Published : 06 Oct 2019, 07:54 PM
শ্বেতপত্রের ধারণাগত ভিত্তি এবং ব্যবহার যুক্তরাজ্যের সংসদীয় গণতন্ত্রের সাথে যুক্ত। সাধারণত কোনও নীতি চূড়ান্তভাবে গ্রহণের আগে সরকার শ্বেতপত্র জারি করে থাকে এবং এর প্রচলন অস্ট্রেলিয়া, কানাডা এবং ইউরোপিয় ইউনিয়নভুক্ত অনেক দেশেই আছে। আমাদের দেশে শ্বেতপত্রের ধারণা তা থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত। বিরোধী দল শাসক দলের বিভিন্ন অপকর্মের বিস্তারিত জানানোর জন্য শ্বেতপত্র প্রকাশ করে থাকে।
শাবিপ্রবি (শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়)- তে বর্তমান উপাচার্যের নামে প্রকাশিত শ্বেতপত্র নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন মহলে তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে, যেখানে 'দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার শাবিপ্রবির শিক্ষক ও কর্মকর্তাবৃন্দ' এর ব্যানারে কিছুসংখ্যক বেনামি মানুষজন এর প্রচারে নেমেছে। বর্তমান উপাচার্যের সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় নেই এবং প্রশাসনিক কোনও কার্যক্রমের সাথে আমি জড়িত নই। তবে এ কথা নি:সন্দেহে বলা যায়, শাবিপ্রবির প্রায় ৩০ বছর বয়সে যতোজন উপাচার্য এসেছেন তার মধ্যে প্রফেসর ফরিদ উদ্দীন আহমেদ একজন অন্যতম ডাইনামিক উপাচার্য।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ফরিদ উদ্দীন আহমেদ ভাইস চ্যান্সেলর হিসেবে এসেছেন দুই বছরেরও বেশি সময় হল। এই দুইবছরে অবকাঠামোগত কোনও উন্নয়ন না হলেও গতি সঞ্চার হয়েছে অনেকগুলো একাডেমিক প্রক্রিয়ায়। বর্তমান উপাচার্য দৃশ্যমান অবকাঠামো উন্নয়ন হয়তো এখনো করেননি; একাডেমিক উন্নয়নও স্বভাবতই দৃশ্যমান হওয়ার কথা না। বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন বলতে অবকাঠামো বা দৃশ্যমান উন্নয়নই যদি বোঝায়, তাহলে একাডেমিক সংস্কার সবচেয়ে বড় উন্নয়ন। সেই একাডেমিক সংস্কারে আমরা অনেকেই খুশি হয়েছি। আবার অনেকেই মুখ কালো করেছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেহেতু জনগণের টাকায় পরিচালিত, তাই অবকাঠামোগত উন্নয়নগুলো একের পর এক ধাপ পেরিয়ে বাস্তবায়নের দিকে এগিয়ে যায়। শাবিপ্রবি'র উন্নয়নে এক হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে, যা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকগুলো দৃশ্যমান উন্নয়ন সম্ভব হবে, অবশ্যই তা সময়সাপেক্ষ এবং ধীরপ্রক্রিয়া যা রাতারাতি সম্ভব নয়। এর আগেও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় বিশ্ববিদ্যালয়ে নানাবিধ সমস্যা নিয়ে লিখেছি। বর্তমান উপাচার্য চেষ্টা করছেন সবগুলো সমস্যা সমাধানের। একটা মহল সর্বদাই সক্রিয় থাকে সমালোচনা কিংবা পেছনে লাগার। কারণ যখন তারা দেখে যে, উন্নয়নের প্রক্রিয়াগুলো তাদের পক্ষে যাচ্ছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মলগ্নের পর থেকে আজ অবধি পর্যন্ত এক সাথে এত বিশাল অংকের টাকার প্রকল্প আসেনি, যা একান্ত সম্ভব হয়েছে বর্তমান উপাচার্যের আন্তরিক প্রচেষ্টায়।
