Published : 31 Oct 2019, 01:34 PM
ফিজিক্যাল ইনজুরি খেলায় খুব নৈমিত্তিক ব্যাপার। জীবনের সবটা দিয়ে দেশ ও দলের জন্য খেলোয়াড় যখন খেলেন তখন শরীরী অস্তিত্ব ভুলে গিয়ে নিংড়ে দেন নিজের সামর্থ্যের সব। মাথায় ব্যান্ডেজ নিয়ে কায়সার হামিদের ডিফেন্স ভুলে যায়নি অনেকেই। তামিম কিছুদিন আগেই থেতলে যাওয়া আগুল নিয়ে এক হাতে ব্যাট করতে নেমে মনে করিয়ে দেন রক্তাক্ত সৈনিকের বুক আগলে দল ও সাথীদের রক্ষা করার বীরোত্তম সাহসিকতা। দলের সবার যতবার না শল্য চিকিৎসা নিতে হয়েছে মাশরাফির একারই হয়তো তার চেয়ে বেশিবার পায়ের হাঁটু কাটা-ছেঁড়া করা হয়েছে তবুও খেলে যাচ্ছেন দেশের জন্য। শারিরীক এসব ইনজুরি খেলার নিত্য অনুসঙ্গ। কিন্তু সাকিব আল হাসান বুকির কল পেয়েও তা যথাযথভাবে না জানানোয় ক্রিকেট থেকে এক বছরের জন্য নিষিদ্ধ হওয়ায় ভয়ংকরভাবে খেসারত দিতে হবে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে। এ আঘাতকে বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য মোর্যাল ইনজুরি বলা যেতে পারে।
বিস্ময়করভাবে অথচ কি অবলীলায় সাকিব আল হাসান টি-টোয়েন্টি, ওয়ানডে, টেস্ট তিন ফরম্যাটেই দিনের পর দিন আইসিসি র্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বর স্থান দখল করেছিলেন অলরাউন্ডার হিসেবে। তাকে একবছর দলে না পাওয়াকে "অপূরণীয় ক্ষতি"র মতো অভিধায়ও ফেলা যাচ্ছে না, তার চেয়ে বেশি কিছু। আফগানিস্তানের সাথে টেস্টে হার, খেলোয়াড়দের ধর্মঘট নিয়ে বোর্ডের সাথে টানাপোড়েন- তুলনারহিত খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে বাংলাদেশের ক্রিকেটকে।
দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক অধিনায়ক হ্যানসি ক্রনিয়ের ভারতীয় জুয়াড়িদের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণ করে ম্যাচ গড়াপেটার ঘটনার মধ্য দিয়ে ক্রিকেটে আইসিসি দুর্নীতিবিরোধী ও নিরাপত্তা কমিটি বা আকসু গঠন করে। ফুটবলে বলবর্ধক নিষিদ্ধ ড্রাগ, অ্যাথলেটিক্সে স্টেরয়েড গ্রহণ বিষয়ে এসব খেলার নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো যেমন বেশ তৎপর। তেমন বিশ্বব্যাপী শীর্ষ ক্রিকেটারদের মাদকদ্রব্য সেবন, বেটিং ইত্যাদিতে জড়িত অপরাধ রোধে আইসিসি কাজ করছে বেশ কিছু দিন থেকে।
বৈধ-অবৈধ পন্থায় জুয়াড়িদের সাথে খেলোয়াড়দের জড়িত থাকার প্রমাণ পাবার পরপরই আইসিসি দুর্নীতিবিরোধী ও নিরাপত্তা কমিটি বা আকসু গঠন করে। ২০০০ সালে গঠিত হওয়ার পর থেকে এই কমিটির কিছু পদক্ষেপ ক্রিকেটের দুর্নীতি রোধে কার্যকর ভুমিকা রেখেছে। ভারতের সাবেক অধিনায়ক মোহাম্মদ আজহারউদ্দীন এবং অজয় জাদেজার বিরুদ্ধে অবৈধ অর্থ গ্রহণের মাধ্যমে ম্যাচ ফিক্সিং করায় ক্রিকেট খেলায় অংশগ্রহণে আজীবন নিষেধাজ্ঞা ও খেলা থেকে কমপক্ষে পাঁচ বছর দূরে থাকার সুপারিশ করেছিল আকসু। ২০১০ সালে মোহাম্মদ আমির, মোহাম্মদ আসিফ ও সালমান বাট- এই তিন পাকিস্তানি খেলোয়াড়কে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের জন্যে যথাক্রমে ৫, ৭ ও ১০ বছরের জন্যে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করে আইসিসি। বিপিএল-এ ম্যাচ পাতিয়ে আরেক বাংলাদেশী মোহাম্মদ আশরাফুলের পর সাকিব আইসিসির নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়লেন।
ক্রিকেটে দুর্নীতি ও ফিক্সিং প্রতিরোধে আইসিসির সচেতনতামূলক কার্যক্রমগুলোতে সাকিব বরাবরই ক্রিয়াশীল ছিলেন। ২০০০ সাল থেকে চালু হওয়া 'আইসিসি অ্যান্টিকরাপশন রুলস অ্যান্ড রেগুলেশনস বেশ ভালোই জানা। এর আগেও একবার জুয়াড়ির ফোন পাওয়ার পর বিষয়টি আকসু ও বিসিবিকে জানিয়েছিলেন তিনি এই নিয়ম জানা ছিল বলে। অথচ তিনিই কি না জুয়াড়ির ফোন পেয়েও না জানিয়ে এত বড় একটা ভুল করেছেন।
