Published : 17 Dec 2019, 04:35 PM
একটি প্রশ্ন দিয়ে লেখাটি শুরু করি- বঙ্গবন্ধু আর আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে প্রতিটি বাঙালি জানবে, এটা স্বাভাবিক এবং আবশ্যক। কিন্তু অন্যদেশের অন্য ভাষার মানুষেরা কেন এবং কিভাবে বঙ্গবন্ধুকে, আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে জানবে?
ইতিহাসের পাঠ বলতে সন, তারিখ আর সময়ের খতিয়ান ধরে পাঠ নয় কেবল। তার প্রায়োগিক আবেদন, রাজনৈতিক প্রাসঙ্গিকতা, দার্শনিক আর মনস্তাত্বিক গুরত্বও জরুরি। তা না হলে ইতিহাসের অনেক ঘটনাই তাৎপর্যের দিক দিয়ে প্রসঙ্গ হারাতে পারে। এমনকি বিস্মৃতির অতলেও চলে যেতে পারে। যে কারণে ইতিহাসের কোনো কোনো ঘটনা মহাকাব্যের বিষয় হয়েছে।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির জীবনে এরকম একটি ঘটনা। আর বঙ্গবন্ধু এরকম একজন ব্যক্তি, যিনি মহাকাব্যের নায়ক হিসেবে তুলে ধরার মত একজন মানুষ। এই দুই সত্যের দিকে আমরা যদি মনোযোগ দেই আমরা বঙ্গবন্ধুর জীবন, তার মনস্তত্ব, স্বপ্ন, দর্শন, দৃষ্টিভঙ্গি, ইতিহাসের ঘটনা পরস্পরায় তার অভিযাত্রা সেসব থেকে শিক্ষালাভ, জাতির উত্থান পতনের ভাগ্যনিয়ন্তা হয়ে ওঠা, তার নিজের বিচার বিশ্লেষণ, আমরা যেমন নানা প্রত্যক্ষ পরোক্ষ সূত্র দলিল দস্তাবেজ বইপুস্তক থেকে জানি, বাকিটা আমরা কল্পনা করতে পারি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্য উত্তর বাংলাদেশের ইতিহাস মূলত বঙ্গবন্ধুর জীবনের পর্যায়ক্রমিক নানা ঘটনার বাঁকে বাঁকে ঘটেছে। তাই বঙ্গবন্ধুর জীবনকে জানতে পারলে, তা উপলদ্ধি করতে পারলে, বাঙালির আধুনিক ইতিহাসের সম্ভাব্য সব প্রসঙ্গের সূত্রসমূহ এসে যায়। এক্ষেত্রে দেশীয় আন্তর্জাতিক কোনো প্রসঙ্গই বাদ পড়বে না। বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্ম বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এতটাই নিবিড়। কিন্তু এত বিশাল পরিসর আর এরকম একজন মহাকাব্যিক নায়ক গোটা একটা প্রজন্মের আড়ালে রাখা হয়েছিল ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত। সেই অন্ধকারের দেয়াল সরিয়ে বঙ্গবন্ধুকে আর মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস বহুমাত্রিকভাবে আলোতে আসা শুরু করে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে।
ইতিহাসকে আড়াল থেকে আলোতে মেলে ধরার উপায় কেবল ইতিহাসের বইয়ে ঢুকিয়ে দেয়া নয়। এজন্য দরকার নানা সৃজনশীল উদ্ভাবন। তাই ইতিহাসের ঘটনাকে মেলে ধরা হয়েছে কবিতায়, গল্পে, নাটকে, উপন্যাসে, চিত্রকর্মে আর চলচ্চিত্রে। ইতিহাসের নানা ঘটনা ইতিহাসের চেয়েও বড় গুরত্ব নিয়ে পাঠ্য হয়েছে সাহিত্য ও নাট্যকলায়- লেখকদের লেখায়, এরকম উদাহরণ মহাকাব্য থেকে শুরু করে কবিতা আর উপন্যাস রয়েছে অসংখ্য। আধুনিক কালে এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়েই যে কত কত গল্প, কবিতা, উপন্যাস রয়েছে তার লেখাজোখা নাই। তবে একটা কথা বলে নিতে চাই উপন্যাস মূলত মহাকাব্যের জায়গা নিয়ে নিয়েছে। ইতিহাস বই যতটা না মনকে টানে তার চেয়ে মানুষকে বেশি উদ্বেলিত করে ইতিহাস নির্ভর সাহিত্যকর্ম। এরকম একটা উদাহরণ বাংলাদেশের দেশভাগের উপর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস 'পূর্ব পশ্চিম'। ব্রিটিশ শোষণকে চিত্রিত করে দীনবন্ধু মিত্রের 'নীলদর্পণ', কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা, মুক্তিযুদ্ধের উপর লেখা শামসুর রাহমানের কাব্যগ্রন্থ 'বন্দী শিবির থেকে' উল্লেখযোগ্য।
