Published : 08 Oct 2019, 05:58 PM
মেধাবীরা ভীতু হয়! এবং বেশ ভীতু হয়! প্রথাগত মেধাবীদের সংজ্ঞাটা এখানে একটু পরিস্কার করা যাক। মোদ্দা কথা, বুয়েট, মেডিকেল এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-এই তিনটি প্রতিষ্ঠানে যারা পড়ে, তারা কোটি কোটি শুক্রানুর মধ্যে একমাত্র হিসেবে ডিম্বানু ভেদ করেই ভর্তি হয়, তাই তাদের মেধাবী হিসেবে গণ্য করেন সবাই। এই সংজ্ঞাটা মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। এবং তা বেশ শক্তপোক্তভাবেই।
ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। লিখছিও। মার খাওয়ার দিন-তারিখ মনে নেই। বাঙালির চিরায়ত বৈশিষ্ট্য- মার খাওয়ার তারিখ ওভাবে মনে রাখে না, যেভাবে মার দেওয়ার তারিখ মনে রাখে। আমারও মনে নেই। সেটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজী মুহাম্মদ মুহসীন হলের অফিসের লোহার লকারে হয়ত সবচেয়ে নিচের তাকে বন্দি থাকা 'ফালতু' ফাইলটা খুঁজে দেখলেই পাওয়া যাবে। নাও পাওয়া যেতে পারে। কারণ সেদিন যে তদন্তকারীদের (শিক্ষক) মুখোমুখি হয়েছিলাম এবং যে তদন্ত রিপোর্টে সাক্ষর দিয়েছিলাম, সে রিপোর্টের লেখা ডাক্তারের প্রেসক্রিপসনের লেখার চেয়েও জটিল এবং দেখতে জঘন্য। এমনভাবেই লেখা, সেটা যেন তারা ছাড়া আর কেউ পড়তে না পারেন! চাইলে প্রশ্নও করা যায়, এত জঘন্য লেখা নিয়ে কেউ শিক্ষক হয় কী করে? আগে দর্শনধারী পরে গুণবিচারি- এই তর্কে যদি নাও যাই, এতটুকু তো বলা যায়, ভালো লেখার জন্য আলাদা মার্কস বরাদ্দ থাকার কথা শুনেছি।
যাক গে, ফিরি সেই রাতের অভিজ্ঞতায়। রুম নাম্বার ৬৫৪। সিঙ্গেল রুম। আমাকেও রুমে তুলেছিলেন এক বড় ভাই। হলে রাজনীতির বাইরেও এলাকাপ্রীতি থাকে। থাকে আরও অনেক মেরুকরণ। ভিন্ন এলাকার বড় ভাই সিটে ওঠালেন প্রিয়জন হিসেবে। সময় গড়ায়। বড়/সিনিয়র হতে থাকি। সময় চলে আসে বিশ্ববিদ্যালয়কে বিদায় বলে দেওয়ার। চেনা ঘর ছেড়ে নতুন ঠিকানা খোঁজার। সিট ছাড়ব-সিটে প্রিয়জনকে রেখে যাব- হলের এই রেওয়াজ ধারণা করি 'হাজার বছরের পুরানো'। এই রেওয়াজ রাখতে গিয়ে তুলতে গেলাম প্রিয়জনকে, যে কিনা আওয়ামী লীগার, কিন্তু আমল যে বিএনপির!
বিপত্তির শুরুও সেখান থেকে। এরপর অকারণ, অযৌক্তিক মারামারি। রক্তারক্তি। এক বনাম দশ/পনের। পনেরজনের বেশ কয়েকজন আবার আশ্রিত, যাদের বহিরাগত বলা হয়। মানেটাও পরিস্কার। এক ঘুষি দিয়েছি কিনা তার হিসেব রাখা কঠিন কিন্তু দশ-পনেরো বা তারও বেশি খেয়েছি এটা সূর্য পশ্চিম দিকে ওঠার মতোই সত্যি! এবং আরও নির্মম সত্যি আশপাশের রুম থেকে 'মেধাবীদের' কেউ বেরিয়ে আসেনি। প্রতিবাদ-প্রতিরোধ তো দূর অস্ত! পাশের রুমেই ছাত্রলীগের এক নেতার বাস, তিনিও কুলুপটা সারারাত মুখে সেঁটে রেখে চুপ!
