ও সেগুলো প্রকাশ করা যায় না। ওই লেখাটা প্রকাশ হবার পরে দেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষ যেমন ফোন করতে থাকে তেমনি অনেকেই অফিসে এসে দেখা করে। এই সময়ে একদিন ফজিলাতুন নেসা বাপ্পী আমার অফিসে আসে। আমি অফিসের এডিটরিয়াল মিটিংয়ে ছিলাম। সে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে। মিটিং শেষে তার সাথে দেখা হতেই সে বলে, 'দাদা, আমি শুধু আপনাকে সালাম করার জন্য এসেছি'। আমি উত্তরে বলি, 'আসলে তোমরা আমাদের ছোটবোন হলেও সালাম তো পাবে তোমরা। কারণ ১৯৭১ এর নয় মাসের পরে এই প্রথম এ পবিত্র ভূমিতে সরাসরি জামায়াতে ইসলামের শাসন চলছে। আর জামায়াতের শাসনে হত্যা ও নারী নির্যাতন ঘটবেই। তোমরা সাহসী মেয়েরা যেভাবে আজ এই জামাতি শাসনের প্রতিবাদে রাজপথে এসেছ তার একভাগও তো আমরা কলমের মাধ্যমে মানুষের সামনে তুলে ধরতে পারছি না।' বাপ্পী কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে বলে, 'দাদা সবসময় ভয় করে আপার জন্য। এরা যেন আপার কোন ক্ষতি করতে না পারে।' বাপ্পী যখন এ কথা বলছিল তখন ওর চোখের কোণ দিয়ে কয়েক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। সে সেটা মুছতে মুছতে উঠে দাঁড়ায়। তারপরে আমাকে বলে, 'দাদা ছোটবোন হিসেবে অনুরোধ, সাবধানে থাকবেন। ওরা কিন্তু আপনাকেও ছাড়বে না।' আমি হাসতে হাসতে বলি, 'তোমাদের মত সাহসী হলে রাজনীতিই করতাম। তবে সাংবাদিকতায় যারা সিদ্ধান্ত নিয়ে আসে, তারা জানে যেকোন ধরনের মৃত্যু তাদের এ পেশার জন্য মেনে নিতে হবে।' আমার কথা নিঃশব্দে শুনে- 'আবারো দাদা সাবধানে থাকবেন' বলে জিন্স ও কেডস পরা বাপ্পী বেশ শক্ত পদক্ষেপে আমার রুম থেকে বেরিয়ে যায়। তার পদক্ষেপ দেখে সেদিন মনে হয়, এ মেয়ে ভাঙবে তবুও মচকাবে না।
বাপ্পী মচকায়নি, তাকে ভাঙতেও পারেনি। ১/১১ এর পরে যখন শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করা হয় ওই সময়ে শেখ হাসিনার মুক্তির জন্য যারা সবসময়ে রাজপথ থেকে আদালত পর্যন্ত সব ভয়কে তুচ্ছ করে লড়েছিল বাপ্পী তাদের একজন। এরপরে বাপ্পীর পার্টি ক্ষমতায় যায়। বাপ্পী পার্লামেন্ট মেম্বার হয়। সাধারণত নিয়মই হয়ে গেছে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা যখন বিরোধী দলে থাকেন, আন্দোলন করেন, তখন তারা সাংবাদিকদের অনেক খোঁজখবর নেন। ক্ষমতায় গেলে তারা আর এটা প্রয়োজন মনে করেন না। সাংবাদিকদেরকেও এটা স্বাভাবিকভাবেই মেনে নিতে হয়। এটাই তার পেশায় স্বাভাবিক, এর বেশি কিছু তাকে ভাবতে নেই। তবে এটা সত্য যাদের ভেতর প্রকৃত রাজনৈতিক নেতার গুণাবলী আছে, তারা শত ব্যস্ততার মাঝেও পরিচিতজন বা দুর্দিনে, সুদিনে যে সমস্ত সাংবাদিক সঠিক সাংবাদিকতা করেন- তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন, এমনকি কঠোর সমালোচনা করলেও তারা বলেন, ''এই সমালোচনাটা দরকার ছিল"। বাপ্পীর ভেতর এ গুণটা ছিল। তার দল ক্ষমতায় আসার পরে সে দু'বার এমপি হয়েছে। কিন্তু সে কখনো কাচের ঘরে ঢোকেনি। সে সবসময় সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতো। আজ তার এই মৃত্যুর পরে একটা ঘটনা মনে পড়ছে, যা প্রমাণ করে কতটা আলাদা এবং কতটা বিনয়ী ছিল বাপ্পী। সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায়ও প্রায়ই সে আমার লেখা পড়ে ফোন করতো এবং শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নিত। তাই অন্য রাজনীতিবিদ লেখকদের মত বাপ্পীও কিন্তু সহজেই আমাকে ফোন করে তার একটা লেখা ছাপার জন্য বলতে পারতো। তাছাড়া বাপ্পীর যে লেখার হাত ছিল তাতে ফোন না করলেও তার লেখা স্বাভাবিকভাবেই ছাপা হতো। কিন্তু হঠাৎ একদিন মতিয়া চৌধুরী আমাকে ফোন করে বললেন, 'আমাদের বাপ্পী