কথায় বলে পাগলে কিনা বলে, ছাগলে কিনা খায়। সমাজে, রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বী নাই বলে যে যা খুশি তাই বলবেন? আর আমাদের তা হজম করতে হবে? জাতীয় পার্টি সুযোগ সুবিধা পেয়ে এখন আঙুল ফুলে কলাগাছ। সে কলাগাছের মালিক সামরিক শাসক একনায়ক নামে সমাধিক পরিচিত হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদ সম্প্রতি প্রয়াত হয়েছেন। এ কথা স্বীকার করতে হবে যতদিন তিনি ছিলেন ততোদিন যেকোনওভাবে তিনি থাকতেন শিরোনামে। একনায়কদের এই ক্যারিশমা নতুন কিছু না। তাদের ক্যারিশমা না থাকলেও বানিয়ে করা হয়।
আমরা পরে জেনেছি জেনারেল জিয়াকে উপস্থাপনযোগ্য করার জন্য প্রবীণ নেতা মশিউর রহমান যাদু মিয়া, শাহ আজিজেরা মিলে খুঁজে পেতে বের করেছিলেন তিনি অক্লান্ত হাঁটাহাঁটি করতে পারেন। ব্যস। ওটাই হয়ে গেল তার ক্যারিশমা। মানুষ এর আগে আর কোনও সরকার প্রধানকে এভাবে হাঁটতে দেখেনি। তাই ক্লিক করে গেল তার পদযাত্রা। এরশাদও অনেককিছু করেছিলেন। একবার তিনি সাইকেল চড়ে অফিস যাবার ভেলকি দেখিয়ে ক'দিন পর আর তা ধরে রাখতে পারেন নি। এমন কাণ্ড তিনি হরহামেশাই করতেন। কিন্তু তার পরিচিতির একটা বড় দিক ছিল রমণীপ্রীতি। সে সব আরব্য রজনীর গল্পকেও আর মানাতো। আর একটা ছিল সকালে বলা কথার দুপুরে বরখেলাপ। নিত্যনতুন গালগল্পে তিনি আসর জমিয়ে রাখতেন রাজনীতির। সে দল এখন এরশাদহীন মানে চমকহীন।
মনে আছে উত্তাল দিনগুলোর কথা। সারা দেশের মতো চটৃগ্রামে ও আমরা শান্তিতে থাকতে পারিনি তখন। কবিতা-গল্প-নাটক-গানে স্বৈরাচার হটানোর সেসব আগুনমাখা দিনে আমরা অনেক হারিয়েছি। আমাদের বন্ধুদের অনেকে ফিরে এসেছিল মৃত্যুর হাত থেকে। শুধু কি তাই? একটা কবিতা পাঠের অপরাধে বাড়িতে থাকতে পারিনি। সেই এরশাদের পতন এত সহজ কিছু ছিল না। একদিকে অনুগত বাহিনী, আরেকদিকে বাইরের দেশের মদদ। তিনি শুধু তেল দিতেন না, মাল-মশলাও পাঠাতেন। তাই প্রতিবেশি দেশগুলো এই মেরুদণ্ডহীন শাসকের ওপর ছিল সন্তুষ্ট। কিন্তু মানুষ তখন ঘরে যেতে প্রস্তুত ছিল না। একনায়কের লৌহ শাসনে অতিষ্ঠ মানুষ সত্যিকার গণতন্ত্রের জন্য তখন মরিয়া। মনে পড়ে ছোট মতিয়ুর কে? যে একাই ঘুরিয়ে দিয়েছিল গতিপথ। মনে পড়ে আসাদকে? যে যুবক আইয়ুব খানের যাওয়া নিশ্চিত করেছিল নিজের প্রাণ দিয়ে। যেমন, বরকত-সালাম-জব্বারেরা প্রাণের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠা দিয়ে গেছে মাতৃভাষা। তেমনি নব্বইয়ের আন্দোলনের প্রাণ ভোমরা শহীদ নূর হোসেন। অচেনা-অজানা অখ্যাত এই যুবক তেমন বিশেষ লেখাপড়াও জানতেন না। কিন্তু তার সাহস ও বুকেপিঠে গণতন্ত্র মুক্তির পোস্টার এবং করুণ মৃত্যু কাঁপিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ। সেই আগুন, সেই ক্রোধ আর সেই প্রতিবাদের সামাল দিতে পারেনি এরশাদ সরকার। সেখানেই তাদের পতন নিশ্চিত হয়ে যায়।
ইতিহাসে এমন বীরত্ব বিরল। প্রশ্ন হচ্ছে এরপরও এরশাদের রাজনীতি টিকেছিল। আমাদেরকে অবাক করে দিয়ে পতিত এরশাদ ফিরে এলেন প্রবল বেগে। কারাগারে থেকে ভোট করে জিতে আসা এরশাদ প্রমাণ করেছিলেন মরিয়াও মরেন নাই। এরপর নানা ছল-চাতুরি আর কথাবার্তায় জমিয়ে রাখা এরশাদ শেষদিকে আওয়ামী লীগের লেজ হয়ে একদিকে যেমন মালকড়ি কামিয়েছিলেন, তেমনি তাদের ওপর চাপ অব্যাহত রেখে এক মজার খেলায় মেতেছিলেন। তার স্বভাবসুলভ রুটিনে একবার সমরেশ মজুমদারকে আমন্ত্রণ করে এনে ভরপেট খাইয়েদাইয়ে তোয়াজে উপহারে এমন বশ করলেন, সমরেশ মজুমদারের মতো লেখকও লিখলেন- তিনি কোনদিন এমন কোনও আতিথেয়তা দেখেননি। ঢুকতে সাহস পাননি কোন রাষ্ট্রপ্রধানের অতিথি ভবনে। শুধু কি তাই? তিনি তাকে দেখানো একটি ভিডিও নিয়েও লিখেছিলেন। যাতে তার মনে হয়েছে নূর হোসেন নামের যুবকটি আর শহীদ মিলনকে এরশাদের নির্দেশে হত্যা করার ঘটনা সত্য নাও হতে পারে। কি সাংঘাতিক! একটা ভিডিও দেখেই তিনি আমাদের ইতিহাস ঠিক করবেন? তখনই আমি এর বিরুদ্ধে লিখেছিলাম ঢাকার কাগজে। পরে নানা কারণে তিনি আর এসব নিয়ে কথা বলেননি। হয়তো এর ভেতরেই জেনে গিয়েছিলেন আসল ঘটনা। কিন্তু এতে একটা বিষয় বোঝা যায়, জাতীয় পার্টি তাদের পতনের কারণেই শহীদ নূর হোসেনকে 'মাফ' করেনি, ভুলতে পারে নি। এটাই আমাদের রাজনীতির বড় দুর্ভাগ্য।
দুনিয়ায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মত পৈশাচিক ঘটনাকেও সহনীয় করে ফেলেছে হিটলারের দেশ। জাপান-জার্মানি তাদের ভূমিকার জন্য এখনো মাফ চায়। এই সেদিনও জার্মানির চ্যান্সেলর পোল্যান্ড গিয়ে মাফ চেয়ে এসেছেন। তাদের এক কথা- আমরা আর এর দায় নিতে চাই না।
অথচ আমাদের দেশে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী শক্তি এখনো কোনওদিন বলেনি তাদের ভূমিকার জন্য তারা মার্জনা চায়। এমন কি দু:খ প্রকাশও করেনি। কেউ করে না। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের আমলে যে সব ঘটনা-দুর্ঘটনা সেগুলোর জন্য তারাও দু:খ প্রকাশ করে না। আর বিএনপিত তো আরো এককাঠি সরেস। তারা দু:খ-বেদনা এগুলোতো মানেই না, উল্টো তাদের কথা শুনলে মনে হয় তারা যেসব অন্যায় করেছিল সবগুলো মূলত পুণ্য । আর এগুলো করা হয়েছিল বলেই আমরা বেঁচে আছি।
এমন রাজনীতিতে সম্প্রতি শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গাঁ যে মন্তব্য করেছেন তা আপত্তির বা ঘৃণার হলেও অবাক হইনি।
রাঙ্গাঁ বলেছেন, নূর হোসেন নাকি ছিলেন মাদকসেবী। অশ্লীল ভাষায় আক্রমণ করে নিজের মুখোশ খুলে ফেলা এই মহাসচিব কেমন রাজনীতি করেন? শোনা যায়, তার মূল উৎস নাকি পরিবহনে চাঁদাবাজী। আমরা এসব কথা এতদিন বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মাঝামাঝি রাখলেও এখন বুঝতে পারছি, আর যাই হোক তিনি ভদ্রলোক হতে পারেন না। ভদ্র রাজনীতিবিদ হলে নিজের দলের চেয়ারম্যান যা বলেনি তা বলে কুৎসিত মনের পরিচয় দিতেন না। আমাদের দুর্ভাগ্য কোনও ব্যক্তি, কোনও ঘটনা, কোনও ইতিহাসকেই আমরা নিখাদ বা অবিতর্কিত রাখি না। এরশাদের পতন যেমন সত্য, তেমনি সত্য নূর হোসেনের আত্মত্যাগ। এই রাঙ্গাঁ আজ আছেন, কাল থাকবেন না। যতদিন ইতিহাস থাকবে, দেশ থাকবে, গুলিস্তানের জিরো পয়েন্ট থাকবে। থাকবে জ্বলজ্বলে নূর হোসেন চত্বর। সে আমাদের ভরসা আর প্রতিবাদের উৎস।
এখন রাজনীতি নাই। নেতা নেতৃত্ব কিছুই নাই। থাকলে রাঙ্গাঁ এমন কথা বলতে পারতেন না। এরা ভাড়া করে মানুষ এনে মাঝে মাঝে উদ্ভট আর মনখারাপ করা কথা বলে পপুলারিটি চায়। খবরহীন, শুষ্ক মিডিয়া এগুলো লুফে নেয়। কিন্তু কারো সাধ্য নাই রাঙ্গাঁকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। এরা ধরে নিয়েছে তারা সবকিছুর ঊর্দ্ধে। ভোট লাগে না। সমর্থন লাগে না। মানুষও লাগে না। লাগে একটা সাইনবোর্ড। সেই সাইনবোর্ড এখন কতটা শক্তিশালী আর বেপরোয়া, রাঙ্গাঁর কথায় শহীদ নূর হোসেনের অপমানই তার বড় প্রমাণ।
আমরা কি এভাবেই সবকিছু হারিয়ে এতিম হতে থাকবো? রাঙ্গাঁরা এটা বুঝে গেছেন মাজাভাঙ্গা সমাজে কেউ তাদের কিছু করতে পারবে না। হায়রে রাজনীতি।