যে প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেই প্রশ্নে ফিরে আসি। বিষয়ের দিক দিয়ে মহাকাব্যের মত বিস্তৃত কলেবরের ঘটনা মুক্তিযুদ্ধ আর তার মহানায়ককে সামগ্রিক গুরত্ব দিয়ে তুলে ধরার জন্যে মহাকাব্যই মোক্ষম মাধ্যম হতে পারে, অথবা উপন্যাস। কিন্তু দুটি বিষয়ই প্রায়োগিক দিক দিয়ে সীমাবদ্ধ মাধ্যম। খোলাসা করে বললে তা কেবল পড়ার জন্যে। তার প্রায়োগিক উপস্থাপনের সুযোগ থাকে না। এর পরের বিকল্প হতে পারে নাটক। কিন্তু একটা নাটকে বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্বের পূর্ণাঙ্গ মনস্তাত্বিক বাস্তবতাকে তুলে আনা যায় কি? তাতে তা খণ্ডিত হয়ে যাবার ঝুঁকি থেকে যায়। পরের বিকল্প হতে পারে মনোলগ বা স্বগতোক্তি। কিন্তু তাতেও একটা ঝুঁকি থাকে তার দার্শনিক আর মনস্তাত্বিক অস্তিত্বের খণ্ডিত প্রেক্ষাপট উঠে আসার সম্ভাবনা থেকেই যায়। তাই লেখালেখির একজন মনোযোগী চর্চাকারী হিসেবে এক নতুন পথ বাতলে নিলাম, 'এপিক মনোলগ' বা মহাকাব্যিক স্বগত সংলাপ। মনোলগটি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর-এর আর্টস পাতায় 'আমি মুজিব বলছি' নামে ২০১৬ সালে ১৫ অগাস্টে জাতীয় শোকদিবসে ছাপা হয়। এরপর ২০১৭ সালে অনন্যা প্রকাশনী থেকে বই আকারে ছাপা হয়। এরপর একাধিক সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে বইটির। ইতোমধ্যে এপিক মনোলগটি ইংরেজি, ফার্সি আর সুইডিশসহ কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়। সুইডিশ সংস্করণটি অনূদিত আর প্রকাশিত হয় সুইডেনের নতুন প্রজন্মের নামকরা কবি আর অনুবাদক ক্রিস্টিয়ান কার্লসনের আগ্রহ আর উদ্যোগে।
এই এপিক মনোলগটির মূল বাংলা সংস্করণটি নিয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কয়েকটি বিভাগের সঙ্গে বিশেষ করে নাট্যকলা বিভাগগুলোর সঙ্গে নানাভাবে যোগাযোগ করেও তাদের মধ্যে কোনোরকম আগ্রহের লক্ষণ দেখিনি। এমনকি ঢাকাস্থ বেশ কয়েকজন নাট্যনির্দেশকের সঙ্গেও যোগাযোগ করে পাণ্ডুলিপি দিয়ে তাদের মাঝে কোনোরকম সাড়া টের পাইনি। নাট্যকলা বিভাগগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করার আগ্রহ আমাদের দেশের নাট্যকলার তরুণ স্নাতকদের নতুন পাণ্ডুলিপি বিষয়ে তাদের আগ্রহ জানার আর বোঝার জন্যে। না তাদের স্বদেশি ইতিহাস, স্বদেশি ভাষা আর নাটকের বিষয়ে উল্লেখ করার মতো কোনো সাড়া পেলাম না। এরপর এই পাণ্ডুলিপি পাঠালাম ওয়েলসের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃজনশীল লেখালেখির দুইজন শিক্ষক, কবি সম্পাদক আর অনুবাদক ডমিনিক উইলিয়াম এবং মল পেরিকে। তারা উত্তর-ঔপনিবেশিক ঘটনা পরস্পরার ইতিহাস ও বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু বিষয়ক এই মনোলগ পেয়ে দারুণ আপ্লুত। তারা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করেছে। এটি ঘিরে কর্মশালা আর মঞ্চায়নের কর্মযজ্ঞ নিয়ে নানা পরিকল্পনা সাজাচ্ছে। আগ্রহ তৈরি হয়েছে জর্জিয়ায়, তেহরানে, শ্রীলঙ্কায় এমনকি ভারতেও। কেবল টনক নড়েনি আমাদের নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢাকার নাটকের পরিমণ্ডলে। বেশ!
