Published : 17 Nov 2019, 03:36 PM
বিশ্বে প্রতিবছর ১.৫ কোটি শিশু অপরিণত বা সময়ের আগেই (৩৭ সপ্তাহের আগে) জন্মগ্রহণ করে এবং তাদের মধ্যে ১০ লাখেরও বেশি শিশু জন্মের প্রথম মাসেই মারা যায়। নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলিতে ৯৮% নবজাতকের মৃত্যুই হয় অপরিণত জন্ম জটিলতার কারণে যা সত্যিই উদ্বেগজনক।
বাংলাদেশের চিত্রও প্রায় একই। বিশ্বের ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে অপরিণত জন্ম জটিলতার কারণে মারা যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭ম। বাংলাদেশে প্রতি ১০০ জন নবজাতক শিশুর মধ্যে ১৪ জনই অপরিণত বা নির্ধারিত সময়ের আগে জন্মগ্রহণ করে যা বৈশ্বিক গড়ের চেয়েও বেশি। প্রতবিছর এদেশে পাঁচ বছরের নিচে বয়স এমন শিশুদের মধ্যে প্রায় ২০ হাজার শিশু অপরিণত জন্মের জটিলতার কারণে মারা যায়। এর মধ্যে অপরিণত নবজাতকের জন্ম জটিলতার কারণে মৃত্যু ঘটে ৩০ শতাংশের।
সময়রে আগইে জন্মানো র্অথাৎ অপরিণত শিশুদের শরীরের তাপমাত্রা কমে গিয়ে সবচেয়ে মারাত্মক জটিলতা তৈরি হয়। এছাড়াও শ্বাসপ্রশ্বাসে সমস্যা, সংক্রমন, খেতে না পারা, জন্ডিস, রক্তশূন্যতা- সর্বোর্পরি শিশুকে বাঁচিয়ে রাখাটাই কঠিন হয়ে পড়ে। আমাদের সবার মাঝে একটি ধারণা বর্তমান যে, এই অপরিণত শিশুদের বাঁচিয়ে রাখতে উন্নত বা উচ্চ প্রযুক্তিগত স্বাস্থ্যসেবা, ইনকিউবেটর বা অন্যান্য ব্যয়বহুল পদ্ধতি প্রয়োজন। কিন্তু ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার (কেএমসি) হচ্ছে অপরিণত শিশুদের জন্য একটি সহজ এবং বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত পদ্ধতি যা একজন নবজাতকের জন্য ইনকিউবেটর হিসাবে কাজ করে। এই অভিনব পদ্ধতিতে নবজাতকের শরীর উষ্ণ রাখার জন্য তাকে মায়ের বুকের তক্বের স্পর্শে রাখা হয়। শিশুকে কেএমসি প্রদানের ফলে নবজাতকের শরীর যেমন উষ্ণ থাকে, বুকের দুধ খাওয়ানো সহজ হয়, তেমনি সংক্রমণ রোধ হয় সহজেই। বিশ্বের বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, কেএমসি প্রচলিত সেবার তুলনায় কম ওজনের শিশুর মৃত্যুর ঝুকি হ্রাস করে ৪০%। উপরন্তু, কেএমসি এর ফলে মা এবং নবজাতকের মধ্যে বন্ধন দৃঢ় হয়। সঠিকভাবে কেএমসি প্রদান করলে, শিশু দ্রুত সুস্থ্য হয় ফলে তাড়াতাড়ি হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে যেতে পারে যা পরিবারের অর্থনৈতিক খরচ কমিয়ে আনতে ভুমিকা রাখে। কেএমসি একটি কম খরচের এবং অত্যন্ত কার্যকর একটি পদ্ধতি যা সময়ের আগে জন্ম নেয়া লক্ষ লক্ষ নবজাতক শিশুর জীবনকে বাঁচাতে পারে।
বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ৪র্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচির (এইচপিএনএসপি) অধীনে ২০১৭ সালে কেএমসি'কে গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি হিসাবে অন্তর্ভূক্ত করা হয়। সম্প্রতি সরকার এই নতুন স্বাস্থ্য সেবা পদ্ধতিকে অপরিণত নবজাতক শিশুর জন্য সারাদেশে সম্প্রসারণ করার বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। হাসপাতালগুলিতে কেএমসি সেবার প্রস্তুতির জন্য এ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর প্রয়োজন, স্বাস্থ্য সেবাদানকারীকে অবশ্যই প্রশিক্ষণ দিতে হবে, এই সেবা পদ্ধতিটি জনপ্রিয় করার জন্য পিতা-মাতা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের উৎসাহ প্রদান করতে হবে যাতে করে এটি আমাদের সামাজিক-পারিপাশ্বিক এবং নিয়মিত স্বাস্থ্য পরিচর্যায় পরিণত হয়। কেএমসি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে আমাদের যে চ্যালেঞ্জগুলি রয়েছে সেগুলোকে অনুধাবন করা প্রয়োজন এবং এই সেবাকে সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। এই সেবাকে জনপ্রিয় করতে পারলে লাখো অপরিণত নবজাতক শিশুকে মৃত্যু থেকে রক্ষা করা যাবে।
বর্তমানে বাংলাদশেসহ সারা বিশ্ব স্বাস্থ্য বিষয়ক যেসব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে তার মধ্যে অপরিণত জন্ম জটিলতার কারণে শিশুমৃত্যু অন্যতম। অপরিণত জন্ম জটিলতা সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রতিরোধ এবং চিকিৎসা বিষয়ের দিকে আরোও গুরুত্ব দিতে হবে। সুশীল সমাজ ও স্বাস্থ্য কার্যক্রমের আওতায় প্রতিষ্ঠানসমূহের অংশগ্রহণ অনস্বীকার্য। এটি বাংলাদেশে নবজাতকের মৃত্যুহারকে উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করতে বিশেষ ভূমিকা পালন করবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য মাত্রা অর্জনের জন্য আমাদের এখনও দীর্ঘ পথ যেতে হবে এবং সে লক্ষ্য মাত্রা অর্জনে যাতে কোনো অপরিণত শিশু মৃত্যুবরণ না করে তার জন্য আমাদের সচেতন হতে হবে।
ছবি: সেইভ দ্য চিলড্রেনের সৌজন্যে।