উপাচার্য মধু বণ্টন করে থাকেন, এই ধারণা অনেকেই পোষণ করে। মৌচাক থেকে মধু আহরণে সর্বদা ব্যস্ত থাকেন গুটিকয়েক শিক্ষক ও কর্মকর্তা। প্যাঁচ কিংবা খটকা তখনই বাঁধে যখন মৌচাক থেকে ঠিকমত মধু পাওয়া যায় না। বিশ্ববিদ্যালয়ের এই প্রক্রিয়াগুলো ছাত্রজীবনেও আমাকে ভীষণ কষ্ট দিত। স্বার্থানেষী মহলের স্বার্থে আঘাত পরলেই তারা উপাচার্য বিরোধী হয়ে যান এবং নতুন সুযোগসন্ধানীরা তখন মৌচাকের দিকে আগ বাড়ান। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৩০ বছর বয়স হওয়ার পরেও অনেক সমস্যার জর্জরিত ছিল। বর্তমান ভাইস চ্যান্সেলর তার প্রশাসনিক দক্ষতা ধারা সেটা অনেকটাই দূর করেছেন। সবচেয়ে খারাপ অবস্থা ছিল ছাত্র-ছাত্রীদের রেজাল্ট পাওয়ার ব্যাপারে। রেজাল্টের পুরো প্রক্রিয়াটি এখন অনেক অল্প সময়ে সম্পাদিত হচ্ছে। যার ফলে ছাত্র-ছাত্রীদের জীবনের অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট হওয়ার হাত থেকে বেঁচে যাচ্ছে। পরিবহন সমস্যা অনেকাংশেই কমেছে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকগুলো নতুন বাস সংযোজিত হয়েছে এবং যতটুকু আছে তা অল্পদিনের মধ্যেই দূর হয়ে যাবে। এই শ্বেতপত্রটি এমন এক সময় প্রকাশ করা হলো যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে অনেকগুলো বড় প্রকল্প, সমাবর্তন এবং ভর্তি-পরীক্ষার মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো রয়েছে। এই কুচক্রী মহল চাচ্ছে সমস্ত প্রক্রিয়াগুলোর বানচাল করতে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী বেশ কয়েকজন উপাচার্যের নামে ইউজিসি তদন্ত করছে। আমি জানিনা এর মধ্যে শাবিপ্রবি আছে কিনা, যদি থেকে থাকে তবে আমার ধারণা শ্বেতপত্রের প্রকাশিত খবরগুলো ভিত্তিহীন প্রমাণিত হবে। শুধু তদন্তই নয়, ইউজিসি চাইলে শাবিপ্রবিতে একটা জরিপ চালাতে পারে, যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক কর্মকর্তা সবাই অংশ নিবে এবং নাম প্রকাশ ছাড়া তাদের মতামত দেবে।
আমার ধারণা অধিকাংশই পজিটিভ মতামত দিবে, কারণ উন্নয়ন বিশ্বাস করে অন্যায় এবং অসঙ্গতি অপছন্দ করে তারা চায় বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে যাক। বাংলাদেশের কিছু সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে চলমান অস্তিরতা চলছে, তা অনেকদিন ধরেই। কিন্তু বিগত দুই বছরে শাবিপ্রবিতে কোনরকম ছাত্র সংঘাত, কোন্দল, একাডেমিক স্থবিরতা ইত্যাদি দেখা যায়নি। কারণ উপাচার্য শুরু থেকেই একটা স্পষ্ট ও স্বচ্ছ অবস্থায় আছেন। কারণ তিনি জানেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষায় শুধু বাংলাদেশেই নয় শাবিপ্রবির সুনাম পুরো বিশ্বজুড়ে। একজন সাধারণ শিক্ষক হিসাবে এই বেনামি শ্বেতপত্রের প্রচার ও প্রকাশের সাথে জড়িত ব্যক্তিবর্গের প্রতি তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।
কবিগুরু লিখেছেন 'বস্তুত নিন্দা না থাকিলে পৃথিবীতে জীবনের গৌরব কী থাকিত? একটা ভালো কাজে হাত দিলাম, তাহার নিন্দা কেহ করে না, সে ভালো কাজের দাম কী! তেমনি পরনিন্দা সমাজের কণায় কণায় যদি মিশিয়া না থাকিত তবে নিশ্চয়ই একটা বড়ো রকমের অনর্থ ঘটিত!' তাই উপাচার্যের উচিত এই, সমস্ত বেনামি শ্বেতপত্রকে তোয়াক্কা না করে দুর্বার গতিতে সামনে এগিয়ে যাওয়া। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে আছেন, তাদের উচিত বর্তমান উপাচার্যের উন্নয়নের সহযাত্রী হওয়ার এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি আধুনিক ও যুগোপযোগী 'সেন্টার ফর এক্সিলেন্স' করার জন্য সহযোগিতা করার। সারা দেশ জুড়ে শাবিপ্রবির একটি আলাদা সুনাম আছে, সেই সুনাম যুগ যুগ অক্ষত থাকুক এবং বর্তমান উপাচার্য তার বাকি মেয়াদে অসমাপ্ত কাজগুলো যেন দৃঢ়তার সাথে সম্পাদন করতে পারেন সেই আশা ব্যক্ত করছি।