Published : 27 Oct 2019, 12:18 PM
বই ঘিরে পৃথিবীর বৃহত্তম আয়োজন ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা। ১৯৪৯ সালে শুরু হওয়া এ বইমেলার বয়স এখন সত্তর বছর। সপ্তদশ শতকেও এর যাত্রা একবার শুরু হয়েছিল। এটি মূলত প্রকাশনা বা প্রকাশক কেন্দ্রিক একধরনের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা হলেও সাহিত্য, প্রকাশনা ও সংস্কৃতি বিষয়ক নানা সভা সেমিনার, সংলাপ আর অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাও থাকে।
২০১৫ সাল থেকে বাংলাদেশের প্রকাশকরা মোটামুটি প্রতি বছর অংশ নিয়ে থাকে এ মেলায়। ইতিপূর্বে গত মেয়াদের সরকারে সংস্কৃতি মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর এই গ্রন্থমেলায় গিয়েছিলেন দলবল নিয়ে। বিগত হয়ে যাওয়া মন্ত্রীর সফর নিয়ে বিশদ কথা নাই বা বললাম। নতুন মেয়াদের সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদও দলবল নিয়ে এবারকার ফ্রাঙ্কফুর্ট মেলা থেকে এই মাসেই ঘুরে এলেন। তার সফর সঙ্গীদের মধ্যে ছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘরের কিউরেটর মো. নজরুল ইসলাম খান এবং বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী প্রমুখ। বেশ? তাদের সঙ্গে বেশ কয়েকজন প্রকাশকও অংশ নিয়েছেন। প্রতিনিধিদলের উল্লেখ করার মত কর্মসূচি হল:
ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা আয়োজকদের সঙ্গে একটা বৈঠক; আন্তর্জাতিক প্রকাশক সংস্থার সঙ্গে মতবিনিময় আর বাংলাদেশ স্টলে গণমাধ্যমের মুখোমুখী হওয়া। রাষ্ট্রাচার কি বলে আমি জানি না। তবে সাধারণ বিবেচনায় যতদূর বুঝি বইমেলা আয়োজকদের সঙ্গে যে বৈঠক তা খোদ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মন্ত্রীর সফরের আগে প্রারম্ভিক যোগাযোগ বা কথাবার্তা এগিয়ে রাখবেন। সে অনুযায়ী মন্ত্রীর উপস্থিতিতে বড় জোর চুক্তি বা সমাঝোতা স্মারক স্বাক্ষর হবে। এই তো মর্যাদাপূর্ণ রাষ্ট্রাচার? না কি অন্য কিছু? আর প্রকাশনা সংস্থার সঙ্গে আলোচনা এটা মূলত প্রকাশকদের বোঝাপড়ার বিষয়। এমনকি এই সংস্থায় বাংলাদেশের একাধিক প্রকাশকের প্রতিনিধিত্ব ইতিপূর্বে ছিল। মন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের নিয়ে তৃতীয় যে কর্মসূচি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের ফেসবুকে ঘটা করে বলা হয়েছে তা হল বাংলাদেশ স্টলে প্রতিনিধিদলের দেশি বিদেশি গণমাধ্যমের মুখোমুখি। যার খবর খোদ মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক ছাড়া আর কোথাও খুঁজে পেলাম না।
প্রতিনিধিদলের সফরের সাফল্যের খতিয়ানের একটি হল সামনের বছর বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ বাড়ানো। সামনের বছর অংশগ্রহণ কতটুকু কিভাবে বাড়ে সেটা জানার অপেক্ষায় আমরা থাকলাম।
তবে একটা প্রশ্ন, ফ্রাঙ্কফুর্ট গ্রন্থমেলায় গত পাঁচ বছরের ধারাবাহিক অংশগ্রহণে এমনিক পরপর দুই মন্ত্রীর সরকারি সফরের পরে অর্জনের যে খতিয়ান, জার্মানিতে বাংলাদেশ দূতাবাসের যোগাযোগ আর উদ্যোগেই তা অর্জন করা বাঞ্চনীয় ছিল। অন্যান্য দেশ তাই করে।
আরো একটি কথা, সামনে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ; পরের বছর মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী এরকম একটা সন্ধিক্ষণে দুই মন্ত্রীর সফরের পরেও ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় কেবল জনগণের টাকা খরচ করে আমলা মন্ত্রীদের সফরের গরজে কেবলই অংশগ্রহণ বাড়ানোর আশ্বাস। 'মূল অতিথি দেশ' হিসেবে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ কেন নয়?
