Published : 01 Jan 2020, 12:16 PM
ইংরেজি নববর্ষ আমাদের কি না সে প্রশ্ন অবান্তর। মূলত দৈনন্দিন কাজে বা ব্যবহারিক জীবনে এর তারিখ মাস সাল আমাদের জীবনে অপরিহার্য। ঘটা করে বাংলা নববর্ষ পালন আমাদের অতীত ঐতিহ্য আর শেকড়ের টান। শাস্ত্রও বটে। বাদবাকী সব চলে এই নববর্ষের আদলে। আপনাকে কেউ যদি বলে আজ মাসের কত তারিখ? বা কোন সাল ? কি বলবেন আপনি? আপনি তো জানেনই না বাংলা কোন মাস চলছে, তারিখতো দূরের কথা। এটাই বাস্তবতা। সারা দুনিয়া জুড়ে ইংরেজি সাল বা খৃস্টাব্দের এটাই প্রভাব। নতুন বছরে আমরা যদি ফিরে তাকাই সত্যি কি সব হতাশ হবার মতো?
শুরুতেই বলি এ বছর সিডনির দুনিয়া মাতানো থার্টি ফার্স্টের আলোকসজ্জা হবে কি না তা নিয়ে সংশয় ছিল। আমরা যারা এই শহরের শহরতলীতে বসবাস করি আমরা কি আসলেই এ বছর চোখ ধাঁধানো আলোকসজ্জা আশা করেছিলাম? কেন করিনি? সবাই জানে দুনিয়াব্যাপী এর আবেদন কতটা। পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে মানুষ আসে এই আলোকসজ্জা দেখতে। কোরিয়ান, জাপানীজ, চাইনীজরা এসময় এখানকার নয়নাভিরাম হারবার ও অপেরা হাউস এলাকা বেছে নেয় বিয়ের জন্য। এটাই তাদের স্বপ্ন। এজন্য বহুবছর ধরে টাকা জমায় তারা। এর ওপরে আছে পর্যটকের ঢল। তারপরও আমরা ভেবেছিলাম এ বছর তা হবে না। কারণ ৩১ তারিখেও মানুষ মারা গেছে। অগ্নিদগ্ধ হয়ে মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশেষ করে জানবাজী রাখা দমকল কর্মী বা ফায়ার ফাইটারদের এমন জীবনাবসান মানুষ মানতে পারছে না। এখনো সিডনির বহু এলাকা বিপদসীমার ভেতরে। তারপরও কিন্তু বন্ধ হয়নি ৩১-এর আলোকময় রাতের সজ্জা। মনে করি দুটো কারণে তারা তা করেনি। এক, বন্ধ হলেই এটা একটা ইতিহাস হবে। এবং এই নেগেটিভ নিউজটাই ঘুরবে সারাবছর। আগামী বছরগুলোতে তার প্রভাব পড়াও বিচিত্র না। পরের কারণটি ব্যবসা। এই অনুষ্ঠান ঘিরে লাখ লাখ মানুষ আসে ঐ এলাকায়। যানবাহন থেকে খাবার, খাবার থেকে বিনোদনে জমজমাট বাণিজ্য। তাতে কুপ্রভাব পড়তে পারে ভেবে হয়তো তারা তা বন্ধ রাখেনি। কথাগুলো বললাম এই কারণে, একবার ভাবুনতো দেশে এমন কিছু ঘটলে কি করতাম আমরা?