আমার সামনে বসে আছে। ও একটা লেখা লিখেছে। লেখাটি আমি পড়ে দেখেছি। বেশ ভালো লেখা। ও লেখাটা ছাপার জন্য পাঠাতে চাচ্ছে।' আমি বলি, 'আপা বাপ্পী আপনার সামনে থাকলে একটু তাকে দেবেন।' তাকে ফোনটা দেয়ার পরে বলি, 'তুমি তো নিজেই আমাকে বলতে পারতে, মতিয়া আপাকে কষ্ট দিলে কেন?' বিনয়ী বাপ্পী বলে, আসলে লেখাটা ছাপা হলে তার ভাল লাগবে কিন্তু বলতে খুবই সংকোচ লাগছিল। বাপ্পীর এই কথায় বুঝতে পারি অনেকে যেমন যোগাযোগ রাখে বা খোঁজখবর নেয় তার পেছনে একটা উদ্দেশ্য রেখে, অর্থাৎ লেখা বা নিউজ ছাপার জন্য। বাপ্পী তাদের দলে নয়। সে সত্যি খোঁজখবর নেয়ার জন্য যোগাযোগ রাখতো। আর যেদিন লেখা ছাপার প্রয়োজন মনে করেছে সেদিন সে মতিয়া আপার কাছে গেছে।
আজ বাপ্পীর মৃত্যু সংবাদ জানার পর থেকেই এমনি অনেক কথাই মনে পড়ছে। তবে বেশি মনে পড়ছে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সিনহা যখন আমার বিরুদ্ধে কনটেম্পট অব কোর্ট মামলা শুরু করেন, সেই দিনগুলোর কথা। তখন অধিকাংশ আইনজীবী সিনহার ভয়ে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেন না। সে দিনগুলোর ইতিহাস বড় বিচিত্র যা খোলাখোলি লেখার এখনও সময় হয়নি। তবে ওই সময়ে যে ক'জন নানানভাবে আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বাপ্পী তাদের একজন। বাপ্পী ওই সময়ে খুবই দুঃখ করে বলত, 'দাদা আপনি একটি বড় ষড়যন্ত্র উম্মোচন করেছেন কিন্তু আমার দূর্ভাগ্য আমি এ নিয়ে পার্লামেন্টে কিছু বলতে পারছি না।' এরপরে সুরেন্দ্র কুমার সিনহার জুডিশিয়াল ক্যু'র বিষয়টা বেশ খানিকটা জনসম্মুখে উম্মোচন হয়ে পড়ে ( বেশ খানিকটা বললাম এ জন্য তার সবটুকু এখনো উম্মোচিত হয়নি। সিনহার সঙ্গে কোন কোন রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক এবং সুশীল সমাজের লোক জড়িত ছিলেন তা এখনো জনসম্মুখে উম্মোচিত হয়নি)। তখন প্রধানমন্ত্রীসহ সকলেই সিনহার বিরুদ্ধে মুখ খোলেন। এ সময় সিনহার দেয়া বিতর্কিত ষোড়শ সংশোধনীর রায়ের ওপর একটি নির্ধারিত দিনে পার্লামেন্টে আলোচনা হয়। সেদিন নির্ধারিত আলোচকদের একজন ছিলেন বাপ্পী। এই আলোচকদের অনেকেই বক্তব্য রাখার আগে সিনহার দুর্নীতি ও জুডিশিয়াল ক্যু করার পরিকল্পনা সংক্রান্ত কিছু তথ্য আমার কাছ থেকে মিলিয়ে নেন। এই সময়ে বাপ্পীকে ১/১১ এর বাপ্পীর মতই মনে হয়। ক্ষমতা তাকে কোনই পরিবর্তন করেনি। বরং সে শুধু শিউরে উঠতে থাকে তার প্রিয় আপার সরকারকে উৎখাত করার এই ষড়যন্ত্রের তথ্যগুলো একের পর এক পেয়ে। সেদিন সিনিয়র নেতারা পার্লামেন্টে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন সিনহার ষড়যন্ত্রের বিষয়ে। বাপ্পী তরুণ হলেও তার বক্তব্য ছিল অনবদ্য। বিভিন্ন সময়ে বাপ্পী যেমন একজন তুখোড় পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে বক্তব্য রাখতো। সেদিনও সে একজন বড় মাপের পার্লামেন্টারিয়ানের মতই বক্তব্য রেখেছিল।
তাই তার এই ৪৯ বছরেই চলে যাওয়া শুধু তার পরিবারের ক্ষতি নয়, আমাদের মত পরিচিতজনের ক্ষতি নয়, ক্ষতি হলো দেশের। কারণ দেশ শুধু রাজপথের আইন অঙ্গনের একজন সাহসী রাজনীতিবিদ ও আইনজীবীকে হারাল না, দেশ একজন ভালো পার্লামেন্টারিয়ানকে হারাল। একজন ভালো পার্লামেন্টারিয়ান হারানো দেশের বড় ক্ষতি। কারণ অনেকে বড় রাজনীতিবিদ হন কিন্তু বড় পার্লামেন্টারিয়ান হতে পারেন না। সব দেশেই ভালো পার্লামেন্টারিয়ান থাকেন হাতে গোণা কয়েকজন। বাপ্পীর মৃত্যু তাই দেশের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। আর আমরা যারা সাংবাদিক, আসলে আমাদের আপনজন হয় খুবই কম, শত্রু হয় বেশি। তাই সাংবাদিক জীবনে বাপ্পীর মত একজন স্নেহময়ী ছোটবোন হারানোকে কোনোমতেই মেনে নেয়া যায় না।