প্রসঙ্গক্রমে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার কিছু আগাম খবর বলে দিতে চাই। ১৯৭৬ সাল থেকে ফ্রাঙ্কফুর্ট গ্রন্থমেলা, সম্মানিত অতিথি দেশ, বা গেস্ট অব অনার কান্ট্রি প্রথা চালু করে। এই বছরের অতিথি দেশ ছিল প্রায় অর্ধকোটি লোকের দেশ নরওয়ে। গতবছর ছিল চল্লিশ লক্ষ লোকের দেশ জর্জিয়া। আগামী বছর সাড়ে তিন কোটি লোকের দেশ কানাডা। আর ২০২১ সালে স্পেন। দেশ দুটির সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে বছর দুই পূর্বে। আর আমরা মোক্ষম সময়ে শুনি আশ্বাসের কথা আর দেখি ফেসবুক সর্বস্ব 'নিজস্বী' কাণ্ড। দায় যেমন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের তেমনি জার্মানিস্থ সংশ্লিষ্ট দূতাবাসেরও। তারা এতদিন করলটা কি? ২০২০ সাল আর ২০২১ সাল তো হঠাৎ করে আসেনি। তাদের সজাগ আর সচেতন দূতিয়ালির যথেষ্ট সুযোগ ছিল।
প্রতিনিধিদলে যেহেতু বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের কিউরেটরও ছিলেন, তাই সংগত হত তিনি যদি জার্মানির দুই একটা জাদুঘরের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক কোনো আলোচনা করতেন বা সমঝোতায় আসতেন, তাহলে বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক সংস্কৃতি বিনিময়ের সুযোগ নিতে পারত। তা তো তিনি করেননি।
বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক গিয়েছেন বইমেলা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্যে। বাংলা একাডেমির মতো একটা প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীর কাজ বইমেলার অভিজ্ঞতা অর্জন না। তার আরও অনেক তাৎপর্যপূর্ণ কাজ থাকার কথা। তিনি মতবিনিময় করবেন ফরাসি বা সুইডিশ বা দিল্লির সাহিত্য একাডেমি কিংবা জার্মানির গ্যেটে ইনস্টিটিউটের মত প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী পর্যায়ের কর্মকর্তা, শিক্ষাবিদ, পণ্ডিত বা লেখকদের সঙ্গে। প্রথমত বইমেলা আয়োজন বাংলা একাডেমির কাজ হতে পারে না। তারপরও বাংলা একাডেমি যেহেতু কাজটা করেই, তাই বইমেলা নিয়ে কেবল অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্যে কোনো বইমেলা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বা পরিচালককে পাঠালে সুন্দর দেখায়।
এবার একটি আন্তর্জাতিক বইমেলায় অংশগ্রণের সুযোগকে অন্য দেশ কিভাবে কাজে লাগায় সে বিষয়ে দুই একটি কথা বলতে চাই। একটি দেশের বইমেলায় অংশগ্রহণের পাশাপাশি দেশটির সংশ্লিষ্ট দূতাবাস, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, প্রকাশক সমিতি আর লেখক সমাজ সমন্বিতভাবে কাজ করে। দূতিয়ালির কাজটা করে সংশ্লিষ্ট দূতাবাস আর সমন্বয়ের কাজটা করে মূলত প্রকাশক সমিতি। আর প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়– অর্থের জোগান থেকে শুরু করে আনুষঙ্গিক বিষয়াদি।
এবার আমার কয়েকটি প্রশ্ন:
১. এরকম বিষয়ে দুতিয়ালি করার মত পেশাদারিত্ব কি আমাদের দূতাবাসগুলোর রয়েছে?
২. এরকম সমন্বয়ের জন্যে আমাদের প্রকাশকদের বা প্রকাশক সমিতির পেশাদারি মনোভাব বা দক্ষতা রয়েছে?
৩. সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় বা সরকার কি প্রয়োজনীয় তহবিল জোগানের জন্যে প্রস্তুত রয়েছে?
৪. আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে আলোচনা, সংলাপ এবং বিতর্কে আমাদের লেখক আর অনুবাদক সমাজকে আমরা কি তৈরি করতে পেরেছি? বিষয়টা ইংরেজিতে ফটর ফটর বলে কথা নয়। ইংরেজি না জানলেও চলবে। দোভাষীর ব্যবস্থা তো থাকবেই।
এই প্রশ্নগুলো ঝালাই করার স্বার্থে বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ ২০২০ আর মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী ২০২১ সালকে সামনে রেখে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উচিত হবে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র আর রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোকে সঙ্গে নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দক্ষ দেশের এবং বিদেশের অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ করে একটা সিম্পোজিয়াম বা অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অর্জনের জন্যে একটা কর্মশালার ব্যবস্থা করা। যেখানে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, প্রকাশক, অনুবাদক, লেখক, গ্রন্থাগারিক আর বই বিতরণ এবং বিপণন সংশ্লিষ্ট লোকজন অংশ নেবেন। আমাদের মেয়র আর আমলারা যেমন মশা মারার কামান চালানো শিখতে সিঙ্গাপুর যান, খাল কাটার অভিজ্ঞতার জন্যে ইউরোপে যান, আন্তর্জাতিক বইমেলার অংশগ্রহণটাও যদি সেরকম হয়ে যায়, কেমন দেখায়?
আমাদের দুইজন সংস্কৃতি মন্ত্রী পরপর জার্মানির মত একটি দেশে যাবেন অথচ ওই দেশের সংস্কৃতি মন্ত্রীর সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক একটা বৈঠক করে আসবেন না। এটা কেমন কথা? তাহলে ওই দেশে আমাদের দূতাবাসের কাজটা কি? আমাদের মন্ত্রী, আমলা আর কূটনীতিকরা গরীব দেশের জনগণের টাকায় 'আইলাম আর গেলাম' করবেন, এই প্রবণতা আর কতকাল?