হয়তো রাজনীতির সুবিধাভোগীদের ডাণ্ডার আঘাতে থেতলে যাওয়া আবরারের চিৎকার কেউ শোনেনি। শুনলেও কেউ আসেনি। আগামীতেও যে কেউ আসবে না, এটাও বিশ্বাস করছি ব্যক্তিগত তিক্ত অভিজ্ঞতায়। কারণ, প্রতিবাদের চেয়ে তথাকথিত মেধাবীরা পড়াতে মনোযোগী। রাজার নীতি রাজনীতিতে মন নেই তাদের। একটা করপোরেট চাকরি হলে, মোটা অঙ্কের বেতন পেলেই স্বপ্নপূরণের উৎসবে মাতে তারা। তাদের পরিবারও। এটা বেশ প্রতিষ্ঠিত, ঘনবসতিপূর্ণ এই দেশে বিপদে পাশে মানুষ পাওয়া কঠিন! শিক্ষার দৈন্যতাও প্রকাশ পেয়ে যায় এখানে। সেটা পরিবার থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায় পর্যন্ত।
যথারীতি মারামারির যজ্ঞ শেষের পর নামের বিশ্লেষণ। তখন আর্তের চিৎকার তখন বড়জোর পৌঁছাতো রুম টু রুম। এখন ফেইসবুকে। আমরা স্লোগানে ফেনা তুলব আবরার আমার ভাই/অপমৃত্যু মানব না, মানি না-হ্যানত্যান অনেক কিছু। ওই ঘটনাতেই সাংবাদিকতার অন্য একটি 'মেধাবী' রূপও দেখা হয়ে গেল! যারা মারতে আসেননি, পরের দিনের একাধিক পত্রিকায় তারা আসামী। যারা মেরেছিলেন তাদের নামগন্ধও নেই! নাক-মুখ থোতা-ভোতা হয়ে যাওয়ার পরও গণমাধ্যমে নাম আসাদের (যারা অপরাধী নন) পরিবারের নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যেতে হয়। ব্যথা উপেক্ষা করে বলতে হয়-চাচি/খালাম্মা আমি থাকতে ওদের শাস্তি হবে না। ওরা নির্দোষ। সে চেষ্টায় সফল হওয়া গেল। কিন্তু দাগ যে থেকে গেল! মারল যে চেনা বড় ভাই, ছোটভাই। সঙ্গী কিছু বহিরাগত!
এত কথা, স্মৃতি খুঁড়ে বেদনা জাগানোর কারণ মেধাবীদের হাতে আরেক মেধাবী ছোট/বড় ভাই আবরারের মৃত্যু। ধরেই নিলাম সে শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, ভিন্ন মতাবলম্বী। সে দুষ্টু। সে খারাপের চেয়েও খারাপ। প্রশ্নও এখানেই- নিজের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনো ছোট বা বড় ভাইকে কি আমরা মেরে ফেলার অধিকার রাখি? একটা পরিবারের স্বপ্নকে গুঁড়িয়ে দিতে পারি? এই রেওয়াজ কেন শুরু হলো? কবে থেকে শুরু হলো? কখন থেকে শুরু হলো?
আরও একটা বিষয় অদ্ভুত লাগছে। বিষয়টি নিয়ে সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের কথা বলেছেন। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না এমন প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তিনি। রাষ্ট্রপতিরও একই কথা। পুলিশ থেকে শুরু করে আরও অনেকে বলবেন। এই দেশে আসলে বলার লোকের অভাব নেই। দুটো কান-একটা মুখ এই সত্যিটা মানার লোক খুবই কম।
কিন্তু দিন শেষের হিসেব কী বলে? ওই যে, জঘন্য হাতের লেখা দিয়ে রিপোর্টের শুরু, প্রতিটি হলের অফিসে লোহার সিন্দুকে গুমরে মরা নমকাওয়াস্তে রিপোর্টের ফাইল, বিচারহীনতা, তথাকথিত রাজনীতির ধোপে হারিয়ে যাওয়া ছোট-বড় ভাই সম্পর্কের মূল্যবোধ, সবই পচে-গলে গেছে। হৃদয়ের টানটুকু আকঁড়ে ধরে রাখতে না পারলে আশু সমাধান নেই। ধরপাকড়ের নির্দেশনা, শাস্তির কড়া ঘোষণা, সেটা যার কাছ থেকেই আসুক না কেন। আর হ্যাঁ, বিএনপির আমল বা আওয়ামী লীগের আমল, যাই বলা হোক না কেন, 'আমল' শব্দটার মানে কিন্তু আলাদা। উন্নতির জোয়ারে যতই ভাসুন না কেন, প্রকৃতির বিচারটাকে অন্তত মনে রাখার, উপলব্ধির সময় এসেছে। না হলে নির্বাক, নিস্তব্ধ থাকতে হবে। বড় জোর অস্ফূটে অনেককেই বলতে হবে- আবরার আমি এখনও বেঁচে আছি।