সর্বশেষ এই পাণ্ডুলিপি পাঠানো হয়েছিল সুইডেনের সৃজনশীল বিদ্যা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ভিকস (Wiks folkhogskola) এর নাট্যকলা বিভাগে। পাণ্ডুলিপিটি পেয়ে তারা তাদের ২০১৯ সালের শরৎকালীন সেমিস্টারের সিলেবাসে ঢুকিয়েছে। তারপর ডিসেম্বরের ৫ তারিখে উপসালা শহরের থিয়েটার ব্লাঙ্কায় নাটকটি জনসাধারণের জন্য মঞ্চে উপস্থাপন করেছে। মঞ্চায়ন এবং পাঠ উন্মোচনের পরের দিন নাট্যকলা বিভাগের ছাত্র-শিক্ষকের সঙ্গে সংলাপের জন্যে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তাদের সঙ্গে এপিক মনোলগটি নিয়ে সংলাপে বসে জানতে পারলাম, এই পাণ্ডুলিপি হাতে পাবার সময় বাংলাদেশ বা বঙ্গবন্ধু বিষয় তাদের তেমন কোনো ধারণা ছিল না। নাটকটি পড়ার পরে এর ভেতরের উল্লেখিত প্রতিটি স্থান আর ব্যক্তি বিষয়ে তারা বইপুস্তক আর অন্তর্জাল ঘেঁটে রীতিমত গবেষণা করেছে। এপিক মনোলগটির সংশ্লিষ্ট প্রতিটি খুঁটিনাটি বিষয়ে তারা পরিষ্কার ধারণা লাভ করেছে। তারা যখন একের পর এক প্রশ্ন করছিল আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন বাংলাদেশেরই একদল ছেলেমেয়ের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ বিষয়ে আড্ডা দিচ্ছি। একইরকম মনে হচ্ছিল তারা যখন মনোলগটির এক একটি সংলাপ থিয়েটার ব্লাঙ্কার মঞ্চে উচ্চারণ করছিল সঙ্গে তাদের শরীরের আলোড়ন, চোখ মুখের অভিব্যক্তি দেখে মনে হচ্ছিল আবেগ ও মনোযোগে তারা যেন বাঙালি হয়ে উঠেছে- কী সে যে আন্তরিক উচ্চারণ। তা যেন তারা আত্মায় ধারণ করেছে। প্রযোজনার নির্দেশক নাট্যকলার শিক্ষক ভিম দ্য ভারদিয়ার (Vim de Vevdier) জানালেন, পাণ্ডুলিপির বিষয়বস্তু ছাত্রছাত্রীদের এত বেশি ভাল লেগেছে সময় সংক্ষিপ্ততার জন্যে পাণ্ডুলিপির কাটছাঁটের প্রয়োজন দেখা দিলে তারা আপত্তি করেছে। অথচ এই মনোলগ পড়ার আগে বাংলাদেশ বিষয়ে তারা তেমন কিছু জানতোই না। আর এখন এত বেশি টান বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশের প্রতি।
বাংলাদেশ বিষয়ে আমার মনের কিছু কথা বলার একান্ত ইচ্ছে থেকেই লেখালেখির একটি কাঠামো নিয়ে দীর্ঘদিন ঘাটাঘাটি করছিলাম। কোনোটাই মনের মতো মনে হচ্ছিল না। শেষতক 'এপিক মনোলগ' এর মত একটি কাঠামো আমার মনে ধরে যায়। মনের কথাগুলো নিজের জানার, বোঝার ও কল্পনার সীমা বিস্তৃত করে তুলে ধরেছি আমাদের মহাকাব্যিক গল্পকে।
তাদের সঙ্গে সংলাপে তারা আমার কাছে অনেক বিষয় জানতে চাইল। তাদের জানার বিষয় আমাদের সংস্কৃতি, পরিবেশ, রাজনীতি, ইতিহাস, নাটকের অতীত এবং বর্তমান অবস্থা। তাদের সর্বশেষ প্রশ্ন ছিল, আমি এই নাটকটি বা এপিক মনোলগটি কেন লিখলাম?
বাংলাদেশ এবং বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আমার একান্ত কিছু কথা বলার ছিল। কিছু কষ্ট, কিছু ভাল লাগা মনের মধ্যে ছিল। তা বলার জন্যেই এই এপিক মনোলগটি লেখা।
আহা তাদের কাছে এই এপিক মনোলগ, একজন বঙ্গবন্ধু এবং একটি বাংলাদেশ নতুন এক বিষ্ময় নতুন এক পাঠ। তাদের এই আন্তরিক মনোনিবেশ আর আমাদের ইতিহাসের প্রতি নিখাদ আগ্রহ আমার কাছে দারুণ এক ঘটনা। আমাদের ইতিহাস তাহলে এভাবেও প্রায়োগিক সীমা ডিঙাতে পারে।