সাকিবের নিষেধাজ্ঞা বিষয়ে আইসিসি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সাকিবের অপরাধের ব্যাপারে বিস্তারিত জানিয়েছে। সেখানে লেখা হয়েছে, 'আইসিসির দুর্নীতিবিরোধী বিভাগ একটি চলমান তদন্তের অংশ হিসেবে দীপক আগারওয়াল নামের এক ব্যক্তির ব্যাপারে জানতে সাকিব আল হাসানকে ২০১৯ সালের ২৩ জানুয়ারি ও ২৭ অগাস্ট জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল'। আগারওয়াল নামের ব্যক্তিটি ক্রিকেট দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত এবং আইসিসির চোখে সন্দেহভাজন একই সাথে কালো তালিকাভুক্ত। এ তদন্তেই সাকিবের বিরুদ্ধে দুর্নীতিবিরোধী আইনের ২.৪.৪ ধারায় তিনটি অভিযোগ আনা হয়েছে। ২.৪.৪ ধারায় অপরাধের বর্ণনায় বলা হচ্ছে- দুর্নীতি দমন আইনের অধীনে অনৈতিক আচরণে জড়িত হওয়ার আমন্ত্রণের কথা আইসিসির দুর্নীতিবিরোধী বিভাগের কাছে প্রকাশ করতে ব্যর্থ হওয়া। আইসিসির দুর্নীতি দমন নীতিমালার ২.৪.৪ ধারায় সবিস্তারিত বলা হয়েছে, কোনো ক্রিকেটার, আম্পায়ার, স্কোরার, কোচিং স্টাফ, গ্রাউন্ডস স্টাফরা কেউ জুয়াড়ির কাছ থেকে যেকোনো ধরনের প্রস্তাব পেলে যথাসম্ভব দ্রুততায় তা আইসিসি বা সংশ্নিষ্ট দেশের ক্রিকেট বোর্ডের দুর্নীতি দমন কর্মকর্তাদের অবহিত করতে হবে। আইসিসির পক্ষ থেকে প্রতিটি সিরিজ বা টুর্নামেন্ট শুরুর আগে ক্রিকেটার এবং অফিসিয়ালদের সচেতন করতে জুয়াড়িদের সম্পর্কে নিয়মিতভাবে অবগত করা হয়। সেই সাথে আইসিসির তালিকাভুক্ত জুয়াড়িদের ছবি ও ফোন নম্বর টানিয়ে দেওয়া হয়। প্রতিটি আন্তর্জাতিক সিরিজে আকসুর সদস্য উপস্থিত থাকেন। এমনকি ঘরোয়া ক্রিকেট মৌসুম শুরুর আগেও আইসিসির দুর্নীতি দমন বিভাগের নির্দেশনা মেনে খেলোয়াড়, টিম অফিসিয়াল, ম্যাচ অফিসিয়াল এবং গ্রাউন্ডস কর্মীদের সচেতন করা হয়।
জুয়াড়ির তিন তিনটি প্রস্তাব পেয়েও সাকিব আল হাসান কিছুই অবগত করেননি আইসিসির দুর্নীতি দমন ইউনিটকে (এসিইউ)। আইসিসির দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থানে এ ধরনের সব অনৈতিক প্রস্তাব যত দ্রুত সম্ভব কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে, এটা সব ক্রিকেটারদের জানা। উপযুক্ত সতর্কতার অভাবেই আজ চরম খেসারত দিতে হচ্ছে। "দুটো খেলোয়াড়ের বিকল্প আমাদের নেই। অধিনায়ক হিসেবে মাশরাফি, খেলোয়াড় হিসেবে সাকিব। সব খেলোয়াড়ের বিকল্প পেলেও সাকিবের বিকল্প কখনো পাব কি না জানা নেই। ওর খেলতে না পারাটা হচ্ছে আমাদের কাছে সবচেয়ে ধাক্কার।" বিসিবি প্রধানের এই মতকে সার্বজনীন মত বলে গণ্য করতে বাধা নেই। একটি বছর ৩৬টি ম্যাচ বাংলাদেশ পাবে না সাকিবের ক্রিকেট।
ক্রীড়া বাণিজ্যের এই যুগে প্রশাসকেরা বড় বড় টুর্নামেন্ট আয়োজন করে, প্লেয়াররা এন্ডোর্সমেন্ট থেকে আর চ্যানেলগুলো টাইটেল বেচে দেদার আয় করছে। জুয়াড়িরা কেন বসে থাকবে, তারাও নানাভাবে কামিয়ে নিচ্ছে। তবে শত প্রলোভনেও ইমেজ ও ক্রীড়া নৈতিকতা অটুট রেখে সাধারণের আস্থা ধরে রাখতে অন্য সবার মতো খেলোয়াড়দের ভূমিকা অনেক বেশি। এমনিতেই তারকারা বিভিন্নভাবে কড়া নজরদারিতে থাকেন আর সাকিবের মতো বৈশ্বিক তারকা তো মাইক্রোস্কপিক মনোযোগের অধীনে থাকেন, তাঁদের ন্যূনতম বিচ্যুতিও গ্রহণযোগ্য নয়। তবে এই নৈতিক স্খলন থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার শক্তি বাংলাদেশ রাখে।