নিউজ চ্যানেলগুলো স্কচটেপ মোড়ানো ভাঙা মাইক্রোফোন হাতে পাঠিয়ে দিতো ডজন ডজন ভাষ্যকার। তারা ঐ এলাকায় দাঁড়িয়ে মানুষকে দিয়ে কথা বলাতো। বলাবাহুল্য যার গোটাটাই হতো সমালোচনা। সরকার ও প্রশাসনের বিরুদ্ধে মাথা ভারী আলোচনায় দলে দলে ছুটতো টকশোবিদেরা। তাদের মূল্যবান ভাষণ আর উত্তাপময় কথায় ঘুম হারাম জাতি ভাবতো তাইতো, তাইতো। এই সরকার আলোকসজ্জাও ভালোবাসে না? কি একটা মৌলবাদী সরকাররে বাবা। সভ্য সমাজে নেগেটিভিটির সুযোগ নাই। আলোচনা হয় কিন্তু তা নিয়ে সমাজ দেশ বা রাষ্ট্রের অপমান করা নাজায়েজ। আমরা কি নতুন বছরে এসব ঘটনা থেকে কিছু শিখবো?
নতুন বছরটা শুরু হতে না হতেই বাজে খবর। কি সেটা? অন্তত হাফডজন ছাত্র-ছাত্রী আত্মহত্যা করেছে। কেন? জিপিএ ফাইভ বা ভালো রেজাল্ট করতে না পারায়। এই ভালো রেজাল্টটা আসলে কি? এদেশের মূল নেতা সর্বজনশ্রদ্ধেয় বঙ্গবন্ধুর কি সার্টিফিকেট জীবন ছিলো? না এ যাবত দেশ শাসন করা কারো ছিলো তেমন কোনো ভালো ফলাফল? আজ দেশের হিরো কারা? মূলত স্বার্থপর কিছু ফার্স্ট বয় আর ফার্স্ট গার্ল? কি হয় এদের দিয়ে? এরা কি মাশরাফি না সাকিব যে দেশের জন্য পদক বয়ে আনে? না সেই ক্রিকেট ফুটবল মাতানো নারী শক্তি যাদের হাতে ওঠে বিজয়ীর কাপ? ব্যক্তিজীবনে ভালো বিয়ে আর সুখের সংসার করা মানুষ হবার জন্য এত তাড়া কেন আমাদের? ব্যক্তিগতভাবে আমিও একবার মেধা তালিকায় ঠাঁই করে নিয়েছিলাম। তো? শেষ পর্যন্ত কি লাভ হয়েছে? দেশের মানুষ বা পরিবারেরও কি এমন উপকার করেছি আমি? ভালো ফলাফল একটি জরুরি বিষয়। তারচেয়েও জরুরি কিন্তু মেধা। মেধাহীন মানুষরা মেধাবী হবার জন্য রাত জেগে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, আইনস্টাইন পড়েন যারা জীবনে এসব ভালো ফলের ধারেকাছেও যায়নি। কোন মাধ্যমে বলবেন? যেদিকে তাকান তথাকথিত ভালো ফলাফলের ছেলেমেয়েরা নাই, যারা আছে তারা মধ্যম। এরাই পাল্টে দেয় জীবন। পলান সরকারের কি লেখাপড়া ছিলো? যিনি পায়ে হেঁটে মানুষকে পড়ালেখায় মাতাতেন। কি পড়াশোনা ছিলো দার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বরের? লালন সাঁই থেকে শাহ আবদুল করিম বা রাধারমন সবটাই নিজের মেধা সবটাই প্রকৃতি জাত। আমি মনে করি, এই ধারণাটাই জরুরি ভালো মানুষ বা আসলে কোন ধরনের মানুষ চাই আমরা? আসলে কেউই তা জানে না। আপনি বঙ্গবন্ধু থেকে আইনস্টাইন বা নজরুল যার নামই বলেন দেখবেন সবাই একমত হতে পারছে না। এই বিভ্রান্তি আর গলদ মূল্যবোধে আজ জিপিএ ফাইভের অত্যাচারে নির্যাতিত বালক বালিকারা আত্মহনন করতে বাধ্য হচ্ছে। এই বছরে কি আমরা মন্ত্রীদের হাতে তুলে দেয়া ফলাফলের ফাইল ও হাসিমুখের ছবি দেখা বন্ধ করতে পারবো? এটা সত্যি সবার জন্য অপমানজনক। উন্নয়ন বা অগ্রগতির সাথে বেমানান। এসব মন্ত্রীদের অনেকে ভালো করে পড়াশোনা করেননি। তারা যদি ফাইল নিয়ে উল্লাস বা ছবি দিতে থাকে আমাদের লজ্জা হয়। দুনিয়ার কোনো দেশে এমন দেখা যায় বলেও শুনিনি।
আর একটি বিষয় হলো উত্তেজনা। নানা কারণে এমন কি বিনা কারণেও আমি মানুষকে উত্তেজিত হতে দেখেছি। নরম শিল্প সাহিত্য থেকে কঠিন রাজনীতি সব বিষয়ে মানুষ তপ্ত। যে কয়েকটা ঘটনা সামাজিক মিডিয়া ও দেশ তোলপাড় করে দিয়ে গেছে তার একটি নির্বাচনোত্তর বাংলাদেশ। যদিও নির্বাচন হয় ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের শেষে কিন্তু তার ফলাফল নিয়ে মানুষের মতামত আর তর্ক-বিতর্ক চলছে সারা বছর ধরে। প্রায় সব মানুষই এই নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ মনে করেন। শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা আর ভালোবাসা যেকোনো সময়ের চাইতে বেশি। তার জনপ্রিয়তা এখন গগণচুম্বি। কিন্তু প্রশ্ন থাকছে নির্বাচন কমিশন নিয়ে। যারা মনে করেন সঠিকভাবে ভোট হলেও আওয়ামী লীগই আসতো তারাও সন্তুষ্ট না। এই ঘটনাটি বছরের প্রথম থেকে শেষ অবদি তুষের আগুনের মতো ধিক ধিক করছে। কথাটা বললাম এই কারণে, সিটি করপোরেশনের ভোট তথা মেয়র নির্বাচন নিয়ে উত্তপ্ত মিডিয়া। অবাক হয়ে দেখি সরকারি দলের প্রার্থীদের হাত উঁচু করা ছবির জোয়ার। যা সাধারণত মানুষ করে জেতার পর। সামাজিক মাধ্যমে স্বার্থান্বেষী আর দলান্ধ লোকদের অভিনন্দনের জোয়ারে মনে হয় ফলাফল বেরিয়ে গেছে ইতোমধ্যে। দুই সিটি করপোরেশনে নয় দলের চৌদ্দজন প্রার্থী আছেন। কিন্তু মনে হবে তাপস আর আতিক ছাড়া বাকীরা দুধভাত। এর নাম কি আসলেই সুষ্ঠুতা? গণতান্ত্রিক হবার জন্য মানুষকে সাধনা করতে হবে না, দরকার সম্ভ্রম আর ন্যায্যতা। সেটা না হলে এ বছরও নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অগ্রগতি আর উন্নতি কিন্তু দারুণ। পাকিস্তানী এক লেখক সম্প্রতি ইসলামাবাদের সভায় বলেছেন তারা যেখানে আইএমএফের সামনে অনুদান বা খয়রাতের ঝুলি ফেলছে সেখানে তাদের ভাষায় এককালের পুওর কাজিন বাংলাদেশ আজ বাঘের মতো এগুচ্ছে। নারীর শক্তি ও সাম্যের কথা বলা এই লেখকের মতো দুনিয়ার নানা দেশে শেখ হাসিনা এখন প্রতীক। তাই তাকে আগলে রাখা সব বিষয়ে জড়িত না করাই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা। এই বছর বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবর্ষ। টুঙ্গিপাড়ার একজন মানুষ সারা বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছিলেন সাহস কাকে বলে। আমাদের চার নেতা ও মেধাবী মানুষরা জীবনভর দেখিয়ে গেছেন কোথায় আমাদের শক্তি। সেই সংস্কৃতি উদারতা আর খোলা মনের আহবানে জেগে উঠুক নতুন বছর। বাংলাদেশ পারে। এদেশের সাধারণ মানুষ সব পারে। ইতিহাসের এই অমোঘ পাঠে ভরে উঠুক বাঙালির জীবন।